আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভ্রমণ : লাভ ইন নেপাল (শেষ পর্ব)



১ম পর্ব : Click This Link ৩. পরদিন সকালে বের হয়ে ঠিক করলাম আমরা যাবো প্রথমে শয়ম্বুনাথ স্তুপা দেখতে । শয়ম্বুনাথ স্তুপা কাঠমাণ্ডু শহর থেকে চার কিলোমিটার পশ্চিমে। একটা ছোট মাঝারী সাইজের পাহাড়ের উপরে এর অবস্থান। যে পাহাড়ে উঠলে মোটমুটি কাঠমাণ্ডু এবং তার আশেপাশের এলাকা চোখের সামনে খুলে যায়। তবে সেটার জন্য ঝামেলা কম না।

প্রায় তিনশ ষাটটা সিড়ি ভেঙ্গে সেখানে পৌছতে হয়। এবং এই পথের মাঝে অভ্যর্থনা জানাতে ছোট ছোট গ্রুপে বসে আছে অসংখ্য বানর। বানরদের প্রভাবপ্রতিপত্তিই এখানে সব। কারণ, এটার আরেক নাম 'মাঙ্কি টেম্পল' বা 'বানর মন্দির'ও। তাই এখানে বানরকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নাই।

তাদেরকে যথাযথ সন্মানপ্রদর্শনপূর্বক এখানে প্রবেশ করতে হয়। নানা ধরণের ঐতিহ্যেকে বনসাই সাইজ বাণিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেছে বিক্রেতারা। পাহাড়ের বিশাল জায়গা নিয়ে নির্মিত এই স্তুপা জুড়ে অসংখ্য মূর্তি। যার মধ্যে বুদ্ধের মূর্তিই বেশি। নানাভাবে তৈরি।

পাথর থেকে শুরু করে ব্রোঞ্জসহ নানান উপাদানে তৈরি বুদ্ধ কোথাও বসে কোথাও দাঁড়িয়ে মাথা উটু করে আছেন, যার সামনে গিয়ে ভক্তরা মাথা নিচু করে বিনীত প্রার্থণা করছে। এই স্তুপার বৈশিষ্ট হচ্ছে, এই স্তুপাতে বৌদ্ধ ধর্মের 'ভাজরাইয়না ফর্ম' অনুসরণ করা হয়। যা 'মহায়ানা বুদ্ধিজমে'র তান্ত্রিক ধারা। জানলাম, এই স্তুপা তৈরি হয়েছে 'লিচ্ছাভি' সময়ে। লিচ্ছাভি সময়টা কোনটা তা না জানা গেলেও এটা জানলাম এখানে আমাদের নির্ধারিত সময় শেষ।

নামতে নামতে চমকে উঠলাম। অপরিচিত জায়গায় পরিচিত চেহারা দেখলে কেমন যেন আঁতকে উঠতে হয়। পরিচিত মানুষকেও প্রথম কিছুক্ষণ অপরিচিত রাগে। তেমনি একজন বসেছিলেন সিড়ির শেষ অংশে। আমীরুল ভাই।

জনপ্রিয় ছড়াকার আমীরুল ইসলাম। এই ভিনদেশে তার সাথে দেখা হওয়ার ফিলিংস নেপালে নতুন কোনও কিছু দেখার চেয়ে কম না। টুরিষ্ট বাসে উঠে জানতে পারলাম, আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কাঠমাণ্ডু দরবার স্কয়ার। কাঠমাণ্ডুর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই স্কয়ার। স্থানীয় লোকজন যাকে তার পুরাতন নামেই চেনে, হনুমান ঢোকা।

নেপালী রাজতন্ত্রের প্রাচীন আসন। হমুমান ঢোকাতে আমরা ঢুকতেই মনে হল যেন কোন টাইম মেশিনে চেপে পেছনে চলে গেছি। সুবিশাল প্রাচীন স্থাপনার ছড়াছড়ি চারপাশে। যে সকল স্থাপনা তৈরি হয়েছে রাজা 'রতনামাল্লা'র সময়কাল ১৪৮৪-১৫২০ অব্দ থেকে শুরু করে 'পৃথ্বী বীরবিক্রম শাহ'র শাসনকাল ১৮৭৫-১৯১১ অব্দের মধ্যে। নেপালী ইতিহাসে যা মাল্লা, শাহ এবং রানা সময়কাল বলে পরিচিত।

অসংখ্য ভক্তের সমারোহ যেমন চারদিকে, তেমনি সমারোহ অসংখ্য বিদেশী দর্শনার্থীর। যারা আমাদের মতোই যা পায় তার সামনেই দাড়িয়ে যায় ছবি তুলতে। মনে হয় এটার সামনে ছবি তোলা বাদ রাখলে 'মহা নেপাল' অশুদ্ধ হয়ে যাবে। আমরাও পিছিয়ে থাকিনী ছবিতে থাকি আর না থাকি, প্রতিটি স্পটের ছবি ক্যামেরার মেমোরী কার্ডে জড়ো করে নিয়ে এসেছি। কারণ কোন এক সময় এগুলো দেখলে আমাদের মেমোরী জেগে উঠবে।

দরবার স্কয়ার পুরোটাই হিন্দু ধর্মের নানান দেবতা ও দেবীর মূর্তিতে পূর্ন। ভক্তরা সেখানে নতমস্তকে নিজেদের সমর্পন করছে। শক্তির দেবী কালির বিশাল মূর্তিটি দেখার মতো। আর যেহেতু এটা হমুমান ঢোকা তাই যে কেউ এখানে এসে একসাথে অসংখ্য হমুনান মূর্তি দেখতে পাবেন। হমুনানকে দরবার স্কয়ারে শক্তিমান রক্ষাকারী বলে বিবেচনা করা হয়।

আরেকটা বিষয় এখানে দেখতে পাবেন তা হল লালের ছড়াছড়ি। এখানকার সব কিছুই লাল রঙে আচ্ছাদিত। লালকে পেছনে রেখে আমাদের সামনে যাওয়ার মানে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হলো। বেরোতেই কিছুক্ষন হাটতেই সামনে পড়ল এক ব্যাক্তির ভাস্কর্য। দেখে সাধারণ চোখেই ধরা যায় এটা মাল্লা, শাহ বা রানার মূর্তি নয়।

স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞাসা করতে জানালেন, উনি তাদের জনআন্দোলনের শহীদ। দেখে ভাল্লাগলো। সব দেশেই নূর হোসেনরা আছেন। ৪. পরদিন আমাদের গন্তব্য নাগোরকোট। নেপালী ভাষায় কোট মানে গ্রাম।

বখতপুর জেলার এ গ্রাম রাজধানী কাঠমাণ্ডু থেকে ৩২ বত্রিশ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। এই হিলস্টেশনের উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে ২১৭৫ মিটার বা ৭২০০ ফুট। নেপাল ঘুরে যাওয়া মানুষের কাছে অসংখ্যবার শোনা এই স্থানটি দেখতে যাওয়ার আগ্রহই ছিল অন্যরকম। কারণ এটাও জানতাম, নাগরকোটকে বলা হয় 'মেঘপুঞ্জের আরাম'। এটা আমাদের কুয়াকাটার মতো জায়গা।

একই স্থান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখা যায়। তবে সেখানে সাগর নেই। পাহাড় থেকে দেখতে হয়। সকালে যাওয়া সম্ভব হয়নি বলে আমরা গেলাম বিকেলের দিকে সূর্যাস্ত দেখবো। নেপালের অসংখ্য গলি, রাজপথ ঘুরে আমরা পৌছলাম পাহাড়ী পর্যটনের সেই তীর্থ নাগরকোটে।

কিন্তু আমাদের ভ্রমণভাগ্য সেদিন আশাতীত খারাপ হওয়ায় মেঘপুঞ্জের আরাম নামক স্থানটি বিরমাহীন হতাশার মেঘে ঢেকে দিল আমাদের মন। মেঘে ঢাকা পড়েছে বিকেলের আকাশ। সূর্যাস্ত দেখা শুধু তখন কল্পনাতেই সম্ভব। কোনও উপায় ছিলনা সেই মেঘ কাটানোর। তাই আশি রুপি করে বাংলাদেশী মুদ্রায় বিশটাকার কফি খেয়ে মেঘের কোটাচ্ছাদিত নাগরকোটের পাহাড় ঘুরেই সেদিন চলে আসতে হয়েছিল।

থামেলে এসে আমরা বেশিক্ষন থামলাম না। আবার বেরিয়ে গেলাম। পরদিন চলে যেতে হবে। কিন্তু এভাবে তো চলে যাওয়া যায়না। মার্কেটের এই এলাকা থেকে মার্কেটিং করে না গেলে নেপালের অর্থনীতি আমাদের অভিশাপ দেবে।

এই গোপন উপলব্দি আমার হলেও এর প্রকাশ্য প্রয়োগ আর আমার করা হয়নি। করেছে আমার পরিবারের সদস্যরা। ৫. বাংলাদেশের মানুষের অতি মুগ্ধতা আর সব কিছুকে আয়োজন করে উদযাপনের যে প্রবণতা তা থেকে আমরাও ব্যাতিক্রম হলামনা। তাছাড়াই এমনিতেই নেপালের প্রতি ভালো লাগায় জড়িয়ে গেলাম। বিদায় জানাতে কষ্ট হচ্ছিল নেপালকে।

ঐতিহ্য এবং সৌন্দর্যের দেশ নেপাল। বিদায় জানাতে কষ্ট হাচ্ছিল প্রতিদিন দেখা নেপালের মানুষগুলোকে। হিমালয়ের পাদদেশে থাকার কারণে যারা আশাতীত শান্ত প্রকৃতির। যারা আমাদের মতো রাজনৈতিক বিভাজনে নেই। তারা রাজনীতি সচেতন কিন্তু সবাই এক দলের।

রাজনৈতিক দল বিরোধী। বিদায় জানাতে কষ্ট হচ্ছিল নেপালের টেক্সি ড্রাইভারগুলোকে, যাদের সাথে প্রতিদিন বাইরে গেলেই গাড়ীতে নানা বিষয়ে কথা বলতাম। তাদের দেশ নিয়ে কথা শুনতাম। শিতি এই মানুষগুলো চাকরীর অভাবে এই পেশায় আছে। দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও দেশের রাজনীতিবীদদের নিয়ে নিদারুন ক্ষোভ।

আমার উপলব্দিতে সবাইকেই দেখলাম একমত হতে, দেশের দেহ নেপাল হলেও মাথা নাম ভারত। ভারত দিয়েই মোটামুটি চলছে। শক্তিশালী একটা দেশ পাশে থাকায় সব কিছুই ভারত থেকে আমদানীকৃত। এমনকি তাদের রাজনীতির প্রভাবও। বিদায় জানাতে কষ্ট হচ্ছিল আমার হোটেলকে।

সেবার মানে থ্রি ষ্টার হলেও অবস্থানের কারণে এটা ফাইভেরও উপরে। বিদায় জানাতে কষ্ট হচ্ছিল লাভ ইন নেপালের শ্রেষ্টাংশে থাকা আরেক কুশিলবকে। হোটেলের রিসিপশনিষ্ট রঞ্জিতা। যার বিনয়ী আচরন, হাসি, কথা বলা ধরণ সব কিছুই মুগ্ধ হবার মতো। যে মুগ্ধতায় আমি প্রতিদিন ২০০ রূপি কম নিয়ে তার কাছে ডলার ভাঙাতাম।

অবশেষে সব কিছু তুচ্ছ করে চলে আসতেই হলো। কারণ সময়, নদীর স্রোত এবং নির্দিষ্ট সময়ের বিমান কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। ছবি : ১. নেপালের একটি বৌদ্ধ মন্দির ২. প্রিয় আমীরুল ভাই, সাথে তার ভাতিজা অমিও ৩.শয়ম্ভুনাথ স্তুপার বৌদ্ধ ভাস্কর্য ৪.নেপালের মার্কেট খ্যাত এলাকা থামেল ৫.নাগরকোট ৬.নেপালী শিশু

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।