আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার ক্যাডেট কলেজ

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল!

আমার ক্যাডেট কলেজ ডঃ রমিত আজাদ (৭ম ব্যাচ) আমার বয়স যখন পাঁচ বছর হলো, সকলে ঠিক করলেন আমাকে স্কুলে দিতে হবে। আমরা তখন থাকতাম ঢাকার মগবাজারে মধুবাগে। কাছাকাছি স্কুল ছিল। মগবাজার টি এন্ড টি স্কুল। বড় বোন রীনা আপার হাত ধরে একদিন ঐ স্কুলে গেলাম।

তখনকার ভর্তি পদ্ধতি আজকের মত এত জটিল ছিল না। স্কুলের একজন শিক্ষককে আমার বড় বোন বললেন “স্যার আমার ছোট ভাই, ওকে ভর্তি করতে চাই। ও সবকিছু খুব সুন্দর করে পড়তে পারে”। স্যার তার হাতের বইটি খুলে আমাকে বললেন, “পড়”। আমি খুব দ্রুত পড়লাম, “বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র................”।

স্যার চমৎকৃত হয়ে বললেন, “বেশ বেশ আর পড়তে হবে না”। চল তোমাকে ভর্তি করিয়ে দেই। সব ফর্মালিটিস শেষ হওয়ার পর আমার আপা বললেন “তুমি ভর্তি হয়ে গিয়েছ, কাল থেকে এই স্কুলে পড়বে”। স্কুলের দিকে তাকিয়ে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। আমি বললাম, “বেড়ার স্কুল!”।

আপারও বোধ হয় মন খারাপ হয়ে গেল, বললেন, “এখন তুমি ছোট তো, যখন বড় হবে, তখন অনেক বড় স্কুলে পড়বে”। মনে আকাঙ্খা রয়ে গেল, অনেক বড় স্কুলে পড়ার। এরপর যখন তৃতীয় বা চর্তুথ শ্রেণীর ছাত্র, একদিন আমার মাতৃতুল্য ফুপু আমাকে বললেন, “রমিত, পত্রিকায় তোমার নাম উঠেছে দেখবে এসো”। আমি অবাক হয়ে গেলাম, পত্রিকায় আমার নাম। এরপর তিনি খবরের কাগজ খুলে একটি বিজ্ঞপ্তি দেখালেন, ক্যাডেট কলেজে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি।

আমি প্রশ্ন করলাম, “কোথায় আমার নাম?” ফুপু হেসে বললেন, তোমার নাম না, এটা ক্যাডেট কলেজের ভর্তির বিজ্ঞপ্তি। খুব ভালো স্কুল। তোমাকে এখানে ভর্তি হতে হবে”। সেই প্রথম জানতে পারলাম, ক্যাডেট কলেজের নাম । এদিকে আমার এক ফুপাতো বোনের ছেলে, ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়েছে।

তার বাবা মা খুব খুশি। একদিন তাকে দেখতে গেলাম। তিনি আমাকে তার ইউনিফর্ম দেখালেন। আমার মনকে আলোকিত করল ঐ ঝকঝকে ইউনিফর্ম । এবার ক্যাডেট কলেজে ভর্তির বাসনা আরো তীব্র হলো।

১৯৮১ সালে আমার বড় দুই বোনের মধ্যে যিনি দ্বিতীয় (রিতা আপা), তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। নিয়ে গেলেন একটি কোচিং সেন্টারে। আমার সৌভাগ্য, সেই কোচিং সেন্টারে পড়েছিলাম যার পরিচালক ও শিক্ষক ছিলেন আশরাফুল হক স্যার। তিনি বর্তমানে হলি চাইল্ড স্কুলের অধ্যক্ষ ও প্রতিষ্টাতা। খুব মনযোগ দিয়ে স্যার পড়িয়েছিলেন।

উনার প্রশিক্ষন পেয়ে আমরা অনেকেই ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। আমার আজও মনে আছে যেদিন লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সংবাদ পেয়েছিলাম সেদিন কি খুশীই না হয়েছিলাম। আমার গৃহশিক্ষক স্বপন ভাই আমাকে খুব যত্ন করে পড়িয়েছিলেন । উনাকে সালাম করে খুশীর সংবাদটা দিলাম। উনি হেসে বললেন, “তুমি যে এ্যালাউ হবে তা আমি জানতাম”।

আশরাফুল হক স্যার বললেন “রিটেন পরীক্ষায় এ্যালাউ হয়ে উচ্ছসিত হওয়ার কিছু নাই। ১৫০ জন এ্যালাউ হয়েছে কিন্ত মৌখিক পরীক্ষার পর রাখা হবে মাত্র ৫০ জন। সুতরাং তোমাদের আরো অনেক পড়তে হবে। স্যারের প্রশিক্ষন নিয়ে কাটলো বাকী দিনগুলো। অবশেষে এলো মৌখিক পরীক্ষার দিন।

পরীক্ষা হলো ঢাকার টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। সারাদিন অপেক্ষা করার পর বিকালের দিকে আমাদের কলেজের স্বপন ভাই (যিনি এখনো কর্মরত) ডেকে নিলেন ভিতরে। রুমে ঢুকে দেখলাম, চেয়ার আলো করে বসে আছেন কলেজের অধ্যক্ষ শ্রদ্ধেয় বাকিয়াতুল্লাহ স্যার। তার পাশে বসে আছেন উপাধ্যক্ষ আল-আমিন স্যার। অনেক প্রশ্ন করলেন, অনেক কিছু জানতে চাইলেন, কিন্তু একটুও ঘাবড়ালাম না।

অবাক হয়ে শুধু ভাবছিলাম, এত চমৎকার শিক্ষক হয়! একই মন্তব্য করেছিল আমাদের ব্যাচের কালাম সারোয়ার, “দু’জনই এত ভালো!” ভাইভায় নানা প্রশ্ন করলেন। মোটামুটি সবকিছুরই ভালো উত্তর দিলাম। এরপর অনেকদিন অপেক্ষা করলাম। তারপর আবারো চিঠি পেলাম। চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সংবাদ।

এত খুশি আর জীবনে কোনদিন হইনি। চিঠিতে লেখা ছিল ৬ই জুন জয়িেনং ডেট এরপর কেবল অপেক্ষা, কবে ৬ ই জুন আসবে। যথারীতি ৫ই জুন এলো। ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমার জীবনের অনেক আনন্দের দিন।

বেশ কয়েকটি আনন্দ একদিনে, জীবনে প্রথম ট্রেনে চড়ার আনন্দ, স্কুলের বই-পত্রে, গল্পে সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, চা-বাগান, হজরত শাহ্জালাল (র) এর মাজার ইত্যাদির গল্প অনেক পড়েছি সেই সিলেট দেখার আনন্দ, সর্বপোরী ক্যাডেট কলেজে ভর্তির আনন্দ। ৬ই জুন সিলেট পৌঁছে রেল ষ্টেশনেই দু’একজন ব্যাচ মেটের সাথে দেখা হলো, যারা আমার সাথেই ভাইভা পরীক্ষা দিয়েছিল। বিকালের দিকে একটি জীপে চড়ে কলেজের দিকে রওয়ানা হলাম। সিলেট শহর ছাড়িয়ে বাইরে নামতেই অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা। মালিনীছড়া আর লাক্কাতুরা চা বাগানের অপূর্ব দৃশ্যে মন জুড়িয়ে গেল।

সেই দৃশ্য শেষ হতে হতেই ঝকঝক করে উঠল সিলেট ক্যাডেট কলেজে-এর ক্যাম্পাস। এয়ারপোর্ট রোড বরাবর কলেজের দেয়াল ঘেঁষে চলে একেবারে শেষ মাথায় থাকা প্রধান ফটক দিকে চট করে জীপ ঢুকে গেল কলেজ ক্যাম্পাসের ভিতর। কিছুদুর যেতেই খাঁকি পোষাকের উপর লাল শ্যাষ পরা দু’জন ক্যাডেট লাঠি উচিয়ে থামতে নির্দেশ দিল জীপটেিক। দেখে খুব ভালো লাগলো, মনে মনে বললাম, বাহ্! বেশ স্মার্ট তো!’ জীপ থেকে নামিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো তৎকালীন কলেজ প্রিফেক্ট মহিউদ্দিন ভাই এর কাছে। খুঁজে দেখলেন আমি শাহ্জালাল হাউজের।

এলেন হাউজ লিডার ওয়ালীউলল্লাহ ভাই। তালিকা খুঁজে বললেন, “মশিউর তোমার রুমমেট। এগিয়ে এলেন আমার এক ব্যাচ সিনিয়র মশিউর ভাই। আমার সাথের কালো ট্রাংকটির একদিকে তিনি ধরে আমাকে বললেন, “তুমি অন্যদিকে ধর”। দু’জনে ট্রাংকের দু’দিকে ধরে এগিয়ে চললাম শাহ্জালাল হাউজের ৩৪ নং রুমের দিকে।

ট্রাংকের একদিকে পুরাতন ক্যাডেট অন্যদিকে নতুন ক্যাডেট। মুগ্ধ হলাম এই রীতি দেখে। ট্রাংকের বন্ধনের মধ্যে দিয়ে হৃদয়ের যে বন্ধন তৈরী হলো তা চিরস্থায়ী হয়ে গেল। কিছুক্ষনের মধ্যে আমার অপর দু’জন রুমমেট আসিফ ও মঈনুলকে পেয়ে গেলাম। কিছুক্ষন পর পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক শ্রদ্ধেয় দেলোয়ার হোসেন স্যার এলেন।

প্রাণবন্ত আলোচনা জমালেন আমাদের তিনজনার অভিভাবকদের সাথে। ৬ ই জুন ক্যাডেট কলেজে প্রথম দিন, প্রীতিকর অভজ্ঞিতার মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু হলো আমার ক্যাডেট জীবনের। ছয় ছয়টি বছারের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা একটি ছোট প্রবন্ধে সীমাবদ্ধ করা যায় না। সিলেট ক্যাডেট কলজে প্রানের কলেজ, কলেজের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ইট, হয়তো প্রতিটি ঘাঁসের সাথেও আছে আমাদরে হৃদয়ের সম্পর্ক। সেই হৃদয়ের কিছু কথা আজ বলব।

কলেজের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের কথা। আমরা প্রথম অধ্যক্ষ হিসাবে যাকে পেয়েছি সেই বাকিয়াতুল্লাহ্ স্যারের কথা। স্যারের শান্ত-সৌম্য অবয়বে ছিল আভিজাত্যের ছাপ। প্রথম দিন পারেডে এসে আমাকে বললেন, “এত স্বাস্থ্য খারাপ কনে? থাক স্বাস্থ্য ভালো হয়ে যাবে। এখানে তো তোমাদের বাবা-মা-রা নেই, এখানে আমরাই বাবা-মা।

” আমাদেরকে এভাবেই স্যার আপন করে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ক্যাডেট কলেজ সমূহের প্রথম সিভিলিয়ান প্রিন্সিপাল। সেরা শিক্ষক হিসাবে এ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন, ফৌজদার ক্যাডেট কলেজে কর্মরত অবস্থায়। তারপর তদানিন্তন সরকার তাকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিল প্রশিক্ষন নিয়ে আসতে। যথাযথই প্রশিক্ষন নিয়েছিলেন।

তার হাতে গড়ে উঠেছে এদেশের অনেক বড় বড় মানুষ। আমি মস্কোতে এক বাংলাদেশীর সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। বৃটিশ এক সুখ্যাত কোম্পানীর মস্কো শাখার কর্নধার। কথায় কথায় জানলাম তিনি ফৌজদারহাটের থার্ড ব্যাচের এক্স-ক্যাডেট। বাকিয়াতুল্লাহ্ স্যারের ভূয়সী প্রশংসা করলেন তিনি।

সেই বাকিয়াতল্লাহ্ স্যার আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। পরম করুনাময় তাকে জান্নাতবাসী করুন। ক্যাডেট কলেজে ভর্তির আগে ঢাকায় একটি সাধারণ স্কুলে পড়তাম আমি। মুখস্থ বিদ্যা ছাড়া আর কিছুই সেখানে শেখানো হতো না। আমাদের সমাজবিদ্যার শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন স্যার এসে প্রথম দিনই বললেন, “তোমরা তো সবাই ভালো ছাত্র।

আর্টস নিয়ে তো কেউই পড়বে না জানি। কিন্তু মানুষ হিসবে বিজ্ঞানের পাশাপাশি আর্টসেরও অনেক কিছু জানা থাকা প্রয়োজন। তাই এই বোর্ডের বইটা থাক। আমি তোমাদের এই বইয়ের বাইরে অনেক কিছু পড়াব, যা তোমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন”। তিনি শুরু করলেন সক্রেটিস থেকে।

তারপর প্লেটো, এ্যারিষ্টটল, মেকিয়েভেলি হয়ে বিশ্ববিক্ষনের অনেক শাখা পেরিয়ে শেষ করলেন বাংলাদেশ ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত । তিনি আমাদের প্রথম আলো দেখালেন দর্শনের, আলো দেখালেন সমাজবিদ্যার, প্রবল আগ্রহ জাগিয়ে তুললেন রাজনীতি বিষয়ে। মনে পড়ে মরহুম মাজহারুল হক স্যারের কথা। সুদর্শন মাজহার স্যার বরাবরই ছিলেন পরিপাটি, সৌন্দর্য্যপ্রীয়। আমাদের মধ্যেও এই সৌন্দর্য্য সচেতনতা তিনি তৈরী করে দিয়েছিলেন।

হাউজ মাষ্টার হিসাবে সুরমা হাউজকে করেছিলেন নানা ভাবে শোভিত। ইতিহাস পড়াতেন। সাধারণ স্কুলে পড়াকালীন ইতিহাসে কোন আনন্দ পেতাম না। মনে হতো দিনক্ষণ মুখস্থ করার একটা কাঠখোট্টা সারজেক্ট্। মাজহার শুরু করলেন সিন্ধু সভ্যতা থেকে।

স্যারের কাছ থেকে জানলাম আলেকজান্ডারের কাহিনী। জানলাম ১৮৫৭ সালে যা ঘটেছিল তাকে ইংরেজরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে সিপাহী বিপ্লব নাম দিয়েছিল, আসলে সেটা ছিল আমাদের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ। জেনেছি গৌতম বুদ্ধের কথা, মহাবীরের কথা। আরো কত কি! মাজহার স্যারই শেখালেন, ইতিহাস কত তাৎপর্যপূর্ণ! বাংলার শিক্ষক রকিবুল হাসান স্যার। কোমলে কঠোরে মিশ্রিত।

যেমনি ভালোবাসতেন, তেমনি শাসনে রাখতেন। পড়ালেখার পাশাপাশি জীবনে প্রয়োজন হবে এমন অনেক কিছুই শেখাতেন বন্ধুর মতো। ক্লাসে সুবোধ বালকটির মত বসে থাকলে স্যার ভৎর্সনা করতেন। বলতেন, শিশু কিশোররা হবে চঞ্চল উচ্ছল। হৈ চৈ আর দুরন্তপনাকে তিনি উৎসাহই দিতেন।

আমার এখানো মনে আছে আমাদের ব্যাচের পাস-আউটের সকল অনুষ্ঠানের আয়োজন স্যারই করেছিলেন। আমাদের কোন আবদারই ফিরিয়ে দেননি। বক্তৃতা, নাটক, আবৃত্তি ইত্যাদি নানা সাংস্কৃতিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছিলাম শফিকুল আজম স্যার এবং সাইফুল ইসলাম স্যারের কাছে। একবার মনে আছে আন্ত:ভবন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার সময় শাহ্জালাল হাউজের প্রতিযোগিদের একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল। গায়ক ঠান্ডা লাগিয়ে গলা ভেঙে ফেলেছে।

তবলা বাদক হসপিটালাইজড। শেষ দু:সংবাদ এলো, অভিনেতাদের একজন হাত ভেঙেছে। আমরা সবাই হায় হায়! হাউজ এবার ডুবল! শফিকুল আজম স্যার ঠান্ডা মাথায় সব ট্যাকল করলেন। নতুন গান সিলেক্ট করলেন, নতুন অভিনেতা নিলেন, আমাকে আনাড়ি হাতে দিলেন তবলা বাজাতে। অনুষ্ঠানের ফলাফল ঘোষিত হলো, শাহজালাল হাউজ প্রথম হয়েছে।

আনন্দের আতিশয্যে স্যারকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম। ইংরেজীর শিক্ষক শফিকুল ইসলাম স্যার নিজেই এক্স ক্যাডেট। তার উপর একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। চমৎকার পড়াতেন। ইংরেজীর ভয় কেটে গেল স্যারের ক্লাশ পেয়ে।

অংকের ভয় বোধ হয় সবার মধ্যেই থাকে , কুদ্দুস স্যার এলেন রাজশাহী থেকে। এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন সেই ভয়। কনফিডেন্স, ব্যাক্তি জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই কনফিডেন্স আমাদের মনে এনে দিয়েছিলেন নজরুল ইসলাম স্যার। তখন তীতুমীর হাউজ সব কিছুতে তৃতীয় স্থান পেত।

তারা নিজেরাও ধরে নিয়েছিল যে, ঐ অবস্থান থেকে তাদের উঠে আসা সম্ভব নয়। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে এসে তীতুমীর হাউজের হাউজ মাষ্টার হিসাবে দায়িত্ব নিলেন নজরুল ইসলাম স্যার । যাদুকরের মতো হাউজকে টেনে তুললেন। এরপর আমরা বুঝে গিয়েছিলাম নজরুল ইসলাম স্যার যতদিন আছেন ততদিন তীতুমীর হাউজ শক্ত ভীতের উপর দাঁড়িয়ে থাকবে। হাসান স্যার ছিলেন ভূগোলের শিক্ষক।

ম্যাপ আঁকতে ভয় পেতাম সবাই। সেই ম্যাপ আঁকা শিখিয়েই ছাড়লেন। শাহজালাল হাউজের হাউজ মাষ্টারের দায়িত্ব পালন করেছেন। সৎ নিষ্ঠাবান একজন মানুষ। নিজের সন্তানের মত স্নেহ করতেন আমাদের।

স্যার যেমন ছিলেন মেজাজী তেমনি আবার হাস্য রসিকতায় মন ভরিয়ে দিতেন। একবার ক্রস-কান্ট্রি প্রতিযোগিতার আগে বললাম, “স্যার ছোট ছোট ক্যাডেটদের দৌড়াতে কষ্ট হয়”। স্যার উত্তরে বললেন, “ছোট পোলাপানে দৌড়াইবে বান্দরের মত”। পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসাবে যোগ দিলেন অমিতাভ বিশ্বাস স্যার। সিলেট ক্যাডেট কলেজই স্যারের প্রথম ক্যাডেট কলেজ।

কলেজে এসেই স্যার সকলকে আপন করে নিলেন। স্যারের ধ্যান-জ্ঞান সবই হয়ে গেল ক্যাডেটরা। ক্লাশে তিনি ডুবে যেতেন শিক্ষকতায়। জটিল সব বিষয়, সূত্র, নীতি, আইন জলবৎ তরলং করে দিতেন। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম স্যারের প্রভাব মুক্ত হতে পারব না।

হলোও তাই, কেবল আমাদের ক্লাশ থেকেই পাঁচ-পাঁচজন পরবর্তিতে পদার্থবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা নিলাম। এদের মধ্যে তিনজন আমি, তানভীর ও সাজ্জাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। ইউরোপে লেখাপড়া করেছি, পি.এইচ.ডি. ডিগ্রী নিয়েছি। আমার লেখা তিনটি বই ইউরোপ থেকে প্রকাশিত। এর সবকিছুর পিছনে স্যারেরই অবদান।

টেকনিকাল ড্রইং-য়ের শিক্ষক ছিলেন বজলুর রহমান স্যার। আমরা যখন ক্লাশ নাইনে, স্যার তখন জয়েন করলেন। কলেজে সাবজেক্টটি মাত্র চালু করা হয়েছে। আমরা দ্বিধা দ্বন্দের মধ্যে ছিলাম। সাবজেক্টটি নেব কি নেব না ৷ নজরুল ইসলাম স্যার এলেন।

সায়েন্সের ষ্টুডেন্টদের জীবনে এই সাবজেক্টের গুরুত্ব সম্পর্ক ছোটখাট বক্তৃতা দিলেন। এর পর পেলাম বজলুর রহমান স্যারের ক্লাশ। অত্যন্ত শান্ত ও নম্র মানুষ। অসীম ধৈর্য্য নিয়ে আমাদের সবকিছু বুঝাতেন। অল্প দিনের মধ্যেই স্যার এবং সাবজেক্ট উভয়ই আমাদের কাছে প্রীয় হয়ে গেল।

এই সাবজেক্টে যা কিছু শিখেছি তা সবই আমার সারা জীবন কাজে লেগেছে, এখনো লাগছে। ভাইস প্রিন্সিপাল হয়ে এলেন মাসুদ হাসান স্যার। তার আগের বছর এস.এস.সি পরীক্ষার ফল ভাল হয় নি। মাসুদ হাসান স্যার এসে যাদু করলেন। পরের বছর চমৎকার ফলাফল।

তার পরের বছর তাক লাগিয়ে দিলেন, বোর্ডে সবচাইতে ভাল ফলাফল সিলেট ক্যাডেট কলেজের। ফলাফল যখন স্যারের হাতে এলো, স্যার টেবিল চাপড়ে বলছিলেন, “আমি ফৌজদারহাটকে হারিয়েছি”। জসিবুর রহমান স্যার ছিলেন প্রাণীবিজ্ঞানের শিক্ষক। কথায় কথায় বলতেন “আমি তোমাদের বড় বড় ডাক্তার বানাতে চাই”। হয়ে ছিলও তাই স্যারের কল্যাণেই অনেকেই বড় ডাক্তার হলো।

শাকিল ভাই এবং আমাদের ব্যাচের ডাঃ হাবিব এদরে মধ্যে উল্লখেযোগ্য। স্যার ছিলেন আমাদের ফর্ম মাষ্টার। আমাদের নিয়ে এক্সর্কাসনে যেতেন। পরিচিত করে দিতেন নানা রকম উদ্ভিদ ও প্রাণীদের সাথে। অবাক হয়ে শুনতাম স্যারের কথা।

সেই স্যারের ছেলে এখন আমারই ছাত্র। উপরওয়ালার কি খেয়াল। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম র্পযন্ত জ্ঞান সঞ্চালিত করে দিচ্ছেন। লেখক রফিক কায়সারের নাম শুনেছি অনেক। তিনি যখন আমাদের শিক্ষক হয়ে এলেন, আমাদের আনন্দ আর ধরে না।

সাহিত্যের কত গভির বিষয় যে উনার কাছ থেকে শিখেছিলাম। মাঝে মাঝে পত্র পত্রিকায় স্যারের নাম দেখে খুব গর্ব হতো, যে উনার ছাত্র আমরা। আবদুর রব স্যার ছিলেন ইসলামিয়াতের শিক্ষক। ধর্মীয় শিক্ষায় তিনি আমাদের শিক্ষিত করেছিলেন। আমাদের চেতনায় গেঁথে দিয়েছিলেন ইসলামের শিক্ষাকে।

কলেজের এ্যাডজুটেন্ট ছিলেন খন্দকার ওবায়দুল আনোয়ার স্যার। এডুকেশন কোরের অফিসার ছিলেন। তাই হয়তো একটু নমনীয় ছিলেন। উনার গানের গলা চমৎকার আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম, সামরিক অফিসারের কন্ঠে গান। ক্যাডেটদের খুব ভালবাসতেন, বিদায়ের দিন ডাইনিং হলের সামনে দাঁড়িয়ে আন অফিসিয়াল একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন।

দেশপ্রেম কি, কোন পথ ধরে বাংলাদেশকে এগোতে হবে, কি হবে আমাদের দায়িত্ব , খুব সুন্দরভাবে আমাদের বুঝেিয় বলেছিলেন। তখনই বুঝতে পারলাম যে, ক্যাডেট কলেজের সাথে স্যারের গভির সম্পর্ক হবে। হয়েছিলও তাই, স্যার পরে সি.সি. আর এর প্রিন্সিপাল হয়েছিলনে। তারও পরে এ.এ.জি হয়ে ক্যাডেট কলেজগুলো খুব ভাল ভাবে পরিচালনা করেছিলেন । সেই স্যারের সাথে দেখা গত বৎসর ।

প্রায় বিশ বৎসর পর। আমি সানগ্লাস পরা অবস্থায় ছিলাম। স্যারকে সালাম করে বললাম, “স্যার চিনতে পেরেছেন?” স্যার আমাকে অবাক করে বললেন, তুমি রমতি আজাদ । ছয় বৎসরে দীর্ঘ শিক্ষাজীবনে অনেক শিক্ষকদের সহচর্যে এসেছি ৷পিছনে ফিরে তাকালে মনে পরে, এক একটি উজ্জল নাম, আবদুল বারী স্যার, জায়েদুল আলম স্যার, মেজর আমীন স্যার, আলতাফুর রহমান স্যার, রয়িাজউদ্দনি প্রামানকি স্যার, কলেজের প্রথম শিক্ষয়ত্রী মুনিরা পারভীন, ওয়াহিদুর রহমান স্যার, চৌধুরী আনিসুর রহমান স্যার, বেলাল হোসেন স্যার, কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম স্যার, উপাধ্যক্ষ আবুল আশরাফ নূর । আমাদের সকলের জীবনে গভীর ছাপ রয়েছে প্রতিটি শিক্ষকের।

তাঁরাই গড়ে তুলেছেন আমাদের জীবন। তাঁদের কল্যানে আমরা আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। আমাদের দেশের যে সামান্য কয়েটি জায়গায় মেধার মূল্যায়ন হয়, এর মধ্যে একটি হলো ক্যাডেট কলেজ । যে শিশুরা মেধা যাচাইয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, এখানে তাদের খতেে দয়ো হয়, কাপড় পরতে দেয়া হয়, সু-চিকিৎসা দেয়া হয়, পড়া লেখাতো শেখানো হয়ই, তার পাশপাশি আরো অনেক প্রশিক্ষনই এখানে দেয় হয়। অথচ তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের অনেকেই ক্যাডেট কলেজের বিরোধী।

ক্যাডেট কলেজ বন্ধ করে দিলেই তারা খুশি হবে। আমাকে একবার এক কম্যূনিষ্ট বলেছিল, যে ক্যাডেট কলেজ বন্ধ করে দেওয়াটাই উচিৎ, কেননা এখানে বিশেষ একটি শ্রেণী খুব ভাল আছে। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, “বিশেষ একটি শ্রেণী মানে কি? ” “কম্যুনিজদের দৃষ্টিকোন থেকে শ্রেণী দু'টো, শ্রমিক শ্রেণী ও মালিক শ্রেণী, ক্যাডেট কলেজে এ জাতীয় কোন শ্রেণী ভেদ নেই। ক্যাডেট কলেজের দরজা সকলের জন্যই উম্মুক্ত। ” ক্যাডেট কলেজ একটি মেরিট স্কুল ।

দেশের সেরা ছাত্রদের বাছাই করে, যথাযথ প্রশিক্ষন দিয়ে পটেনশিয়াল বিশেষজ্ঞ তৈরি করা হয় । এতে দেশের সামরিক ও বেসামরিক দুটি ক্ষেত্রই লাভবান হয় । অথচ এই ক্যাডেট কলেজের বিরোধীতা করছে একদল তথাকথিত বুদ্ধিজীবি । অবশ্য আমি ভিন্নমতের মানুষও দেখেছি ৷ বিদেশে অধ্যায়নরত সময়ে এক বাংলাদেশীর সাথে পরিচয় হয়েছিল, কট্টর কম্যূনিষ্ট, ক্যাডেট কলেজের ঘোর বিরোধী । ক্যাডেট কলেজ সর্ম্পকে তার ধারনা ছিল এটি একটি র্বুজোয়া প্রতিষ্ঠান ৷ আমার সাথে কিছুদিন চলাফেরার পর দেখলাম, হি ইজ ইমপ্রেস্ড।

একদিন আমাকে প্রশ্ন করলেন, ক্যাডেট কলেজে ভর্তির নিয়ম কি ? আমি জানতে চাইলাম, “কেন?” বললেন, “ দেশে ভাতিজা-ভাতিঝি আছে ওদেরকে র্ভতি করাতে চাই ” । আর একদিন প্রশ্ন করলেন, “বাংলাদেশে ক্যাডেট কলেজ কয়টি ?” বললাম, “দশটি ” । উনি বললেন, “এর সংখ্যা বাড়ানো যায়না? ” আমি বললাম, “ক্যাডেট কলেজ ব্যায়বহুল প্রতিষ্ঠান, “ক্যাডেট কলেজ চালাতে যা খরচ হয় এই টাকা দিয়ে ছোটখাটো নদীর উপরে সেতু তৈরী করা যায় ” । তিনি বললেন, “সেতুর দরকার নাই, নৌকা চলবে , তাও ক্যাডেট কলেজের সংখ্যা বাড়ুক ” ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.