আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজধানীর বর্জ্য পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি

গণমাধ্যমকর্মী, চেয়ারম্যান - উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান, সদস্য সচিব - সম্মিলিত জলাধার রক্ষা আন্দোলন।

রাজধানীর বর্জ্য পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি রাজধানীর অলিতে গলিতে এমনকি অনেক বড় বড় অফিসের সামনেও মানুষ প্রতিদিন ময়লা ফেলছে অবাদে। এমনও অনেক এলাকা আছে যেসব এলাকে দেখই মনে হয় পুরো এলাকাটাই যেন ডাস্টবিন। নাক চেপে ধরেই এখন হাটতে হয় সাধারণ মানুষকে। আর এটা দেখেও আবাক হয়না কেউই।

মানুষের এখন সয়ে গেছে। এটাতেই মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর এসব নিয়ে সিটি করপোরেশন বা দায়িত্বশীল কোন মহলের দায়িত্ব আছে বলেও মনে হয় না কর্মকান্ড দেখে। প্রতিদিনিই বড় হচ্ছে ময়লার স্তুপ। বাড়ছে জনসাধারণের দূর্ভোগ।

অভাব সমন্বয়ের : ঢাকা শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বয় নেই সংশ্লি­ষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে। নেই উৎপাদিত বর্জ্যরে সঠিক হিসাব। সিটি কর্পোরেশনের হিসাব মতে, ঢাকা শহরে দৈনিক উৎপন্ন ৩ হাজার ২শ মে. টন বর্জ্যরে প্রায় সবটুকুই ডাম্পিং করা হয়। বিশ্ব ব্যাংকের মতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন মজুদ হচ্ছে প্রায় ৭ হাজার মে. টন বর্জ্য। এরমধ্যে মাত্র ৩ হাজার ৮শ মে.টন বর্জ্য ডাম্পিং করা হয়।

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ওয়াসা মাত্র ৩০ শতাংশ বর্জ্য নিষ্কাশন করে। এ ব্যাপারে ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা বিপিন কুমার সাহা বলেন, এটা সত্য যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কিছুটা সমন্বয়হীনতা আছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি ডেন এ সমস্য দ্রুতই সমাধান করা যায়। এজন্য সব মহলের সহযোগীতা প্রয়োজন। অবহেলার কারণে নিষ্কাশন হয় না বর্জ্য : ওয়াসা দাবি করেছে তারা নিষ্কাশন করে মাত্র ২০ শতাংশ বর্জ্য ।

বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রথম রিপোর্টে সিটি কর্পোরেশনের দেয়া তথ্যমতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। এমনকি দায়িত্বে অবহেলার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ওই রিপোর্টে দেয়া তথ্যমতে, ঢাকা শহরের মাত্র ৩ শতাংশ এলাকায় ওয়াসা পরিচালিত সুয়ারেজ লাইন আছে। গত বছরের হিসাব অনুযায়ী উত্তরা, মিরপুর, শ্যামলীসহ অনেক এলাকায়ই সুয়ারেজ লাইন নেই। এসব এলাকায় রাজউককে ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে ড্রেনের মাধ্যমে সুয়ারেজ লাইনে বর্জ্য নিষ্কাশন করা হচ্ছে।

বাড়ি নির্মাণের অনুমোদন দেয়ার পর বাড়িটি অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মিত হয়েছে কিনা রাজউক তা আর খতিয়ে দেখে না বলে একই রিপোর্টে বলা হয়েছে। সেেেত্র এই বাড়িতে সেফটি ট্যাংকি আছে কি নেই তাও আড়ালে পড়ে যায়। যদিও এ ব্যাপারে রাজউক জানিয়েছে- তাদের কাজ শুধু লে-আউটের পরিবর্তন হয়েছে কিনা সেটি দেখা। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে ওয়াসার মহাব্যবস্থাপকের প্রদত্ত তথ্য থেকে জানা গেছে, ঢাকায় মানুষের ব্যবহৃত পানির ৮৭ শতাংশ ভূমির গভীর থেকে তোলা হয়। এ কারণে প্রতিবছর ২ থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।

একই সঙ্গে খাল, জলাধার ইত্যাদি দিন দিন ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি নদীতে গিয়ে পড়ছে। নদীর পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। নদীর পানি বিশুদ্ধ করে সরবরাহ করতে পারছে না ওয়াসা। রিপোর্টে বলা হয়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের মূল কারণ এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কো-অর্ডিনেটিং বডি নেই। সমন্বয় থাকলে সুনির্দিষ্ট ল্েয কাজ করা সহজ হতো।

বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রেখে ওয়াসার আরেক কর্মকর্তা কমিটিকে এক বৈঠকে জানিয়েছিলেন, ঢাকার মাতুয়াইল বর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট পরীা করে কোরিয়ার এক বিশেষজ্ঞ জানান, এ ধরনের বর্জ্য থেকে পাওয়ার প্ল­্যান্টের মাধ্যমে ৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। সবচে বিপজ্জ্বনক হাসপাতাল বর্জ্য : রাজধানীর দেড় সহস্রাধিক হাসপাতাল, কিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চিকিৎসা-বর্জ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ৯২ শতাংশ বর্জ্য রাস্তার ওপর খোলা ডাস্টবিন, নর্দমা বা রাজধানীর চারপাশের নদীতে ফেলা হচ্ছে। যত্রতত্র মেডিকেল বর্জ্য নিেেপ ছড়িয়ে পড়ছে হেপাটাইটিস ‘বি', হেপাটাইটিস ‘সি’, যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, এমনকি এইডসের মতো মরণব্যাধির ঝুঁকি। এদিকে, মেডিকেল বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনার দাবিতে স¤প্রতি ৮টি পরিবেশবাদী সংগঠন মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, রাজধানী ঢাকায় ১২শ' ছোট-বড় রেজিস্টার্ড প্রাইভেট হাসপাতাল, কিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর বাইরেও রেজিস্ট্রেশনবিহীন ৫ শতাধিক প্রতিষ্ঠান নগরীতে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য হুমকি হাসপাতাল বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনা মেনে চলছে না। সৃষ্ট চিকিৎসা বর্জ্য যেখানে সেখানে ফেলা হচ্ছে। নিপ্তি বর্জ্যরে তালিকায় রয়েছে ব্যবহৃত সূচ, সিরিঞ্জ, রক্ত ও পূঁজযুক্ত তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ, মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, ওষুধের শিশি, ব্যবহৃত স্যালাইন, রক্তের ব্যাগ এবং রাসায়নিক দ্রব্যসহ সব ধরনের চিকিৎসা-জাত ময়লা-আবর্জনা।

সুনির্দিষ্ট আইনের অভাব, প্রচার, নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে হাসপাতাল-কিনিকগুলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আওতায় আসছে না। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আইনগত বাধ্যবাধকতা ও প্রয়োজনীয় সচেতনতা না থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে সক্রিয়ভাবে অংশও নিচ্ছে না। সূত্র আরও জানায়, ২০০৭ সালের শেষ দিকে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা প্রাইভেট হাসপাতাল, কিনিক ও প্যাথলজী সেন্টার স্থাপন সংক্রান্ত অধ্যাদেশ হালনাগাদ করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু এ অধ্যাদেশ আলোর মুখ দেখেনি। ২০০৮ সালে দেশে চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা তৈরি করা হয়।

কিন্তু এতে হাসপাতালগুলোর জন্য কোনো নির্দেশনা নেই। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (ডিসিসি) পরিচ্ছন্নতা বিভাগ সূত্র জানায়, ঢাকা শহরে দৈনিক সৃষ্ট কঠিন বর্জ্যরে পরিমাণ আনুমানিক সাড়ে ৩ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৫০ মে. টন আসে স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। এর মধ্যে মাত্র ৪ মে.টন বর্জ্য সংগ্রহ করছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বাকি ৪৬ টন পড়ে থাকছে খোলা অবস্থায়।

ডিসিসি'র দাবি, হাসপাতালগুলো তাদের সাধারণ বর্জ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য আলাদা না করেই ডাস্টবিনে ফেলছে। অধিকাংশ শিল্পকারখানায় বর্জ্য শোধনাগার নেই : বর্জ্য শোধনাগার কেন্দ্র-ইটিপি স্থাপন না করেই চলছে রাজধানীসহ আশপাশের শিল্প কারখানা। বর্জ্য শোধনাগার কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি ভঙ্গ করে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে কারাখানা চালাচ্ছে মালিকরা। এদিকে এক যুগেরও বেশি অকার্যকর বাংলাদেশ পরিবেশ সংরণ আইন ও বিধিমালা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিল্প কারখানাগুলোতে বর্জ্য শোধনাগার না থাকায় নগরীর ২২ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রানত্ম হচ্ছে।

আনত্মর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার জরিপে বলা হচ্ছে, ৩০টি কঠিন রোগের অন্যতম কারণ দূষণ। বর্জ্য দূষণের কারণে রাজধানীর পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার তি হচ্ছে। রাজধানীর আশপাশের এলাকাগুলো থেকে ৬২ রকম রাসায়নিক বর্জ্য পানিতে মিশছে। ঢাকা বিভাগে শিল্প কারখানার সংখ্যা ৮ শতাধিক। এর মধ্যে রাজধানীসহ আশপাশে রয়েছে প্রায় ৬০০ শিল্প কারখানা।

এ সবের বর্জ্যে নষ্ট হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গাসহ রাজধানীর আশপাশের নদীর পানি। পরিস্থিতি এমন যে, দূষণের কারণে পানি শোধনের কোন অবস্থা এখন আর নেই। এই অবস্থায় আইন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম স¤প্রতি সরকারি দায়িত্বের কথা এগিয়ে পরিবেশ দূষণের সঙ্গে সংশিস্নষ্ট কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে সুশীল সমাজসহ পরিবেশবাদী সংগঠনসমূহকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কারখানা মালিকদের আন্দোলনের ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। অথচ দূষণের কারণে রাজধানী ঢাকা এখন হুমকির মুখে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২০ বছর পর বসবাসের অযোগ্য হবে রাজধানী ঢাকা। ঝুঁকির মূখে আগামীর প্রজন্ম : স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরবাসীর রোগব্যাধির ২২ শতাংশই পরিবেশ দূষণের কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফসহ বিশ্বব্যাংকের একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০টি কঠিন রোগের অন্যতম কারণ পরিবেশ দূষণ। অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বায়ু ও ভূপৃষ্ঠের পানি দূষণ এই তিনটিকে দূষণের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তাঁরা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মন্তব্যের প্রমাণ মেলে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে আসা রোগীর চিত্র দেখেই।

হাসপাতাল কর্তৃপরে ভাষ্য, দিন দিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ঝুঁকির মুখে আগামী প্রজন্ম। স¤প্রতি এক গবেষণায় বিশেষজ্ঞরা বুড়িগঙ্গাকে চিহ্নিত করেছেন সবচেয়ে দূষণকবলিত নদী হিসেবে। ঢাকা বিভাগে ৮০৪টি শিল্প কারখানার মধ্যে বর্জ্য শোধনাগার-ইটিপি রয়েছে ১৯০টিতে।

৫৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে ইটিপি নির্মাণাধীন থাকার কথা বলা হলেও এর অগ্রগতি নেই। দূষণের অন্যতম উৎস ট্যানারি। রাজধানীর হাজারীবাগে ১৮৫টি ট্যানারি থেকে দৈনিক ২২০ টন চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এ থেকে ৭৭ লাখ লিটার তরল ও ৮৮ টন কঠিন বর্জ্য নির্গত হয়। যার মধ্যে রয়েছে ক্রোমিয়াম, সালফার, এ্যামেনিয়া, লবণ ও অন্যান্য পদার্থ।

জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক তিকারক এসব বর্জ্য বুড়িগঙ্গাকে এমন মাত্রায় দূষণ করছে যে, নদীর পানিও এখন শোধনের অযোগ্য।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।