আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডায়াবেটিস ,একুশ শতকের মহামারী

একবার আপনারে চিনতে পারলে রে , যাবে অচেনা রে চেনা

ডায়াবেটিস এখন সবার কাছেই খুব পরিচিত একটি অসুখের নাম। সারা বিশ্বের মোট ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ এই অসুখে ভুগছে। শতকরা হিসাবে এটি মোট জনসংখ্যার ৬ শতাংশ। ধারণা করা হচ্ছে ২০২৫ সালের মধ্যে গোটা বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হবে। আমেরিকার মতো একটি উন্নত চিকিত্সা সুবিধার দেশে প্রতি বছর ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতায় মারা যাচ্ছে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষ।

বাংলাদেশের প্রায় ১৫ লাখ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। এই সংখ্যা সামনে আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশের পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসের ঝুঁকির মধ্যে আছে। ডায়াবেটিস কী? ডায়াবেটিস রোগটি মূলত বেশকিছু সমস্যার সমষ্টি যা শরীরে শর্করার বিপাক প্রক্রিয়া বিঘ্নিত করে। ডাক্তারি ভাষায় একে বলে ডায়াবেটিস মেলিটাস’।

প্রস্রাবের চারদিকে পিঁপড়ার সমাবেশ দেখে প্রাচীনকালে এই রোগটিকে বলা হতো সুইট ইউরিন ডিজিজ’। আমাদের প্রধান খাদ্যোপাদান হলো শর্করা। শর্করা ভেঙে হয় গ্লুকোজ। আবার আমিষ বা চর্বি জাতীয় খাবার ভেঙেও বিশেষ অবস্থায় গ্লুকোজে পরিণত হয়। গ্লুকোজ আমাদের শরীরের প্রধান জ্বালানি।

এসব গ্লুকোজের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে একটি হরমোন, তার নাম ইনসুলিন। ইনসুলিন আসে অগ্ন্যাশয় থেকে। এটি রক্ত থেকে গ্লুকোজকে কোষে সরিয়ে নেয়। কিন্তু যদি কোনো কারণে অগ্ন্যাশয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন তৈরি না হয় অথবা শরীরের কোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি যথেষ্ট সাড়া না দেয় তাহলে রক্তে গ্লুকোজের এই মাত্রা বাড়তে থাকে। এই অবস্থাকেই আমরা বলি ডায়াবেটিস।

ডায়াবেটিসের কারণ দুই ধরনের কারনে ডায়াবেটিস হয়্। একটা হলো জিনগত কারণ, অপরটি পরিবেশগত। বাবা-মা’র ডায়াবেটিস থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে অনেক বেশি। খাদ্যাভ্যাস ডায়াবেটিস রোগের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অধিক ক্যালরিযুক্ত খাবার, চর্বি জাতীয় খাবার ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।

স্থূলতা ডায়াবেটিসের একটি বড় কারণ। কিছু কিছু অসুখের কারণেও ডায়াবেটিস হয়। যেমন অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ বা ক্যান্সার। ডায়াবেটিসের দুই ধরন টাইপ-১ ডায়াবেটিস, টাইপ-২ ডায়াবেটিস। শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন তৈরি না হলে যেটা হয় তাকে আমরা বলি টাইপ-১ ডায়াবেটিস।

আর ইনসুলিনের প্রতি কোষের সংবেদনশীলতা কমে গিয়ে যে ডায়াবেটিস হয় তাকে বলি টাইপ-২ ডায়বেটিস। টাইপ-১ ডায়াবেটিস মূলত অল্প বয়স্কদের হয়। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সঙ্গে স্থূলতার একটি ভালো সম্পর্ক রয়েছে। বাচ্চাদেরও এই রোগ হতে পারে। তবে চল্লিশোর্ধদের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা বেশি— শতকরা ৭০ ভাগ।

আরেক ধরনের ডায়াবেটিস আছে। একে বলে গেসেল্টশনাল ডায়াবেটিস বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। যখন কোনো মায়ের গর্ভাবস্থায় প্রথমবারের মতো ডায়াবেটিস ধরা পড়ে তখন তাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলে। এই ধরনের ক্ষেত্রে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ রোগী পরবর্তী সময়ে স্থায়ীভাবে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। ডায়াবেটিসের লক্ষণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুরুতে রোগীরা বুঝতেই পারে না যে, তাদের ডায়াবেটিস হয়েছে।

কারও কারও ক্ষেত্রে ঘন ঘন পিপাসা লাগা, দুর্বল লাগা, ঠোঁট ও মুখ শুকিয়ে যাওয়া, ঘন ঘন ক্ষুধা লাগা, শরীর শুকিয়ে যাওয়া এসব লক্ষণ দেখা যায়। কেউ কেউ ডাক্তারের কাছে আসেন পায়ে, নখে, চামড়ায় বা যৌনাঙ্গে বিভিন্ন রকম ইনফেকশন নিয়ে। ডায়াবেটিস হলে মেজাজ খিঁচড়ে থাকে কারও কারও, মুড ওঠা-নামা করে। হাত-পা জ্বালাপোড়া করাও ডায়বেটিসের লক্ষণ। জটিলতা ডায়াবেটিসের জটিলতাগুলোই আসলে এই রোগের মূল সমস্যা।

পা থেকে মাথা পর্যন্ত এমন কোনো অঙ্গ নেই যেখানে ডায়াবেটিস তার ক্ষতিকর থাবা বসায় না। ডায়াবেটিসে সেল্ট্রাকের ঝুঁকি বাড়ে। চোখে রেটিনোপ্যাথি হয়ে চোখে কম দেখা, ঝাপসা দেখা, চোখের ছানিপড়া ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। হৃদরোগের ঝুঁকি এবং হার্ট অ্যাটাক হয়ে মৃত্যুর আশঙ্কা বাড়ে ডায়াবেটিস হলে। কিডনির সমস্যা, ধীরগতির কিডনি বিকল ডায়াবেটিসের অন্যতম জটিলতা।

বিশ্বের অনেক মানুষ ডায়াবেটিসের কারণে কিডনির সমস্যায় ভুগছে। ডায়াবেটিসে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে শরীরে বাসা বাঁধে নানা রকম ইনফেকশন। কখনও কখনও হয় পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি। তখন হাত-পা জ্বালাপোড়া করে, বোধশক্তি কমে যায়।

শরীরের মাংস পেশিগুলো শুকিয়ে দুর্বল হয়ে যায়। রোগ নিরূপণের উপায় খালিপেটে (ফাসিল্টং) রক্তের সুগার দেখে ডায়াবেটিস বোঝা যায়। খালি পেট মানে অন্তত ৮ ঘণ্টা না খেয়ে থাকা। খালি পেটে রক্তে সুগারের মাত্রা ৭ মিলিমোলের সমান বা বেশি হলে বুঝতে হবে ডায়াবেটিস আছে। ‘ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেসল্ট’ হলো ডায়াবেটিসের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা।

খালি পেটে ব্লাড সুগার দেখার পর ৭৫ মি. গ্রা. সুগার খাইয়ে দেয়া হয়। তার দুই ঘণ্টা পর আবার রক্তের সুগার দেখা। গ্লুকোজ খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর যদি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ১১.১ মিলিমোলের সমান বা বেশি হয় তাহলে ডায়াবেটিস হয়েছে ধরে নিতে হবে। গ্লুাইকেটেড হিমোগ্লোবিন বা ঐনঅ১ঈ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নির্দেশ করে। এটা রোগ নিরূপণে সাহায্য করে না।

চিকিৎসা সচেতনতা এবং সুশৃঙ্খল জীবনাচারণই ডায়াবেটিসের প্রধান চিকিত্সা। খাবার-দাবারে নিয়ম মেনে চলতে হবে। মিষ্টি খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। শাক-সবজি এবং আঁশ জাতীয় খাবার খেতে হবে। টকফল খাওয়া যাবে কিন্তু মিষ্টিফল কম করে খেতে হবে।

ধূমপান, অ্যালকোহল একদমই না। ভাত খাবেন খুবই কম। রুটির অভ্যাস করলে ভালো। দৈনিক ক্যালরি হিসাব করে খাবার খেতে হবে। প্রয়োজনে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেবেন।

ডায়াবেটিসের চিকিত্সা কেন্দ্রগুলোতে নিয়মিত যাতায়াত রাখবেন। চিকিত্সকের পরামর্শ নেবেন কোনো সমস্যা হলে। আর একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ তা হলো কায়িকশ্রম। দৈনিক হাঁটুন খোলা ময়দানে, পার্কে। সাইকেল চালান, সাঁতার কাটুন কিংবা সিঁড়ি ভাঙুন।

রক্তের গ্লুকোজগুলোকে পোড়াতে হবে কাজের মাধ্যমে। মনকে প্রফুল্ল রাখতে হবে, বিষণম্নতা ডায়াবেটিস বাড়ায়। খাওয়ার ওষুধ বা ইনসুলিন যাই হোক চিকিত্সা নিয়মিত চালাবেন। রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে থাকলে শরীরের সব অঙ্গই ঠিক থাকবে। মনে রাখবেন ডায়াবেটিস নিরাময়যোগ্য নয় তবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য।

নিয়ম মানলে একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। একুশ শতকের এই মহামারীকে রুখতে চাই সার্বিক সচেতনতা।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.