আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের ঐতিহ্য ও সাহিত্যচিন্তা



'সাহিত্যচিন্তা' একটি বইয়ের নাম হিসেবে শুনতে মামুলি অর্থাৎ সাহিত্য বিষয়ক চিন্তাধারা নিয়ে একটি সাধারণ আলোচনার সংকলন মনে হতে পারে। প্রকৃত বিচারে বইটি শুধু তাই নয় বরং অধিক কিছু। এর বিষয় বিন্যাস দেখেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায়। বইটি মুহম্মদ মতিউর রহমানের প্রবন্ধ সংকলন। ভূমিকায় লেখক জানিয়ে দিয়েছেন ‘এ গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধ ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে লেখা হয়েছে।

' বইয়ের দশটি প্রবন্ধের সূচিক্রম এরকম- সাহিত্যচিন্তা, সাহিত্যে সুনীতি, রোমান্টিকতার স্বরূপ, ইসলামী সাহিত্যের রূপ ও সংজ্ঞা, সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় মহানবী (সা.), আমাদের ভাষাচিন্তা, আমাদের ভাষার স্বাতন্ত্র্য, আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের পরিচয় সন্ধানে, আমাদের সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র্য, বাংলা কবিতার ঐতিহ্যিক প্রেক্ষাপট। এগুলো থেকে 'সাহিত্যচিন্তা' ও 'রোমান্টিকতার স্বরূপ' প্রবন্ধ দুটি বাদ দিলে বাদবাকী সব ক'টি প্রবন্ধে বাংলাসাহিত্যের চলমান প্রেক্ষাপটে মুসলিম সাহিত্যসেবীদের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বসহ আলোচনার অবতারণা করেছেন লেখক। অর্ধ-শতাব্দীকাল তিনি নানাভাবে বাংলাসাহিত্যের খেদমত করে যাচ্ছেন লেখক, সংগঠক ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। এই সত্তাগুলো সবসময় তার মধ্যে ক্রিয়াশীল। এগুলোর মধ্যে তার লেখক সত্তাটিই আসল, বাকিগুলো পরিপূরক মাত্র।

টুকটাক কবিতা ও ছোটগল্প লিখলেও তার লেখকসত্তা বিকশিত হয়েছে মননশীলতা ও গবেষণায়। একজন মুসলিম হিসেবে মুসলিমমনের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করেছে তার মননচর্চা। তারই নজির আমরা দেখতে পাই উক্ত বইয়ের আলোচ্যসূচিতে। প্রবন্ধগুলো পাঠ করে আবিষ্কার করা যাবে একজন গভীর প্রত্যয়ী সাহিত্যসেবীকে যিনি আত্মপরিচয় বিসর্জন দিয়ে সুখ পাওয়া যুগে আত্মপরিচয়কে যথাযোগ্য মর্যাদা ও দৃঢ়তর প্রত্যয়ের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। যে চারটি প্রবন্ধের শিরোনাম তিনি 'আমাদের' শব্দ দিয়ে শুরু করেছেন সেই প্রবন্ধগুলোর 'আমরা' কোন পরিচয় বহন করে? 'আমরা' আসলে কারা? প্রকৃতপক্ষে লেখক 'আমরা' বলে তার মুসলিমমনের উত্তরাধিকারই বুঝিয়েছেন।

তার দীর্ঘদিনের প্রত্যয়যুক্ত মনন বইয়ের প্রবন্ধগুলোকে যথাযথ পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে। দুই. দেশের তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে বিরাজ করছে সংশয়। একদল, যারা চলমান স্রোতে গা ভাসিয়ে কাব্য-সাহিত্যের সাধনা করছে তারা প্রকৃতপক্ষে ঔপনিবেশিক মননের উত্তরাধিকার বহন করছে, অন্যদল, যারা ঐতিহ্যের কথা বলছে প্রকৃতপক্ষে তাদের সামনে তাদের ঐতিহ্যের স্বরূপ স্পষ্ট নয়। প্রথম দল অনেক সময় ঐতিহ্যের কথা বলে ঠিকই তবে তাদের ঐতিহ্যচিন্তাও ঔপনিবেশিক। ফলে তারা এ দেশে হাজার বছরের লালিত মুসলিম মনকে সাম্প্রদায়িক মন বলে বিচার করে অপরপক্ষে হিন্দুধর্মের সাথে সম্পর্ক ও সাযুজ্যপূর্ব অন্যান্য লোকঐতিহ্যকে ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচনা করে।

এতে করে তারা মুসলিম মনের উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করে বসে, যদিও তাদের অধিকাংশ মুসলিম পরিবারের সন্তান। দ্বিতীয় দলের নিকট তাদের ঐতিহ্যের স্বরূপ এ কারণেই স্পষ্ট নয় যে, বিষয়টি তাদের নিকট স্পষ্ট করে তোলার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উপকরণের সংকট বিদ্যমান। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজনীয় গবেষণা, অনুসন্ধান, প্রকাশনা, প্রচার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব যেমন প্রকট তেমনি অভাব আগ্রহ, উদ্যম ও পরিশ্রমেরও। বাঙালি মুসলিম পুনর্জাগরণের শুরু থেকে গত শতকের চল্লিশ দশক পর্যন্ত মুসলিম মানসে এ সমস্যা বলতে গেলে ছিলই না। চল্লিশ দশকে এই বিভাজনের সূত্রপাত ঘটে এবং পঞ্চাশ ও ষাটে বিভাজনটি স্পষ্ট হয়।

মুসলিম সমাজের একটি অংশ ক্রমশ তাদের ঐতিহ্যকে স্বীকার করতে অনীহা প্রকাশ করতে থাকে। সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা নিরেট বোধহীন ভোগবাদী চিন্তা-চেতনা এই বিভাজনের মূলে কাজ করে। মুহম্মদ মতিউর রহমান ষাটের দশকের সাহিত্যসেবী হিসেবে তার নিকট এই বিভাজনের চিত্রটি স্পষ্ট। তিনি ঐতিহ্যবাদী, তার মননচর্চায় নিহিত মুসলিমমন। ফলে তিনি তার নিজস্ব ধারাটির অন্তরাত্মাই এই বইয়ের সেই আটটি প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন।

তিন মুহম্মদ মতিউর রহমানের গদ্য বিশিষ্ট কোন সৃজনশীলতার স্বাক্ষর না রাখলেও সে গদ্য প্রবহমান, পরিমিত, তার বিশ্লেষণ গভীর, তার যুক্তি স্বচ্ছ এবং তার বক্তব্য বলিষ্ঠ। তাছাড়া ‘সাহিত্যচিন্তা' বইটি তার দীর্ঘ সাধারণ পরিণত মানসের পরিশীলিত বয়ান। বিভিন্ন প্রসঙ্গে যথাযথ সূত্রসহ কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ প্রয়োজনীয় দলিলপত্রও তিনি এ গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী নিয়ে এরকম তথ্যবহুল বস্তুনিষ্ঠ বইয়ের অভাব থাকার ফলে বইটি মুসলিমমনের উত্তরাধিকারিত্ব বহনকারী তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের নিকট সর্বাধিক গুরুত্ববহ বিবেচিত হবে বলে আশা করি এবং সাধারণভাবে তরুণ-অতরুণ সকলের জন্য বইটি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশ্বাস করি। সাহিত্যচিন্তা- লেখক মুহম্মদ মতিউর রহমান।

প্রকাশক-বাংলা সাহিত্য পরিষদ, ঢাকা। প্রবন্ধ : এস এম হাসান। প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর ২০০৯। পৃষ্ঠা : ১২৮। মূল্য : ১৫০ টাকা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।