আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এশিয়ান

বাংলা সাহিত্যের নতুন এক বাতাসের ঝাপটা আমি

প্রথম প্রচ্ছদ: আঁকিবের বিদায় সূর্য ডুবে-ডুবে যাচ্ছে এমন অবস্থায়। পিসি সারের কাছ থেকে পড়া শেষ করে আমি রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল থেকে বাসায় ফিরছি এমন সময় আঁকিবের সাথে দেখা। “আরিফ, কোথায় যাচ্ছিস?” আঁকিব আমাকে দেখে একটু অবাকই হল। “বাসায় ফিরতিসিলাম। অংক পড়তে গেসিলাম,” আমার মুখে হাসি লেগেই রইলো।

“ও...পড়া শুরু করে দিসিশ। যাক বছরের শুরু থেকে পড়ালেখা না করলে এস.এস.সে তে গোল্ডেন এ পাওয়া যায় না। ” "জানিরে বন্ধু," তরিৎ গতিতে হটাত করে আমার মাথায় বিষয়টা আসলো, “তুই কোথা থেকে আসতিসিশ?” আঁকিব এখন একটু রাগান্বিত হল। “গেসিলাম একটু ফুপুর বাসায়। ” আমার সন্দেহ হইলো।

“তোর ফুপুর বাসা মোহাম্মদপুরে? এটা তো জানতাম না। ” আঁকিব এবার বিরক্তিকর সরে বলল, "তুই কেমনে জানবি আমার কোন মামা-ফুপু কোথায় থাকে?" আমারও এখন বিরক্তি ধরে গেসে, “রাগ হওয়ার কি আসে? পরে কথা হবে। এখনই যদি না রওনা দেই তাহলে রাত জেগে পড়তে হবে। ” আমি উল্টো দিকে ঘুরে রাস্তা পারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পেছন থেকে আঁকিব বলে উঠলো, "আল্লা হাফেয, বন্ধু।

" আল্লার নাম নিয়ে আমাকে বিদায় জানায় আঁকিব। আমি কোন দিক থেকেই ভাবি নাই যে আঁকিবের কাছ থেকে এই-ই শেষ কথা শুনবো আমি। দুইদিন পর, দুপুর একটার দিকে আমি, সাদি এবং রাসেল স্কুল থেকে ফেরত আসছিলাম। আমার বাসা অনেক কাছেই। তাই তিন জনের মধ্যে আমিই প্রথম বাসায় পৌছাই।

লিফটে করে ৮ম তলায় উঠি। তারপর আমি যে দৃশ্য দেখলাম তা পরবর্তী জীবনে বোধ হয় খুব কমই দেখেছি। বের হয়ে দেখি মা দরজার বাইরে, সিরিতে বিষণ্ণ মুখে বসে আছেন। আমাকে দেখেই যেন মুখের রঙ বিষণ্ণতা থেকে কেঁদো-কেঁদো হয়ে উঠলো। “কি হইসে মা? তুমি সিরিতে কেন?” আমি অনেক চিন্তিত হয়ে উঠেছিলাম।

কারণ এর আগে যেদিন তিনি সিরিতে অমন মুখ করে বসেছিলেন, সেদিন আমি আমার বান্ধবীর সাথে সময় কাটানোর জন্য স্কুল থেকে বাসায় আসতে আধা ঘণ্টা দেরি করি। এর মধ্যে মা একে ওকে ফোন করে আমার সন্ধান করতে লেগে যান এবং শেষে সিরিতে বসে কাঁতে লাগেন। বাসায় ফিরে দেখি কেঁদে তার চোখ ফুলে গেছে। কিন্তু আজকে তো আমি দেরি করি নি! তবে কেন এমন করে বসে আছে। আমার প্রশ্ন এবং তার জবাবের মধ্যে মনে হয় যেন ঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছিল।

আমি প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। কিন্তু শেষমেশ কোন উত্তর না পেয়ে আমি জোরে বলে উঠি, "মা!” মা যেন গভীর ধ্যান থেকে জেগে উঠলেন। আমার চোখে চোখ দিয়ে তিনি ফিসফিস করে বললেন,” গতকাল রাতে...আঁকিবকে কারা যেন...গুলি করে মেরে ফেলেছে!” আমি সত্যি অনেক মর্মাহত হয়েছিলাম। সত্য বলতে কি প্রথমত আমি বিশ্বাস করতে পারি নি। কেমন করে বিশ্বাস করতাম? আমার জীবনের সবথেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে আমি আর দেখতে পাব না, একসাথে গান গাইতে বা গিটার বাজাতে পারবো না।

মনে হচ্ছিলে কোন ধরনের ভুল হয়েছে। অজ্ঞাতসারে আমি বাসার ভিতর ধুকেই আমার ফোন বের করে আঁকিবকে ফোন করি। একটার পর একটা রিং হতেই থাকে। তারপর একজন তার উত্তর দেয়। “আরিফ বাবা,” আঁকিবের মার গলা শুনতে পেলাম।

তার গলার স্বরও আমার মায়ের মত। “আন্টি...আন্টি আঁকিবকে দেন না, প্লিস!” আমি অসহায়ের মত বললাম। আঁকিবের মা’র কান্না শুনে আমার মনের গভীর এক অংশ তৎক্ষণাৎ ভাবে বুঝে ফেলেছিল, যে মা মিথ্যা বলে নি। কিন্তু আমি আসা ছাড়তে পারছি না। “ও কোথায় আন্টি? আঁকিবকে একটু ডাক দেন।

আমার মা বলছিল যে আঁকিব নাকি খুব খারাপ ভাবে আহত। ” আমারও অবস্থা কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠছে। কিযে করবো বা বলবো তা ভাবে উঠতে পারছিলাম না। তাই আন্টির উত্তরের অপেক্ষায় ছিলাম, যদিও উত্তর আমি যানতাম এবং তা আমার মনে বার বার খচা দিচ্ছিল। অবশেষে আন্টি বলে উঠলো, “আরিফ...” কিন্তু তারপর আবার স্তব্ধতা।

“জি?” আমি কি-ই বা বলতাম? আমি তো নিজেই ভেঙ্গে পরেছিলাম। “বাবা, ওকে কারা যেন গুলি করে মেরে ফেলেছে,” বলেই আন্টি কেঁদে উঠলো। আমি আর সহ্য করতে পারলাম। সাথে সাথে, দুঃখ, কষ্ট, বেদনা যা ছিল সব যেন উতলে পরে আসছিল। আকিব আমার ভাইয়ের মত ছিল।

আমার জীবনের পরম বন্ধু। তাকে কিভাবে আমি হারাতে পারি? অসম্ভব! হতেই পারে না। মা পেছনে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল। আমি ঝড় হাওয়ার মত তার পাশ থেকে চলে গেলাম। স্কুলের কাপড় পরেই আমি রিক্সা ধরলাম।

আধা ঘণ্টার মধ্যে মিরপুর ২ এ আঁকিবের বাসা চোখে এলো। বাসার সামনের রাস্তাটা সম্পূর্ণ গাড়িতে ভরে গিয়েছিল। ভিতরে কান্নাকাটির আওয়াজ। সেই প্রথম বারের মত আঁকিবের বাসায় দুঃখের ঘ্রাণ পেলাম। আগে যখন ওর বাসায় যেতাম তখন সব সময় না হয় গান চলতো অথবা ও বাসার সামনে বসে আড্ডা দিত।

কিন্তু আজ পুরো রাস্তাটাই স্তব্ধ, নিঃশব্দ, অন্ধকারাচ্ছন্ন। আমার মনের মধ্যে বিদ্যুৎ গতিতে অনেক ভাবনা চলছিলে। এমন সময় রিক্সা আঁকিবদের পাঁচ তলা দালানের সামনে এসে দাঁড়াল। তাকে টাকা দিয়ে আমি প্রায় দৌড়ে গিয়ে লিফটে উঠলাম। আঁকিবরা সম্পূর্ণ দালানটির মালিক ছিল।

নিচের চার তলা ভারা দিয়ে পঞ্চম তলায় থাকতো তারা। লিফট আমাকে পঞ্চম তলায় নিয়ে গেলো। লিফট খুলতেই দেখতে পেলাম যে আঁকিবদের বাসার দরজা খোলা এবং বাসার ভিতর মানুষে ভরা; সকলেই সাদা কাপরে। তারপর আমার যা চোখে পড়লো তার জন্য আমি কোন ভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। আমাকে যদি কেউ বজ্রপাত দ্বারাও আঘাত করতো, আমি এতটা স্তম্ভিত হতাম না।

সাদা কাপড়ে সকল মানুষ এক বিছানা ঘিরে বসে রয়েছেন। সেই বিছানার ওপর ৫.৮` লম্বা আঁকিবের শরীর পরেছিল; নির্জীব। এক পলক ওর চেহারা দেখার পর আমি আর তাকাতে পারছিলাম না। সাধ্য ছিল না। সিরি দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছিল।

এবং তাই করেছি। সত্যতা থেকে পালিয়ে চলে গিয়েছিলাম আমি। ঢাকা শহরে শুধুমাত্র ধানমন্ডি লেকই আমার শান্তিপুর্ণ মনে হত। শান্ত মাথায় ভাবা দরকার ছিল আমার। তার ধানমন্ডি ৩৩ এ লেকের পারে চলে গেলাম।

একটা সুন্দর বেঞ্চ দেখে সেখানে আস্তানা গেড়ে নিলাম সত্যতা মেনে নিতে হবে আমার। ‘আঁকিবকে আর দেখবো না। ওর সাথে বসে আর গিটার বাজানো হবে না। ’ ভেবে অসম্ভব মনে হচ্ছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যেতে লাগে।

অনেক স্মৃতি চোখের সামনে একের পর এক ভেসে উঠতে লাগলো। আমার ফোনে বাবার দুটো কল আসে। তার পরই ফোন বন্ধ করে রাখি। শেষে সন্ধ্যা সাতটার দিকে বেঞ্চ থেকে উঠে, বাসার জন্য হাটা শুরু করলাম। আমার মন নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল।

অন্য কিছু নিয়ে ভাবতেই পারছিলাম না। এমনকি রাস্তায়ও মনোযোগ দিয়ে চলতে পারছিলাম। শেষমেশ বাসায় ফিরলাম। মা-তো চিন্তাতে মরেই যাচ্ছিল। সে জানতো আমার মনে আঁকিবের জন্য কতটা শ্রদ্ধা ছিল, কতটা ভাল জানতাম।

তাই আমার কথা ভেবেও মার কষ্ট হচ্ছিল। এভাবেই আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধুকে হারিয়ে ফেললাম!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.