জীবন একটাই; জীবনের জয় অনিবার্য..
ব্যক্তিগতভাবে আমি ছবির সমালোচক হওয়ার মতো যতেষ্ট যোগ্যতাহীন, একজন সাধারণ সারির দর্শক, নিচুতলার কর্মী মাত্র। ছবির সমঝদার ভাবতে আরো বেশি সংকোচ লাগে। কিন্তু তারেক মাসুদ চট্টগ্রামে আসছেন, একটি সুন্দর কর্মসূচি নিয়েছে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র (সিএফসি)। আর আমি যখন পত্রিকায় কাজ করি, তখন ছবিগুলোর ব্যাপারে দুই কলম না লিখে বিবেকের আদালতে অপরাধী হবো কেন? সে আশাতেই এত কথা। পত্রিকার জন্য লেখা বড় গা জ্বলা করা! শব্দবাজেটের মধ্যে মনখুলে, হাতখুলে লেখার ফুরসৎ নাই- এগুলোও তেমনিই।
ভবিষ্যতে ঘরে বসে কখনো ছবিগুলো দেখার সুযোগ হলে তখন চেষ্টা থাকবে আরো নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখার এবং ছবিদুটো নিয়ে আলাপ তোলার। আপাতত এই পোস্টে রানওয়ে ছবি নিয়ে আলাপ করলাম। ধন্যবাদ!
_______________________________________
চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র আয়োজিত প্রদর্শনী:
''আমার ছবি ‘রানওয়ে’র টেক-অফ হচ্ছে বীর চট্টগ্রাম থেকে। চলচ্চিত্র এই সময়ের দর্শন। বর্তমান অস্থিরতা এই চলচ্চিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে।
ছবিতে অনেকগুলো গল্প। কোনটাই শেষ হয় না। দর্শকদের দায়িত্ব তা শেষ করার। এই গল্প আমি বুনেছি বাংলার বুকে জংগিবাদ নামক একটা ভয়ংকর রোগ বিস্তারের প্লট মাথায় রেখে। রাজধানীর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে সংলগ্ন উত্তরায় একচালা ঘর এখানে বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
''
গতকাল বিজয় দিবসের বিকেল বেলায় চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘রানওয়ে’ চলচ্চিত্রের শুভমুক্তি আর 'নরসুন্দর'র প্রদশনী উপলক্ষে এমন মন্তব্যই করেন তারেক মাসুদ। প্রদর্শনী শুরু হয় ১৬ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় টি আই সি মিলনায়তনে। চলবে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত। উদ্ভোধনীতে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও চলচ্চিত্র সমালোচক ঢালী আল মামুন ও চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের পরিচালক শৈবাল চৌধুরী। তারা বক্তব্যও রাখেন।
প্রতিদিন সকাল ১১ টা, বিকেল ৩টা, ৫টা ও সন্ধ্যা ৭টায় প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। বর্তমান অস্থির/দুর্মূল্যের বাজারে প্রদর্শনী মাশুল রাখা হয়েছে ৩০ টাকা (মাত্র)।
'রানওয়ে' যে গল্পের শেষ নেই:
কাহিনিচিত্রটির পটভূমি ২০০৫-০৬ সালে সংঘটিত বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তজার্তিক ইস্যু। ছবিটির কাজ তিনি শুরু করেন ২০০৮ সালের অক্টোবরে, শেষ হয় ২০০৯ সালের এপ্রিলে। ছবির বেশির ভাগ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন নতুন শিল্পী।
অভিনয় করেছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, নাজমুল হুদা বাচ্চু, মোসলেম উদ্দিন, নাসরিন আক্তার ও রিকিতা নন্দিনী। অতিথি শিল্পী হিসেবে দর্শক বোনাস পেয়েছেন হাল আমলের টিভি নাটকের অভিনেত্রী তিশাকে! ক্যাথরিন মাসুদের সঙ্গে যৌথভাবে লেখা চিত্রনাট্যের গল্প ও সংলাপ লিখেছেন তারেক মাসুদ। ছবিটির চিত্রায়নে ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর সন্তান মিশুক মুনীর। প্রযোজনায় ক্যাথরিন মাসুদ। আর তারেক-ক্যাথরিন মাসুদের সংগীত পরিচালনায় মূল আবহ সুর করেছেন সজীব।
গল্পের শুরুতেই আমরা শুনি অর্ন্তভেদী এক সুতীব্র চিৎকার। ঘর কেঁপে উঠে। বেড়ার একচালা ঘর। মাথার উপর উড়োজাহাজ গেল। ঢাকার উত্তরায় এমন দুর্দান্ত লোকেশন আবিষ্কার করেছেন তারেক; তিনি সত্যিই ধন্যবাদার্হ্য।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে রুহুলের বুড়ো দাদু। বিমানের প্রচণ্ড শব্দে। এরপর কাহিনী আমাদের নিয়ে যায় সমস্যা সংকুল এক জনপদে।
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে সংলগ্ন একচালা ঘরে সেই রুহুল ও তার পরিবারের বাস। মা রহিমা ক্ষুদ্রঋণের টাকায় কেনা গাভীর দুধ বিক্রি করে সংসার চালায়।
রুহুলের বোন ফাতেমা গার্মেন্টেসে চাকুরী করে। মধ্যপ্রাচ্যে চাকুরী করতে গিয়ে বাবা একমাস ধরে নিরুদ্দেশ। বেকার, কিছুটা হতাশ অথচ আদর্শবাদী রুহুল চাকরী খোঁজার বৃথা চেষ্টা করে উড়জাহাজের ছায়ায় দিন কাটায়। মাঝে মধ্যে সে মামাকে সাইবার ক্যাফেতে সাহায্য করে এবং ইন্টারনেট শেখার চেষ্টা করে। সেখানে দৃঢ় অথচ শান্ত মেজাজের কম্পিউটারে দক্ষ আরিফের সাথে তার ক্রমশঃ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।
আরিফ উগ্র ধর্মীয় রাজনীতির মধ্যে জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে রুহুলকে উদ্বুদ্ধ করে। নতুন আদর্শে উজ্জীবিত রুহুল বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অবশেষে জীবনের গভীরতর অভিজ্ঞতা উপলব্দির দিকে এগিয়ে যায়।
ইরাক যুদ্ধে রুহুলের বাবা নিজের আশা নিয়ে অসহায় দিন যাপন করতে থাকে। পোশাক কারখানায় বোন শোষণের শিকার। মাদ্রাসা শিক্ষায় ছেদ ঘটিয়ে তরুণ রুহুল ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতীক সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ইন্টারনেট ব্রাউজিং শেখে।
সাইবার ক্যাফেটি মামার দোকান। রুহুল তখনো জানতো না তার পাশে বসে ইন্টারনেটের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে যে তাকে সাহায্য করছে সেই আরিফের হাতে, কথার জাদুতে, সৌম্য চেহারার আকর্ষণে ইসলামি বিপ্লব তাকে ডাকছে। তাগুদি আইনের বিরুদ্ধে তার অজানা অধ্যায় শুরু হওয়ার ক্ষণ সেটিই। আরিফ রুহুলকে টেনে নিয়ে যায় প্রচলিত ধর্মীয় রাজনীতি যেখানে গণতন্ত্রকে সম্বল করে মার্কিনির স্বার্থের কাছে গাটছড়া বেধেছে তার বিরুদ্ধে ইসলামি বিপ্লবী আন্দোলনে-জঙ্গিবাদের পথে। আফগানিস্তান-ফেরত মুজাহিদ দলনেতার জঙ্গি শিবিরে শরিক হয় সে।
সিনেমা হলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় আরিফের স্কোয়াড। আরিফ আত্মঘাতি হামলায় আহত হয়ে মেডিকেলে ঢুকে। দ্বীন রক্ষার্থে গৃহত্যাগী রুহুল তখন নিজের বিবেকের সঙ্গে আরেক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। নান্দনিক জীবনের কক্ষচ্যুত রুহুল মায়ের দুধ মাখা হাতের আশ্রয়ে চলে আসে।
আরিফের চরিত্রটি আগাগোড়াই মুগ্ধ করে দর্শকদের।
দর্শক এখানে নির্মল আনন্দ পায় যমুনা বিহারের সময় জঙ্গি নেতার বিজ্ঞপনী মানসিকতা দেখে, বাংলাদেশের সনাতনী সিনেমায় নিম্নবর্গের দর্শকদের অংশগ্রহণ, রুহুলের মামার শুদ্ধ ইংরেজি বলার ধরণ, পাথরকে মাঝে রেখে রুহুলের প্রেমালাপ, উড়ন্ত বিমানকে মাটিতে ফেলে দেয়ার ক্রোধে গুলতি ছুড়ে মারার ইমেজগুলো।
জঙ্গিবাদ, পোশাকশ্রমিক, বিদেশে ভাগ্যহত বাংলাদেশি, ক্ষুদ্রঋণের ফাঁস, নিটোল প্রেম, নিম্নবর্গের গণসংস্কৃতি একসঙ্গে অনেকগুলো হাড্ডি মিলেই যেন রক্তমাংসের শরীর- রানওয়ে। আলোচিত ইস্যুগুলোর যুগপৎ উপস্থিতি রানওয়েকে একটি মাত্রা দেয়, দর্শককে অস্থির করে না, ব্যস্ত করে না, বিরক্ত করে না। যেন সত্যিই মনে হয় অনেকগুলো স্থাপনার সমষ্টি যেন এই রানওয়ে। এরা যেন রানওয়ের এক একটি 'দরকারি স্থাপনা'।
কোনটি বাতিঘর, কোনটি কন্ট্রোলরুম, কোনটা সিগন্যাল ম্যান, কোনটা বা বিমান সড়ক।
মাটির ময়না আর অন্তর্যাত্রার পর তারেক মাসুদের তিন নম্বর এই পূর্ণদৈঘ্য কাহিনিচিত্র। তারেক মাসুদের সিনেমার ক্যামেরা জঙ্গিবাদকে পরাস্থ করতে পারে না। পাল্টা আদর্শ দাড় করায় না। শুধু দেখি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অনালোকিত অংশে তিনি আলো ফেলেছেন।
জঙ্গিবাদের জতুগৃহে তিনি হাজির হন। শেষে তিনি অবশ্য জীবনের জয়গান গেয়ে মানুষ আর প্রকৃতির শ্রেষ্টত্বকে মেডেল পরিয়েছেন।
ছবিটি কেমন হলো? বেশ জটিল প্রশ্নটিতে শ্রোতাকে ধৈর্য ধরতে হবে। কারণ ছবি সবসময় ভালো বা খারাপ- দুইয়ে দুইয়ে চারের মতো সহজ সমীকরণ নয়। ছবি অনেক সময় উস্কানি দেয়, ঘুম হারাম করে, বিতর্ক তৈরি করে, প্রশ্ন তোলে, নিস্তেজও করে।
রানওয়ে সব গল্প বলেও কোন গল্প শেষ করে না। সব কাহিনীর শুরু করেও কোন কাহিনী শেষ করে না। রুহুলের চোখে দেখা প্রজাপতিটি কি তাকে সংসারী করাতে পারে? মা কি ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁস থেকে মুক্তি পায়? বাবা কি দেশের মাটিতে কিছু করতে পারে? জঙ্গিবাদ কি পরাস্থ হয় বাংলার মাটি থেকে??
এসব প্রশ্নের উত্তর দর্শকদের নিজ ক্ষমতায় খুজে দেখার জন্য উসকানি দিয়েছেন তারেক মাসুদ। ছবির শেষে তিনি কোন সাম্যবাদের পতাকা উড়ান নি, তিনি সমাধান টানেন নি, বাংলা সিনেমার চিরাচরিত সমাপন 'পুলিশ এসে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে সুখের সংসারের পুন:প্রতিষ্টা'তো তিনি দেখান-ই নি। তিনি দর্শকদের জন্য একটি আরামের ঘুম আয়োজন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তাই তিনি সফল! আর ক্যামেরার কাজে মিশুক মুনীর যে যতেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় তা নিয়ে বলার বা কিছু লেখার দু:সাহস আমার নেই।
ছবিটিকে নিয়ে কিছু দরকারি লিঙ্ক-
এই লিঙ্কে ক্লিক করে পাবেন ফেসবুকের পেইজ
এটাও ফেসবুকের সাইট
ছবিটির ওয়েবসাইট দেখতে http://www.bangladeshfilm.net/runway' target='_blank' >ক্লিক করুন
এই লিঙ্কে
তারেক মাসুদ সম্পর্কে উকিপিডিয়ার তথ্য
তারেক মাসুদের কাজের কিছু ভিডিও পাবেন এই লিঙ্কে ক্লিক করলে
সামু ব্লগেই আছে অধ্যাপক ফাহমিদুল হকের রানওয়ে নিয়ে একটি দুর্দান্ত বিশ্লেষণ। এই লিংকে রানওয়ে: সমকালীন বাংলাদেশের সংবেদনশীল চিত্রায়ণ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।