আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি !

কোন সিস্টেম সাম্যাবস্থায় থাকা কালে যদি এর কোন নিয়ামক পরিবর্তন করা হয় তাহলে সিস্টেমের অবস্থান এমনভাবে পরিবর্তত হবে যেন সেই নিয়ামক পরিবর্তনের ফলাফল প্রশমিত হয়

বল বীর--- বল উন্নত মম শির ! শির নেহারি’ আমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির ! বল বীর— বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’ চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’ ভূলোক দ্যুলোক গোলোক ভেদিয়া, খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া, উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর! মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটিকা দীপ্ত জয়শ্রীর ! বল বীর— আমি চির-উন্নত শির ! আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত নৃশংস, মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধবংস, আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর, আমি দুর্বার আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার ! আমি আনিয়ম উচ্ছৃংখল, আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল ! আমি মানি না কো কোন আইন, আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন । আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর ! আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ববিধাত্রীর ! বল বীর – চির-উন্নত মম শির ! আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি ! আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল ! আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা ! আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর। বল বীর— আমি চির-উন্নত শির ! আমি চির-দুরন্ত দুর্মদ, আমি দুর্দম, মম প্রাণের পিয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ। আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি, আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।

আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান, আমি অবসান, নিসাবসান ! আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য, মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণ-তূর্য ! আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যাথা-বারিধির। আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর। বল বীর— চির-উন্নত মম শির ! আমি সন্যাসী সুর সৈনিক আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান-গৈরিক আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিশ, আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ। আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিশাণে ওংকার, আমি ঈস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুংকার, আমি পিণাক-পানির ডমরু ত্রিশূল, ধ্বর্মরাজের দন্ড, আমি চক্র ও মহাশংখ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড ! আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য, আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব ! আমি প্রাণ-খোলা হাসি-উল্লাস, --- আমি সৃষ্টি বৈরী মহাত্রাস, আমি মহা প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস ! আমি কভু প্রশান্ত, -- কভু অশান্ত দারুণ স্বাচ্ছাচারী, আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী। আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহা কল্লোল, আমি উজ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্বল, আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-উর্মির হিন্দোল-দোল ! আমি বন্ধন হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি, আমি ষোড়শির হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি।

আমি উন্মন মন উদাসীর, আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর। আমি বঞ্চিত ব্যাথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের, আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্চিত বুকে গতি ফের ! আমি অভিমানি চির-ক্ষুদ্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যাথা সুনিবিড়, চিত- চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর ! আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনী, ছল ক’রে দেখা অনুক্ষন, আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তার কাঁকন-চুড়ির কন-কন ! আমি চির-শিশু, চির-কিশোর, আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর ! আমি উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাস পুরবী হাওয়া, আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গান গাওয়া। আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি, আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়াছবি ! আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, একি উন্মাদ, আমি উন্মাদ ! আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়াছে গিয়াছে সব বাঁধ ! আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন , আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তি, মানব-বিজয়-কেতন। ছুটি ঝড়ের মত করতালি দিয়া স্বর্গ মর্ত্য করতলে ত্যাজি বোর্‌রাখ আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে ! আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি কালানল, আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল ! আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ, আমি ত্রাস সঞ্চারী ভুবনে সহসা সঞ্চারী’ ভুমিকম্প ! ধরি বাসুকির ফনা ঝাপটি’, ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি ! আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল, আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্বমায়ের অঞ্চল ! আমি আর্ফিয়াসের বাঁশরী, মহা সিন্ধু উতলা ঘুম্‌ ঘুম্‌ ঘুম্‌ চুমু দিয়ে করে নিখিল বিশ্বে নিঝ্‌ঝুম মম বাঁশরির তানে পাশরি’। আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।

আমি রুষে উঠি যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া, ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া ! আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া ! আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা, কভু ধরণীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা ---- আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু বক্ষ হইতে যুগল কন্যা । আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি, আমি ধুমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী। আমি ছিন্ত মস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী, আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি ! আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়, আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়। আমি মানব দানব দেবতার ভয়, বিশ্বের আমি চির-দূর্জয়, জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য, আমি তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য ! আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ !! আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ !! – আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার, নিক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার ! আমি হল বলরাম-স্কন্ধে, আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে ! মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেইদিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভুমে রণিবে না – বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেইদিন হব শান্ত । আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন ; আমি স্রষ্টা-সুদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।

আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন ! আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন ! আমি চির-বিদ্রোহী বীর— বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির ! _______________ বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.