আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে _অমর্ত্য সেন



সম্প্রতি কেউ একজনের ডাকে একদিন আমি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠি। লোকটি আমাকে বলেন, ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর আমার আলোচনা তিনি ব্যাপকভাবে উপভোগ করছেন। কাউকে কিছু আনন্দ দিতে পেরেছি শুনে খুব খুশি হই। কিন্তু একই সঙ্গে আমি এই ভেবে বিস্মিত হই, লোকটি পৃথিবীর কোন বিষয় নিয়ে আলোচনার কথা বলছেন । তখনও আমি সে ধরনের কোন আলোচনা বা বিতর্কে সম্পৃক্ত হইনি।

যদি তেমনটি হয় তবে এ ধরনের আলোচনায় আমি বহু ফোনকল পাই ও গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে হয়। তখনও উলিস্নখিত আলোচনার বিষয়টি আমার স্মরণে আসেনি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর বিভিন্ন প্রেৰিতে গত কয়েক মাসে আমি যেসব মনত্মব্য করেছি তা স্মরণ করার চেষ্টা করি। অবশেষে আমি স্মরণ করতে সৰম হই। গত ডিসেম্বরে দিলস্নীতে দি ইন্ডিয়ান্স এন্টারপেনার্স (টিআইই) সভায় আমি বলেছিলাম শিৰা, মৌলিক স্বাস্থ্য অথবা গড় আয়ুর মতো অন্যান্য বিষয়ে যখন চীনের সঙ্গে আমাদের তুলনা করা হচ্ছে না, তখন গড় জাতীয় উৎপাদন (জিএনপি) 'র প্রবৃদ্ধির হারের ভিত্তিতে চীনকে অতিক্রম করার বিষয়টি সর্বৰণিক পর্যবেৰণ একটি নির্বোধের পরিচায়ক।

গড় জাতীয় উৎপাদন অবশ্যই জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং দারিদ্র্যতা দূরীকরণে খুব সহায়ক। কিন্তু সেখানে বিভ্রানত্মির কিছু কারণ রয়েছে। তা হলো ১. ভাল কিছু অর্জনের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং ২. জড়বস্তুর প্রবৃদ্ধির মধ্যে এর লৰ্য অনত্মর্নিহিত। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া কারও সমীচীন নয়, আমিও সে ধরনের কিছু করিনি। স্বীকার করতে হবে এটিই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ নয়।

কিন্তু উন্নতমানের জীবনযাত্রাসহ যেসব বিষয় আমরা গুরুত্ব দেই তা অর্জনের এটি একটা কার্যকর উপায়। চীনের সঙ্গে ভারতের সুদূরপ্রসারী প্রাসঙ্গিক তুলনা আমার মনত্মব্য দ্বারা বাতিল করা ঠিক হবে না। এটি একটি ভাল সম্ভাবনা, যার মধ্যে দুটি দেশকে মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে। অতীতে আমার নিজের ও জেন ড্রেসের বিভিন্ন কাজকর্মে এসব সম্ভাবনা ব্যবহার করা হয়েছে। কিছু ঐতিহাসিক স্বার্থে চীনের সঙ্গে ভারতের তুলনা বহুদিন থেকে আলোচনার বিষয়।

সপ্তম শতাব্দীতে ইং জিং কে জিজ্ঞাসা করা হয় ভারতের পাঁচটি অংশে এমন কেউ কি আছেন , যিনি চীনকে পছন্দ করেন না? জিং ভারতের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় নালান্দায় অধ্যায় শেষে দশ বছর পর চীনে ফিরে যান। ৬৯১ খ্রিস্টাব্ধে তিনি ভারতের ওপর একটি বই লেখেন। বইটিতেই প্রথম অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে দু'দেশের মেডিক্যাল প্রাকটিস ও স্বাস্থ্য সেবার তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়। তিনি পর্যবেৰণ করেন ভারতের কাছ থেক চীন কি শিখতে পারে এবং বিনিময়ে চীনের কাছ থেকে ভারত কি গ্রহণ করতে পারে। অতীতের ন্যায় বর্তমানেও সে ধরনের তুলনা খুব প্রাসঙ্গিক।

বর্তমানে ভারত ও চীনের সঙ্গে তুলনায় যে মাপকাঠি ব্যবহার করা হচ্ছে সেখানে কিছু ভুল আছে। আর তা হচ্ছে তুলনার ৰেত্র নির্ণয়ে। বর্তমানে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বছরে ৮ শতাশেংর মতো। ভারত কখন, কবে চীনের ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধিকে ধরতে পারবে বা অতিক্রম করবে সে বিষয়ে অনেক কল্পবিলাসী পরিকল্পনা ও রম্নদ্ধশ্বাস আলোচনা চলছে। বিশ্বব্যাংকের বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন ও জাতিসংঘের মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিবেদন মতে চীনের মানুষের গড় আয়ু ৭৩ দশমিক ৫ বছর, অন্যদিকে ভারতের ৬৪ দশমিক ৪ বছর।

চীনে শিশু মৃতু্যর হার প্রতি হাজারে ১৭ জনের বিপরীতে ভারতে শিশু মৃতু্যর হার ৫০ জন এবং ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃতু্যর হার ভারতে প্রতি হাজারে যেখানে ৬৬ জন সেখানে চীনে এই সংখ্যা ১৯ জন। চীনে বয়স্ক শিৰার হার যেখানে ৯৪ ভাগ সেখানে ভারতে এই হার ৬৫ ভাগ। শিশুদের স্কুলে যাওয়া গড় বয়স ভারতে ৪ বছর ৪ মাস। অন্যদিকে চীনে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার গড় বয়স ৭ বছর ৫ মাস। ভারতে মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর অনেক প্রচেষ্টা গ্রহণ করার পরও এই হার চীনের অনেক নিচে।

ভারতে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারী শিৰার হার যেখানে ৮০ ভাগের নিচে সেখানে চীনে এই হার ৯৯ ভাগ। যেখানে ভারতের প্রায় অর্ধেক শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে চীনে এই হার খুব সামান্য। চীনে যেখানে শতকরা ৯৭ জন শিশুকে টিকা দেয়া হয় ভারতে এই হার ৬৬ ভাগ । এসব ৰেত্রে ভারত নিজেদের চীনের সঙ্গে তুলনা করলে একটা ভাল সম্ভাবনা তৈরি হবে। চীনের উচ্চ জিএনপি নিশ্চিতভাবে দেশটির দারিদ্র্যতা ও বঞ্চনার বিভিন্ন সূচক দূরীকরণ এবং উন্নত জীবনধারণের বিভিন্ন ৰেত্র প্রশসত্ম করতে সহায়তা করছে।

তাই টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিষয়টি উৎসাহিত করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বর্তমান ও ভবিষ্যতে জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে আমরা দ্বিমত পোষণ করতে পারি। টেকসই উন্নয়ন গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের পরিষ্কার হওয়া দরকার আরমা যা করছি তা কেন করছি এবং কি করছি। চীনের সঙ্গে জিএনপি বৃদ্ধির পালস্না থেকে এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার সম্ভব নয়।

অধিকন্তু, আমাদের এই বিষয়টি স্মরণ রাখতে হবে যে মাথাপিছু গড় জাতীয় উৎপাদন আমাদের জীবনের একমাত্র মূল্যবান পরিমাপক নয়। এর সঙ্গে আরও অনেক বিষয় জড়িত যা আমরা করছি বা করতে ব্যর্থ হচ্ছি। অনেক বছর আগে জেন ড্রেজ এক নিবন্ধে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের তুলনা করতে গিয়ে উলেস্নখ করেছেন বাংলাদেশে 'সামাজিক সূচক' অত্যনত্ম দ্রম্নত গতিতে উন্নত হচ্ছে। আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে ভারত অনেক এগিয়ে। ভারতের মাথাপিছু গড় জাতীয় উৎপাদন যেখানে ৩ হাজার ২৫০ রম্নপী সেখানে বাংলাদেশের ১ হাজার ৫৫০ রম্নপী।

শুরম্ন থেকেই মাথাপিছু আয়ের দিক দিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ভারত এগিয়ে ছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের দ্রম্নত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে ভারতের মাথাপিছু আয় এখন বাংলাদেশের প্রায় দ্বিগুণ। ভারতের এই মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি অন্যান্য বিষয়ে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে কিনা তা সত্যিকারার্থে গুরম্নত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু ৬৬ দশমিক ৯ বছর। অন্যদিকে ভারতে গড় আয়ু ৬৪ দশমিক ৪ বছর। বাংলাদেশে কম ওজনের শিশুর হার যেখানে ৪১ দশমিক ৩ ভাগ, সেখানে ভারতে এই হার ৪৩ দশমিক ৫ ভাগ।

বাংলাদেশে জন্মের হার যেখানে ২ দশমিক ৩ ভাগ, ভারতে এই হার ২ দশমিক ৭ ভাগ। বাংলাদেশে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার গড় বয়স ৪ বছর ৮ মাস। ভারতে ৪ বছর ৪ মাস। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী যুবকদের শিৰার ৰেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে ভারত এগিয়ে। অন্যদিকে নারীদের ৰেত্রে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে।

মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশের তরম্নণ প্রজন্মের মধ্যে নারী শিৰার হার সত্যিকারার্থে পুরম্নষের চেয়ে বেশি। অন্যদিকে ভারতের তরম্নণ প্রজন্মের মধ্যে পুরম্নষের তুলনায় নারী শিৰার হার খুব শোচনীয়। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত প্রমাণ করে বংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়নের পেছনে নারীদের বিরাট অবদান রয়েছে। স্বাস্থ্যের অবস্থা কেমন ? কারণ অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে স্বাস্থ্যের বিষয়টি সকলের কাছে খুব আগ্রহের । ভারতে ৫ বছরের নিচে শিশু মৃতু্যর হার প্রতি হাজারে ৬৬, অন্যদিকে বাংলাদেশে এই হার ৫২।

শিশু মৃতু্যর হারের ৰেত্রেও ভারতে চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা ভাল। ভারতে শিশু মৃতু্যর হার যেখানে প্রতি হাজারে ৫০, সেখানে বাংলাদেশে এই হার ৪১। বাংলাদেশের ৯৪ ভাগ শিশুকে টিকা দেয়া হয়েছে, ভারতে এই হার মাত্র ৬৬ ভাগ। শুধুমাত্র মাথাপিছু আয়ের দিক দিয়ে দ্বিগুণ ব্যতীত উলিস্নখিত প্রতিটি ৰেত্রে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ অনেক ভাল করেছে। তবে যাই হোক এর মানে এই নয় যে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থেকে বাংলাদেশের মানুষ উপকৃত হবে না।

প্রবৃদ্ধিকে শুধু কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে যদি ভাল কিছু করার কাজে ব্যবহার করা হয় তবে অবশ্যই তারা উপকৃত হবে । এটি বাংলাদেশের জন্য বিরল সম্মানের বিষয় যে কম আয় হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন ৰেত্রে অতিদ্রম্নত তারা প্রভূত অগ্রগতি লাভ করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটা বড় বিষয় হচ্ছে, সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ বৃদ্ধি করা। প্রকৃতপৰে জিএনপির চেয়ে পাবলিক সম্পদ দ্রম্নত বৃদ্ধি পায়। যখন জিএনপি ৭ থেকে ৯ ভাগ বৃদ্ধি পায় তখন জনগণের আয় বৃদ্ধি পায় ৯ থেকে ১২ ভাগ।

উদাহরণস্বরূপ, ভারতের শুল্ক আয় বর্তমানে ১৯৯০-৯১ সালের তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি, যা মাথাপিছু জিএনপির চেয়ে অনেক বেশি। স্বাস্থ্য, শিৰা, পুষ্টির মতো বিভিন্ন বিষয়ের ব্যয়কে অনেক সময় সামাজিক খাত হিসেবে ধরা হয়। এসব ৰেত্রে ভারতের ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার পরও ভারতের অবস্থান এখনও চীনের চেয়ে অনেক নিচে। চীনে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ ভারতের প্রায় পাঁচগুণ।

চীনের চেয়ে ভারত বেশি মাথাপিছু আয় বাড়াতে পারে। কিন্তু বাসত্মবিকার্থে চীন যখন তার স্বাস্থ্য খাতে মোট জিডিপির প্রায় ২ ভাগের মতো ব্যয় করছে তখন এই খাতে ভারতের ব্যয়ের পরিমাণ মাত্র ১ দশমিক ১ ভাগ। ভাষান্তর: শামীম আহমেদ সূত্র : দি হিন্দু View this link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.