আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নরকের রাজপুত্র

বিকট
আমি জানি মৃত্যুর পর আমার ঠাঁই হবে নরকে। প্রবল প্রতাপশালী, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর কোন করুণা দেখাবেননা আমার জন্যে। কবরে বা শশ্মানে হয়তোবা আমাকে সমাহিত করা হবে যথাযোগ্য মর্যাদায়। অথবা ডাস্টবিনে বা নর্দমার আবর্জনায় মুখ গুঁজে পশ্চাদ্দেশ ঊর্ধমুখী করে পড়ে থাকবো উৎসুক জনতার জন্যে দ্রষ্টব্য বস্তু হয়ে, সাংবাদিকদের আকর্ণবিস্তৃত হাসির উপলক্ষ্য হয়ে। পোকামাকড়দের ভোজনৎসব, দেবদূতদের প্রশ্নবান আর বৃহদাকার সর্পের ছোবল সইবো কত হাজার বছর জানিনা।

তারপরে একদিন ঈশ্বর তার দাপ্তরিক কাজের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠলে আমাকে ডেকে পাঠাবেন, নীরিক্ষার চোখে দেখবেন, তখন হয়তোবা দীর্ঘ কবরবাসের ক্লান্তি আমাকে রূঢ় করে তুলতে পারে, কিন্তু ভীত কখনই নয়। তারপর আসবে সেই অবশ্যম্ভাবী ঘোষণা। অনন্ত নরকবাস। আমার দোষের তো কোন সীমা নেই, স্বর্গলাভের আশায় প্রতিনিয়ত তাকে তোয়াজ করার মত নতজানুতা দেখাতে পারিনি কখনও। আনুগত্যলোভী ইশ্বরকে তোয়াজ করতে, আলসে অকর্মা সরকারী আমলা অথবা ব্যবসায়ী মনোবৃত্তির বই প্রকাশকদের ঘুষ দিতে আমার রুচিতে বাঁধে।

শেষোক্ত দুটির চেয়ে প্রথমটি নিঃসন্দেহে বড় অপরাধ। তাই অনন্ত নরকবাসের জন্যে আমি এখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে যেনতেনভাবে নরকে থাকবো তা কী করে হয়! যেরকম বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, নরকে গেলে মানিয়ে নিতে একটু কষ্টই হবে বটে। আমার বিলাসীপনারও কোন সীমা নেই। রাত জেগে ঈশ্বর, প্রেমিকা এবং মশা-মাছির চোখ রাঙানি সয়ে লিখে গেছি লাইনের পর লাইন পরাবাস্তব গল্প।

আমার রাত্রিবিলাসের অন্ধকার মাধুর্য কখনও সইতে পারেনি ঈশ্বর এবং তার প্রেরীত দেবদূতগণ। তারা আমার কাঁধে চড়ে বসে থাকতো আর খিটখিটে মেজাজের ইস্কুল মাস্টারের মত খাতা কাটতো। এইসব রাত্রিজাগা, হ্যালুসিনেশন এবং ঘোরের জগতে বসবাস করে আমি বিস্মৃত হয়েছিলাম প্রথম প্রেম, প্রেমিকার মুখ। হঠকারী অবিমৃশ্যকারীতায় বোনা প্রেমের বীজ মহীরুহ হয়ে উঠলে দক্ষ কাঠুরের মত কুঠার চালিয়েছি। এত পাপ শয়তানেও সইবেনা।

শয়তানের সাথে আমার এক আধটু সখ্যতা আছে। যদিও তাকে আমি পছন্দ করিনা মোটেও। তবে সে ঈশ্বরের মত পায়াভারী আর অহংকারী নয় বলে টুকটাক কথাবার্তা চালানো যায় মাঝেমধ্যে। সে আমাকে সেদিন বলল, "বন্ধু চল একসাথে পান করি, মাতাল হই, কবিতা লিখি, সুন্দরীদের ঠোঁটে চুমু খাই, লুকিয়ে স্নান দেখি, চল মাতাল হই, গান গাই, বেশ্যাপাড়ায় যাই..." তার অসীম কর্মক্ষমতা এবং প্রাণপ্রাচুর্য সম্পর্কে অবগত থাকায় সেখানেই তাকে থামিয়ে দিই। "প্রস্তাবগুলো লোভনীয়, সন্দেহ নেই।

তবে সবগুলো পালন করা সম্ভব না। তুমি তো জানোই..." "কেন, ঈশ্বরকে ভয় পাস!" বক্রচোখে ব্যাঙ্গের ভঙ্গিমায় বলে সে। "যদি ভয় পেয়েই থাকি, তাতে তোর কি? ঈশ্বর বেচারা নিজের মত থাকে কাউকে বিরক্ত করেনা। আর তুই দুদিন পরপর এসেই খাতির জমাতে চাস। লাথিগুতো খেয়েও শিক্ষা হয়না! যা ভাগ! নির্লজ্জ!" "হ্যাঁ যাচ্ছি! তবে তোর ডাকেইতো এসেছিলাম।

আবার দরকার পড়লে ডাকবি, কোন সমস্যা নেই। আই এ্যাম এ্যাট ইয়োর সার্ভিস অলওয়েজ!" বলে কুচক্রী হাসি হেসে চলে যায় সে। আমি এই গভীর রাতে একা ঈশ্বরের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে হস্তমৈথুন শেষে কবিতা লিখতে বসি। আমার অপরাধের সীমা নেই। অনন্ত নরকবাস ছাড়া গতি কি! তাই এখন থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করছি।

প্রেমিকার পবিত্র ঠোঁটে ঠোঁট রেখে যখন আমি চুমুর চুমুক দিই, ভুলে যাই স্বর্গের অমৃতের কথা, তার রাগমোচনের সময় যখন আমাকে শক্ত করে পেচিয়ে ধরে,ভুলে যাই কামকলায় দক্ষ সত্তরটি অপ্সরার কথা। স্বর্গের জন্যে কখনও লালায়িত নই আমি। কিন্ত যখন বিদায়ের দিনে মুঠোফোনে তার আর্দ্র কন্ঠস্বর ভেসে আসে, সে কান্না লুকোনোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, তখন আমার মনে হয় "বড় পাপ হে!"। আমি নরকবাসের প্রস্তুতি নিতে থাকি। আমি জানি এখনও আরো বড় বড় পাপ করা বাকি রয়েছে আমার।

একদিন হয়তোবা বই প্রকাশের জন্যে উন্নাসিক সম্পাদকের কাছে উপহার হিসেবে এক কার্টন বেনসন আর সাম্প্রতিক জনপ্রিয় পর্নো ভিডিও নিয়ে যাবো, একদিন হয়তোবা বড় কোন কমিউনিটি সেন্টারে সাজসজ্জার ভারে জবুথবু কোন তরুণীর পাশে উৎকট রঙের আচকান পরে তার চোখের দিকে তাকিয়ে অন্য কাউকে খুঁজতে চাইবো, অথবা ঘোরগ্রস্থতা থেকে বেরিয়ে এসে ছিড়ে ফেলবো কবিতার খাতা তারপর মার্কেটে গিয়ে একটা দশাসই মানিব্যাগ কিনে আনবো, আর গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে ভ্রমগ্রস্থতা পেয়ে বসলে মানিব্যাগটায় যৌনাবেদন খুঁজে পেয়ে তাকে গর্ভবতী করে ফেলবো। বড় বড় পাপ করা বাকি অনেক। অনেক! তবে পাপের রোলারকোস্টারে চড়ে বসেছি অনেক আগেই। বুর্জোয়া সুখকে পিটিয়ে আধমরা করে পঙ্গু করে দিয়েছি সারাজীবনের জন্যে। এখন তাকে ডাকলেও সাড়া দেয়না।

যন্ত্রণা আমার বিশ্বস্ত শয্যাসঙ্গী। শয়তান অবিশ্বস্ত বন্ধু। ডাকলেই চলে আসে। ঈশ্বরের চেয়ে এই একটা দিক থেকে সে এগিয়ে যোজন যোজন। সেদিন খবরের কাগজে ভূমিকম্প দূর্গত মানুষদের দেখে আমি ঈশ্বরকে ডেকেছিলাম।

তার দেখা পাইনি। তবে শয়তানের বিশ্রী খ্যাকখ্যাক শব্দের হাসি ঠিকই শুনতে পেয়েছিলাম। সেদিন ঈশ্বর আর শয়তান দুজনের ওপরেই খুব রাগ হয়েছিলো। তবে শয়তানের ওপর রাগটা বজায় রাখতে পারিনি পরেরদিন যখন সে আমাকে একটা ছুরি উপহার দেয়। ভোঁতা ছুরি দিয়ে কষ্টেসৃষ্টে শক্তি প্রয়োগ করে নিজের হাত কাটার পৈশাচিক আনন্দ, রক্তের অগোলাপীয় স্নিগ্ধতা আমাকে মোহিত করে তোলে।

এই ছুরিটা আমি কাছে রেখে দিয়েছি। ছোট ছোট পাপ করে, নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে নরকের দারোয়ান হয়ে থাকার কি দরকার? আমি আরো বড় বড় পাপ করব। আমি হব নরকের রাজপুত্র! সেদিন একটা বড় পাপ করেছি। আমার মা আমাকে ঈশ্বরের স্তুতি করার আহবান জানিয়ে তার প্রশংসাবাণী প্রচার করার বিরক্তিকর অভিপ্রায়ে আমার পাশে বসলে আমি এড়ে তর্ক শুরু করি। যুক্তির ভান্ডার থেকে একের পর এক রসদ বের করে মাকে পরাভূত করার নেশা চেপে বসে আমার।

তার ব্যথিত চোখে তাকিয়ে আমি দেখতে পাই ঈশ্বর মারা যাচ্ছে। মহাপরাক্রমশালী ঈশ্বরের শীর্ণদশা দেখে আমার করুণা হয়। তবে ঈশ্বরের প্রতি এহেন অত্যাচার করার পরেও আমার মধ্যে অনুতাপবোধ জাগেনা। আমার অনুতাপ জাগায় মায়ের ব্যথিত চোখ। আমি সিদ্ধান্ত নিই ঈশ্বরকে আবার বাঁচিয়ে তুলতে হবে।

অন্তত আমার মায়ের জন্যে হলেও। নিরাকার, পরাক্রমশালী, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের চেয়ে আমার ছোটখাট, দুর্বল, অশ্রূসিক্ত মা অনেক বেশি প্রভাববিস্তারী। আমার কাছে তাকেই ঈশ্বর মনে হয়। আমি তাকে উপাসনা করতে চাই, কিন্তু মা চেয়েছিলো আমি জনৈক ঈশ্বরের উপাসনা করি। সে চাইতোনা ঈশ্বরের মেজাজ খিঁচড়ে দিয়ে আমি অনন্ত অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হই।

আর আমি চাইনি মায়ের অশ্রূতে অশ্রূত বেদনার কাহিনী লিপিবদ্ধ থাকুক। তাই অনেকদিন পর যথার্থ ধর্মীয় পোষাক পরে আমি উপাসনালয়ে যাই মাকে খুশী করার জন্যে। বাসায় ফিরলে সে আমার সুমতি দেখে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়। কিন্তু যদি সে জানতো ঐ সময়টায় আমি মোড়ের দোকানে বসে চা-সিগারেট খেয়ে কাটিয়েছি! আমি নরকবাসী হব জানি, নরকের নিকৃষ্টতম অধিবাসী। এখন মনে হচ্ছে বুক ফুলিয়ে নরকে প্রবেশের ভাগ্য, সে আমার নেই।

ছুরিটা এখনও রেখে দিয়েছি। শয়তান সেদিনও এসে তাগাদা দিয়ে গেল, "আরে এটা তোকে এমনি দিয়েছি নাকি! নিজের শরীরে কাটাকুটি করে কি হবে! কাট সাম থ্রোটস! রেপ সাম প্রেটি গার্লস! কাট দেয়ার কান্টস" "খামোশ!" পানসাক্ত অবস্থায় আমি বিজাতীয় শব্দাবলী উচ্চারণ করি। "তাহলে নিজের গলায় চালায় দে" "দিবো?" সে আমাকে প্ররোচিত করে ফেলেছিলো প্রায়। তবে সফল হয়নি। কোন এক উপযুক্ত মুহুর্তের জন্যে অপেক্ষা করাই শ্রেয় হবে বলে আমার মনে হয়েছে।

কিরকম হবে সেই মুহুর্তটা? শুনেছি পাড়ায় নতুন এক আলীশান দালান উঠেছে। এক শশ্রূমন্ডিত ধার্মিক ব্যক্তি ওটার মালিক। হেন অপকর্ম নেই যা সে করেনি। তার গলা কাটবো? "কেটে ফেল কেটে ফেল" শয়তান আমাকে উৎসাহ দেয়। তার আমোদের সীমা নেই।

কিন্তু আমিতো শয়তানের মত উন্মত্ত সাইকো না, আমাকে ভাবতে হবে আমি কেন কাটবো। তার প্রশংসা করে মানুষজন। কারণ সে ঈশ্বরকে নিয়মিত স্মরণ করে। উপার্জিত অঢেল কালোটাকার একাংশ দিয়ে উপাসনালয় তৈরী করে দেয়। মানুষজন খুশী।

ঈশ্বরও নিশ্চয়ই! অবশ্য সে যুদ্ধের সময় দেশের সাথে বেঈমাণী করেছিলো। তাতে কি হয়েছে, ঈশ্বরের প্রতি তার সাচ্চা ঈমাণ অটুট! সে বিপক্ষবাহিনীকে মেয়ে সরবরাহ করেছিলো। আমাদেরই মা-বোনদের। বিরাট পাপ। তবে ঈশ্বর ক্ষমা করে দেবেন নিশ্চয়ই! যেহেতু তিনি অসীম দয়ালু, এবং উক্ত ব্যক্তি ঈশ্বরের একজন অনুগত দাস।

"কেটে ফেল কেটে ফেল কেটে ফেল!" শয়তানের খুনবিষয়ক ফ্যাসিনেশন এই প্রথম আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়। আমি ছুরিতে ধার দিতে থাকি। ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করতে পারে, আমি না। জানি, তাকে খুন করলে পাপের বোঝা আরো ভারি হবে। তবে নরক তো আমার জন্যে অবধারিত।

আমি বুক চিতিয়ে নরকে ঢুকতে চাই। ছুরিতে শান দিতে দিতে আমার মনে হয় পোকামাকড়দের ভোজনৎসব, দেবদূতদের প্রশ্নবান আর বৃহদাকার সর্পের ছোবল শেষ হলে একদিন ঈশ্বর তার দাপ্তরিক কাজের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠলে আমাকে ডেকে পাঠালে, দীর্ঘ কবরবাসের ক্লান্তি আমাকে রূঢ় করে তুলতে পারে, কিন্তু ভীত কখনই নয়। তাজা খুনে হাত রঞ্জিত করে আকন্ঠ রক্তপান করে আমি হব নরকের রাজপুত্র!
 


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।