আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাতায় পাতায় হাসি

.....

মন্দিরার দু'চোখের পাতা যেন সুপার গ্লু দিয়ে জুড়ে দিয়েছে কেউ, টেনে চোখ খুলতে পারছে না। তবু উঠে গিয়ে মেয়ের রুমের দরজায় টোকা দিল। বললো, --- ওয়েক আপ! ইটস ফোর থার্টি অলরেডি!! রাতে শুতে শুতে প্রায় আড়াইটা বেজেছিল, তার মানে মোটে দু'ঘন্টা ঘুম। ডিনার শেষ করে গেষ্টরা বিদায় হতে হতে একটা বেজে গিয়েছিল। গেষ্ট বলতে ওর আত্নীয়-স্বজন, যারা এখানে আছে ।

কাল সারাদিন কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে ওকে। এতোসব আইটেম নিজের হাতে করা কি চাট্টিখানি কথা! মন্দিরার বাতিক যা কিছু করবে, একেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট পারফেক্ট হওয়া চাই। বিশ পাউন্ডের টার্কি, দু'রকম স্টাফিং, ম্যাশড পটেটো, কর্ন, গ্রিন বিন্স উইথ আলমন্ডস, সুইট পটেটো, ক্যান্ডিড ইয়ামস, ক্রানবেরি সস ইত্যাদি ইত্যাদি ... সব থ্যাংসগিভিং তালিকাভুক্ত খাবার। শুধু ডিসার্ট আর ব্রেড ঘরে বানানো হয়নি । মন্দিরার স্বামী শাহেদ একটা পাই, ডিনার রোল আর কর্ণ-ব্রেড এনেছে কস্টকো থেকে।

মন্দিরা যখন ফ্লাওয়ার আরেঞ্জমেন্টটা উঠাতে গেলো বিস্টল ফার্মে, নিয়ে এলো তিল ধরনের পাই ...পামকিন, পিকন আর আপল । বাটার ফ্লেক ডিনার রোল ও ব্রিস্টল ফার্ম থেকেই এনেছে ... দামটা একটু বেশী পড়লেও পরিবারের সবারই ওটা পছন্দের । মন্দিরা বাংলাদেশের উৎসবের পাশাপাশি এদেশের উৎসবগুলোও বরাবর ই পালন করে এসেছে। এ ব্যাপারে ওর কোনো সংস্কার নেই । ওর ছেলেমেয়ে এদেশে জন্মেছে, এদেশেই বড় হয়েছে ।

ওদের ছোটবেলায় হ্যালোউইনে কস্টিউম পরিয়ে 'ট্রিক-অর-ট্রিটিং'-এ গেছে, থ্যাংসগিভিং-এ টার্কি খেয়েছে, ক্রিস্টমাসে ক্রিসমাস ট্রি সাজিয়েছে । মন্দিরা বিয়ের পর থেকে আমেরিকায় বাস করছে । স্বামীর বিজনেস আর ওর চাকুরীতে ভালো গুছিয়ে নিয়েছে। প্রায় বারো বছর হলো লং বিচের বাড়ীটা কিনেছে । তিনবার ডাকার পর পাখি উঠে ওর রুম থেকে বের হয়ে হলওয়ে ডিঙ্গালে যে বাথরুমটা সেটাতে ঢুকলো ।

মন্দিরা তার নিজের বেডরুমের লাগোয়া বাথরুমে গিয়ে চট করে ফ্রেশ হয়ে নিলো । তারপর ছেলেকে ডাকলো । পল্লব চোখ কচলাতে কচলাতে বললো, __ মাম, আই কুড নট স্লিপ আ উইঙ্ক ! মন্দিরা শুনেও শুনলো না । ভাবলো সপিং-এ যেতে মানা করলেতো আর শুনবে না খামোখা বাক্যব্যয়ে কাজ নেই। মন্দিরার স্বামী শাহেদ কাজপাগল মানুষ ।

ব্যবসাই তার ধ্যানজ্ঞান । তিনি সংসারের বিন্দুবিসর্গও জানেন না বা জানার চেষ্টা করেন না । রাতে ছাড়া তাকে বাড়ীতে দেখা যায় না বললেই চলে । তিনি এখন অথৈ ঘুমে। তার দিকে চেয়ে মন্দিরা বিড়বিড় করলো ---- কুম্ভকর্ণের নিদ্রা।

বিড়বিড় করাটা ওর স্বভাবে সবচেয়ে নতুন সংযোজন । 'টু কার'-গ্যারেজওয়ালা বাড়ি। তাই বাবা-মা'র গাড়ী গ্যারেজের ভেতরে আর বাইরে ড্রাইভ-ওয়েতে থাকে ছেলেমেয়ের গাড়ি। মন্দিরার গাড়ী বের করতে হলে পল্লবের গাড়ি সরাতে হবে আগে । পাখি ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললো, --- গো, গেট ইয়োর কিজ ! পল্লব দুড়দাড় করে দৌড়ে গিয়ে চাবি নিয়ে এসে ওর গাড়ী সরালো ।

মন্দিরার মেয়ে পাখী, আর ছেলে পল্লব। বয়স চব্বিশ আর বিশ। বেশ কয়েকবছর ধরেই তারা ড্রাইভ করে । কিন্তু মা'র সাথে কোথাও যেতে হলে মার গাড়িতেই যাবে ... একেবারে সেই ছোট্টবেলার মতো। মন্দিরা ড্রাইভ করছে ।

দু'জনেই পিছনে বসলো । এবং সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো খুনসুটি । একটা না একটা কিছু নিয়ে দু'জনের মতবিরোধ লেগেই থাকে । আর চলতে থাকে তর্ক । বাইরে এখনও ভালো অন্ধকার।

নভেম্বরের শেষের দিক, তবু এবছর তেমন একটা শীত পড়েনি । তবে কুয়াশা আছে। বীচের কাছে বলে এখানে প্রায়ই কুয়াশা থাকে, বিশেষ করে সকালের দিকে । এভাবে অন্ধকার থাকা সকালে, কুয়াশার বুক চিরে গাড়ি চালানোর মধ্যে কেমন যেন অন্যরকম ভালোলাগা আছে । যানবাহনের অপ্রতুলতা, ভোরের পবিত্রতা মিলে মনে হয় স্বপ্নের মধ্যে অথবা রুপকথার দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা।

বাচ্চাদের কাছে ছোটবেলায় পরম উপভোগ্য হয়েছিল বলেই হয়তো সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আগেভাগেই ওরা মাকে বলে রাখে যেন কাজ থেকে ছুটি নেয়া হয় সেদিন । কারণ ব্ল্যাক ফ্রাইডে অফিসিয়াল হলিডে নয়। এরকম সময়ে বের হওয়া সচরাচর হয় না । শুধু ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে । থ্যাংসগিভিং পালিত হয় নভেম্বর মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার ।

থ্যাংসগিভিং-এর পরের দিন(শুক্রবার) আমেরিকায় 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে' বলে পরিচিত। এ দিনকে আমেরিকানরা বছরের হলিডে শপিং-এর প্রথমদিন বলে বিবেচনা করে। সমস্ত রিটেইলার্সদের জন্য ব্ল্যাক ফ্রাইডে সবচাইতে ব্যাপক সেল ইভেন্ট । আমেরিকানরা এমনিতেই হুজুগে জাতি । কিছু একটা পেলেই হলো, ঝাপিয়ে পড়ে ।

তার ওপর ব্যবসায়ীরা বেশ আগে থেকেই টিভি আর খবরের কাগজে প্রচার করে করে উস্কে দেয় আমেরিকানদের । এমন কি সব খবরের কাগজে যুক্ত হ্য় স্পেশাল এডিশান । ছবিসহকারে দ্রব্যসামগ্রীর দাম দেয়া থাকে, যা'তে জনগণের সুবিধা হ্য় মনস্থির করতে কোন স্টোরে বেশী সেভ করা যাবে। কেউ কেউ 'আর্লি বার্ড' স্পেশাল রাখে আগেভাগে ক্রেতাদের ধরে রাখার জন্য। টিভির খবরে দেখায় কোন কোন ব্যাবসাকেন্দ্রে লোকজন সারারাত লাইনে ছিল, তাদের ইন্টারভিউ ও নেয় ।

মোটকথা ব্ল্যাক ফ্রাইডে এক এলাহী কান্ড । পাখি আর পল কোন স্টোরে আগে যাবে তা নিয়ে কথা বলছে। পল বললো, _ মাম লেটস গো টু বেস্ট বাই ফার্স্ট! মন্দিরা সায় দিল। না দিয়েই বা উপায় কি। ওদের আলোচনা কানে গিয়েছে এবং অবগত হয়েছে বেস্ট বাই-তে দু'জনেরই দরকার রয়েছে ।

পল্লবের দরকার ল্যাপটপ আর পাখির দরকার জিপিএস । তবে একটা ব্যাপারে মন্দিরা একটু টেনশনে আছে । ল্যাপটপের যে দামটা ওরা প্রচার করেছে বিভিন্ন মাধ্যমে তা একটু অবিশ্বাস্য ধরণের । আর এরকম অবিশ্বাস্য সেভিং আইটেমগুলো ওরা ক্রেতাদের সামনে বড়শির টোপ হিসেবে -- সাপ্লাই খুব সীমাবদ্ধ রাখে । তা'তে ওই আইটেমের জন্য আসা লোকজন যখন শপিং-এর মুডে এসে যায়, ওটা না পেলেও খালি হাতে ফিরে যায় না।

বরং সপিং কার্ট বোঝাই করেই বের হয়। বেস্ট বাইয়ের কাছাকাছি পৌঁছাতে দেখা গেলো পিপড়ার মতো সারি সারি মানুষ বেরিয়ে আসছে সপিং কার্ট বোঝাই জিনিষ নিয়ে। যেন হরির লুট পেয়েছে! ভিতরে ঢুকে দেখা গেলো মন্দিরার ধারণাই ঠিক। ওরা সেই বিশেষ ল্যাপটপটি ডিসপ্লেতে পেলো না । ওখানকার একজন সেলসম্যানকে জিজ্ঞেস করলো ।

সে যা বললো তার মর্মার্থ হলো ---- তা'দের হাতে খুব কম সংখ্যক এসেছিলো, চারটায় দরজা খোলার সাথে সাথে আউট অফ স্টক হয়ে গেছে। আবার কয়েকদিনের মধ্যেই ওদের স্টকে থাকবে বলে আশ্বাস দিলো । কোনোকিছুর জন্য অপেক্ষা করা মন্দিরার ছেলের ধাতে নেই । চাওয়ার সাথে সাথে না পেলে একেবারে মুষড়ে পড়ে । _ ড্রপ মি হোম, মাম! পলের কন্ঠে হতাশার সুর।

_ কাম অন, দিস ইজ নট দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড! -- পাখি ভাইকে সান্তনা দিলো। _ আই ডোন্ট নিড ইয়োর এডভাইজ _ ডোন্ট বি সো সেলফিস ডিয়ার, মন্দিরা বললো । _ ইয়া ডোন্ট বি সো সেলফিস, পাখি গলা মেলায় ... _ ওহ বি কোয়ায়েট, পাখি !! মন্দিরা ঝাঁঝিয়ে ওঠে । _ বাট উই হ্যাভ আদার সপিং টু ডু, মাম ক্যান্ট ড্রপ ইউ নাউ। অর উই আর গন্না মিস অল দ্যা সেল আইটেমস --- ঠোকাঠুকি চলছেই ।

ওদের বাদানুবাদ ছাপিয়ে মন্দিরা ডুবে গেলো ভাবনায়। ওর ছোটবেলায় একটা পেন্সিলের জন্য অপেক্ষা করতে হতো মাসের পর মাস, এমনকি বছর । আট ভাইবোনের সংসার থেকে আসা মন্দিরার ছোটোবেলা আর ওর সন্তানদের ছোটবেলা যেন আকাশ-পাতাল । আর একটা ব্যাপারও মন্দিরাকে খুব ভাবায় --- তা হলো, পাখি আর পল্লব ছোটবেলা থেকেই কিছুই ভাগাভাগি করতে চায় না । দু'জনের রুম যেন দু'টি আলাদা পৃথিবী ।

কেউ কারো জিনিষে হাত দিতে পারবে না । আর বিয়ের আগে পর্যন্ত মন্দিরার নিজের কোন রুম তো দূরের কথা, বিছানা বা পড়ার টেবিলও ছিল না । তা নিয়ে কোনো দুঃখ ও ছিল না কোনোদিন । সবসময় দু'/তিন ভাইবোনকে এক বিছানায় ঘুমুতে হয়েছে। চার আনার বাদাম কদাচিৎ কিনতে পেলেও সবাইকে ভাগ দেয়ার পর নিজের ভাগে তিন চারটের বেশী পড়তো না কখনো।

এমনকি মন্দিরার মা যখন ডিম ভুনা করতেন তা'ও ভেংঙে অর্ধেকটা করে ভাইবোনদের দেয়া হতো । তখন ও স্বপ্ন দেখতো বড় হয়ে একদিন গোটা ডিম খাবার। এরপর আরও তিন/চারটি স্টোরে থামতে হলো পাখির লিস্ট করা সব জিনিষের জন্য । এ বছর ওর লিষ্টটা একটু বেশী লম্বা । কারণ এমাসেই সে নিজের এপার্টমেন্ট নিয়েছে বেষ্ট ফ্রেন্ড ক্রিষ্টিনার সাথে ।

পাখি জর্নালিজমে ব্যাচেলরস করে লস এঞ্জেলেসে একটা অফিসে কাজ করছে বছরখানেক ধরে । এতোদিন লং বিচ থেকে ড্রাইভ করেই যাচ্ছিলো । তবে ফ্রি ওয়েতে অফিস আওয়ারের ট্রাফিক পোহাতে গিয়ে প্রায়ই সে মাথাব্যথার শিকার হচ্ছিলো । তারপর কিছুদিন আগে ভয়ঙ্কর এক একসিডেন্টে ওর ব্রান্ড নিউ গাড়িটা একেবারে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিলো । ওর লস এঞ্জেলেসে মুভ করার সবচেয়ে বড় কারণ হলো নেক্সট ফল-এ ও মাস্টার্স করার প্ল্যান করেছে।

ওর অফিসটাও লস এঞ্জেলেসের দু'টো ইউনিভার্সিটি থেকে কাছে। এপার্টমেন্টও সেখানে নিয়েছে। মল-এ থেমে 'মেইসি' থেকে এটা-ওটা কিনলো । 'বেড বাথ এন্ড বিয়ন্ড' থেকে পাখির এপার্টমেন্টের অনেক জিনিষ কেনা হলো । টার্গেট ও বাদ গেলো না ।

ওখানে তিল-পরিমাণ জায়গা ছিল না এমন ভিড়। মন্দিরা বিড়বিড় করেছে _ গস, ইট'স আ টোটাল ম্যাড হাউস !! তারপর সার্কিট সিটি থেকে পল্লব দ'টো ভিডিও গেম কিনলো । পাখিই কিনে দিলো বোধ হয় । সে ই পে করলো । এবারে পল ঘোষণা দিলো _ আই হ্যাভ আ হেডেক, মাম __ উই আর অলমোস্ট ডান, দিস ইজ দ্যা লাষ্ট ওয়ান, আই প্রমিজ ছিয়ার্স-র গিয়ে দেখা গেলো জুতো খুব ভালো সেলে দিয়েছে ।

মা-মেয়ে মিলে তিনজোড়া বুট কিনে ফেললো । তারপর এস্কেলেটরে একেবারে থার্ড ফ্লোরে উঠে গেলো। ওখানেই রয়েছে হোম এপ্লায়েন্স এন্ড ফিটনেস । ইলেপটিকাল ট্রেনারটা খুব ভালো দামে দিচ্ছে। ওটা লিষ্টে না থাকলেও কিনে ফেললো পাখি ।

মাকে খুশী করতে বললো --- আই উইল লিভ দ্য ট্রেডমিল ফর ইউ মাম _ ওহ লাকি মি! মন্দিরা বিষন্নতা আর কৌতুক মেশানো হাসি মুখে বললো । এবার বাড়ি ফেরার পালা । কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল । ইলেপ্টিকাল মেশিন ডেলিভারি নিতে ফিফটি ডলারস এক্সট্রা লাগবে বলছে । অনেকসময় ফ্রি ডেলিভারি থাকে।

পাখি ডেলিভারি না নিয়ে ফিফটি ডলারস বাচাতে চাইছে । সে বললো _ মাম, পল ক্যান গো উইথ মি নাউ সো উই ক্যান আসেম্বল ইট _ আ'ম নট গোইং এনিওয়্যার নাউ । পল্লবের কন্ঠে অনমনীয়তা । আবার কিছুক্ষণ ঠোকাঠুকি চললো । _ গো টুমরো প্লিজ! নট ওনলি পল, নান অব আস হ্যাড এনাফ স্লিপ লাষ্টনাইট।

বিসাইডস হি হ্যাজ আ হেডেক ... মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করলো মন্দিরা । _আই ডোন্ট থিংক হি হ্যাজ আ হেডেক, দ্যাটস বিকজ হি ডিডন্ট গেট দ্য ল্যাপটপ _ আয়াম নট লাইক ইউ পাখি, আই ক্যান গো টুমরো _ ইফ ইউ আর নট ফিলিং টু ব্যাড, গো হেল্প ইয়োর সিস্টার, এবার পল্লবের উদ্যেশে বললো মন্দিরা। ওর কথায় কেউ কর্ণপাত করলো না। যার যার সিদ্ধান্তে অটল একেবারে । বাড়ির দিকে ড্রাইভ করতে করতে মন্দিরা লক্ষ্য করলো, এখনও সূর্য দেখা যাচ্ছে না ।

অথচ বেলা প্রায় এগারটা । পাখি ওদের বলেছে ইলেপটিক্যাল পিক-আপ করবে তিনটেয় । মন্দিরা বলেছে আজ পিক আপ করে লং বীচে রাখতে, কাল দু'ভাইবোনে গিয়ে এসেম্বল করলেই হবে। পাখির কথা হলো -- অত ভারি মেশিনটা কেনো একবার টানাটানি করে লং বীচের বাড়িতে ওঠাবে আবার এল এ নেবে, একবারে ওখানে নিয়ে গিয়ে এসেম্বল করে ফেলাই উচিত হবে । ওর আইডিয়া একেবারে অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দিচ্ছে না মন্দিরা ।

কিন্তু জীবনে কি সবকিছুই সবসময় নিজের ইচ্ছেমতো বা সুবিধেমতো হয় ! বাড়ি পৌঁছে সবাই মিলে শপিং ব্যাগগুলো নামালো । পরিবেশ থমথমে । সবার মুখ গোমড়া । পল্লব ভিডিও গেমের ব্যাগটা ধরতে যাচ্ছিলো, পাখি ধমকে উঠলো _ ডোন্ট এভেন থিংক!! ইউ আর সো সেলফিস! ইউ আর নট গেটিং ইট! পল্লবের হাত থেকে ব্যাগটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেলো নিজের রুমে। পল্লব চেয়ারে বসে জুতা-মোজা খুললো ।

তারপর রুমে গিয়ে বিছানায় ছুড়ে মারলো নিজেকে। এভাবে ছেলেমেয়ে যখন মনক্ষুণ্ণ হয়ে যার যার রুমে গিয়ে ঢোকে, মন্দিরার পৃথিবী তখন লন্ডভন্ড মনে হয়। মনে হয় কিছু একটা অমুল্য রত্ন হারিয়ে ফেলেছে । নিমেষে শরীরটাও যেন হারিয়ে ফেললো সব শক্তি। গতরাত্রির অনিদ্রা শোধ তুলে নিচ্ছে বোধ হয় ।

লিভিং রুমের সোফায় বসে পড়ে ও । ওর যেন সব ভুমিকা ফুরিয়ে গেছে । সামনে নেমে এসেছে যবনিকা । কিছুক্ষণ পরে পাখি ঝড়ের বেগে এসে বললো _ আ'ম লিভিং টুডে মাম _ হোয়াট ডু ইউ মিন? মন্দিরা জানতে চায় । _ আ'ম গোয়িং টু পিক আপ ক্রিষ্টিনা ফ্রম আরভাইন নাউ, দেন উই'ল পিক আপ দ্য ইলেপটিকাল, গো টু এল,এ এন্ড এসেম্বল ইট ।

ক্রিষ্টিনা সেড সি ইজ গন্না হেল্প মি ... বোঝা গেলো পাখি ক্রিষ্টিনার সাথে ফোনে আলাপ করেছে । ক্রিষ্টিনা মেয়েটি পাখির একেবারে ছোটবেলার বন্ধু । একসাথে একেবারে ফার্স্ট গ্রেড থেকে একই স্কুলে পড়েছে, কয়েক জেনারেশন ধরে লং বীচের স্থায়ি বাসিন্দা । ওর ফ্যামিলির সাথে মন্দিরা আর শাহেদের ও বন্ধুত্ব আছে। থ্যাংসগিভিং-এ ফ্যামিলির সবাই একত্র হবার ট্রাডিশন ।

ক্রিষ্টিনা ফ্যামিলির সাথে আরভাইন গিয়েছে বলে তার গাড়ি নেই সাথে । তাই পাখি গিয়ে ওকে আনতে হবে। মন্দিরার ভালো ঠেকলো না ব্যাপারটা । এখন এতদুর ড্রাইভ করে যাবে, আবার আসবে লং বিচে, তারপর যাবে এল,এ । সারাদিন তো ওর ড্রাইভিং-এ ই থাকতে হবে।

আজ শুক্রবার। শনি রবিতো উইক এন্ড । থ্যাংক্সগিভিং ডে নিয়ে চারদিনের ছুটি কাটাতে এসেছিলো পাখি । কিন্তু ভাইয়ের ওপর রাগ করে চলে যাচ্ছে। মন্দিরার ভিতরে ছটফট করলেও মুখে কিছুই বললো না ।

শুধু ভাবছে । ও কখনো ছেলেমেয়েকে সীমাহীন প্রশ্রয় বা আহ্লাদ দিয়ে মাথায় উঠায় নি । যদিও ওদেরকে বাংলা বলানোর চেষ্টায় অকারণ তামাশা করতে পছন্দ করে না সে । ওরা জন্মসূত্রে আমেরিকান আর পারিবারিক সূত্রে বাংলাদেশী । বাংলা ভালো বলতে পারে না, কাজ চালানোর মতো বুজতে পারে কেউ বললে ।

কিন্তু মানুষের মধ্যে যে সব ভালো গুন থাকা দরকার সেগুলো ওদের মধ্যে দেখতে চেয়েছে । ওরা মোটেই খারাপ ছেলেপেলে নয় । ওদের আছে সারল্য, সততা । নেই হিংসা, দ্বেষ, লোভ । আবার তুচ্ছ কারণে ক্ষেপে যাওয়া ও আছে।

পাখি তার সাথে করে নিয়ে আসা সবকিছু প্লাস শপিং করে আনা পুরো এক সংসারের জিনিষ কিছু কিছু করে ওর গাড়িতে উঠাচ্ছে । একবার ঘরে ঢুকছে আবার কিছু নিয়ে বাইরে গাড়ীতে রেখে আসছে । লন্ড্রি-বাস্কেটটা এনে সোফার চেয়ারে রেখে, বাইরে গেলো দু'হাতে অনেককিছু নিয়ে । লন্ড্রি-বাস্কেট বোঝাই করে কাপড়-চোপড় নিয়ে এসেছিলো, লন্ড্রি করা হয়নি, ওভাবেই নিয়ে যাচ্ছে। একটু পরে পল্লব এসে ঢুকলো লিভিং রুমে ।

এদিক ওদিক তাকালো । মাকে জিজ্ঞেস করলো, ---হোয়ারস পাখি? _ শী ইজ লিভিং, ইন হার কার ... আই গেস -- মন্দিরা নির্লিপ্ত উত্তর দিল । একেবারে ম্রিয়মাণ হয়ে বসে আছে সে। এভাবে বিশাল শক্তির কাছে আত্মসমর্পন করতে হয় ওকে কখনো কখনো । মনে মনে প্রার্থণার মতা করে চাইছে কিছু একটা ।

হঠাৎ দেখলো ছেলেটা লন্ড্রি-বাস্কেট উঠিয়ে নিয়ে কিচেনের ব্যাক ডোর খুলে বাইরে গেল । মুখে দুষ্টুমি হাসি । পাখি ভিতরে ঢুকে চেয়ারে বাস্কেট না দেখে রীতিমতন চটে উঠে, _ হোয়ারস মাই বাস্কেট !!! ভিতরে গিয়ে, ফিরে এসে বললো, _ হোয়ারস পল? হি টুক মাই বাস্কেট ... কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর সে নিজেই ভাইকে আবিস্কার করলো । বোন ছুটি শেষ হওয়ার আগে রাগ করে চলে যাচ্ছে বলে, পল হার মেনেছে, মাথাব্যথা নিয়েও যাচ্ছে বোনকে হেল্প করতে । লন্ড্রি-বাস্কেট নিয়ে ব্যাক পোর্চে লুকিয়ে রেখে, সে ব্যাক-ইয়ার্ড ঘুরে সাইডের গেট দিয়ে গিয়ে বোনের গাড়ীতে উঠে বসে আছে, পাছে পাখি ওকে রেখে চলে যায় ।

মন্দিরা যেন পরশপাথর খুঁজে পেয়েছে। ভালবাসার পরশপাথর, যার পরশে জ়ীবন হয়ে ওঠে সোনার মতো উজ্জ্বল। ওদের সব খুনসুটির আড়ালে ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল । মন্দিরা উৎকর্ণ হয়ে ছিল, এবার দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালো । ... ওর সন্তানেরা মজা করে হাসছে! দৃশ্যটা যেন সত্যি নয়, অলৌকিক।

ওর সারামুখে যেন মধুর আলো ছড়িয়ে গেলো । অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল মনটা । হঠাৎ খেয়াল করলো, নভেম্বরের কুয়াশা চিরে রোদের ঝিলিক পাতায় পাতায় । মন্দিরা বিড়বিড় করলো, _ বিউটিফুল ডে !!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.