আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টেলিভিশন কেন দেখব, কেন দেখব না?

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

আমাদের দেশে এখন অনেকগুলো টেলিভিশন চ্যানেল। সংখ্যায় কতগুলো হবে? ২৫টি? ২৮টি নাকি ৩০ টি? জানি না। তবে আগে যেখানে কেবল বাংলাদেশ টেলিভিশন ছিল, সে তুলনায় এই সংখ্যা কিন্তু অনেক। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল, এতোগুলো টেলিভিশন চ্যানেল থাকা স্বত্ত্বেও একটি চ্যানেলও বিশেষায়িত চ্যানেল হতে পারলো না। সবগুলো চ্যানেলেই একই ধরনের বস্তাপচা অনুষ্ঠান।

কোনো নতুনত্ব নেই। সবচেয়ে বিরক্তিকর হল, যখন সংবাদ প্রচার শুরু হয়, প্রায় সবাই সংবাদ দেখায়। যখন বিজ্ঞাপন বিরতি শুরু হয়, তখন প্রায় সবার বিজ্ঞাপন বিরতি। যখন টক শো শুরু হয়, তখন প্রায় সবারই টক শো। যখন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান শুরু হয়, তখন সবার প্রায় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান।

যখন বাংলা সিনেমা দেখানো শুরু হয়, তখন প্রায় সবাই বাংলা সিনেমায় হাবুডুবু খায়। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর এই নাজুক দশার পেছনে কি কি কারণ থাকতে পারে? চলুন একটু আলোচনা করা যাক। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে যারা অনুষ্ঠান সূচি বানানোর দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলতে চাই, আপনাদের মাথায় কি নতুন কিছু নাই? যদি না থাকে তাহলে টেলিভিশন চ্যানেলের একজন অনুষ্ঠান বিষয়ক প্রযোজক বা এডিটর বা ম্যানেজার, আপনার পদমর্যাদা যা-ই হোক না কেন, আপনি কারো দয়ায় বা অনুরোধে এই চাকরিটা করছেন। এই চাকরিটা করার জন্য আপনি মোটেও উপযুক্ত কোনো ব্যক্তি নন। স্বজনপ্রীতি বা আত্মীয় বা বন্ধুত্ব বা কোনো এক সম্পর্কের জোরে আপনি এই পদটি দখল করে আছেন।

টেলিভিশনে কিভাবে দর্শক ধরে রাখতে হয়, সে বিষয়ে আপনার কোনো বিবেক নেই। বুদ্ধির কথা নাইবা বললাম। ফলে একই ধরনের প্রোগ্রাম দেখার জন্য দর্শক মোটেও বাধ্য নয়। দর্শকের হাতে থাকে শক্তিশালী এক রিমোট। যা দিয়ে দুনিয়ার অনেক চ্যানেল সে মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে।

তাই যখনই আপনি সংবাদের মাঝে উচ্চারণ করেন- 'সঙ্গেই থাকুন' বা 'দেখতে থাকুন' বা যতো ধরনের চালাকি করে বিজ্ঞাপন বিরতিতে যেতে চান, দর্শক সঙ্গে সঙ্গেই রিমোট বাটন চেপে পছন্দের বা অন্য কোনো প্রোগ্রাম খুঁজতে থাকে। তখন আর আপনার চালাকিটা কাজে লাগে না। আরেকটা জিনিস হল, টেলিভিশনের মনিটরে দর্শকের কিন্তু দুটো চোখ দিয়েই দেখার নিয়ম। আপনি যদি নিজেকে বেশি বুদ্ধিমান মনে করে একদিকে প্রোগ্রাম চালাতে থাকেন, নিচে স্ক্রলে সর্বশেষ সংবাদ এবং বিজ্ঞাপন চালাতে থাকেন, আবার মনিটর বিশেষ কায়দায় ছোট করে একপাশে বা দুইপাশে বিজ্ঞাপন চালাতে থাকেন, বা কোনো এক কোনায় একটা জিনিস কিছু সময় পরপর ফুটে ওঠে, এগুলো দর্শকদের নিশ্চয়ই বিরক্তি ধরায়। চোখের সমস্যা তো করেই।

আপনাদের প্রোগ্রাম দেখতে গিয়ে আমার চোখ নষ্ট করার সময় একদম নাই। দেশে আইনের যথাযথ ব্যবহার থাকলে, কোনো দর্শক টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে এই চোখ নষ্ট করার ফাজলামি সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে মামলা ঠুকে দিতো। ভাগ্যিস, আমাদের আইন-কানুন এবং তার প্রয়োগ ততোতা শক্তিশালী এবং কঠোর নয়। কিন্তু কোটি কোটি দর্শকের চোখ নষ্ট করার অপরাধে তাই আপনাদের কিছুই হয় না। সবগুলো চ্যানেলে একই সংবাদ দেখানোর মানে কি? কয়েকজন মন্ত্রী, কয়েকজন বিরোধীদলীয় নেতার প্রায় সারাদিনের সকল অনুষ্ঠান সবাই প্রচার করেন।

এটা খুবই বিরক্তিকর। টেলিভিশনে আমার সবচেয়ে প্রিয় অনুষ্ঠান শাইখ সিরাজের 'মাটি ও মানুষ'। সেখানে নতুনত্ব যেমন আছে, তেমনি নতুন নতুন বিষয়ও উঠে আসে প্রায়ই। টক শোতে সবচেয়ে বিরক্তিকর বিষয় হল, যখন আলোচনা জমে ওঠে, তখন যিনি অ্যাংকর তিনি বক্তাকে থামিয়ে দিয়ে বিজ্ঞাপন বিরতিতে চলে যান। আসল কথাটি আর বলা হয় না।

সবচেয়ে মজার বিষয় হল, যারা সম্মানিত আলোচক, তাদেরও কোনো ব্যক্তিত্ববোধ নেই। ওনারা তারপরেও অনুষ্ঠানে থাকেন এবং পরের দিন বা একই দিন অন্য চ্যানেলে আবার আলোচনার জন্য টক শোতে হাজির হন। অনেক আলোচক তো কি বলেন, নিজেরাই জানেন না। কিছুক্ষণ বগবগ করেন। আচ্ছা, আপনি-ই বলুন, সাদি মোহাম্মদকে কি রবীন্দ্রসঙ্গীত বাদ দিয়ে টেলিভিশন চ্যানেলে সবজি রান্না করতে দেখতে আপনার ভালো লাগবে? মিতা হককে গানের বদলে রাজনৈতিক বক্তৃতা দিতে দেখলে ভালো লাগবে? শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়াকে টেলিভিশনে কৌতুক বলতে বা গান গাইতে দেখতে ভালো লাগবে? ঈদের সময় আমাদের প্রায় সবগুলো টেলিভিশন চ্যানেল একই বস্তাপচা অনুষ্ঠান নিয়ে হাজির হয়।

কারো সাতদিন, কারো আটদিন, কারো ছয় দিন ব্যাপী ঈদের প্রোগ্রাম। কিন্তু কোনো প্রোগ্রামে কোনো নতুনত্ব নেই। তারপর বিজ্ঞাপনের বিরক্তিতে সেই বস্তাপচা অনুষ্ঠান দেখে সময় কাটাবেন, সে সুযোগও নেই। আমাদের দেশে সবাই নাট্যকার। সবাই পরিচালক।

যার যখন ইচ্ছে হয় নাটক বানায়। সেই নাটক আবার এই চ্যানেলগুলোতে দেখায়!! বছরে অন্তঃত যদি একটা ভালো নাটক দেখার সুযোগ পেতাম, কোনো আফসোস থাকতো না। কিন্তু সেই সুযোগ কোথায়? সেদিন, একাত্তর টিভিতে আমার দুইজন কাছের মানুষ একাত্তর জার্নালে কিছুক্ষণ কথা বললেন। একজন বিশিষ্ঠ নাট্যকার ও পরিচালক অনিমেষ আইচ। আরেকজন টেলিভিশন সংগঠক ও কবি, ও লেখক পারভেজ চৌধুরী।

আমার খুব দুর্ভাগ্য যে, এই দুইজন ব্যক্তিও টেলিভিশনে গিয়ে সরাসরি অনুষ্ঠানে কোনো নতুন কথা শোনাতে পারলেন না। বরং দুইজন যার যার পক্ষে আলোচনা করলেন। যা অনেকটা যাতে কেউ অখুশি না হন এমন একটা অবস্থা বজায় রেখে ভারী কৌশলে কথা বললেন। আমার কথা হল, তাহলে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা কে বাঁধবে? কারো একজন তো দায়িত্ব নিতে হবে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এখন নাটক বানানোর দিকে প্রচুর আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।

এটাই আশার আলো দেখায়। কিন্তু সবাইকে কেন নাটক বানাতে হবে? কেউ তো অন্য প্রোগ্রাম বানাতে পারে। নতুন নতুন হাজার হাজার সাবজেক্টে কাজ করা যায়। সেদিকে কারো আগ্রহ না দেখে আমি একটু হতাশ হই। টেলিভিশন চ্যানেল গুলো যদি তাদের অনুষ্ঠানে, সংবাদে এবং বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামে নতুনত্ব না আনে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এই চ্যানেলগুলো দর্শক হারাতে বাধ্য হবে।

সেই সুযোগে বিদেশী চ্যানেলগুলো ব্যবসা বাগিয়ে নেবে। আমাদের সরকার এবং দেশীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো'র এই বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল বা ডিসকোভারি চ্যানেলও কিন্তু বিজ্ঞাপন দেয়। কিন্তু তাদের সেই সেন্সটা যথেষ্ট উন্নত মানের। সেই সেন্সটা না থাকলে একশো প্রাইভেট চ্যানেল আসলেও দেশে টেলিভিশন প্রোগ্রামে কোনো বৈচিত্র্য আসবে না।

দর্শকেরও কোনো আগ্রহ থাকবে না। আমাদের বিশেষায়িত প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেল দরকার। যেমন শুধু মিউজিক নিয়ে মিউজিক চ্যানেল। শুধু সংবাদ নিয়ে সংবাদ চ্যানেল। শুধু টক শো নিয়ে টকশো চ্যানেল।

শুধু ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নিয়ে ম্যাগাজিন চ্যানেল। শুধু নাটক নিয়ে নাটক চ্যানেল। শুধু বাংলা সিনেমা নিয়ে সিনেমা চ্যানেল। খেলাধুলা নিয়ে খেলার চ্যানেল। নইলে এই জগাখিচুরি চ্যানেলের সংখ্যা যতোই বাড়ুক, কাজের কাজ কিছুই হবে না।

তবে হ্যা, যারা সেই চ্যানেলের মালিক থাকবেন, তাদের কর ফাঁকি বা রাজনৈতিক ব্যাপার স্যাপারে কিছু সুযোগ সুবিধার কৌশল বরাবরই থাকবে। যেমন সংবাদপত্রের মালিকগণ করে থাকেন। তাই টেলিভিশন চ্যানেলে নতুন নতুন বিষয় বিশেষায়িত হয়ে না আসলে দর্শক হারানোর পাশাপাশি অনেক কিছুই হারানোর সুযোগ রয়ে যাবে। সরকার ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো'র বিষয়টি নিয়ে নতুন করে এখনই ভাবার সময়।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।