আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

র‌্যাবের কলঙ্ক ক্রসফায়ার

অতি সাধারণ....প্রধানমন্ত্রী হলে দেশটারে সাজাইতাম

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় গেলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে। কিন্তু ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা চলছেই। চলতি বছরের ১১ মাসে শুধু র‌্যাবের হেফাজতে নিহত হয়েছে ৬৯ জন। ছয় বছরে এই সংখ্যা ৬৯৩। একই সময় পুলিশের হেফাজতে মৃতের সংখ্যা প্রায় এক হাজার।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রমতে, ক্রসফায়ারের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের এ পদ্ধতিতে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সম্মতি আছে। দেশে-বিদেশে ক্রসফায়ারের সমালোচনা অনেক দিন ধরেই চলছে। সর্বশেষ ভিন্নধারার সংবাদমাধ্যম উইকিলিকস ক্রসফায়ার সম্পর্কে কিছু তথ্য ফাঁস করে, যার ভিত্তিতে মঙ্গলবার প্রভাবশালী ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই তথ্যে বলা হয়, সন্ত্রাস দমনে গঠিত র‌্যাবের সদস্যরা ব্রিটিশ সরকারের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শুধু র‌্যাবকে মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

কারণ তারা মনে করে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে র‌্যাব মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। একটি বার্তায় বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি র‌্যাব সম্পর্কে বলেন, এখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মধ্যে র‌্যাবেরই কোনো একদিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার (এফবিআই) মতো সংস্থা হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মানবাধিকারকর্মীদের মতে, র‌্যাবের পক্ষে অনেক ভালো কাজ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু সমালোচনা সত্ত্বেও তারা একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েই যাচ্ছে। ফলে ক্রসফায়ার হয়ে উঠেছে র‌্যাবের কলঙ্ক।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বলেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। যদি কেউ অপরাধমূলক কাজ করে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার জন্য বলে আসছি। কোনো সভ্য জগতে, সভ্য আইনব্যবস্থায় এ রকম চলতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র ও সংবিধানকাঠামোতেও এটা গ্রহণযোগ্য নয়।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, ক্রসফায়ারজনিত মৃত্যু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হলেও সরকারের তদন্তে এসব ঘটনাকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে যত ঘটনার তদন্ত হয়েছে, সব ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে, কোনো আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়নি। জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলম প্রথম আলোকে বলেন, আমরা সব সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে। সরকারও এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কেউ সমর্থন করে না।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, র‌্যাব বা পুলিশ বিচারবহির্ভূত কোনো কাজ করতে পারে না। তারা যা করছে, সবই আইনের মধ্যেই করছে, আইনের বাইরে কোনো কিছু ঘটছে না। যেমন পুলিশ কারও ওপর ইচ্ছে করে গুলি ছুড়ছে না। আবার গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে থাকলে বিধি অনুযায়ী তদন্ত হচ্ছে। সর্বশেষ ১৯ ডিসেম্বর রাতে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ঢাকার হাজারীবাগের আলম ওরফে টাক্কু আলম (৩০) ও টাঙ্গাইলের গোপালপুরের মামুনুর রহমান (২৫)।

আলম সন্ত্রাসী ও মামুনকে অস্ত্র ব্যবসায়ী বলে র‌্যাব দাবি করেছে। এর আগে ১৩ ডিসেম্বর রাজধানীর ভাষানটেক এলাকায় র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শহীদ ওরফে জামাই শহীদ (২৬) নামের এক সন্ত্রাসী নিহত হন। শহীদ সাভার এলাকায় তৈরি পোশাক কারখানায় পণ্য সরবরাহ করতেন। ৩ ডিসেম্বর রাজধানীর মালিবাগে নিহত হন হোন্ডা বাবু। র‌্যাবের যাত্রা: বিশেষ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য নিয়ে ২০০৪ সালের ২১ মার্চ পুলিশের অভিজাত বাহিনী হিসেবে পরিচিত র‌্যাব আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।

তবে ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা শুরু হয় ২৬ জুন থেকে। ওই সময় র‌্যাবের দেখাদেখি পুলিশও ক্রসফায়ারে নেমে পড়ে। র‌্যাবের আইন ও জনসংযোগ শাখার পরিচালক এম সোহায়েল জানান, র‌্যাব গঠনের পর ছয় বছরে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৬৯৩ জন। এ বছরের ১১ মাসে মৃতের সংখ্যা ৬৯। র‌্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযানে নিহত হন ৮১ জন।

তাঁর মতে, ছয় বছরে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে র‌্যাবের ১৬ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন হটলাইন বাংলাদেশের সমন্বয়ক রোজলিন কস্তা জানান, ক্রসফায়ার শুরুর পর ২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত এক হাজার ৯০০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ৮১১ জন নিহত হন। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ক্রসফায়ারে নিহত হন ৫৪৭ জন। অন্যরা বর্তমান সরকারের আমলে মারা যান।

তিনি জানান, র‌্যাবের হাতে ৭২২ ও পুলিশের হাতে প্রায় এক হাজার ২০০ লোক নিহত হন। উদ্বেগ: মানবাধিকার সংগঠনগুলো বরাবরই ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যা বন্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছে। ক্রসফায়ারে মৃত্যু নিয়ে চারদলীয় জোট সরকারকেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থার চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল। বর্তমান আমলেও এ নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু উইকিলিকসের ফাঁস করা মার্কিন দূতাবাসের কেব্ল থেকে দেখা যায়, দূতাবাসের মার্কিন কর্মকর্তারা র‌্যাব রাখা উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি ঢাকায় তৎকালীন ভারতের হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর সঙ্গে আলোচনায় বিষয়টি উত্থাপন করেন। তখন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সমর্থন করেন ভারতীয় হাইকমিশনার। জানা গেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ক্রসফায়ারে মৃত্যু বেশ কয়েক মাস বন্ধ ছিল। সরকারের ভেতরের একটি মহল এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও এসব মৃত্যু বন্ধ করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।

কিন্তু সরকারের ক্ষমতা নেওয়ার পর রাজনৈতিক মদদ পেয়ে অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। ওই সময় সরকারের নীতিনির্ধারকেরা ক্রসফায়ারের ব্যাপারে নমনীয় মনোভাব দেখাতে শুরু করেন। এর পরই শুরু হয় ক্রসফায়ার। কৌশল পরিবর্তন: র‌্যাব গঠনের পর দেখা গেছে, ক্রসফায়ারের প্রতিটি ঘটনার পর র‌্যাবের পক্ষ থেকে ঘটনার যে বিবরণ দেওয়া হতো, তা ছিল প্রায় একই। শুধু নাম-ঠিকানা বদল করা হতো।

এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ওঠায় কৌশল পাল্টে যায়। ক্রসফায়ারের বদলে বলা হয় এনকাউন্টার ও বন্দুকযুদ্ধ। অভিযোগ আছে, কৌশল পাল্টানোর পর অনেককে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আর খোঁজ মেলে না। এ তালিকায় আলোচিত দুজন হলেন কাউন্সিলর চৌধুরী আলম ও লিয়াকত হোসেন। পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, তাঁরা র‌্যাবের গুপ্তহত্যার শিকার।

এক বছর আগে পুলিশ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসপিরা গুপ্তহত্যার অভিযোগ তুলে তা বন্ধ করার দাবি জানান। তবে র‌্যাবের কর্মকর্তারা তা কখনো স্বীকার করেননি। নিরীহ মানুষও শিকার: ক্রসফায়ারের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের সব সময় সন্ত্রাসী বলা হলেও অনেক নিরীহ মানুষও এর শিকার হয়েছেন। রামপুরার কায়সার মাহমুদ বাপ্পী, খিলগাঁওয়ের সুমনের মতো অনেক ঘটনার তদন্তে নেমেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক এম সোহায়েল প্রথম আলোকে বলেন, র‌্যাবের বিরুদ্ধে অযথাই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা হচ্ছে।

কিন্তু ক্রসফায়ারের প্রতিটি ঘটনার তদন্ত ও বিচার হচ্ছে। তিনি বলেন, মানবাধিকারের ব্যাপারে র‌্যাবকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তারা র‌্যাবের কার্যক্রম নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, সন্ত্রাসী যখন র‌্যাবের ওপর হামলা চালায়, তখনই র‌্যাব পাল্টা গুলি চালায়। এটাকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলা যায় না।

র‌্যাব বিচাবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে না। বিশিষ্ট আইনবিদ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহ্দীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্র যখন বেআইনি পথ ধরে, তখন ধরে নেওয়া হয় এটা ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এসব কাজকে ভালো মনে করা হলেও যেসব দেশ এসব করেছে, পরে তাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। এটা বন্ধ করা না হলে বাংলাদেশকেও এভাবে মূল্য দিতে হবে। যোগাযোগ করা হলে সাবেক আইজিপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এএসএম শাহজাহান বলেন, ক্রসফায়ারের মতো ব্যবস্থা কোনো সুরাহা দেবে না।

এটা কোনো সমাধানই না। এটা অবশ্যই হত্যা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এসবে উৎসাহিত করা উচিত নয়। তাঁর মতে, প্রতিটি ক্রসফায়ারের যথাযথ তদন্ত হওয়া উচিত। সূত্রঃ সোনার বাংলা ডট কম


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.