আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঝাপসা অতীত



আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র, আমাদের বাসায় এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক আসতো,আমাকে নাতি ডাকত, হাতে অদ্ভুত ধরনের একটা বাঁকা লাঠি,আমি নিজের হাতে উনাকে যাই দেই উনি হাত তুলে দোয়া করেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, আমিও উনাকে অন্যদের চেয়ে একটু বেশী সমাদর করতাম হয়তো দোয়া পাওয়ার জন্যই । কিন্তু হঠাৎ করেই উনি আসা বন্ধ করে দিলেন, কেন জানি না.. আর জানতেও পারবনা... তখন একটু বড় হলে হয়ত খুঁজতে বের হতাম.... হতাম কি?? গ্রাম ছেড়ে শহরের রকমারি যান্ত্রিকতার সাথে পরিচয় ৯২ সালে, তখন ফাইভে ভতির্ হই, অচেনা শহর তাই খুব একটা বাহিরে বের হতাম না, স্কুল আর চার দেয়ালের মাঝে আমার জগৎ, তখন হঠাৎ একদিন একটা মানুষ এলো সাহায্যের জন্য, ডান হাতটা কব্জি পর্যন্ত কাটা, জানতে চাইলাম কি হয়েছিল, জানলাম উনার একটা ধান ভাঙানোর মেশিন ছিল, একদিন কাজ করার সময় ডান হাতটা মেশিনের মধ্যে ঢুকে যায়, পরে এটার চিকিৎসা করতে গিয়ে সেই মেশিনটা বিক্রি করে দিতে হয়, আমার খুব মায়া হয়, বললাম যেদিন বড় হব সেদিন আপনাকে একটা মেশিন কিনে দেব, উনি হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে চলে যায়, আমি বড় হতে থাকি কিন্তু আমার মেশিন কিনে দেয়ার স্বপ্নটা ছোট হতে থাকে... মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়ের কথা, পরীক্ষার প্রস্তুতি আর সবার উপদেশ এভাবেই চলছে প্রতিটা দিন, মন না বসলেও পড়ার টেবিলে বসে থাকার অক্লান্ত চেষ্টা, অনেকের মতই খুব ধামর্িক হবার চেষ্টাও করে যাচ্ছি, খোদা যদি এ যাত্রায় উদ্ধার করে নেন,এর মধ্যেই এক বয়স্ক লোক আসলো বলল পুরাতন জামা থাকলে যেন দেই, আমিও দিলাম একটা পুরাতন পান্জাবী, পরীক্ষাটা যদি একটু ভালো হয় উনার দোয়ায়, দুদিন পর আবার আসে লোকটা আমার খোঁজে, আমি যেতেই আমার হাতে গুজে দেয় ১৭ টাকা, শুনলাম এটা সেই জামার পকেটে ছিল, কিছুটা অবাক হয়ে টাকাটা দিতে চাইলাম কিন্তু নিলো না, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যায়, যাবার সময় বলে যায় এ জামাটা পরে নামায পড়ে আমার জন্য দোয়া করবে, আমি শুধু সে চলে যাওয়া একমনে দেখতে থাকি.... মধ্যদুপুরে রিক্সায় চেপে নিউমার্কেট যাচ্ছিলাম, রেল ক্রসিংপার হতে গিয়ে থামতে হলো, রেলগাড়ি যাচ্ছে, না থেমে উপায় নেই । রিক্সায় বসে তপ্ত রোদে পুড়ছি আর চলন্ত রেলগাড়ি দেখছি, ধ্যান ভাঙলো পা'য়ে কারো স্পশর্ পেয়ে, এক চল্লিশোধর্ নারী পা ধরে আছে, কিছুটা বিরক্তি কিছুটা সংকোচ নিয়ে তাকালাম, বললাম পা ছাড়েন, বলল বাড়িতে সাত সাতজন খাবার মানুষ না খেয়ে আছে, কিছু সাহায্য যেন করি । আমার পকেটে ১৩৬ টাকা ছিল, কিছু চিন্তা না করেই ভাংতি টাকাগুলো দিয়ে দিলাম, কখনও এমন হয়না, কেন এমন করলাম জানিনা, রিক্সা চলতে শুরু করল একটু বেশীই গতিতে আর পেছনে পড়ে রইল মায়ের বয়সী একটা নারীর বাস্তবতার চাপে ছেলের পা ধরার কষ্টমাখা সময়টা, নিজেকে অনেক তুচ্ছ মনে হচ্ছিল তখন, রেলগাড়ির মতো আমার ভাবনাগুলো চলছিল অবিরত.... এ মানুষগুলোর সাথে আমার আত্নিক কোনো সম্পকর্ নেই, কিন্তু মুখগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল... কেন জানিনা, জানতে চাইও না.. উনারা সবাই এখন কেমন আছে জানিনা..... আছেন নাকি এ জগৎ ছেড়ে অন্য কোথাও.. যেখানে চাইলেও সে বৃদ্ধটিকে খুঁজে পাবেনা কেউ, যেখানে মেশিন কেনার মিথ্যে স্বপ্ন দেখাবে না কেউ, যেখানে সততার প্রতীক সে লোকটা কারো কাছে হাত পেতে রইবে না, যেখানে মা'কে নত হতে হবে না তার সন্তানের কাছে..... যেখানে অথর্ বিত্ত মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করবেনা কোনদিন.... কিসের এতো অহংকার আমাদের.... ??

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।