আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গণতন্ত্র এবং একমুঠো হাহাকার

আমি না হয় ভালবেসেই ভুল করেছি, ভুল করেছি। নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে পাঁচ দুপুরের নির্জনতায় খুন করেছি...

কাল ঈদ। সবাইকে প্রথমেই ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদের আগের দিন এই রকম গুরুগম্ভীর টাইপের একটা পোস্ট দেওয়া হয়তো উচিত হচ্ছে না। তারপরও দিচ্ছি।

ইচ্ছা করছে তাই। এ পোস্টে বেশ উন্নত মানের প্যাঁচাল আছে। যাদের প্যাঁচাল পড়তে কিংবা পাড়তে ইচ্ছা করে তারা লেখাটা পড়তে পারেন। যাদের এসব ইচ্ছা নেই তারাও পড়তে পারেন! যাই হোক। কাজের কথায় আসি।

আজ ঈদ উপলক্ষ্যে নিজের মহামূল্যবান বুক শেলফটাকে গোছগাছ করছিলাম। হঠাৎ একটা বইয়ের দিকে চোখ আটকে গেল। বেশ পুরোনো একটা বই। উল্টেপাল্টে দেখলাম। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রবন্ধের একটা ছোটখাটো সংকলন।

বইটার নাম বাংলাদেশঃ রাষ্ট্র ও রাজনীতি। মনে পড়ল প্রথম বইটা পড়ে বেশ চমৎকার লেগেছিল। তাই মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলাম। বেশ কিছু প্রবন্ধ আছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে। লেখকেরা সবাই মোটামুটি বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর ব্যক্তিত্ব।

প্রথম প্রবন্ধের নাম "গণতন্ত্র, কার্যকর সংসদ, সরকার ও বিরোধী দল"। প্রবন্ধের প্রথম অংশটুকু পড়ে মাথাটা খারাপ হয়ে গেল। পাঠকদের সুবিধার জন্য অংশটুকু তুলে দিচ্ছি। গণতন্ত্রে প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের জন্য যেসব জাতির খ্যাতি রয়েছে, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা এবং বিশেষ করে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য যেসব জাতি অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছে এবং রক্ত দিয়েছে সেসব দেশের তালিকায়ও বাংলাদেশের নাম শ্রদ্ধার সাথে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

বস্তুত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছদ্য অংশ। পাঠক হয়তো ভাবছেন একথায় মাথা খারাপ হওয়ার কি আছে? কথাগুলো তো ভুল না। কিংবা এখানে তো একবিন্দুও বাড়িয়ে কিছু বলা হয় নি। তাহলে সমস্যা কোথায়?? ঠিক সমস্যা আসলে উপরের এ অংশটুকুতে না। সমস্যা অন্যখানে।

লেখকের লেখার এ অংশটুকুতে তিনি যা বলেছেন তা অবশ্যই এবং অবশ্যই সত্যি। লেখাটা পড়ে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, স্বাধীনতার পর প্রায় চার দশকের এ সময়টুকুতে এদেশের সাধারণ মানুষ, যারা স্বাধিকার, স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের জন্য সবসময় লড়াই করেছে, তাদের প্রাপ্তি কতটুকু? উত্তর খুঁজতে গিয়ে হতাশ হলাম। '৭১ এর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দেশের শাসনভার নিলেন। দেশে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে শুরু করল। সমস্যা হল এটা ছিল শুধুই সুবাতাস।

'সু' গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি যুদ্ধবিদ্ধস্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশের একজন নেতার নিদেনপক্ষে যে সময়টুকু পাওয়া উচিত ছিল, বঙ্গবন্ধু তা পেলেন না। তার উপর বাকশাল সহ আরো কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি নিজের পতনকে ত্বরান্বিত করলেন (এখানে বলে রাখা দরকার, আমার সবসময় মনে হয় বঙ্গবন্ধু মানুষটা অনেক বেশি আবেগ প্রবণ ছিলেন। আবেগ আর মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি শত্রু মিত্র চিনতে ভুল করলেন। সিদ্ধান্তেও কিছু গোলমাল করলেন। আর তার ফলেই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি বরণ করতে হল)।

'৭৫ এ শুরু হল সামরিক শাসন। এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে পাকিস্তানি রক্তলোলুপ শাসকদের হাত থেকে রক্ষা পেতে চেয়েছিল। '৭৫ এ তারাই কি না পড়ল রক্তলোলুপ শাসকের হাতে! যে গণতন্ত্রের জন্য দেশের মানুষ যুদ্ধ করেছিল, সেই গণতন্ত্রের সুবাতাসই শুধু পেল তারা, তার অস্তিত্বের দেখা পেল না! সামরিক শাসকদের দুঃশাসনের কথা আমরা সবাই জানি। '৮১ তে আবার পট পরিবর্তন। এরপর পর্যায়ক্রমে দেশের সামরিক শাসনের পট পরিবর্তন হতে থাকল।

দেশের মানুষের কাছে গণতন্ত্র হয়ে রইল সোনার হরিণ। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর আমরা পেলাম প্রথম 'সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক' সরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য সে গণতন্ত্র শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাস্তবে তখনকার প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র মানেই মার মার কাট কাট, কাদা ছোড়াছুড়ি, ক্ষেত্র বিশেষে পরস্পরের বাপ মা তুলে গালি গালাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাস, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার খেলা, সরকারি আমলাদের দৌরাত্ম, বিরোধি দলের সংসদ বর্জন, সরকারি দলের পিতৃসম্পত্তি ভোগের মতো আচরণ, জনগণের দুর্ভোগ, অতিষ্ঠ জীবনযাত্রা, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, বিরোধি দলের প্রতিবাদি ভাষা অর্থাৎ হরতাল নামক নিষ্ঠুর এবং ভয়ানক তাণ্ডব, চাঁদাবাজি, স্বজন প্রীতি, দেশের সম্পত্তি পাচার, অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে বিশাল মাপের ফাঁকা বুলি.... ইত্যাদি। এর পরবর্তী সময়ে '৯৬ তে সাজানো নির্বাচন হল।

শুরু হল প্রতিবাদের ঝড়। আবার নির্বাচন হল। এবার ক্ষমতার মঞ্চে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের আগমণ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তাদের ক্রিয়াকলাপ আর দেশের পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হল না। যেই লাউ সেই কদু- এই প্রবাদকে সত্য প্রমাণ করে তারা তাদের শাসনকার্যের অতি পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব মনোযোগ ও নিষ্ঠার সংগে পালন করতে লাগলেন! (উৎসাহী পাঠকেরা তাদের কার্যক্রম জানতে উপরের মোটা হরফের অংশটুকু আরেকবার পড়ে নিতে পারেন!) যাই হোক, '০১ এ আবার নির্বাচন।

এবার ক্ষমতার গুরু দায়িত্ব পেলেন আগের দলটি যারা '৯১তে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ ঘটিয়েছেন! যেহেতু ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে তাই তারাও তাদের স্বকীয়তা এবং মৌলিকতা বজায় রেখে শাসন কার্য পরিচালনা করা শুরু করলেন। ফলাফল এবং পরিণতির সমীকরণ এবারো অপরিবর্তিত। উপরন্তু সহগ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নতুন চলক হিসেবে আগমণ ঘটল জেএমবি নামক বীরত্বপূর্ণ এক সক্রিয় এবং দায়িত্বশীল সংগঠনের। সাথে সাথে জাতি পেল এক অমূল্য সম্পদ। এক অসাধারণ মেধা।

যিনি তার মেধার বলে নতুন এক ভাষার সৃষ্টি করেছিলেন এবং সেই ভাষায় তার অমোঘ বাণী ছিল "উই আর লুকিং ফর শত্রুজ!" সেই সময়ে যে সরকার দেশের দায়িত্বে ছিলেন, তারা তাদের অতীত ঐতিহ্য এবং অসাধারণত্ব বজায় রেখে চললেন নির্দ্বিধায়। ফলাফল একই এবং তা হল শূণ্য। সেই সফল () সরকার দমন করল জেএমবি নামক কার্যকর সংগঠনটিকে। তাদের নেতা নেত্রীদেরও এক অসাধারণ বাণী ছিল- "দেশ উন্নতির জোয়ারে (নাকি সাইক্লোনে?) ভেসে যাচ্ছে!" এরপর আসল আরেক নির্বাচন। তখনই সৃষ্টি হল বিপত্তি।

গণতন্ত্রের পূজারী বাঙালী ক্ষমতায় দেখল এক "অগণতান্ত্রিক" সরকারকে (যাকে অনেকে সামরিক সরকারও বলে থাকেন)। সৃষ্টি হল নতুন কিছু চরিত্র। আজীবন ইয়েস ইয়েস করা বিশিষ্ট মৃত্তিকা বিজ্ঞানী কয়েকদিনের মাঝে হয়ে গেলেন দেশের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী! বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের একজন বিশিষ্ট গভর্নর হয়ে গেলেন দেশের ভাগ্য নিয়ন্তা! সাথে সাথে আবির্ভাব হল আই ইউ বা এরকম কোন নামের এক সামরিক প্রধানের যিনি কিনা অতীব গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন! পাশাপাশি দেশ দেখল একজন নির্বাচন কমিশনারকে, এক দুর্নীতি দমনকারী বাঘকে (যার বর্তমান পরিণতি নখ দন্তহীন বাঘ!)। জাতি আরো দেখল নতুন হুজুগ- সবাই দুর্নীতিবাজ-কারো জন্য কোন ছাড়াছাড়ি নাই। সেই সরকারের দুই বছরের শাসন কাল এ দেশের সম্পূর্ণ ভাগ্যকেই মোড় ঘুরিয়ে দিল।

অনেকেই বলে থাকেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনের ফলেই পরবর্তিতে আমরা একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন পেয়েছি। আমার কেন যেন মনে হয়, সেই সময়কার সবচেয়ে মজার ইস্যু ছিল মাইনাস টু! যাই হোক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অসাধারণ এবং বিচিত্র কার্যক্রমের পর হল নির্বাচন। বেরসিকের একশেষ বাঙালী নতুন ভাষার জনক আর সৌন্দর্য সচেতন নেত্রী এবং বাগবৈদগ্ধে পারদর্শী এক কাকা (নাকি অন্য কোন নাম?) চৌধুরী সংবলিত দলকে দেশের শাসনভার থেকে হটিয়ে দিল। সাথে সাথে ক্ষমতায় দেখা গেল আগেরই আরেকটি দলকে। যারা কিনা নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ রেখেছে ৯৬ এর পরবর্তি সময়ে।

কাণ্ডজ্ঞানহীন বাঙালী নতুন সরকারকে নিয়ে শুরু করল লাফঝাঁপ। সত্যি সত্যি এসময় মনে হচ্ছিল যেন দেশে নবযুগের সূচনা হয়েছে! আবারো যেন সত্যিকারের গণতন্ত্রের সুবাতাস পাওয়া শুরু করল সবাই। আর সে সুবাতাসে অবগাহন(!) করার আগেই বাধ সাধলেন এ সরকারেরই কয়েকজন। দেশ এবার আবিষ্কার করল- এ সরকার কথা একটু বেশি বলে। একটু না।

অনেক বেশিই বলে। সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-সাংসদের কথার ফুলঝুড়িতে চরম বিস্ময়ের স্বীকার হতে থাকল দেশের মানুষ। দশ টাকার চালের আশায় হা করে থাকা মানুষগুলো দেখতে শুরু করল জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির খেলা। বীরত্ব আর সাহসিকতার নতুন অধ্যায়ের আরম্ভ হল ছাত্রলীগ নামক এক অতীব ক্রিয়াশীল এবং প্রগতিশীল(চরম মাত্রার এবং অনেক-অনেক-অনেক) সংগঠনের দায়িত্বপূর্ণ আচরণের মধ্য দিয়ে। দেশের সেরা সেরা বিদ্যাপীঠগুলোতে শুরু হল প্রতিহিংসার খেলা।

আর এর জন্য খুন হল মহিউদ্দিনের মতো নির্দোষ কিছু ছেলে। (আরো কিছু লেখা যেত- কিন্তু ঐ বোল্ড অংশটুকু আবার পড়েন!) ফল শ্রুতিতে, একশ দিনের মাথায় তারুণ্যের শক্তিতে উজ্জীবিত এবং দিন বদলের শ্লোগানে আলোকিত এ সরকারের ক্রিয়াকলাপে দেশের মানুষগুলোর মাঝে শুরু হল আশা ভংগের বেদনা। যা এখন পরিণত হয়েছে পুঞ্জিভূত অসন্তোষে। সামনে আরো অনেক কিছুই ঘটবে। সমস্যা হল খুব ভালো কিছু ঘটবে বলে মনে হচ্ছে না।

দেশের সরকার আর বিরোধী দলের কাছে এখন ইস্যুর কোন শেষ নেই। (সকলের প্রিয় নেত্রীর বাড়ী ছাড়ার বিষয়টাও যেমন একটা ইস্যু) তারা এসব ইস্যু ব্যবহার করবেন। শুধু করবেন না। বেশ ভালভাবেই করবেন। আর এর জন্য বলি হতে হবে দেশের মানুষগুলোকে।

গণতন্ত্র তাই হয়তো আরো অনেকদিন শুধু কাগজে কলমেই থেকে যাবে। যাই হোক, তারপরও ভাল কিছুর জন্য প্রত্যাশা করা যাক। আশা করতে তো আর দোষ নেই। তাই না??? এ লেখা অনন্ত হওয়ার সুযোগ ছিল। এক বসায় লিখতে হল বলে অনেক কিছুই বাদ গেল।

কি আর করা?? লিঙ্কঃ নতুন এক ব্লগারের লেখাটা চমৎকার লাগল। বিষয়বস্তুর সাথেও বেশ সংযোগ আছে। পাঠক, ইচ্ছে করলেএখানে ঘুরে আসতে পারেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.