আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিহারী, রিফুজি নাকি বাংলাদেশী!

বুদ্ধিজীবী হতে ডিগ্রী লাগেনা। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। কথাটা মনে হয় সব সময়ের জন্য সত্য নয়। স্থান কাল পাত্র ভেদে মানুষের জীবনের মান কম বেশী হতে পারে। কোঠাও মানুষ ভালোবেসে মাটির ধরণীকে বান্য বেহেস্তের কুটির, আবার কোথাও মানুষ হিংসে বিদ্বেষের জন্য পৃথিবীকে বানিয়ে ফেলছে নরকের নিবাস।

মানুষের মৃত্যু ঘটছে মানুষেরই হাতে। আজ আমি ধ্বংস মৃত্যু হানাহানির কথা বলবো না। আমি কিছু মানুষের কথা বলবো। মানূষ হিসেবে আমরা তাদের কতটা মূল্যায়ণ করি জানিনা কিন্তু জাতি হিসেব তাদের আমরা চরম ঘৃণার চোখে দেখি। সোনালী জীবনের প্রত্যাশায় পৈতৃক ভিটা বাড়ীর মায়া ঝেড়ে ফেল তারা এসেছিলো এই ভূখন্ডে।

খুব কম মানুষই বাপের ভিটার মায়া কাটাতে পারে। বলতে গেলে তারা একরকম বাধ্য হয়ে আসে বাংলায়। পরবর্তী এক প্রজন্মের ভূলের মাসুল দিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আমি বিহারীদের কথা বলছি। আমি বাংলাদেশে বাস করা আটকে পড়া পাকিস্তানীদের কথা বলছি।

যারা আর কখনো পাকিস্তানে ফিরে যেতে পারবে কিনা তাদের কথা বলছি। আমি বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে পড়া মানবেতর জীবন যাপন করা কিছু মানুষের কথা বলছি। একজন মানুষ হিসেবে মানুষের কথা বলছি। বিহারীদের আমরা সাধারনত রিফিউজি বা প্রচলিত উচ্চারণে রিফুজি বলে জানি। আমাদের অধিকাংশের ধারণা রিফুজিরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী যারা আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশে আটকে আছে।

তুমি কি অবাক হবে যদি আমি বলি যে বিহারীরা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আসে নি। তারা এসেছিলো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে। পুরানের ত্রিশংকু দশা অবস্থার কথা মনে পড়ে গেলো। স্বর্গ, মর্ত, পাতাল কোথাও ঠাঁই না হওয়ার শূন্যে ঝুলে রইলো। বিহারীদের আজ ত্রিশংকু দশা।

ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ কোন দেশ তাদের নয়। পরগাছা এক জীবন তাদের। কিন্তু এমনটা হওয়ার কি কথা ছিলো। এমন জীবন কি তারা ইচ্ছে করে বেছে নিয়েছে! ইন্ডিয়া পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে বিহারীরা বাস করত ভারতের বিহার প্রদেশে। বিহার রাজ্যে হিন্দুরা ছিলো।

সংখ্যাগরিষ্ঠ। মানব সভ্যতার সব থেকে নোঙড়া দিক যে সকল জায়গায় সব সময় সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরুদের দ্বারা কোন না কোন ভাবে নিপীড়িত হয়েছে। সাত চল্লিশের রায়টের সময় ভারতের অন্যান্য জায়গার মত বিহারেও সংখ্যলঘু মুসলিম বিহারীরা নির্যাতনের শিকার হয়। সুস্থ একটা জীবনের প্রত্যাশায় তারা পা বাড়ায় নবগঠিত মুসলিম দেশ পাকিস্তানে। যেহেতু ধর্মের বিভক্তিতে সৃষ্টি হলো দুটি দেশ।

পাকিস্তান মুসলিম বিহারীদের কাছে স্বর্গরাজ্য। পথের দূরত্বের কারণে তারা পূর্ব পাকিস্তানে এসে ভীড় করলো। নতুন দেশ, নতুন জায়গা, নতুন করে বাঁচার প্রেরণা। তারা মনে প্রানে পাকিস্তানী হওয়ার চেষ্টা করলো। বাংলাদেশ মিশ্র সংস্কৃতির দেশ।

দেশের সুপ্রাচীন ইতিহাসে ভিন্ন ভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর আগমনের প্রমাণ পাওয়া যায়। একসময় বাংলাদেশে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর ব্যাপক আগমন ঘটে| পুরানো ঢাকা কিংবা দেশের অন্যান্য স্থানে যে বনেদী মুসলমান পরিবারগুলো ছিল তারা নানা কারণে আরবি এবং ফার্সির পাশাপাশি উর্দু চর্চা করত। তাদের পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলের ভাষাও ছিল উর্দু। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দশকগুলোতে ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে কাজ করার জন্য অনেক উর্দু ভাষাভাষী তৎকালীন পূর্ব বাংলায় আসে। তাদের মধ্যে এক বিশাল অংশ ছিল বিহার থেকে আগত যারা প্রধানত রেল, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা ও অন্যান্য বেসামরিক পদগুলোতে যোগ দিয়েছিল।

ঢাকা থেকে ২০০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে সৈয়দপুরে এ অঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ রেলওয়ে ওয়ার্কশপ অবস্থিত। এ ওয়ার্কশপে কাজ করার জন্য ব্রিটিশরা বিহার থেকে প্রায় ৭০০০ জনকে এখানে নিয়ে এসেছিল। উল্লেখ্য সৈয়দপুর শহরটি বিহার সীমান্তে অবস্থিত। ১৯৪৭ সালে যখন উপমহাদেশ বিভক্ত হলো তখন ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির কয়েক মাসের মধ্যেই হিন্দু মুসলিম দ্বন্দ্ব্বে ২ কোটি লোক বাস্তুহারা হয় এবং ১০ লক্ষ লোক মারা যায়। ৭৫ হাজার মহিলা নির্যাতিত, ধর্ষিত ও গৃহহারা হয়।

১৯৪৭ সালের মধ্যে ৭২ লাখ মুসলিম পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে অভিবাসী হিসাবে গমন করে। অন্যদিকে ৫৫ লাখ হিন্দু ও শিখ ভারতে অভিবাসী হিসাবে যায়। এর মধ্যে ১৩ লাখ মুসলিম অভিবাসী পূর্ব পাকিস্তানে যায় যাদের মধ্যে ১০ লাখ ছিল বিহার থেকে আসা। সেই সময়ে বিহারে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মুখে বিহার, উড়িষ্যা ও পশ্চিম বঙ্গ থেকে বিপুল সংখ্যক মুসলিম অভিবাসী পূর্ব বাংলায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এছাড়া ব্রিটিশরা তাদের সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে কোন একটি দেশে যোগদানের সুযোগ করে দেয়।

এ সুযোগ এবং ১৯৪৭ এর ঘটনা প্রবাহে ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং পশ্চিম বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান তৎকালীন পূর্ব বাংলা (বাংলাদেশ) ও পাকিস্তানে চলে আসে বা আসতে বাধ্য হয়। এভাবে শুরু হয় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক নতুন পরিচয়ের আশায় লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলমানের ভিন্নমুখী যাত্রা। বাংলাদেশে (তৎকালীন পাকিস্তান) আসা এ সকল অভিবাসীর বিরাট অংশ ছিল উর্দুভাষী। তখন রাজনৈতিক কারণে এদেরকে উদ্বাস্তু না বলে মুহাজির হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। এসব অভিবাসীরা আরবি এবং ফার্সির পাশাপাশি উর্দু চর্চা করত।

তাদের পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলের ভাষাও ছিল উর্দু। এরা বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক ভিন্নতার পাশাপাশি ভাষাগত ভিন্নতার মুখোমুখি হয়। বাংলা ভাষা কিংবা লিপি তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এ কারণে এবং রাজনৈতিক নীতির কারণে এরা বাংলা ভাষাকে এড়িয়ে চলে এবং দৃঢ় গোষ্ঠীগত বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী থেকে তারা সব সময় আলাদা থাকে।

ফলে প্রথম থেকে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারণে এরা বাংলাদেশের প্রধান জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন পড়ে এবং এই ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ বিহারীদেরকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের পর তাদের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে ইউএনএইচসিআর ( United Nations High Commissioner for Refugees) ও আইসিআরসি (International Committee of Red Cross) তাদের নিয়ে কাজ করে। ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪ সালে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ এই মানবিক সমস্যা মোকাবেলায় একাধিক চুক্তি করে। ইন্দো-পাক অ্যাগ্রিমেন্ট ১৯৭৩, জেস ট্রাইপার্টাইট অ্যাগ্রিমেন্ট অফ বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ইন্ডিয়া, ১৯৭৪ এই চুক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম।

আইসিআরসি বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারীদের পুনর্বাসনের চেষ্টার অংশ হিসেবে নাগরিকত্ব সর্ম্পকে জানতে চায়। তখন তারা পাকিস্তানে যাবার পক্ষে রায় দেয়। তখন বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারীদের Stranded Pakistani (আটকে পড়া পাকিস্তানী) বলে অভিহিত করা হয়। ফলশ্রুতিতে বিহারীদের তথা উর্দুভাষী এ জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে পাকিস্তানে পুনর্বাসন করা হয় বা পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে বাকিদের আইসিআরসি এর অধীনে ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হয়। আইসিআরসি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ৬৬টি ক্যাম্প স্থাপন করে।

এর মাধ্যে ছিল ঢাকার মিরপুর ২৫টি ও মোহাম্মদপুর ৬টি। মোহাম্মদপুরের ৬টি ক্যাম্প হলো জেনেভা ক্যাম্প, টাউন হল ক্যাম্প, সিআরও ক্যাম্প, মার্কেট ক্যাম্প, কমিউনিটি সেন্টার ক্যাম্প এবং স্টাফ কোয়ার্টার ক্যাম্প। ১৯৭৩ সালে আইসিআরসি এর বিদায়ের পর বাংলাদেশ সরকার ও বিডিআরএস (Bangladesh Red Crescent Society) এদের দায়িত্ব নেয়। রাবেতা আল আলম ইসলাম (রাবেতা আল আলম ইসলাম আটকে পড়া পাকিস্তানীদের পুনর্বাসনের জন্য পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়াউল হক কর্তৃক গঠিত ফাণ্ড যা পরবর্তীকালে নওয়াজ শরিফের হাতে পূর্ণতা লাভ করে। ) পরিচালিত জরিপ (২০০৩) অনুযায়ী প্রায় ২ লক্ষ ৭৫ হাজার উর্দু ভাষাভাষী বাংলাদেশের ৮১ টি ক্যাম্পে বসবাস করছে।

আইসিআরসি এর সদর দফতর জেনেভাতে। এ নামে তাই ১৯৭২ সালে নামকরন করা হয় জেনেভা ক্যাম্প। লিয়াকত হাউজিং সোসাইটির সাথে চুক্তির মাধ্যমে এ স্থানটিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে ক্যাম্প তৈরি করা হয়। সেখানে আশ্রয় নেয় ১৯৭১ সালে বাস্তুহারা বিহারীরা যারা মোহাম্মদপুরের রাস্তা, মসজিদ, স্কুলে অবস্থানরত ছিল। এটি বর্তমানে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৪৫ নং ওয়ার্ডের অধীনে অবস্থিত।

জেনেভা ক্যাম্পের জনসংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। ক্যাম্পটি দুই অংশে বিভক্ত। এক পাশে ব্লক এ এবং বি। অপর পাশে সি থেকে আই পর্যন্ত (৭টি ব্লক)। সবচেয়ে বড় ব্লক সি এবং সবচেয়ে ছোট ব্লক আই।

১৯৭৩ সালে আইসিআরসি থেকে ক্যাম্পের দায়িত্ব নেয় বিডিআরএস। ১৯৭৫ সালে ক্যাম্পের দায়দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে আসে। যেহেতু তারা পশ্চিম পাকিস্তানের কেউ নয় তাই বর্তমান পাকিস্তান তাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে কখনো কোন আগ্রহ দেখায় নাই। বিহারীরা পাকিস্তানী না বাংলাদেশী! নাকি তারা দেশহীন মানুষ! এই প্রশ্নে দীর্ঘদিন কেটে গেছে। ২০০৩ সালে আদালতের রায়ে বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারীদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.