আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নরকের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে



ঘুমোতে যাওয়ার পূর্বে সাজ্জাদকে বললাম; তাহাজ্জুদের ওয়াক্তে জাগিয়ে দিতে। সে বলল ঠিক আছে তাড়িতাড়ি ঘুমিয়ে পর। আল্লাহর তৈফিকে ও তার সুবাদে ঘুম থেকে যথা সময়ে উঠলাম। চারিদিক কেমন যেন ঘোলাটে মনে হল। সাজ্জাদ বলল; আগুন লেগেছে।

এই সংবাদ শুনা মাত্রই আতঙ্কে আতকে উঠলাম। আমি মালিবাগ জামিয়ার চার তলায় থাকি। সেখান থেকে ভালভাবে বুঝা যাচ্ছিল না। তৎক্ষণাত কামরা থেকে বেরিয়ে পাঁচ তলায় গেলাম। ধূয়া আর ধূয়া।

কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশময় রক্তিম করে ফেলল। ভীত সন্ত্রস্থ হলাম। বিষণœ মনে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম, বার বার। কেমন যেন একা একা মনে হল নিজেকে।

চিন্তার জগতে একবার বিচরণ করে আসলাম। আগুন লেগেছে ৩.৪০ মি:। ফায়ার বিগেঢের গড়ির শব্দ পেলাম ৫.৩০ মি:। প্রায় দু’ ঘন্টা পর। আসার পর আবার তাদের বেগ পেতে হল দু’ কারণে।

‘এক. দেরী করায় আক্রোশ বসত বস্তিবাসি কতৃক পাথর নিক্ষেপ। দুই. রেল পথ বলে কথা। খুবই সংকীর্ণ রাস্তা। ’ ফজর নামাজ আদায় করে উক্ত স্থানে গেলাম। অসহায় বস্তিবাসির আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠল।

কান্নার রোল পড়ল চারিদিকে। মর্মাহত হলাম। তখনও আগুন জ্বলছে। অনেক চেষ্টা এবং সাধনার ফলে কর্মীরা আগুন নিভাতে সক্ষম হয়। তাতে কি? ততক্ষণে যা সর্বনাশ হবার ছিল হয়েই গেছে।

লোকদের জিগ্যেস করে জানতে পারি, একজন মহিলা তার ছোট ছোট দুই কন্যাসন্তানকে তাদের বাবার মত ইয়াতিম করে চলে গেছে না ফেরার দেশে। সামনেই ছিল সেই মহিলার লাশ। কিন্তু অবাক কা-! তার শরীরে আগুনের কোন ক্ষত নেই। সন্ধিৎসু ভঙ্গিতে লোকদের জিজ্ঞাস করলাম, কিভাবে তার মৃত্যু ঘটে? একজন বলল; আগুন লাগার সাথে সাথে যার যা সম্বল ছিল তা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ঐ মহিলা তার ঘর থেকে টিভি নিয়ে বেরুতেই একটি ট্রেন তাকে সজোরে আঘাত করে, ফলে সে মাটিতে ছিটকে পড়ে।

ঘটনাটি শুনা মাত্রই বিচলিত হলাম। শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে উঠল। অস্থিরতা অনুভব করলাম। ফরিয়াদ করলাম মহান প্রভুর দরবারে। ইয়া রব তুমি বাংলার জমিনে দ্বীনি শিক্ষার বিস্তার ঘটাও।

আজ যদি তার সমান্যতম ইসলামী জ্ঞান থাকত হয়ত এরূপ ঘটতনা। পরক্ষণেই সমবিত ফিরে পেলাম। ভাগ্যের লিখন না যায় খ-ন। মানুষ লিপ্ত হবে কঠোর সাধনা ও পরিশ্রমে এই ত ছিল তার শিক্ষা। ধর্মজ্ঞান বিবর্জীত এক ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার সমাজে আমাদের বাস।

আগুন প্রায় নিষ্প্রভ, সবাই ছুটাছুটি করতে লাগল আপন রুজি অন্বেষণে। কেউবা কুড়াচ্ছে টিন, প্লেট, কেউবা বেচে যাওয়া বাঁশ, কাঠ। আবার এনিয়ে ঝড়য়ায় লিপ্ত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। হায়রে বাঙ্গালি! দরিদ্র দেশ বলে কথা। আমাদের স্বপ্নের রেশ আজও কাটেনি, ডিজিটাল বাংলা গড়ি।

এর বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব হবে, দুর্নীতি আর লুট্যরাজ হবে যখন দমন। মমতাময়ী মার কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠল। চেচিয়ে, চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে সে। তার কষ্ট লাঘব করার উদ্দেশ্যে প্রবোদ দিয়ে বললাম; মা আপনার কি হয়েছে? কাঁদছেন কেন? যেন সে আশ্রয় খুজে পেল শীতল ছায়ায়। অমনিতেই আরো বেশি হাউ মাউ করে কাঁদলেন ।

একেবার শিশুর মত ঠোট ফুলিয়ে। বললেন; বাবা আজ আমার মেয়ের বার্ষিক পরীক্ষা। বস্তির এই দুরাবস্থা দরুন সে পরীক্ষা দিতে চাচ্ছে না। তা ছাড়া ওর বইগুলোও পুড়ে ছাই হয়েছে। কোন উপায় না পেয়েই কাঁদছি।

তার কথাগুলো কর্ণকুহুরে বাজতে লাগল। ভাবান্তর হলাম ভিন্য এক রাজ্যে। পরে আমি ও বস্তির কিছু হৃদয়বান ব্যক্তিবর্গ তাকে বুঝাবার চেষ্টা করলাম। বললাম খুকি পাগলামো করো না যাও পরীক্ষা দিতে। সে নারাজ।

বিষণœ মনে কি যেন ভাবছে। তার মনের অবস্থা পরখ করে বললাম; মায়ের দুঃখ মোচন করার উদ্দেশ্যে তোমায় আজ পরীক্ষা দিতে হবেই। কথাগুলো শুনছিল এক উদারমনা মহিলা। সম্ভবত পাশের বাড়ি ওয়ালনি হবেন। সে বলল মা তোমায় আমি বই কিনে দিব, পরীক্ষার হলে আমার সাথে যাবে চল।

পরোপকারী ও নিস্বার্থ ঘটনাটি দেখে বড়ই অবাক হলাম। মা ও মেয়ে যেন এক ফালি চাঁদ হাতে পেল। ভাবলাম কিছু ভাল মানুষ আছে বলেই আজও দুনিয়া অবশিষ্ট আছে। কিছুটা সামনে অগ্রসর হতেই দেখলাম এক নরকীয় দৃশ্য। আগুনের ভয়াবহতা টের পেলাম।

আশে-পাশে ছাদের উপর রাখা ট্যাংকিগুলো দুমড়ি মুছড়িয়ে গেছে আগুনের তাপে। আল্লাহর অসীম দয়ায় পাশে থাকা মাদ্রাসার কোন ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। বরং মাদ্রাসা সংলগ্ন একটা বিল্ডিংয়ের দোতলায় আগুন লেগে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। তখনও শরীরে আগুনের তাপ অনুভব করছিলাম। ফায়ার বিগেঢের অক্ষমতা ও আগুন দেরীতে নেভার কারণ জানতে চাইলাম।

এক কর্মী বলল দু’ থেকে তিন বার ট্রেনে পাইপ কাটা পড়েছে। তাছাড়া রাস্তা সঙ্কীর্ণ হওয়ায় এবং বস্তির ছেলেদের পাথর নিক্ষেপ করায় কাজে বিঘœতা ঘটে। পরে আমরা রেললাইনের নিচ দিয়ে পাইপ এনে আগুন নিয়ন্ত্রনে আনি। আমি বললাম; অথচ উচিত ছিল প্রথমত রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়ে ক্ষণিকের জন্য রেল চলাচল বন্ধ করা। আগুন কিভাবে লেগেছে? এখনও জানা যায়নি ব’লে তিনি চলে গেলেন।

ব্যকুল মনে আকুতি করলাম ওহে মহান আমাদের ক্ষমা করুণ। এই দুঃস্থদের পাশে দাড়াবার হিম্মাত ও উপায় উপকরণ দান করুণ। ঘটনার ভয়াবহতা ও ক্ষয় ক্ষতি দেখে এক আল্লাহ ভিরু ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তি কিছু কম্বলের ব্যবস্থা করেন। পরে গরিবদের তালিকা করে সে অনুযায়ী কম্বল বিতরণ করা হয়। যদিও তা সবার মাঝে বিতরণ করা সম্ভব হয়নি, পর্যাপ্ত পরিমাণ মওজুদ না থাকার কারণে।

তবুও কিছু গরিব দুখি কণকণে হাড় কাঁপানো শীতের হাত থেকে রক্ষা পাবে।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।