আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মধ্যবিত্তের ঈদ বাজার এবং একজন গনি মিয়া।

আমি একাই পৃথিবী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম http://www.facebook.com/kalponikvalo

প্রিয় পাঠক, এই লেখাটি গত বছর (১৭ ই আগস্ট) প্রকাশ করেছিলাম। তখন এই নিকে কিছুটা নতুন ছিলাম বলেই হয়ত লেখাটা অনেকের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে। ব্যক্তিগত ভাবে এটা আমার পছন্দের লেখাগুলোর মধ্যে একটি। ঈদ আসলেই দেখেছি মানুষের কেনাকাটা ধুম পড়ে।

সবাই সবার সাধ্যমত কেনাকাটা করেন। ঈদের আনন্দ আমাদের সবার, কিন্তু আক্ষরিক ভাবে এই আনন্দ পেতে গিয়ে আমাদের অনেকেই হয়ত অনেক বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মানুষ পড়ে সবচেয়ে যাতাকলে। আমার পরিচিত একজন ব্যক্তি আছে, নাম গনি মিয়া। তিনি ঢাকার একটি গার্মেন্টসে নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটি মাঝারি মানের পদে কর্মরত।

তার সাথে প্রতিষ্ঠানের সাথে আমার ব্যবসায়িক সম্পর্ক। অদ্ভুত কোন এক কারনে এই ভদ্রলোক আমাকে অনেক পছন্দ করেন। আমি অনেক চেষ্টা করেও সঠিক কারনটি বের করতে পারি নি। তার এই পছন্দের কারনে আমি বা আমার প্রতিষ্ঠান নানাভাবে উপকৃত হয়েছে। আমি চেষ্টা করি তাকেও কিছুটা অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে।

কিন্তু আমি ব্যর্থ। তিনি কখনই তার অতিরিক্ত সেবা বা কাজের বিনিময়ে আমার কাছ থেকে অতিরিক্ত পয়সা চান নি। আমি দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও তার সাথে আমার সম্পর্কটিকে শুধুমাত্র ব্যবসায়িক রাখতে পারিনি। সময়ের সাথে সাথে তা হয়ে গিয়েছে ব্যক্তিগত। ভদ্রলোকের পরিবারে সদস্যসংখ্যা সাত জন।

স্বামী স্ত্রী, ছেলে মেয়ে ও বৃদ্ধ বাবা মা। খরচ কুলাতে পারেন না দেখে পরিবারকে রেখেছেন এক মফস্বলের এক শহরে। প্রতিবার রোজা আসলেই তিনি শুরু করেন বাড়তি খরচ কাটাকাটি। যেমন তিনি তেমন একটা ইফতার করেন না, সেহেরীও সেভাবে করেন না। শুধু পানি আর একটা খেজুর খেয়ে তারাবী পড়েন।

তারপর একেবারে ভাত খেয়ে শুয়ে পড়েন। সেহেরীর সময়ে তিনি শুধু পানি খেয়ে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েন। জিজ্ঞেস করলাম, এতে তার কত টাকা বাঁচে? তিনি কিছু জবাব দেন না মুচকি হাসেন। পারতপক্ষে তিনি রিকশা তো দূরে থাক, এই সময়ে তিনি বাসেই উঠেন না। তার ভাষায় কাছাকাছি দুরত্বের জন্য আবার গাড়ী ভাড়া কিসের।

অথচ আমি জানি, তার সেই কাছাকাছি দূরত্ব আমাদের কাছে অনেক দূরের পথ। এই সব নানারকম বাড়তি খরচের টাকা বাঁচিয়ে তার সাথে বোনাসের টাকা যোগ করে তিনি চেষ্টা করেন ঈদের বাজার করতে। কয়েকদিন আগে তার সাথে মার্কেটে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমাকে অনুরোধ করেছিল, তার পরিবারের জন্য কেনাকাটায় পছন্দের ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে। আমরা মার্কেটে মার্কেটে ঘুরি আর জামাকাপড় দেখি।

আমাদের সবই পছন্দ হয়, কিন্তু দামে হয় না। আমার নিজেরই মন খারাপ হয়। আমি যখন হতাশ হয়ে দোকানদারের দিকে তাকাই, তিনি কোন এক অদ্ভুত শক্তির বলে আমার দিকে চেয়ে হাসেন আর বলেন, আহারে ভাই! আপনি তো গরমে ঘেমে গিয়েছেন!! চলেন আপনাকে লাচ্ছি খাওয়াই। তবে আমার তো ঠান্ডা, আমি খেতে পারব না। আমার এত শক্তি নেই।

আমি খুব সাধারন একজন মানুষ। যে লোকটা খেয়ে না খেয়ে টাকা জমায় তার পরিবারের ঈদের আনন্দের জন্য, যেখানে একটা টাকারই মূল্য অনেক, সেখানে এক গ্লাস লাচ্ছির খাওয়ার অনুরোধে কি পরিমান ভালোবাসা লুকিয়ে আছে, তা ভেবে আমার মত একজন অভাজনের চোখে পানি আসাটাই স্বাভাবিক। সৃষ্টিকর্তার সাথে আমার অনেক অভিমান, তিনি পুরুষের চোখের পানি লুকানোর জায়গা দেন নি। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি তাকে তার ছেলে মেয়ের জন্য জামাকাপড় উপহার দিতে। তিনি বার বার চরম কাঠিন্য ও বিনয়ের সাথে তা প্রত্যখ্যান করেছেন।

মধ্যবিত্ত মানুষের কিছু থাকুক বা না থাকুক, তাদের আত্মসম্মানবোধ থাকে প্রবল। সেই প্রবল আত্নসম্মান নষ্ট করার সাহস আমার মত দূর্বল মানুষের কোন দিন ছিল না আর হবেও না। আমি বড়জোড় আমার লেখাটি তাদের জন্য উৎসর্গ করতে পারি। তাই আমার এই লেখাটি সকল মধ্যবিত্ত মানুষের জন্যই উৎসর্গ করা। আর গনি মিয়া! আপনার জন্য রইল আমার অনেক অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

মূল পোষ্টঃ মধ্যবিত্তের ঈদ বাজার। মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা কি আমি আসলে তা জানি না। তবে আমার কাছে মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের সংজ্ঞার মত। তিনি বলেছিলেন, যে গল্প শেষ হইয়াও হয় না শেষ, তাহাই ছোট গল্প। তেমনি মধ্যবিত্তের সব ইচ্ছা আহলাদ পূরন হয়েও পূরন হয় না।

এটা কিনলে ওটা হয় না। কিছু পেলাম তো কিছু ছাড় দিলাম। সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে মধ্যবিত্তের সংসারে কাউকে না কাউকে অনেক কিছুই ছাড় দিতে হয়। মধ্যবিত্ত জীবন আসলে অনেকটা শাখের করাত। দু'দিকেই কাটে।

সব কিছু রক্ষা করে বা নিয়ম মেনে চলার একমাত্র দায়িত্ব শুধু এই মধ্যবিত্তদের। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা গুলো হাসিমুখে মেনে নেয়াই হয়ত মধ্যবিত্ত জীবনের সংজ্ঞা। একজন মধ্যবিত্ত ব্যক্তির মাসিক আয় কত কিংবা মাসিক আয় কত টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে কাউকে মধ্যবিত্তের কাতারে ফেলা যাবে আমি সঠিক জানি না। এই ভাবে বিবেচনা করলে আমার ধারনা মধ্যবিত্তের ব্যপারটা আপেক্ষিক। একজন লোক মনে করুন মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা আয় করে।

পঞ্চাশ হাজার টাকার কথা শুনে অনেকেই বলবেন এটা তো কম না, অনেক টাকা। কথা সত্যি, পঞ্চাশ হাজার টাকা অনেক টাকা। কিন্তু এমন যদি হয় পরিবারের লোকসংখ্যা ৬ জন, স্বামী স্ত্রী আর দুই সন্তান এবং বাবা মা। এবং যখন এই পঞ্চাশ হাজার টাকার উপরেই পরিবারের সবাই নির্ভরশীল, তখন কি অনেক টাকা বলে মনে হবে? মনে হবার কথা নয়। এই দুমূল্যের বাজারে তখন পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে সংসার পরিচালনা করা কঠিন ব্যাপার।

ঢাকা শহরে আপনি যদি মোটামুটি মানের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন তাহলে আপনার প্রতিমাসে নূন্যতম বিশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা শুধু বাড়ি ভাড়ায় যাবে। এরপর থাকে খাওয়া খরচ, যাতায়াত, ছেলে মেয়ের পড়াশুনার খরচ, চিকিৎসা খরচ, ইত্যদি আরো নানা রকম খরচ। সব খরচ মিটিয়ে কত টাকাই বা থাকে। তাই মাস শেষে একজন অর্ধ লক্ষ টাকা আয়কারী যদি নিজেকে মধ্যবিত্ত ভাবেন তাহলে খুব বেশি কি অবাক হবার আছে? । আমার ধারনা নেই।

মধ্যবিত্তের জীবনে আনন্দের উপলক্ষ্য খুব বেশি একটা আসে না । তাই তো মধ্যবিত্ত জীবনে ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবগুলোই আনন্দের প্রধান উৎস। যেকোন আনন্দ উৎসবে সাথে নতুন পোষাকের বা কেনাকাটার একটা সর্ম্পক আছে। উৎসবের এই কেনাকাটা মধ্যবিত্তের জন্য অনেকটা বজ্রা আটুনির ফস্কা গেরোর মত হয়ে দাঁড়ায়। পারিবারিক দায়িত্ববোধ থেকেই হোক কিংবা সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেই হোক ঈদ আসলে মধ্যবিত্ত মানুষরা মার্কেটে ভীড় জমায়।

তাই তো বছরের এই সময়টাতেই মার্কেটে সবচেয়ে বেশী ভীড় থাকে। অন্যান্য সময়ের মার্কেটে ঘুরাঘুরি সেটাও ঈদ কেন্দ্রিক। দোকানের বাইরে থেকে ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র দেখা, নিজেকে নিজে বুঝানো, 'নিশ্চয়ই ঈদে আরো ভালো কালেকশন আসবে, আরো ভালো জিনিস আসবে, তখন এই দোকানে আসব'। হয়ত পছন্দের জিনিসে একটু হাত বোলান, একটু স্পর্শ করা সবই ঈদকে সামনে রেখে কিছু সুন্দর কল্পনা। বাস্তবতার তাগিদে হয়ত অনেকের এই কল্পনাটুকু বাস্তবে রুপ নেয় না।

ঘুরে ফিরে কিছুটা আহাজারি এবং সেই পুরানো স্বপ্নে ফিরে যাওয়া, 'এই বার হয়নি, আগামি বার হবে' সন্তানের কান্না ভেজা চোখ, স্ত্রীর অভিমানী হাসি, একজন বাবার পরাজিত চেহারা, একজন স্বামীর হতাশার দৃষ্টি ইত্যাদিই হয়ত মধ্যবিত্তের ঈদ আনন্দ, মধ্যবিত্তের ঈদ বাজার। বর্তমান বাজারে আপনি সীমিত টাকায় পরিবারের সবার জন্য হয়ত কিনতে পারবেন না। যারা ভবিষ্যতের কথা ভেবে কিছু কিছু টাকা জমিয়েছেন, তারা চেষ্টা করেন বোনাসের টাকার সাথে মিলেয়ে সবার জন্য কিছু কেনার। মোটামুটি আয় যারা করেন, তাদের অনেকের ইচ্ছে থাকে কোন ভালো শপিং মল থেকে কিছু কেনার। কিন্তু যারা সারা বছরের ব্যবসা একমাসেই করতে চায় তাদের কি কোন দায় আছে এই মধ্যবিত্ত মানুষের নাগালের মধ্যে কোন কিছু বিক্রি করার? না, তাদের কোন দায় নেই।

একজন মধ্যবিত্তের ঈদ বাজেট কত? পনের থেকে বিশ হাজার টাকা? যে মার্কেটেই যাওয়া হোক না কেন, পাঁচ হাজারের নিচে তেমন ভালো শাড়ি পাওয়া যায় না। সাথে স্যান্ডেল যদি কেউ কিনে সেখানেও নূন্যতম দেড় থেকে দুই হাজার টাকা নিচে সারা বছর পড়ার উপযোগী স্যান্ডেল পাওয়া যাবে না। ছেলে মেয়ের জন্য কেনাকাটা, সেটাও পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার নিচে সম্ভব নয়। বাবা মা এর জন্য কেনাকাটা করবেন, সেটাও নূন্যতম ছয় বা সাত হাজারের নিচে সম্ভব নয়। তারপর থাকে হয়ত নিজের জন্য কিছু কেনা পালা।

অনেকের হয়ত আরো সীমিত বাজেট থাকে। তখন হয়ত শুধু ছেলে মেয়ে আর বাবা মা এর জন্যই কেনা হয়। কাকে বাদ দিয়ে কার জন্য কেনা হবে এটা নিয়ে হয়ত স্ত্রীর সাথে কিছুটা মনোমালিন্যও দেখা দেয়। তাই তো দেখা যায় শুধু হয়ত বাবা মা বা সন্তানদের জন্যই কিছু কিনে বাড়ি ফেরা। বাড়ি ফিরে বলা, 'আমার আগের ঈদের পাঞ্জাবিটা তো নতুনই, পড়াই হয়নি তাই আমি কিছু কিনব না, শুধু শুধু টাকা নষ্ট।

' কিংবা স্ত্রীও হয়ত কোন কম ব্যবহার করা শাড়ী বের করে ইস্ত্রী করে রাখেন ঈদের দিন পড়ার জন্য। পাশের বাসার কোন ভাবি যখন প্রশ্ন করেন, 'ভাবি ঈদে নতুন কি নিলেন? তখন গুছিয়ে সুন্দর করে একটা মিথ্যে বলা, ভাবি, গত ঈদে আমার এই শাড়ীটা একে বারেই পড়া হয় নি। আমি এইটা এইবার ঈদে পড়ব, ও তো ভীষন রাগ করেছে। পাগলকে যদি বুঝাতে না পারি তাহলে হয় গিয়ে কিছু একটা কিনব। ' সকল ধর্মেই বলা আছে, মিথ্যে বলা মহা পাপ।

আমার ভীষন জানতে ইচ্ছে করে, পরম করুনাময় আল্লাহপাক মধ্যবিত্তের লজ্জা নিবারনের এই মিথ্যের শাস্তি কি দিবেন। আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা আরও কম টাকা আয় করে সংসার চালাচ্ছেন, বাবা, মা ,স্ত্রী , পুত্র সবাইকে নিয়ে এই ব্যস্ত শহরে দিন কাটাচ্ছেন। যে যার সামর্থ অনুযায়ী ভালো থাকার চেষ্টা করছেন। কোন মধ্যবিত্ত ব্যক্তিকে যদি জিজ্ঞেস করেন, 'ভাই কেমন আছেন?' তিনি হেসে জবাব দেন, 'আলহামদুল্লিলাহ ভাই, ভালোই আছি'। সত্যি হোক মিথ্যে হোক ভালো থাকতেই হবে।

কারন ভালো থাকাই নিয়ম। শহরের জীবন হচ্ছে অনেক গতিময়। এইখানে পিছিয়ে পড়াদের কিংবা খারাপ থাকাদের কোন স্থান নেই। ঈদ আসে ঈদ চলে যায়। মধ্যবিত্তের সুখ, দুঃখের খবর কেউ রাখে না।

আমরা অনেকেই হয়ত ঈদে অনেকগুলো পোষাক কিনি। যা হয়ত আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত। আমাদের আশে পাশে অনেক পরিবার আছে, যাদের কথা হয়ত আমারা স্মরন করি না। ঈদ একটি সার্বজনীন উৎসব। আমাদের একটু খেয়াল, আমাদের একটু অপচয় রোধ দিয়ে আমরা আরো একটি পরিবারের ঈদের আনন্দ কি কিছুটা বাড়িতে তুলতে পারি না? হয়ত পারি।

চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই। কারন কথায় বলে, আনন্দ ভাগ করলে তা বাড়ে, আর কষ্ট ভাগ করলে তা কমে। সবাই ভালো থাকুক, ঈদের অগ্রিম শুভেচ্চা সবাইকে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।