আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চলচ্চিত্র সংসদ নিয়ন্ত্রণ আইন: কালাকানুনের ৩০ বছর

কোনো জটিলতা নেই তবুও জটিলতর শেষ বিকেলের রোদ

চলচ্চিত্র সংসদ নিয়ন্ত্রণ আইন: কালাকানুনের ৩০ বছর বেলায়াত হোসেন মামুন আজ কালাকানুনের ৩০ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৮০ সালের ৯ জুলাই জাতীয় সংসদে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কণ্ঠরোধ করার জন্য প্রগতি বিরোধী, মুক্তচিন্তানাশী, দমনমূলক আইন প্রণয়ন করে তৎকালীন বিএনপি সরকার। জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকারের ভারপ্রাপ্ত তথ্যমন্ত্রী শামসুল হুদা চৌধুরী সেই দিন ‘চলচ্চিত্র সংসদ নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৮০’ নামের আইন পাশ করানোর মধ্যদিয়ে বিকাশমান চলচ্চিত্র চর্চা, চলচ্চিত্র আন্দোলনের গতিমুখকে স্তব্ধ করে দেয়। মন্ত্রী শামসুল হুদা চৌধুরী সেই দিন আইনটি জাতীয় সংসদে উত্থাপনকালে সংসদকে বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় একশত ফিল্ম ক্লাব/সিনে সোসাইটি রহিয়াছে’। বর্তমানে অর্থাৎ ২০১০ সালে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের তত্ত্বাবধানে সারাদেশে মাত্র ২৩টি চলচ্চিত্র সংসদের কার্যক্রম অব্যাহত আছে।

প্রায় একশত চলচ্চিত্র সংসদের অস্তিত্ব আর এ দেশে নেই। এটাই এই আইনটির সবচেয়ে বড় ‘সাফল্য’। চলচ্চিত্র সংসদ নিয়ন্ত্রণের নামে গত ৩০ বছর ধরে নানারকম হয়রানী ও নিপীরণমূলক কর্মকান্ডের ফলশ্র“তিতে সরকারী হিসেবে প্রায় ৮৭টি চলচ্চিত্র সংসদ বিলুপ্ত হয়েছে এবং জন্ম হতে পারেনি বহু সংসদের। এ এক বন্ধ্যা সময়। এই বন্ধ্যাকরণের দায় কী এদেশের চলচ্চিত্র অথবা সংস্কৃতিঅঙ্গনের মানুষের নাকি জেনারেল জিয়াউর রহমানের? অথচ আইনটি প্রনয়নের পরপরই এর প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল দেশের চলচ্চিত্র সংসদসমূহ।

সে সময় ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক কবীর চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক সদ্যপ্রয়াত চলচ্চিত্রকার বাদল রহমান জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আইনটির প্রতিবাদে তুলে ধরেছিলেন যুক্তিসমূহ। আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে এই আইনের কারনে এদেশের বিকাশমান চলচ্চিত্র সংস্কৃতির পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। বলেছিলেন সরকার সাধারণত আইন প্রণয়ন করে থাকে অন্যায় প্রতিহত করতে অথবা জনগণের কল্যাণের নিমিত্তে। কিন্তু প্রণীত এই আইনটি অন্যায়ের জন্ম দেবে এবং সংস্কৃতি চর্চার বিরোধী অকল্যানের প্রতীক হয়ে থাকবে। যেহেতু এই আইন কোনো ধরনের কল্যানের উদ্দেশ্যে নয় বরং দমনমূলক উদ্দেশ্য থেকে প্রণীতে তাই একে কালাকানুন ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

সেদিন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী এবং বাদল রহমান আরো বলেছিলেন সামরিক সরকার ক্ষমতায় এলেই আমরা এমন দমন মূলক আইন প্রণীত হতে দেখি যা মুক্তচিন্তাকে প্রতিহত করে, সুস্থ সংস্কৃতি চর্চায় বাধা দেয়। পাকিস্তানী সামরিক শাসক আইয়ুব খানের সময়ে রবীন্দ্র সংস্কৃতি চর্চায় যে ভাবে বাধা দেয়া হয়েছে এ আইন তার চেয়ে কোন ভাবেই আলাদা নয়। ফলে অবিলম্বে এই কালাকানুনটি বাতিলের দাবী তাঁরা সেদিন তুলেছিলেন। কিন্তু কোথায় কী? সেই দিন আর এই দিনের মধ্যে ৩০ বছর সময় অতিবাহিত হয়ে গেলো। সে সময় সারাদেশে সক্রিয় একশরও অধিক চলচ্চিত্র সংসদ থেকে ৮০/৯০ টি চলচ্চিত্র সংসদ ধীরে ধীরে নি¯প্রভ, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো।

এই ভূখন্ডে ১৯৬৩ সালে জন্ম হয়ে ছিল চলচ্চিত্র সংসদের। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মাত্র ১০টি বছরে এদেশে যে ব্যপকতায় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন বিকশিত হয়েছিলো তা আর কোন সাংস্কৃতিক অঙ্গনেই সম্ভব হয়নি। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এ ভূ-খন্ডে শুধুমাত্র একটি চলচ্চিত্র সংসদই ছিল। ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’ (পরবর্তী কালে যা ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ’) এবং এর সভাপতি ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। অথচ ১৯৮০ সালের মধ্যেই সারাদেশে একশ’টির অধিক চলচ্চিত্র সংসদ যে ভাবে কাজ করছিল তাতে সামরিক শাসকদের অনাকাঙ্খিত হৃৎকম্পন শুরু হয়ে যায়।

ফলে অকারণ ভয়ে তারা তাড়াতাড়ি এই প্রাণবান, দীপ্ত আন্দোলনের কন্ঠনালীতে বজ্রকঠিন ফাঁস দিয়ে একে হত্যায় উদ্যত হয়। ৩০ বছর পর তাদের সাফল্য ঈর্ষান্বিত। চলচ্চিত্র সংসদের কাজ কী, চলচ্চিত্র সংসদ তাদের সভ্যদের দেশি-বিদেশী শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র দেখায়, চলচ্চিত্র সম্পর্কে পড়ায়, আলোচনা-সমালোচনা করে, লেখালেখি করে, দেশে সুস্থ চলচ্চিত্রের বিকাশে ফিল্ম আর্কাইভ, ফিল্ম ইন্সটিটিউট, চলচ্চিত্র নীতিমালা প্রণয়নের দাবি-দাওয়া জানায়, এই তো। এর কোনটি খারাপ কাজ? কোন কাজটি দেশের স্বার্থের পরিপন্থি, যে এই চর্চার বিকশিত হওয়ার পথকে কতটা দূর্গম করা যায় তার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হবে সরকারগুলোকে। ব্রিটিশ সরকার ‘অভিনয় নিয়ন্ত্রন আইন’ নামে একটি আইন পাশ করেছিলো।

কেন তা আমরা সকলেই জানি। বহুবছর আন্দোলনের পর সেই আইন বাতিল করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার (১৯৯৬-২০০১)। যে কোন সংস্কৃতিচর্চা বিরোধী আইন কী উদ্দেশ্যে প্রনয়ন করা হয় তা কি আমরা সকলে বুঝি না, নিশ্চয় বুঝি, তবুও কিন্তু নিরবে গোপনে চলচ্চিত্র সংসদ নিয়ন্ত্রন আইন বাংলাদেশে চলচ্চিত্র চর্চার বিপুল ক্ষতি করে ফেলেছে। এখন মাত্র ২৩টি চলচ্চিত্র সংসদ সক্রিয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে খুব দেরি নেই যখন এই আন্দোলন সম্পর্কে আমরা বলবো ‘এ দেশে একদা চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন নামে একটা কিছু ছিল’।

কেননা বর্তমানের পণ্যায়িত বাজার ব্যবস্থায় ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর’ সময় এবং ধৈর্য্য কারো থাকার কথা নয়। প্রতিযোগিতার দৌড়ে কার ফুসরত আছে শিল্প আন্দোলন করার? স¤প্রতি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন প্রজন্ম সম্পর্কে বলেছেন এরা টাকা রোজগারের বিষয়েই এদের সমস্ত তারুণ্য ব্যয় করে ফেলছে। তিনি এই প্রজন্মকে নিজস্ব ইতিহাস ও শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। একই সাথে এই অবিরাম দৌড় প্রতিযোগিতার বিপদ সম্পর্কেও সচেতন হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। কিন্তু নিজের খেয়ে বনের মোষ যারা তাড়ায় তাদের কে আর কিছু না পারুন অন্তত এইটুকু নিশ্চয়তা দিন যে বনে ঢুকলেই গুলি করবেন না।

মোষ তাড়াতে গিয়ে গুলি খেয়ে বেঘোরে জীবন হারানোর তাগিদ কারো থাকার কথা নয়। বিশ্বমন্দায় ব্যবসায়ীরা প্রণোদনা চেয়েছেন। ৩০ বছর ধরে কালাকানুনের নিষ্পেষণে থেকে আমরাওতো প্রনোদনা চাইতে পারি সরকারের কাছে। এই কালাকানুনটি বাতিলের প্রতিশ্র“তি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গত ১৪ জানুয়ারী জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ আয়োজিত একাদশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষনে তিনি এ কথা বলেছেন। সদ্য প্রয়াত চলচ্চিত্রকার এবং ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সভাপতি বাদল রহমান চলচ্চিত্র উৎসব উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় কালাকানুনটি বাতিলের দাবি জানালে এবং এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রধানমন্ত্রী এ প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন।

কিন্তু এখনো পর্যন্ত আইনটি বাতিলের অগ্রগতি সম্পর্কে আমরা অন্ধকারেই আছি। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ জানাচ্ছি বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে আইনটি বাতিলের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনই বাংলাদেশে চলচ্চিত্রকে একটি শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই আন্দোলনের থেকে বেরিয়ে এসেছেন অগ্রজ আলমগীর কবীর, বাদল রহমান, সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, মসিহউদ্দিন শাকের, শেখ নেয়ামত আলী, মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, মানজারে হাসিন মুরাদ, তারেক মাসুদ, শামিম আক্তার, আবু সাইয়ীদ, এনামুল করিম নির্ঝরসহ সুস্থ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সকলেই। চলচ্চিত্র আন্দোলন শুধুমাত্র সুস্থ দর্শকেই তৈরী করেনি, এদেশের ‘সুস্থ চলচ্চিত্র’, ‘নির্মল চলচ্চিত্র’ এ সকল ভাবনার জন্ম দেয়ার কাজটিও চলচ্চিত্র আন্দোলন থেকেই হয়েছে।

এই আইনটির নাগপাশ না থাকলে এই দেশে চলচ্চিত্র আরো অনেক অগ্রগতি অর্জন করতে পারত। পৃথিবীর সকল দেশেই কিভাবে এবং কত প্রকারে এ ধরনের সাংস্কৃতিক চর্চাকে সহযোগিতা করা যায় তারই নানারকম পথ খুঁজে বের করে দেশগুলোর সরকার। আর আমাদের দেশে এ ধরনের সাংস্কৃতিক চর্চা, আন্দোলনকে দমিয়ে রাখার ব্যবস্থা প্রনয়নে ব্যস্ত সরকারগুলো। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের সক্রিয় এবং কার্যকর চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন আছে। কিন্তু কোথাও এমন আইনের নজির নেই, ছিল না।

গত ৩০ বছর ধরে অবিরাম প্রতিবাদ জানানোর পরেও এই কালাকানুনটি বহাল তবিয়তেই আছে। সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি এই আইনটি অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। বেলায়াত হোসেন মামুন চলচ্চিত্র সংসদকর্মী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.