আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটুখানি আমার ঈদ



অফিসে ছুটি চাইলাম। নিউজ এডিটর বললো, এই ঈদে ছুটি নিলে কুরবানীর সময় নিতে পারবা না। খুবই খারাপ লাগলো। সেই কতোদিন আগে গ্রাম দেখেছি! বুনো ঝোপের ভেতর থেকে ভেসে আসা অদ্ভুদ ঘ্রান। বুক কেমন করা সন্ধ্যা, জ্যোৎস্নার ঝিলিমিলি, কত কত মানুষের প্রতীক্ষা, সব শেষ।

সাংবাদিকদের জীবনটা এমন কেন? বললাম কুরবানিতেই যাবো। তখন যাওয়া বেশি জরুরি। ঈদের দিনও কাজ করার জন্য বললো চীফ রিপোর্টার। ভারী অভিমান হলো। অনলাইন দৈনিক আবার নিউজ এজেন্সি।

অফিস বন্ধ হওয়ার সুযোগ নেই। আমার অন্য আরেকভাইয়ের পরিবারের সাথে ঈদের আনন্দময় সময় কাটানোর জন্য সুযোগ হোক। বললাম, ঈদের ৩দিনও কাজ করবো। নিউজ এডিটর (প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট) মাকছুদ ভাই বললেন, পথের ধারে বসবাস করা মানুষ কিভাবে ঈদ কাটায় তার উপর একটা স্টোরি দাড় করান। বিষয়টি আমারও ভালো লাগলো।

ঈদের দিন তাই নামাজ পড়েই বেরিয়ে পড়লাম। ঘুরলাম গুলিস্তান, মতিঝিল, শাহজাহানপুর, মগবাজার সহ বিভিন্ন এলাকা। এরপর দাড় করালাম ‘বিত্তহীনদের ঈদের দিনলিপি’। এটাই আজ আপনাদের জন্য। প্রকাশিত হওয়া প্রতিবেদনটি এডিটের আগের অবস্থায় হুবুহু তুলে ধরা হলো- শাওয়ালের বাঁকা চাঁদের বাহনে ঈদ এসেছে ফের।

প্রাণে প্রাণে বইয়ে দিচ্ছে অসীম আনন্দের দুর্লভ ধারা। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের জীবনে তা কোন ছাপ ফেলতে পারে না। এ দিনটিও তাদের কাছে অন্য একটি দিনের মতো জীবন টেনে নেয়া কতগুলো মুহূর্ত ছাড়া কিছু নয়। ঈদের দিন সকাল সাড়ে এগারোটার মতিঝিলের কালভার্ট রোডের মুখে কথা হয় সোহেলের সঙ্গে। বয়স পঁচিশের মতো, বাড়ি নোয়াখালী।

ছোটবেলা থেকেই পথেই থাকেন। কথা বলতে চাইলে তার একটা পরিস্কার গেঞ্জি বিছিয়ে বসতে দেন। বসতেই আরো চার-পাঁচজন ছুটে আসেন। সোহেল জানান, আমরা সবাই একসাথে থাকি। আমার ভাই সজিব, ভাবী রূপালী, আমার বউ ইতি, এ ভাইয়ের ছেলে হৃদয়, এইডা সজিব আমগো লগে থাকে।

এদের কাউকে ঈদ স্পর্শ করেনি। জিজ্ঞেস করি ঈদ কেমন কাটছে, কি কি কিনেছেন? সোহেল একটা পোটলা থেকে সেমাই, চিনি বের করে বলেন, এইগুলা কিনছিলাম পাতিল নাই তাই রানতে পারি নাই। নতুন কাপড় কেনেননি। প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলেন সোহেল? অস্বস্তি লাগে। উঠে দাড়াই।

মাত্র কয়েক মিনিটেই আপন করে নেয়া ছোট্ট হৃদয়, পেছন থেকে ডাকে- মামা, মামা। ফিরি না। সোহেল হয়তো তখনো হাসছে। সচিবালয়ের সামনে ওসমানী উদ্যানের উত্তর-পূর্ব কোনে ডেরা গেড়েছেন, সোহাগ মিয়া। দুপুরের দিকে তিনি, ছোট্ট বাচ্চার সাথে শুয়ে শুয়ে খুনশুটি করছিলেন।

পাশেই তার স্ত্রী কাঁথা সেলাই করছিলেন। জিজ্ঞেস করি- নাম বাচ্চার কি। উঠে বসেন সোহাগ। বলেন, মাইয়ার নাম আমার মরিয়ম। আজ তো ঈদ? শুনেই সোহাগ মিয়া দূরে আকাশের দিকে তাকান।

নগরভবন পেরিয়ে আরো দূর আকাশে, যেখানে বিন্দুর মতো কয়েকটি চিল উড়ছে। তারপর বলেন, ঈদ আর কি তাতো বুঝতাছি না। এইডা বুঝি যে, আরো একটা দিন আইছে। সোহাগ মিয়া আর কথা বলতে আগ্রহ পান না। বাচ্চাটা তার নাক খামছে যাচ্ছে অনবরত।

উঠে আসা ছাড়া উপায় কি আমার। এজিবি কলোনীর উত্তর পাশের রাস্তায় পলিথিনের ঝুপড়ির সামনে বসে আছেন তিন বৃদ্ধা। আমেনা, সমেলা ও লালবিবি। সবার বাড়ি জামালপুর। কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বসতেই আমেনা ছোটেন সেমাই আনতে।

কোন মানাই শোনেন না তিনি। কতদিনের আপন যেন! বলেন- তুই আমার নাতির মতোন। একটু পরেই আমেনা বেগমের ছেলে সুজন ফেরেন। কোলে ছোট্ট ছেলে ‘শুভ’। সুজন বলেন, ভাই ঈদে কারো জন্যই কিছু কিনতে পারি নাই।

পুরা রোজার মাস অসুখে ভুগছি। পাশে কখন তার বউটা এসে দাড়িয়েছে টেরই পাইনি। তাকাতেই মাথার উপর থাকা মলিন আঁচলটা অযথাই একটু টেনে দিলো। ঈদের বর্ণিলতার ছাঁট এসে লাগেনি এদের কারো জীবনপটে। টিএন্ডটি কলোনীর পেছনের রাস্তায় অসংখ্যা পলিথিনের খুপড়ি।

ঈদের দিন ১২টার দিকে গিয়ে দেখা গেল সেখানে দুই নারীর মধ্যে তুমুল ঝগড়া। ঝগড়া পেরিয়ে সামনে যেতেই দেখা গেলে খুপড়ির ভেতর রোগকিষ্ট একটা শরীর। রুকুর ভঙ্গিতে নুয়ে ভালো করে চোখ রাখতেই দেখা গেল, একজন নারী অসুস্থ এক ব্যক্তির শরীর মুছে দিচ্ছেন। জানা গেল, তাদের বাড়ি বরিশাল। সুপারি গাছ কাটতে গিয়ে তার নিচে পড়ে আহত হয়ে বামপাশ অবশ হয়ে গেছে তছলিম হোসেনের।

চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব। এখন পথই ঘরবাড়ি। পাশেই ছিলো তাদের দুই বছরের ছেলে রহিম। চোখদুটি তার ছল ছল। ঈদের কথা তুলতে আর ইচ্ছে হয়নি।

তুলিওনি। শহিদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়কে সূর্যের হাসি কিনিকের পাশে রুবিনা বেগম তার এক বছরের মেয়েকে পান্নাভাত চটকে খাওয়াতে খুব চেষ্টা করছিলেন। কিছুতেই খাচ্ছিল না। রুবিনা বলেন, মাইয়ার বাপ ছাইড়া গেছে। এই রাস্তায়ই থাহি।

আমাগো আবার ঈদ কি ভাই?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।