আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঝাপসা নীল বিন্দু



ভয়েজার ১ উপগ্রহটি ১৯৯০ সালের দিকে সৌরজগত ছেড়ে অসীম মহাশুন্যের দিকে যাত্রা শুরু করে। পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে তখন ভাবা হলো উপগ্রহটিতো সারা জীবনের জন্য সৌরজগত ছেড়ে চলে যাচ্ছে, যাওয়ার আগে সৌরজগৎটার কিছু ছবি তুলে নেওয়া যাক। যেই ভাবা সেই কাজ। উপগ্রহটিকে পুরো উলটো দিকে ঘুরানো হলো। এরপর র ক্যামেরা দিয়ে তোলা হলো বেশ কিছু ছবি।

ছবি তোলা শেষে উপগ্রহটিকে আবার তার গতিপথে অর্থ্যাৎ মহাশুন্যের দিকে ছেড়ে দেওয়া হলো। মজার ব্যাপার ঘটলো যখন বিজ্ঞানীরা ছবিগুলোর দিকে ভালো করে তাকালেন। বিশেষ করে পৃথিবীর যেই ছবিগুলো তুলেছে ভয়েজার ১। ছবিগুলো তোলা হয়েছিলো প্রায় চার বিলিয়ন (চার'শ কোটি) মাইল দূর থেকে। ভয়েজার ১ তখন ছিলো সৌরজগতের এক প্রান্তে।

পৃথিবীর একটা ছবিটি এসেছে একটা আলোর বিন্দু হিসেবে। ন্যারো এঙ্গেল ক্যামেরা দিয়ে তোলার কারণে ছবিটাতে কয়েকটি আলোর রেখা (সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে) চলে এসেছে। ওই রকম একটা আলোর সরু রেখার মধ্যে একটা অতি ক্ষুদ্র ঝাপসা নীল বিন্দু হিসেবে এসেছে পৃথিবী। পৃথিবীর ওই ছবিটি সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছিলো বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, কার্ল সাগানকে। এমনিতেই সাগান পৃথিবী আর বিশ্বজগৎ নিয়ে গবেষণা করতেন।

তাই চার বিলিওয়ন মাইল দূর থেকে তোলা পৃথিবীর বিন্দুসম ছবিটি দেখে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ১৯৯৬ সালে এক সমাবর্তন বক্তৃতায় (ওই বছরই তিনি মারা যান) তিনি পৃথিবীর ওই বিন্দুর মতো ছবিটিকে "Pale Blue Dot" আখ্যা দেন এবং খুব মর্মস্পর্শীভাবে পৃথিবীর প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ করেন। আমি এখানে তার বক্তৃতার প্রাসঙ্গিক অংশটুকু বাংলায় তুলে দিচ্ছি। "এই বিন্দুটির দিকে তাকান। এটা এই পৃথিবীর ছবি।

এটাই আমাদের বাড়ী। এটাই আমরা। আমরা যাদের ভালোবাসি, আমরা যাদের চিনি জানি, আমরা যাদের কথা শুনেছি, সবাই এই বিন্দুতেই থাকে। সৃষ্টির শুরু থেকে যতো মানুষ বেঁচে ছিলো সবাই এই বিন্দুতেই বেঁচে ছিলো। আমাদের সারা জীবনের সব দুঃখ কষ্ট, হাজার হাজার আত্মবিশ্বাসী ধর্ম, মতবাদ, এবং অর্থনৈতিক তত্ব, যারা শিকার করেছে এবং যারা লুন্ঠন করেছে, সাহসী বীর এবং ভীরু মানুষেরা, যারা সভ্যতা সৃষ্টি করেছে এবং যারা সভ্যতা ধ্বংস করেছে, সব রাজা এবং প্রজা, সব প্রেমে মগ্ন তরুণ তরুণী, সব পিতা ও মাতা, স্বপ্নে বিভোর কিশোর কিশোরী, আবিষ্কারক এবং পরিভ্রমক, নৈতিকতার শিক্ষক, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, তারকা শিল্পী-খেলোয়াড়, মহামান্য নেতা, সাধু এবং পাপী; আমাদের মানবজাতীর ইতিহাসে যারাই বেঁচেছিলো সবাই বাস করতো ওই আলোর রেখায় ভাসমান ক্ষুদ্র ধুলাবিন্দুতে।

মহাবিশ্বের বিশালত্বের মাঝে পৃথিবীটা একটা ক্ষুদ্র মঞ্চ। কতো শত সম্রাট আর সমরনায়ক রক্তের নদী বইয়ে দিয়েছেন শুধুমাত্র এই ক্ষুদ্র বিন্দুর একটা ক্ষুদ্র অংশের বিজয়ী বীর হওয়ার জন্যে। এই বিন্দুর এক প্রান্তের মানুষেরা নৃশংসতা চালিয়ে ধ্বংস করেছে আরেক প্রান্তের মানুষদের। কী ভয়াবহ দ্বন্ধ তাদের মধ্যে, কী তীব্রভাবে একে অন্যকে হত্যা করতে চায়, কী গভীর ঘৃণা তাদের পরস্পরের প্রতি। আমাদের নিজেদের সম্মন্ধে উঁচু ধারণা, কল্পিত অহম, এই ধারণা যে আমরা এই বিশ্বজগতে অন্য প্রানীদের থেকে বেশি মহান কোন অবস্থানে আছি - এর সবকিছু এই ঝাপসা নীল বিন্দু দ্বারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

আমাদের এই গ্রহ মহাবিশ্বের মহাঅন্ধকারের মধ্যে একটা নিঃসঙ বিন্দু। এই বিশাল বিশ্বজগতের মধ্য থেকে কেউ এসে আমাদেরকে নিজেদের নিজেরা ধ্বংস করা থেকে বাঁচাবে না। এখন পর্যন্ত পৃথিবীই একমাত্র জানা জায়গা যেখানে জীবন বেঁচে থাকতে পারে। মানুষের আর কোন যাওয়ার জায়গা নেই। অন্তত নিকট ভবিষ্যতে নয়।

ভ্রমণ সম্ভব, কিন্তু যেয়ে বসতি গড়া? খুব শীঘ্রই সেটি হচ্ছে না নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আমাদের ভালো লাগুক বা না লাগুক, এই মুহুর্তে পৃথিবীই একমাত্র যায়গা যেখানে আমরা জীব হিসেবে টিকে থাকতে পারি। বলা হয়ে থাকে জ্যোতির্বিজ্ঞান মানুষকে বিনয়ী করে আর চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। চার বিলিয়ন মাইল দূর থেকে তোলা পৃথিবীর এই ছবির চেয়ে আর কিছুই সম্ভবত মানুষের অহমিকাকে এতো খাটো করে দেয় নাই। আমার মনে হয়, এটা আমাদের একজনের সাথে আরেকজনের আরো সহানুভূতি নিয়ে চলার কথা মনে করিয়ে দেয়, আরো মনে করিয়ে দেয় এই ঝাপসা নীল বিন্দুটিকে যত্ন এবং সংরক্ষণ করার কথা, যেটা আমাদের একমাত্র বাসভূমি।

" সত্যি কথা বলতে কি মূল ইংরেজীতে লেখাটির যে গভীর আবেগ ছিলো সেটা বাংলা অনুবাদের সময় পুরোটা ফুটিয়ে তোলা যায়নি। অনুবাদ নিয়ে এই সমস্যাটা প্রায়ই হয়। সে যাই হোক। আজকের পৃথিবীর মানুষে মানুষে যে ঘৃণা আর দ্বন্ধ তার দিকে তাকালে খুবই আফসোস হয়। পৃথিবীর সব বালুকণার মধ্যে একটি কণা যেমন অতি ক্ষুদ্র তুচ্ছের মতো, তেমনি আমাদের পৃথিবী এই মহাবিশ্বের অসীম সংখ্যক নক্ষত্র আর বস্তুপিন্ডের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি বালুকণা।

ঝড়, বন্যা, খরা, গ্রীন হাউজ এফেক্ট, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, মাত্রারিরিক্ত জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, পারমাণবিক বোমার হুমকি, ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি - ইত্যাদি হাজারো প্রাকৃতিক এবং মানুষের সৃস্টি সমস্যার মুখে আমাদের পৃথিবী। নিজেদের ভেতরের বানানো দ্বন্ধের চেয়ে বেশি গুরুত্মপূর্ণ এই মুহুর্তে আমাদের একমাত্র বাসভূমি এই পৃথিবীকে বাঁচানো। ভয়েজার ১ এর তোলা ঝাপসা নীল বিন্দুটি আমাদের বিপন্ন পৃথিবীর প্রতি আরো মমতাময়ী হতে বলে, নিজেদের ভেতরের ঘৃণা কমিয়ে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে। উইকিপেডিয়া লিঙ্কঃ Pale Blue Dot on Wikipedia কার্ল সাগানের নিজের কন্ঠে বানানো ভিডিওঃ

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।