আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিনেমা ফিল্ম মুভি - ২



আগের টুকু বিটিভি, সিনেমা হল আর ফিল্ম শো'র কথা লিখেছি আগের পোস্টে। আজকে শুরু করি ভিসিপি-ভিসিআর দিয়ে। এরপর দেখি কতদূর টেনে নেয়া যায়। বাসায় ভিসিপি কেনার পেছনে একটা ছোট ইতিহাস আছে। পয়লা বৈশাখে বিটিভিতে ছোটদের একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল যেখানে মেজপা অংশ নিয়েছিল।

অনুষ্ঠানটা আব্বা তার সিনিয়র কলিগকে দিয়ে রেকর্ড করিয়েছিলেন। সেটা দেখার জন্যই ভিসিপি কেনা হয়। বছর দুই-তিন পর এটার বদলে একটা ভিসিআর আনা হয়। যা হোক ভিসিপি আসার পর বাসায় হিন্দী সিনেমা দেখা শুরু হয়। আব্বা অফিস থেকে আসার সময় একটা-দুটা করে ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে আসতেন।

পাড়ায় পাড়ায় তখন ভিডিও ক্যাসেট ভাড়ার দোকান। হিন্দী শুরুতে প্রায় কিছুই বুঝতাম না। আব্বা আম্মা একটু একটু উর্দু জানতেন বলে মোটামুটি কাহিনীটা বুঝতে পারতেন আর আমাদের বুঝিয়ে দিতেন। দেখতে দেখতে এক সময় আমরাও হিন্দী বুঝতে শুরু করলাম। আব্বা বেছে বেছে অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা বেশি আনতেন।

তার আরেক প্রিয় নায়ক ছিল রজনীকান্ত। এজন্য এই দুই নায়কের সিনেমা দেখা হয়েছে অনেক। আমার কাছে সাদা-কালো সিনেমাই বেশি ভালো লাগত। দিলীপ কুমার, দেবানন্দ, সুনীল দত্তের অভিনয়ে মুগ্ধ ছিলাম। মধুবালা, মীনা কুমারী, বীনা রায়, মালা সিনহা এরা সবাই এত সুন্দর কী করে হয় তাই ভাবতাম।

কিশোর কুমারের চেহারা বা শারীরিক গঠন কোনটাই নায়কোচিত ছিল না, কিন্তু তার অভিনয় গুণেই তার ভক্ত ছিলাম। তার অভিনীত 'হাফ টিকেট' যতবার দেখি হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। দিলীপ কুমার-মীনা কুমারীর 'আজাদ' দেখে অবাক হয়েছিলাম ঐ সময়ে এমন দারুণ রোমাঞ্চক (আর রোমান্টিকও) একটা কাহিনী নিয়ে কিভাবে সিনেমা বানাল। আর দিলীপ কুমারের অভিনয়ে পুরোপুরি মুগ্ধ হওয়ার জন্য এই একটা সিনেমাই যথেষ্ট। একই সাথে একজন রহস্যময় সাহসী যুবক আর এক পাগলাটে বুড়োর অভিনয় সমান তালে করে গেছেন এখানে।

দিলীপ কুমার-দেবানন্দ-বীনা রায়ের 'ইনসানিয়াত' সিনেমাটাও ভালো লেগেছিল। আমাদের বিখ্যাত 'সিরাজউদ্দৌলা' সিনেমায় পলাশীর যুদ্ধের যে দৃশ্যগুলো আছে, সেগুলোর বেশির ভাগই 'ইনসানিয়াত' থেকে নেয়া হয়েছিল। নাম মনে থাকলে আরও অনেক সিনেমার কথা বলা যেত, কিংবা ডায়রীটা থাকলেও হত। ডায়রীটা ছিল মেজপার। ভিডিও ক্যাসেটে যত সিনেমা দেখা হত সবগুলোর নাম আর পাত্র-পাত্রীদের নাম ঐ ডায়রীতে লিখে রাখা হত।

দায়িত্বটা মূলত বড়পা পালন করত। মাঝে মাঝে ডায়রীতে কিছু কাঁচা হাতের লেখা পাওয়া যেত, সেটা কার বলব না । হারিয়ে গেছে মনে হয় ডায়রীটা। হিন্দীর পাশাপাশি বাংলা সিনেমাও দেখা হত। কিছু সিনেমার মাস্টার কপি আব্বা কিনে রেখেছিলেন।

এগুলো বারবার দেখা হত। এর মধ্যে ছিল সত্যজিত রায়ের 'পথের পাঁচালি', 'অপরাজিত', 'অপুর সংসার' (এই তিনটা আম্মার পছন্দে কেনা), 'সোনার কেল্লা' (মেজপার পছন্দে), 'গুপি গাইন বাঘা বাইন' (এইটা আমি বলেছিলাম আনতে)। আরও ছিল অমিতাভের 'দেশপ্রেমি', 'কুলি' (বোঝাই যাচ্ছে আব্বার পছন্দের)। ছোট ভাইয়ের কল্যাণে প্রতিটা সিনেমার প্রতিটা ডায়লগ বাসার সবার মুখস্থ ছিল। সে সারাদিন ধরে একটার পর একটা ক্যাসেট চালাতে থাকত।

খাবার সময় হলে আম্মাকে বলত, কুলি কুলি দেখতে খাব। আসলে বলতে চাইত, 'কুলি' দেখতে দেখতে খাব। এমন কি বাথরুমে গেলেও ভিসিআর ছেড়ে সাউন্ড বাড়িয়ে দিয়ে ঢুকত, আর সবাইকে বলে রাখত যেন কেউ সিনেমা বন্ধ না করে। আবার মাঝে মাঝে সিনেমার দৃশ্যের সাথে সাথে সে-ও অভিনয় করতে থাকত। 'দেশপ্রেমি'তে একটা দৃশ্যে অমিতাভের স্ত্রী ভারতী (চরিত্রের নাম) মারা যায়, অমিতাভ 'ভারতীইইইই' বলে চিৎকার করে তার উপর মাথা রাখে।

এই দৃশ্যটা এলেই ছোট ভাই 'বাত্তীইইইইই' বলে চিৎকার করে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত, আমি বসে আছি না শুয়ে আছি, পড়ছি না খাচ্ছি সেটা কোন ব্যাপার না। এই যে আবার সিনেমা ছেড়ে অন্য লাইনে রওনা দিয়েছি। ইংরেজী সিনেমা দেখার দর্শক বাসায় তেমন কেউ ছিল না। আব্বা নিজে দেখার জন্য মাঝে মাঝে নিয়ে আসতেন। আব্বার সাথে বসে আমিও দেখতাম।

আব্বার প্রিয় ছিল অ্যাকশন মুভি, বিশেষ করে ওয়েস্টার্ন। আব্বা ওয়েস্টার্ন মুভিকে বলতেন টেক্সাস মুভি। আমার কাছে ওয়েস্টার্ন মুভির সবগুলো একই রকম মনে হত। অন্যগুলো ভালোই লাগত। আব্বার সাথে দেখা সিনেমাগুলোর মধ্যে Guns of Navaron এই একটা নামই মনে পড়ছে এখন।

এরপর এল কেবল টিভি, বলতে গেলে নতুন এক দুয়ার খুলে গেল আমার সিনেমা দেখার। বাংলা, হিন্দী, ইংরেজী কী নেই। ভিসিআরটা আর কেউ ছুঁয়েও দেখত না। পড়ে থাকতে থাকতে নষ্টই হয়ে গেল বেচারা। এদিকে আমার সিনেমা দেখার হারও বেড়ে গেল।

বাংলা হিন্দীর চেয়ে ইংরেজীই বেশি দেখতাম, দেখতাম বলছি কেন, এখনও তা-ই দেখি। Star movies, HBO, Zee studio টিভি অন করলেই আগে এই তিনটা চ্যানেলে ঢুঁ মারি। এখন তো এমন হয় যে এসব চ্যানেলে যে সিনেমাই দেখায় আমি বলি, ওহ, আমিতো এটা আগেই দেখেছি। ইংরেজী সিনেমার ক্ষেত্রে প্রায়ই এমন হয় যে প্রথম কয়েকটা দৃশ্য দেখে তেমন আগ্রহ হয় না, কিন্তু একটু ধৈর্য্য নিয়ে বসে দেখলে পরে বেশ ভালো লাগে। এরকমই একবার হয়েছিল একটা সিনেমা দেখতে গিয়ে।

প্রথম দশ মিনিট দেখে এত বোরিং লাগছিল যে চ্যানেল পাল্টেই দিচ্ছিলাম প্রায়। ঠিক তখুনি নায়কের এমন জবরদস্ত আগমন ঘটল যে দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম এই সিনেমা পুরোটা না দেখে আমি রিমোট কন্ট্রোলে হাতই দিব না। জবরদস্ত আগমনটা কার ছিল আন্দাজ করতে পারেন? ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো। তখনও জানতাম না "Pirates of the Carribian" এমন সুপারহিট একটা সিনেমা। জনি ডেপের সিনেমা অবশ্য আগে থেকেই ভালো লাগত।

তাকে সব সময় একটু অন্যরকম চরিত্রে অভিনয় করতে দেখি। একটা সিনেমায় সে ছিল একটা চকলেট ফ্যাক্টরীর মালিক, একটু আজব কিসিমের, জাদু-টোনা জানে। আরেকটায় তার চরিত্র ছিল একটা রোবটের, যার আবিষ্কারক তার মধ্যে মানবীয় গুণাবলী ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু রোবটের হাত দুটো তৈরী করার আগেই বিজ্ঞানী মারা যান, আর রোবটের হাতের জায়গায় রয়ে যায় কতগুলো ধারালো ছুরি। ফ্যান্টাসী মুভির প্রতি একটু ঝোঁক আছে, তবে রুচিশীল কমেডি আর সামাজিক কাহিনীর মুভিগুলো আমার বেশি প্রিয়।

Monalisa Smiles, Corina Corina, Erin Brokovitch এই সিনেমাগুলো যেমন হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায়, তেমনি Baby's Day Out, See Spot Run, Home Alone, Beethoven, Bean, George of the Jungle এগুলো দেখে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা বানিয়ে ফেলি। Baby's Day Out নিয়ে একটু বলতেই হয়। এই সিনেমাটা প্রথম দেখেছিলাম যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, দেখছিলাম প্লেনে বসে। হাসির দমকে পেট ফেটে যাচ্ছে, সবার সামনে মন খুলে হাসতেও পারছি না, কারুর সাথে শেয়ারও করতে পারছি না, সে যে কী কষ্ট! বাসায় এসে সব ভাই-বোনকে একসাথে জড়ো করে পুরো সিনেমার প্রতিটা দৃশ্য একের পর এক বর্ণনা করে গেলাম। ওরাও দেখার জন্য অস্থির হয়ে গেল।

পরে সবারই কমপক্ষে ২০-২৫ বার করে দেখা হয়ে গিয়েছিল অবশ্য। অ্যাকশন মুভির মধ্যে Mission Impossible, Transporter এই ধরণের সিনেমাগুলো ভালো লেগেছে। তবে জানি না কেন জেমস বন্ডের অ্যাকশন দৃশ্যগুলো ভীষণ রকম মেকি মেকি লাগে। জ্যাকি চ্যানের সব সিনেমাই দেখতে মজা লাগে। হরর মুভি বেশির ভাগ একই রকম লাগে।

একটা দুটা দেখলেই বাকীগুলো আর দেখার আগ্রহ থাকে না, আর ভয়ও লাগে না। তবে একটা হরর দেখে সত্যি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম, The Grudge। রাতের বেলা একা বাসায় বসে দেখেছিলাম। এরপর কয়েকদিন এমন হয়েছিল যে একা থাকলেই ভয় লাগত। ভয়টা কিভাবে কাটানো যায় চিন্তা করতে করতে একটা পদ্ধতি বের করলাম।

ঐ মুভিটা আবারও দেখলাম, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। এইবার আগে থেকেই জানি কখন কী ঘটবে। পদ্ধতি ভালোই কাজে দিল, পুরোপুরি কেটে গেল সব ভয়। এবার আসি অ্যানিমেশন ফিল্মের কথায়, আমার সবচেয়ে প্রিয়। অনেকেই এই ব্যাপারটা নিয়ে হাসাহাসি করে যে আমি এই বয়সেও অ্যানিমেশন ফিল্মের পাগল।

তাদেরকে বোঝাতে পারি না অ্যানিমেশন ফিল্ম মানেই বাচ্চাদের ফিল্ম না। টারজান এটা নিয়ে এক সময় অনেক কিছু শোনাত আমাকে। একদিন ওকে নিয়ে জোর করে Surfs Up দেখতে বসলাম। প্রথম দিকে তো ভারী গজগজ করছিল, এই বাচ্চা-কাচ্চাদের সিনেমা আমাকে দেখাচ্ছ কেন, এসবে আমার কোন ইন্টারেস্ট নাই, হেন তেন নানান কথা। সিনেমার অর্ধেকটা যখন হয়ে গেছে তখন আমাদের খাওয়ার সময় হল।

আমি খাবার নিয়ে এসে টিভির সামনে বসলাম। দুই মিনিট পর দেখি টারজানও দৌড় দিয়ে খাবারের প্লেট নিয়ে এসে হাজির। সিনেমার বাকী অংশ সে আর মিস করতে চায় না। Finding Nemo, Happy Feet, Ice Age, Shrek, Kungfu Panda, Chicken Little, The Antz, Bug's Life, Wall E, Monster Inc., Flashed Away, Rattatoule, Barbie আরও যে কত নাম ভুলে যাওয়া অ্যানিমেশন ফিল্ম দেখেছি, সবগুলোই আমার প্রিয়। এখন সিনেমা দেখা তেমন হয়ে ওঠে না।

বাসায় গেলে টিভি ছেড়ে বসি, কোন চ্যানেলে কী সিনেমা দেখাচ্ছে দেখি। আর মাঝে মাঝে ডিভিডি জোগাড় করে দেখা হয়। আশা আছে কোন একদিন থ্রি ডি মুভিও দেখতে পারব।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.