আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিএনপির জন্ম যেভাবে সেনানিবাসে: ৩ সেনাছাউনিতে বিএনপির জন্মকে ষড়যন্ত্রমূলক বলেন আইজেনব্রাউন



স্টিফেন আইজেনব্রাউন জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করলেও সেনাছাউনিতে বিএনপির জন্মকে ষড়যন্ত্রমূলক বলেই মনে করেন। কারণ মওদুদ আহমদকে তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম বলে উল্লেখ করেন। আইজেনব্রাউন মার্কিন কথ্য ইতিহাসবিদ চার্লস স্টুয়ার্ট কেনেডিকে মশিউর রহমান যাদু মিয়ার সঙ্গে তাঁর বৈঠকের বিবরণ দেন এভাবে, ‘সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটতে লাগল। আমাদের রাষ্ট্রদূত তত দিনে আরও কিছু তথ্য জোগাড় করলেন। এমনকি তৎকালীন মার্কিন পলিটিক্যাল কাউন্সেলর ক্রেইগ বেক্সটারের কানেও কিছু কথা ভেসে আসতে লাগল।

কিন্তু আমি বিএনপির জন্ম-প্রক্রিয়া সম্পর্কে অব্যাহতভাবে তথ্য দিয়ে গেছি। কী পরিকল্পনা নেওয়া হবে, সে-সংক্রান্ত কোনো গুজবের ধার আমি ধারতাম না। গুজব সম্পর্কে দূতাবাসকে কোনো ধারণাই দিতাম না। সেই সময় ঢাকার অন্যতম বিশিষ্ট একজন তরুণ ব্যারিস্টার ছিলেন মওদুদ আহমদ। তিনি পরে বিভিন্ন সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

যা হোক, জেনারেল জিয়ার নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে মূল ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম ছিলেন মওদুদ। আমাকে বলা হয়েছিল, মওদুদ দলের গঠনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ’ প্রশ্নের জবাবে মওদুদ আহমদ এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেন, বিএনপি ও তার আগে গঠিত জাগদলের (জাতীয় গণতান্ত্রিক দল) গঠনতন্ত্রের রূপকার তিনিই। জিয়া-যাদু চুক্তি: মওদুদ আহমদ নিশ্চিত করেন, সংবিধানে ক্ষমতার বণ্টন প্রশ্নে জিয়াউর রহমান ও যাদু মিয়ার মধ্যে একটা মতানৈক্য দেখা দেয়। মোখলেসুর রহমান সিধু মিয়াও বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

তবে তিনি জানান, এ নিয়ে পরে জিয়া-যাদু লিখিত চুক্তি হয়েছিল। সিধু মিয়ার কথায়, ‘আমি বলেছিলাম জিয়াকে এ রকমভাবে সমর্থন দেওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে যাদু মিয়ার একটা চুক্তি হতে হবে এবং সেটা হতে হবে সংবিধানের ওপর ভিত্তি করে। সেই চুক্তিপত্রে যাদু মিয়া ও জিয়াউর রহমান দুজনেরই সই ছিল। চুক্তিপত্রটির দুটি কপি ছিল। একটা ছিল যাদু মিয়ার কাছে, আর একটা জিয়াউর রহমানের কাছে।

তৃতীয় একটা কপিও থাকতে পারে। খুব সম্ভব সেটা ছিল মেজর জেনারেল নুরুল ইসলামের কাছে। আমি দেখেছি, সেই কপিটায় ১২-১৩টা প্রস্তাব লেখা ছিল। তাতে সংসদের এবং প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কতটুকু থাকবে, তার বিবরণ ছিল। মোটামুটি একটা গণতান্ত্রিক সংবিধানের রূপরেখাই তাতে তুলে ধরা হয়েছিল।

তবে ওটার প্রথম খসড়াটা কার করা ছিল, সেটা আমি জানি না। ’ মওদুদ জানান, পঞ্চম সংশোধনীর খসড়া করেছিলেন আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী। পরে তিনি বিচারপতি হন। জিয়া-যাদু চুক্তির কপি কোথায় আছে, জানতে চাইলে যাদু মিয়ার ছেলে আনোয়ারুল গনি বলেন, ‘এটা আমরাও অনেক খুঁজেছি, পাইনি। এটা ছিল ইংরেজিতে, এপিঠ-ওপিঠ হাতে লেখা।

এক পৃষ্ঠা। এক বা দুটি বাক্য বাংলায় ছিল। চুক্তিতে জিয়া ও বাবার সই ছিল। এই চুক্তি আমি দেখেছি। আমার বোন রিতার কাছে একসময় ছিল।

’ এ বিষয়ে সিধু মিয়া ’৮৫ সালে তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘যাদুর মৃত্যুর পর আমি ওই চুক্তির কপি খোঁজ করেছি। যাদুর শোবার ঘরে আলমারির ওপর একটা স্যুটকেসের মধ্যে ওটা রাখা ছিল। কিন্তু এত খুঁজেও ওটা পাইনি। ’ বাহাত্তরের সংবিধান নয়: সিধু মিয়ার কথায়, ‘একদিন যাদু মিয়া আমার কাছে একটা জরুরি চিঠি পাঠায়। এতে বলা হয়, সংবিধান ও অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

আমি তো একা সামাল দিতে পারছি না। আপনি তাড়াতাড়ি আসেন। আমি তাড়াতাড়িই গেলাম। অবশ্য আমি যাওয়ার আগেই জিয়াউর রহমান সাহেবের সঙ্গে যাদু মিয়ার নানা রকমের আলোচনা হয়ে গেছে। বাহাত্তরের সংবিধানে তিনি ফিরবেন না।

তাঁর হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা চাই। জিয়ার প্রথম কথা, তাঁকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট করা হোক। প্রেসিডেন্ট এবং সংসদের ক্ষমতা কেমন হবে, তা নিয়েও কথা হলো। ফরাসি, জার্মানি ও পাকিস্তানের সংবিধান ইত্যাদি নিয়েও আলাপ হয়। ’ মওদুদ আহমদও জানান, তখন এসব দেশের সংবিধান, বিশেষ করে ফরাসি ও তুরস্কের সংবিধানের মডেল নিয়ে আলোচনা হয়েছিল।

এ বিষয়ে মওদুদের সঙ্গে কথোপকথনের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো। প্রথম আলো: সংবিধান নিয়ে কী ঘটেছিল? মওদুদ: আমি ও যাদু ভাই সংকল্পবদ্ধ ছিলাম, দেশকে তাড়াতাড়ি গণতন্ত্রে ফিরিয়ে নিয়ে যাব। সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা করব। সুতরাং আমরা যখন প্রস্তাব দিলাম, দলের সব কমিটি চেয়ারম্যানই (জিয়া) ঠিক করবেন, তখন যাদু ভাই এটা পছন্দ করেননি। তাঁর অপছন্দ এতটাই ছিল যে এ জন্য তিনি মন্ত্রিসভার তিনটি বৈঠকে আসেননি।

প্রথম আলো: কোন বিষয়টি তিনি পছন্দ করেননি? মওদুদ: পুরো নির্বাহী ক্ষমতা জিয়াকে দেওয়া। আমি জিয়ার হাতে সব ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে ছিলাম। কারণ জিয়াকে দিয়েই তো আমাদের গণতন্ত্রটা ফিরিয়ে আনতে হবে। সুতরাং তাঁর অবস্থানটি নিরাপদ রাখতে হবে। আমি তাঁকে প্রশ্ন করি, দলে গণতন্ত্র আগে, না দেশের গণতন্ত্র আগে? দেশে গণতন্ত্র আগে চাইলে জিয়াকে আত্মবিশ্বাস দিতে হবে।

তিনি উর্দি ছাড়বেন। তাই তাঁর ভরসা চাই। এক প্রশ্নের জবাবে মওদুদ আহমদ বলেন, রাষ্ট্রপতি ও সংসদের ক্ষমতার ভারসাম্য প্রশ্নে যাদু মিয়ার সঙ্গে যে সমঝোতা হয়েছিল, তা পরে রক্ষা করা হয়। যাদু মিয়ার পারিবারিক সূত্র বলেছে, সেটা করা হয়নি। স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার কথাও ছিল।

এরশাদ পরে উপজেলা করেন। আর সেটা ওই চুক্তির আলোকেই। তবে ’৯১ সালে সংসদীয় ব্যবস্থায় ফেরার সময় জিয়া-যাদু চুক্তির কথা উঠেছিল। উল্লেখ্য, জিয়া পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ৯২(ক) অনুচ্ছেদ যুক্ত করেন। এটা ’৯১ সালে বিলোপ হয়।

এই অনুচ্ছেদটি দিয়ে জিয়া সংসদকে পদানত রাখেন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের রায় থেকে দেখা যায়, এতটা বেপরোয়া স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা ভোগের চিন্তা মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের নিকৃষ্ট স্বৈরশাসকেরাও করেননি। বিরোধী দল সৃষ্টি: সিধু মিয়ার দাবি, গণতন্ত্রে বিরোধী দল রাখার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি পরামর্শ দেন। তাঁর বর্ণনায়, ‘তারা আমার কথাটা খুব ভালোভাবে নিয়েছিল। কিছু কিছু লোক সংসদে এসেছিলেন নিজেদের জোরে।

আর কিছু কিছু জায়গায় ব্যাপারটা একটু অন্যভাবে ঘটেছিল। যেমন, সবুর সাহেবের কথাই ধরুন। তিনি মুসলিম লিগার। তাঁর সঙ্গে এ রকমের চুক্তি হয়েছিল, তাঁকে তিন জায়গা থেকে পাস করিয়ে আনতে হবে। সেটা রক্ষা করা হয়েছিল।

রংপুরে মুসলিম লীগের কাজী আবদুল কাদেরের কথাই ধরা যাক। সেখানে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছিলেন যিনি, তিনিই আমাকে বলেছিলেন, তাঁকে টাকা দেওয়া হয়নি। শুধু তা-ই নয়, তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি কর্মকর্তারা পর্যন্ত কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগের কিছু লোক নিজেদের শক্তির বলেই এসেছেন। ফলে একটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিরোধীদলীয় সদস্য সংসদে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন।

তাঁদের সংখ্যা ছিল ৮০ জনের মতো। সিনিয়র মিনিস্টার যেভাবে: যাদু মিয়াকে প্রধানমন্ত্রী না করা এবং তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর যোগসূত্র সম্পর্কে ওই সময়ই রাজনীতিতে একটা গুঞ্জন তৈরি হয়। এমনকি যাদু মিয়ার চিকিৎসা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এই প্রশ্ন যাদু মিয়ার পরিবারের কাছে এখনো রয়েছে। অনেকে মনে করেন, জিয়ার কাছে ওই সময় কট্টর ইসলামপন্থীদের খুশি রাখার প্রশ্ন ছিল বড়।

সে জন্য শাহ আজিজের গ্রহণযোগ্যতা ছিল বেশি। যাদু মিয়া ছিলেন ভাসানী অনুসারী পিকিংপন্থী। জানা যায়, আতাউর রহমান খানও যাদু মিয়ার সঙ্গে সেনানিবাসের বাড়িতে বৈঠক করেছেন। তবে তিনি দলে যোগ দেননি। আতাউর রহমান খান পরে লিখেছেন, ‘জিয়া আমাকে দলে ভেড়াতে এক বছর চেষ্টা চালান।

যাদু মিয়া আমাকে ফুসলিয়েছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে খুবই শক্ত থাকতে বলেন। শক্ত ছিলাম। তারপর জিয়াকে বাগিয়ে তিনি মন্ত্রিত্বে ঢুকে পড়েন। ’ যাদু মিয়াকে কেন প্রধানমন্ত্রী করা হলো না? জবাবে মওদুদ বলেন, তিনি জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছিলেন।

কথা ছিল ’৭৯ সালের নির্বাচনের পর তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং তিনি তা হতেনও, যদি তাঁর মৃত্যু না ঘটত। অন্য কারণ ছিল নাকি? মওদুদের জবাব, ‘না অন্য কারণ ছিল না। তাঁর মৃত্যু না ঘটলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতেন। তাঁর প্রটোকল ছিল সিনিয়র মিনিস্টারের। শুধু নির্বাচনের কারণে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়নি।

সংবিধানে সিনিয়র মিনিস্টার বলতে কিছু ছিল না। সংবিধান ফিরে এলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন। এটাই ছিল কথা। ’ মওদুদ এ বিষয়ে তাঁর দুটি বইয়ে দুই রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ২০০১ সালে মওদুদ লিখেন, ‘মশিউর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু পরে জিয়া মত পাল্টান। অনেক প্ররোচনার পর জেনারেল নুরুল ইসলাম (শিশু) যাদু মিয়াকে সিনিয়র মিনিস্টার পদ গ্রহণে সম্মত করান। ’ উল্লেখ্য, সেনাছাউনিতে বিএনপি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী জেনারেল নুরুল ইসলাম। সম্প্রতি ঢাকা সফরে আসেন। এ সময় তিনি তাঁর বাড়ি বিক্রি করেন বলেও জানা যায়।

যাদু মিয়ার পারিবারিক সূত্র বলেছে, নওরতন কলোনির এক বাড়িতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে শিশু যাদু মিয়াকে জিয়ার প্রস্তাব পৌঁছে দিয়েছিলেন। সিধু মিয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘একদিন যাদু মিয়া আমাকে দুঃখ করে বলেছিল, “আমি তো শাহ আজিজকে নিয়ে গেলাম সংসদ আর প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কী হবে, কতটুকু হবে, সে ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য। এ রকমের একটা ধারা ছিল যে প্রেসিডেন্টই প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করবেন; কিন্তু সংসদে গিয়ে তাঁকে ৩০ দিনের মধ্যে আস্থা ভোট নিতে হবে। শাহ আজিজ ওখানে বসে ছিলেন। তিনি জিয়াকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, স্যার, এর আবার কী দরকার? আপনি নমিনেট করবেন, আস্থা ভোটের কী দরকার? ইয়োর নমিনেশন ইজ এনাফ।

” যাদু বলল, “তাঁকে নিয়ে গেলাম আমি, আর সে গিয়ে কিনা আমার বিরুদ্ধেই কথা বলতে শুরু করল জিয়ার কাছে। ” এসব ব্যাপার নিয়ে যাদু মিয়া শাহ আজিজ সম্পর্কে হতাশা বোধ করতে শুরু করে। কিন্তু তখন আর উপায় ছিল না। ’ সিধু মিয়া বলেন, ‘নির্বাচনের পর জিয়া অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হন। যাদুর কাছে ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার অফার আসে।

কিন্তু যাদু বলছিল, সে অন্য কিছু নেবে না। এ নিয়ে খুব গোলমাল হলো। যাদু মিয়ার মৃত্যুর কিছুদিন আগে টঙ্গীতে একটা সভা ছিল। সেখানে সে বক্তৃতা করেছিল। সেই সভা চলার সময়ই সে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে।

তার খুব উচ্চ রক্তচাপ ছিল। মানসিক উত্তেজনা থেকেই সেটা আরও বেড়েছিল। ’ অভিনন্দন জানাতে পারিনি: আইজেনব্রাউন তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘১৯৭৮ সালের জুনের কথা। জিয়ার নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের গুজব শহরময় রটে গেছে। আর আমি তখনো যাদু মিয়ার কাছ থেকে ভেতরের স্কুপ পেয়েই চলেছিলাম।

এক কিংবা দুই সপ্তাহ আগে যাদু মিয়া আমাকে বললেন, জিয়াউর রহমান একটি মন্ত্রিসভা, একটি রাজনৈতিক দল গঠন ও সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছেন। যাদু মিয়ার কাছ থেকেই অধিকাংশের নাম জানলাম, কারা মন্ত্রিসভায় থাকছেন এবং তাঁদের কাকে কী দায়িত্ব দেওয়া হবে। তিনি আমাকে বলেননি, কে হতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী। আমি এ বিষয়ে যাদু মিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু যাদু মিয়া বললেন, জিয়া এখনো সিদ্ধান্ত নেননি, কে হবেন মন্ত্রিসভার নেতা? একদিন দিল্লিমুখী দুপুরের ফ্লাইট ধরতে বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দেব।

যাওয়ার আগে আমি সংবাদপত্রের দিকে নজর দিচ্ছিলাম। দেখলাম, বড় হরফে শিরোনাম—জেনারেল জিয়া একটি নতুন রাজনৈতিক দল ও মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। শিগগিরই সংসদ নির্বাচনের অঙ্গীকার করেছেন। চিফ মিনিস্টার যাদু মিয়া। আমি কখনো তাঁকে অভিনন্দন জানাতে পারিনি।

তবে আমি শুনেছিলাম, কয়েক মাস পর যাদু মিয়ার স্ট্রোক হয়। ১৯৭৯ সালের মার্চে তিনি মারা যান। ’ মৃত্যুর পর অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদায় তাঁর দাফন হয়েছিল। ব্যারাকে ফেরা নয়: পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরের ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লবে’ জিয়ার উত্থান। পঁচাত্তরের নভেম্বরে দেওয়া ভাষণে জিয়া বলেছিলেন, ‘সামরিক বাহিনী রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকবে, সামরিক সরকার কোনো রাজনৈতিক দলের নয়।

’ এর পর থেকেই অন্যদের মতো মার্কিন কূটনীতিকেরাও নজর রাখছিলেন, ’৭৭ সালের ফেব্রুয়ারির প্রতিশ্রুত সংসদ নির্বাচন জিয়া করবেন কি না। ’৭৬-এর ডিসেম্বরে তিনি হঠাৎ নির্বাচন স্থগিত করেন। এর অনেক আগ থেকেই তিনি মোশতাক-ফারুক-রশীদের ধারাবাহিকতায় মার্কিন সরকারের সঙ্গে দোস্তি গড়ে তোলেন। মার্কিনদের কাছে তাই স্পষ্ট ছিল যে, জিয়া রাজনীতিতে আসছেন। জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে ওই সময়ে মার্কিন কূটনীতিকদের বেশ যাতায়াত (’৭৬-এর ২৪ নভেম্বরের এক সন্ধ্যাকালীন বৈঠকে এরশাদ ও রওশন এরশাদকেও দেখা যায়) ছিল।

আরভিং চেসল ছিলেন আইজেনব্রাউনের অন্যতম বস। মার্কিন দূতাবাসের তখনকার ডেপুটি চিফ অব মিশন। ২৮ অক্টোবর, ১৯৭৬ চেসল ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠান: গত জুনে জিয়া একবার আমন্ত্রণ জানান। এবারে আরও অনানুষ্ঠানিকতায় গত রাতে আমি ও আমার স্ত্রী এক চা-চক্রে জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে গেলাম। জোড়া দম্পতির সম্মিলন।

আমরা ছাড়া জিয়া ও বেগম জিয়া। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল থেকে এল আমেরিকান ক্লাব স্যান্ডউইচ। আন্তরিকতার ছোঁয়া ছিল। আলোচনা হলো সাড়ে চার ঘণ্টা। চেসল লিখেছেন, ‘সবশেষে বললাম, আমি যদি এখন শহরময় রটে যাওয়া এই শখের প্রশ্নটা না করি, তাহলে আপনি হয়তো বেজার হবেন।

প্রশ্নটি হলো, আপনি দেশের রাজনৈতিক অবস্থা কেমন দেখছেন? নির্বাচনের সম্ভাবনা কতটুকু? জিয়া বললেন, আপনাকে গোপনীয়তার সঙ্গে বলছি, সারা দেশ সফর করে বুঝতে পারছি যে, অধিকাংশ জনগণ ও রাজনীতিক এখনই নির্বাচন চায় না। তবে তিনি নিশ্চিত নন যে, নির্বাচন স্থগিত করা হলে তার ফল কী দাঁড়াবে? জিয়া কৌতুকভরে জানতে চাইলেন, আমার কোনো পরামর্শ আছে কি না? আমি কৌতুক না করে বললাম, এ ধরনের উচ্চমাত্রার জটিল বিষয়ে আমি কোনো ধারণামূলক উত্তর দেব না। আমি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত ইউপি নির্বাচনের প্রসঙ্গ টানলাম। জিয়া এ বিষয়ে অত্যন্ত উচ্চ আশাবাদ ব্যক্ত করলেন। বললেন, এর মাধ্যমে বিরাট সুফল মিলবে।

তবে জিয়া এ কথাও বললেন যে, তিনি নিশ্চিত নন যে ইউপি নির্বাচন দিয়ে জাতীয় নির্বাচন চার থেকে পাঁচ মাসের বেশি (জিয়া সম্পূর্ণ অনুকূল পরিবেশে দুই বছর পরে ’৭৯ সালে নির্বাচন দেন। পঞ্চম সংশোধনী পাস করেন) স্থগিত করা যাবে কি না। চেসল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো ওই বার্তায় (নম্বর ১৯৭৬ ঢাকা এ০৫৫৪৫) মন্তব্য করেন, ‘এর আগে ও গত রাতে জিয়ার সঙ্গে আলোচনার মধ্যে একটা বড় ফারাক ঘটে গেছে। তাঁকে আগের চেয়ে অনেক কম সেনা অধিনায়ক মনে হলো। তিনি এখন অনেক বেশি নিরুদ্বেগ, সংকল্পবদ্ধ, আত্মবিশ্বাসী ও পেশাদার রাজনৈতিক নেতা।

এই নতুন লোকটি আর ব্যারাকে ফিরে যাচ্ছেন বলে আমি মনে করি না। ’ দেলোয়ার যখন একান্তে: আইজেনব্রাউন তাঁর সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, ‘৯৬ সালে আমি দ্বিতীয়বার চাকরির সুবাদে ঢাকা যাই। রাষ্ট্রদূত আয়োজিত এক নৈশভোজে বিএনপির কতিপয় জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটে। আমি সিদ্ধান্ত নিই, তাঁদের দল গঠনে আমার জানা সেই ইতিহাস আমি তাঁদের কাছে ব্যক্ত করব। তবে ১৮ বছর পরও এ বিষয়ে ঢাকার রাজনীতিতে একটা রাখঢাক ভাব আমি লক্ষ করেছিলাম।

সে কারণে আমি একজন ভদ্রলোককে বেছে নিলাম। মনস্থির করলাম, তাঁর কাছেই সব খুলে বলব। তিনি খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। তিনি একাগ্রতার সঙ্গে মনঃসংযোগ করলেন। কোনো প্রশ্ন না তুলে আমার কথা শুনে গেলেন।

আমি যখন বলা শেষ করলাম, তখন মন্তব্য করলেন, আপনার বিবরণ সঠিক। আপনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই সবকিছু ঘটেছিল। ’ (শেষ) সংশোধনী: গত ১৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত প্রথম প্রতিবেদনে ন্যাপ গঠনের তারিখ ১৯৭৫ ছাপা হয়েছে। এটা হবে ১৯৫৭। অনিচ্ছাকৃত এ ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত।

Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.