আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিধাতা

তোমাদের পাগল বন্ধু এনায়েত চৌধুরী সাহেব বাসার বারান্দায় একটা ঝুলন চেয়ারে এলিয়ে আছেন অলস ভঙ্গিতে। চশমাটা খুলে পাশের টুলটার ওপর রেখেছেন, পানের বাটার পাশেই। সন্ধ্যা অনেক গড়িয়েছে। এশার আযান দেবে একটু পরেই। বাহিরে উলটো পালটা বাতাসের ছোটা ছুটি।

উঠানের কামরাঙা গাছটার পাতা উড়িয়ে এনে বারান্দায় ফেলছে। কারেন্ট যাবে যাবে অবস্থা। বারান্দার হলুদ লাইটটা এর মাঝেই চল্লিশ ওয়াটের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল হয়ে গেছে- যে কোনো মুহূর্তে কারেন্ট চলে যাবার আগাম সংকেত। বৃষ্টি আসার ব্যাপারটা উঁই পোকারা বোধ হয় সবার আগে টের পায়। বারান্দার শ্যাডওয়ালা লাইটটার নিচে শত শত উঁই পোকা কুন্ডলী পাকিয়ে উড়ছে।

ওড়ার ধরণটা খুব অদ্ভুত। মুগ্ধ ভঙ্গিতে আলোর দিকে ছুটে গিয়ে আচমকা গা ঝাড়া দিয়ে শেষ মুহূর্তে ডানা ফেলে দেয়। ছোট খাটো অপুষ্ট শুঁয়োপোকার মত দেখাতে থাকে তখন। গরম লাইটে বাড়ি খেয়েই মেঝেতে এসে পড়ছে। রীতিমত মৃত-অর্ধমৃত ডানাহীন উঁই পোকা দিয়ে বাদামি রঙের কার্পেটের মত তৈরি হয়েছে বারান্দার অনেকটা জায়গা জুড়ে।

বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে উঁই পোকাও উড়ে যাচ্ছে এদিক সেদিক। এনায়েত সাহেব আধ বোজা চোখে শুয়ে থেকে পানের বাটা থেকে না তাকিয়েই পান সুপারী নিচ্ছেন। চুন-জর্দা খান না গত দুই সপ্তাহ হল। চুন জর্দা খেয়ে খেয়ে মুখের বাম পাশে আলসারের মত করে ফেলেছেন। নিজের ফার্মেসিতে মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে এফ.সি.পি.এস ডাক্তার এসে বসেন।

সেই ডাক্তার সাহেব এক নজর দেখেই তাঁকে গম্ভীর গলায় বলে দিয়েছেন, “এনায়েত সাহেব, আর কিছুদিন বেশি বাঁচতে চাইলে পান, সুপারী, চুন-জর্দা, বিড়ি সিগারেট সব খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে আপনাকে। না হলে ক্যান্সার হতে বেশি দেরি নেই। অলরেডি মুখের বারোটা বাজিয়ে ফেলেছেন। বিশেষ করে চুন-জর্দা আর সিগারেট না ছাড়লে- আপনাকে বাঁচানোর কোনো সম্ভাবনা দেখছি না আপাতত। ” এনায়েত সাহেব শুঁকনো মুখে কেবল মাথা নাড়িয়েছেন।

সিগারেট তিনি অল্প সল্প খান। ওটা বাদ দেয়া কোনো সমস্যা না। কিন্তু চুন জর্দা দিয়ে যে পান খাওয়ার অভ্যাস করেছেন- সেটা তাঁর পক্ষে ছাড়া সম্ভব না। বয়সও কম হয়নি। ষাট পেড়িয়ে গেছে বহু আগেই।

আসল বয়স যে কত- নিজেও জানেন না। অনেক দিন তো বাঁচা হল- মুখে ক্যান্সার বাঁধিয়েই না হয় মরলেন। মরার জন্য সব সময় উপলক্ষ্য দরকার। রোগ ব্যাধী হল সেই সার্বজনীন উপলক্ষ্য। অনেক দিন সুস্থ শরীরে কাটিয়েছেন।

এবার একটু অসুস্থ হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী মরিয়মের কারণে চুন-জর্দা হারাম হয়ে গেছে তাঁর। ঘরে যতক্ষণ থাকেন পান সুপারী খেতে দিলেও চুন জর্দার চেহারাও দেখতে পান না তিনি। ডাক্তার সাহেবের সেই কথার পর মরিয়ম বাসায় যত চুন জর্দা ছিল সব পেছনের পুকুরের নিয়ে ফেলে এসেছেন। মরিয়মের এই কাজে এনায়েত সাহেব যথেষ্ট রাগ করেছিলেন।

কিন্তু মরিয়মের এক কথা, “সংসারের বট বৃক্ষের নিচে সবার বসবাস। বট বৃক্ষ মরে গেলে সংসারও মরে যাবে। ” স্ত্রীর ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে দুদিন কথা বলেন নি এনায়েত চৌধুরী। কিন্তু লাভ হয়নি। তাছাড়া স্ত্রীর সঙ্গে কথা না বলেও থাকতে পারেন না তিনি।

বহু বছরের অভ্যাস। হুট করে কথা বন্ধ করে দিতে গেলে নিজেই ঝামেলায় পড়ে যান। তাই স্ত্রীর কথাই মেনে নিয়েছেন। মরিয়ম কঠিন প্রকৃতির মহিলা। এনায়েত সাহেব যথেষ্ট সন্দিহান তাঁর জান কবজ করতে এসে আজরাইল (আঃ) ঝামেলায় পড়ে যেতে পারেন।

মরিয়ম মানুষকে সংসারে টিকিয়ে রাখার মানুষ। সে জানে কাকে কোন চালে খেতে দিলে টিকে থাকবে বেশিদিন। এনায়েত সাহেব হাজার গাঁই গুঁই করলেও মরিয়মকে কিছু বলেন না মুখের ওপর। তিনি জানেন এই সংসারের বট বৃক্ষ যেমন তিনি, তাঁর শেকড় হচ্ছেন মরিয়ম। মাটি আঁকড়ে ধরে রাখার পরই বট বৃক্ষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।

মরিয়ম আছেন বলেই এনায়েত চৌধুরী টিকে আছেন সংসারে। আধ বোজা চোখে পান সুপারীর সঙ্গে বেশ কিছু উঁই পোকা আর ছোট মেটে একটা ফড়িং চলে গেছে পানের ভাঁজে। বাহিরে বাতাসের ঝাপ্টা দিচ্ছে থেকে থেকে। ছাড়া ছাড়া ভাবে বৃষ্টি। কারেন্ট যায়নি এখনো।

অন্যদিন এতক্ষণে চারপাশ ঘুট ঘুটে অন্ধকার করে দিয়ে কারেন্ট চলে যায়। আজ যাচ্ছে না কেন? বাতাসের ধাক্কায় বাসার খোলা জানালাগুলো খট্‌ খট্‌ করে বাড়ি খাচ্ছে। বাসার ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে মরিয়ম গলা উঁচিয়ে মেঘলাকে বলছে, “জানালা সব খুলে রাখছিস ক্যান? বন্ধ কর! ঘরের ভিতর সব ধূলা বালি ঢুকে যাইতেছে দেখস্‌ না? হাওয়া খাওয়া বন্ধ করে জানালা লাগা। ” গজ গজ করতে করতে ঘরের অন্যদিকে চলে গেলেন মরিয়ম। এনায়েত সাহেব পানটা হাতে নিয়ে চেপে চুপে ভাঁজ করছেন অনেকক্ষণ লাগিয়ে।

মুখে দিচ্ছেন না। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। বাতাসের সাথে বৃষ্টির ফোঁটা উড়িয়ে এনে গায়ে ফেলছে, পানির ফোঁটাগুলো ঠান্ডা না, কেমন গরম গরম। উষ্ণ বৃষ্টির সময় নাকি এটা? বাজ পড়ার শব্দ হচ্ছে থেকে থেকে। চোখ বন্ধ দেখে কারেন্ট কখন গেল টের পেলেন না।

তবে ঘরের ভেতর থেকে শুনতে পেলেন মরিয়ম ধমক দিয়ে মেঘলাকে বলছে, “কারেন্ট যে গেছে দেখস্‌ নাই? জানালার কাছে বইসা আছিস্‌ ক্যান? তোর আব্বা যে বারান্দায় একলা অন্ধকারে বসে আছে- তাঁরে চার্জার জ্বালায় দিয়াসতে পারতেছিস না? জানালায় বইসা থাকোস ক্যান সারাক্ষণ? টিকটিকি নাকি তুই? যা, চার্জার নিয়া যা। বড়টা হইছে ধারী অলস, চব্বিশটা ঘন্টা ফার্মেসিতে বইসা বইসা ইট কলের মত বিড়ি টানে। ছোটটা হইছে জানালার টিকটিকি!” এনায়েত সাহেব বিরক্ত মুখে পানটা মুখে দিলেন। ঘরে বসে থাকলেই নিজের ছেলে মেয়ে দুটো সম্পর্কে সারাদিন নানান কথা শুনতে হয়। চার জন মানুষের সংসারে মরিয়মই কেবল অনর্গল বক বক করে যেতে পারেন।

বাকি তিন জনের অস্তিত্ব কেবল মরিয়মের কথাতেই বোঝা যায়। সাড়া পাওয়া যায় না। পানটা মুখের ডান পাশে ঢুকিয়ে চুপচাপ রেখে দিলেন। শুরুতেই চিবাতে পারেন না। মুখের ভেতর পান সুপারী পুরে তার একটা কাঁচা স্বাদ নিতে থাকেন।

চিবানো আরাম্ভ করেন আরো পরে। চারপাশ আলো করে বিদ্যুৎ চমকালো। চোখ বন্ধ করেও টের পেলেন এনায়েত সাহেব। শব্দটা বেশ জোরে সোরেই হবে। ভাল লাগছে তাঁর।

বাজ পড়ার শব্দে আনন্দ পান তিনি। যত আলো, ততটা বিকটা তার আওয়াজ। মুগ্ধ হয়ে সেই আওয়াজ শোনেন তিনি। কিন্তু অন্ধকার হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে চারপাশে নীরবতা ভেঙে খান খান করে বাজ পড়ার শব্দ হতেই- তাঁর খুব কাছে ভারী কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ পেলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকালেন।

আবছা অন্ধকারে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তাঁর ছোট মেয়েটা। বাজের শব্দে কুঁকড়ে গেছে ভয়ে। অস্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে মেঝেতে পড়ে থাকা জিনিসটা একটা চার্জার লাইট। আচমকা বজ্রপাতের শব্দে ভয় পেয়ে হাত থেকে চার্জারটা ফেলে দিয়েছে মেঘলা। সোজা হয়ে বসলেন এনায়েত সাহেব।

মুখে পান নিয়েই নরম গলায় বললেন, “ভয় পাইছিস মা? কাছে আয়। ” একটা হাত বাড়িয়ে ডাকলেন। ছায়ার মত নিঃশব্দে এগিয়ে এলো মেঘলা। এই অন্ধকারের মাঝেও গলা হাত আর মাথা পেঁচিয়ে রেখেছে ওড়না দিয়ে। কথা বলছে না।

এনায়েত সাহেব নিজেই উঠে চার্জার লাইটটা তুলে জ্বালালেন। ভাল জিনিস। দুবাই থেকে তাঁর ছোট শালা পাঠিয়েছে গত বছর। হাত থেকে পড়লেও নষ্ট হয় না সহজে। মেয়ের মাথায় আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দিলেন, “বেশি ভয় পাইছিস?” অস্পষ্ট স্বরে মাথা নাড়ালো মেঘলা, “ন্‌-না।

” চার্জারের আলোতে মেয়ের মুখটা দেখা যাচ্ছে কেবল। ঘরের ভেতরেও হিজাবের মত ওড়না পেঁচিয়ে রাখে মেয়েটা। বড় বড় মায়া মায়া আনত দুটো চোখ। এনায়েত সাহেবের চেহারা পেয়েছে মেয়েটা। কথা বার্তাতেও একই রকম।

কম কথা বলে। এবারে ইন্টার পরীক্ষা দিচ্ছে। ছাত্রী খারাপ না। সায়েন্স থেকেই পরীক্ষা দিচ্ছে। বড় ছেলের মত সায়েন্স নিয়ে শুরু করে মাঝপথে আর্টসে চলে যায়নি।

“তোর পরীক্ষা কেমন হইতেছে মা?” “আল্লাহ্‌র রহমতে ভাল। ” নিচু গলায় উত্তর দিল। কথা খুঁজে পেলেন না আর এনায়েত সাহেব। মুখে পান রেখে যে কথা বলতে পারেন না তিনি তা নয়। কিন্তু মেয়ের সঙ্গে কেন জানি কথা বার্তায় তাঁর মাইল পথের দূরত্ব।

পিতা হওয়া অনেক কঠিন কাজ। সন্তানের মত এত আপন মানুষগুলোর সাথে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে না চাইলেও একটা দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। ভদ্রতার সম্পর্ক। যেখানে ইচ্ছে করলেই কাছে নেমে আসা যায় না। বিচিত্র একটা জড়তা কাজ করে।

না তারা দূরত্ব অতিক্রম করে, না তিনি। ধ্রুবক দূরত্ব রাস্তার দুই সারির গাছের মত দূরে ঠেলে রাখে সন্তান আর বাবাকে। মাঝে সাঝে বাতাস উঠলে নুয়ে এসে ছুঁয়ে দেয়া যায় দু’পাশের গাছে। এক থাকা হয় না। মেঘলাকে বলার মত কথা খুঁজে পাচ্ছেন না এনায়েত সাহেব।

মাথায় হাত রেখে অসহায় চোখে কেবল তাকিয়ে আছেন মেয়ের দিকে। “আব্বা চা খাবেন?” বাবার দিকে তাকালো মেঘলা। এনায়েত সাহেবের কথা আটকে যাওয়াতে অবাক হয়নি সে। তার বাবা বড় হওয়ার পর কয়দিন ক’টা কথা বলেছে- হাতে গুণে বলে দিতে পারবে সে। পান মুখে নিয়ে হাসলেন এনায়েত সাহেব, “আইনা দে।

বৃষ্টির ঠাণ্ডা পড়ছে। চা খাইলে ভাল লাগবে। ” মেঘলা আর দাঁড়ালো না। ঘুরে ভেতরে চলে গেল। এনায়েত সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল।

চা আনতে না বললে বোধ হয় মেয়েটা আরেকটু সময় থাকতো। সারাক্ষণ তো ঘরেই বসে থাকে জানালার পাশে। দেখা সাক্ষাৎ হয় না। ঝুলন চেয়ারে বসতে বসতে পান চিবানো শুরু করতেই মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। মুখের আলসারের কারণে, নাকি উঁই পোকা আর ফড়িং মেশানো সুপারীর জন্য- বোঝা গেল না।

তবে ফেলে দিলেন না তিনি। চিবিয়ে যেতে লাগলেন জোর করে। হেলান দিলেন চেয়ারে। মুখটা বিস্বাদ লাগছে। তাও নির্বিকার চিত্তে পান চিবাচ্ছেন ধীরে ধীরে।

চারপাশে কালি ঘুলে দেয়া অন্ধকার। থেকে থেকে বজ্রপাতের আলো এসেই মিলিয়ে যাচ্ছে। এনায়েত সাহেব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেনবাহিরের বৃষ্টির দিকে। টিনের চালে ঝম ঝম শব্দে ঝাপিয়ে নেমেছে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি। এখন বাতাস মিইয়ে গেছে।

খাঁড়া ভাবে বৃষ্টি হচ্ছে। চার্জারের আলোয় টিনের চাল থেকে অনেকগুলো সমান্তরাল রেখায় বৃষ্টির পানি পড়ছে। সাদাটে আলোয় হীরার মত মনে হচ্ছে। অবিরাম হীরার স্রোত গড়িয়ে নামছে টিনের চাল থেকে। শীত শীত লাগছে এনায়েত সাহেবের।

এশারের আযান শোনা যাচ্ছে বৃষ্টির মাঝেও। মসজিদে যাবেন নাকি যাবেন না দ্বিধায় ভুগছেন। এই বৃষ্টির মাঝে ছাতা নিয়ে বের হলে জ্বর আসাবে তাঁর। আবার জ্বর হবার ভয়ে মসজিদে যাবেন না- এটা ভাবতেও খারাপ লাগছে তাঁর। আয়েশে জীবন কাটাবার জন্য দুনিয়ায় পাঠানো হয়নি তাঁকে।

মরিয়মকে একটা ছাতা আনার কথা বলা দরকার। কিংবা মেঘলা চা নিয়ে এলে তখন ছাতা দিতে বলতে হবে। সারাদিন তো বাড়ীতেই পড়ে থাকেন। এই বয়সে এসেও যদি মসজিদে না যান- লোকে কি বলবে? নিজের ওপরেই বিরক্ত হলেন এনায়েত সাহেব। লোক দেখানোর জন্য মসজিদে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? তাহলে তো পূণ্যের চেয়ে পাপটাই বেশি হবে।

টিনের চালে বৃষ্টির রেখার বিচিত্র দেয়ালটার মাঝ দিয়ে ওপাশের অন্ধকারে দেখা গেল একটা হলদেটে টর্চের আলো এগিয়ে আসছে এদিকে। তাকিয়ে রইলেন এনায়েত সাহেব। কে আসছে? মনোয়ার? তাঁর বড় এই ছেলে তো এতো তাড়াতাড়ি বাড়ীতে ফেরার মানুষ না। ছেলে পড়াশোনায় ভাল না দেখে কম বয়সেই বিয়ে দিয়েছিলেন। ভাল ঘরের মেয়ে।

কিন্তু ছেলে বৌয়ে বছরে বারো মাসে এগারো মাস ঝগড়া লেগে থাকে। তিন তিনটা বাচ্চা হওয়ার পরেও শুধরায়নি মনোয়ার। হুট হাট করে মেরে বসে বৌমাকে। এনায়েত সাহেবের ছেলের বৌ মরিয়মের মতই কঠিন মেয়ে। স্বামীর মার খেলেই তিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ীতে গিয়ে ওঠে।

উঠলে আর আসার নাম করে না। মরিয়ম কিংবা এনায়েত সাহেব গিয়েও বৌমাকে ফিরিয়ে আনতে পারেন না। সে বাড়ীর এক কথা- জামাই নিজে না এলে মেয়ে দেবে না। অপমানের চূড়ান্ত। বাড়ী ফিরে ছেলেকে পাঠালেও দেখা যায় মেয়েকে ছাড়ছে না।

মাফ চাইলেও রেখে দেয়। বহু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তারপর দেয় মেয়েকে। শ্বশুড় বাড়ীর এই আচরণে বেশ কয়েকবার ক্ষিপ্ত হয়ে তালাকের কথাও বলে ফেলেছিল মনোয়ার। কিন্তু মরিয়মের কারণে তালাক দিতে পারেনি। এই বংশে অন্য বাড়ীর মেয়ে এসে কখনো তালাক কিংবা সতীনের ঘর করেনি।

তার ছেলেকেও করতে দেয়া হবে না। মরিয়ম কঠিন গলায় বলে দিয়েছে, “বৌমাকে যেদিন তালাক দিবি- আমার লাশের মুখ দেখাও হারাম হয়ে যাবে তোর জন্য। অন্যের ঘরের মেয়ে আনে মার ধোর করবি- এই শিক্ষা দিছি তোরে আমি?” মনোয়ার মায়ের কথা অমান্য করেনি কোনদিন। তবে বৌ পিটিয়ে বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দিলেই কেমন যেন হয়ে যায় ছেলেটা। ঘর সংসারের প্রতি উদাসীন একটা ভাব এসে যায়।

সারাক্ষণ ফার্মেসিটায় গিয়ে বসে থাকে আর একটার পর একটা সিগারেট টানে। আগে বয়স যখন কম ছিল- এনায়েত সাহেবের সামনে সিগারেট খাওয়ার সাহস পেত না। কিন্তু এখন বয়স বেড়েছে। চল্লিশ পেড়িয়ে গেছে। এখন এনায়েত সাহেব ফার্মেসিতে গিয়ে বসলেও বাবার সামনেই উদাস উদাস মুখে সিগারেট টানতে থাকে।

মাঝে মাঝে ছেলের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত হন এনায়েত সাহেব। বৌমা দোষ করতে পারে, বাচ্চাগুলো কি করেছে? তাদের এনে রাখতে পারে না? নাতি নাতনি ঘরে ছোটা ছুটি না করলে এ বয়সে জীবন ক্ষয়ী রোগ তাড়াতাড়ি বাসা বাঁধে শরীরে। কিন্তু তাঁর ছেলেকে এই কথাটা কে বোঝাবে? এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন এনায়েত সাহেব। আলোটা কাছে এগিয়ে আসতেই আবার হেলান দিলেন চেয়ারে। মনোয়ার আসেনি।

মনোয়ার এতো হন হন করে হাঁটে না। মনোয়ার কচ্ছপ শ্রেণীর মানুষ। বৌ পেটানোর সময় কেবল খরগোশের মত তিড়িং বিড়িং করে লাফ ঝাপ দিতে পারে সে। বৃষ্টির দেয়ালটা ভেঙে ভেজা ছাতা নিয়ে বারান্দায় দৌড়ে উঠে এলো হালকা পাতলা কালো একটা ছেলে। ছাতা নিয়ে আসলেও প্যান্টের নিচের দিক আর পিঠ ভিজিয়ে ফেলেছে।

বা হাতে একটা কালো পলিথিন ব্যাগ ধরে রেখেছে। ছেলেটা মনোয়ারের এসিস্টেন্ট, ফার্মেসিতে বসে। দিলিপ। “সালামালেকুম স্যার। ” হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুখের পানি মুছতে মুছতে বলল দিলিপ।

“ওয়ালাইকুম সালাম। এই বৃষ্টি বাদলের মাঝখানে হঠাৎ কি মনে কইরা আসলা?” ওভাবেই চেয়ারে শুয়ে শান্ত গলায় বললেন। “মনোয়ার ভাই পাঠাইলো। চাচী আম্মা নাকি এলার্জির ওষুধ চাইছে? হাচ্চি দিতেছেন বলে?” ছাতাটা ভাঁজ করে নিতে লাগলো ছেলেটা। ছাতা ভাঁজ করছে কেন? বসবে নাকি ছেলে? সামান্য ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন এনায়েত সাহেব, “তোমার চাচীকে তো তেমন হাঁচি দিতে দেখলাম না।

মনোয়ার নিজেই রাতে আসার সময় নিয়ে আসতে পারতো। এত জরুরী কিছু না। তোমারে ঝড় বাদলার মাঝে না পাঠাইলেইও পারতো। ” দিলিপ দাঁত বের করে হাসল, “সমস্যা নাই স্যার। অভ্যাস আছে আমার।

আগে বৃষ্টিতে ভিজে অনেক কাজ করতে হইছে। গা শওয়া হইয়া গেছে। ” ছেলেটাকে এনায়েত সাহেব ঠিক পছন্দও করেন না, আবার অপছন্দও করেন। মনোয়ার কোত্থেকে যেন খুঁজে নিয়ে এসেছে এই ছেলেক। ফার্মেসির কাজ ভাল জানে।

তবে তার থেকে বেশি জানে কিভাবে উপজেলা হেলথ এডমিনিস্ট্রেটর ইন্সপেকশনে এলে ফার্মেসীকে বাঁচিয়ে দেয়া যায়। লোকজন কাকে কিভাবে হাত করে কাজ বের করে নিতে হয়- দিলিপের মত বোধ হয় ভাল কেউ জানে না। এনায়েত সাহেব চালাক চতুর মানুষ অপছন্দ করেন। দিলিপ শুধু চালাক চতুর না, রীতিমত ধূর্ত স্বভাবের মানুষ। গত বছর জেলা মেজিস্ট্রেট আর সিভিল সার্জন এসেছিল তাদের বাজারের ফার্মেসিগুলোতে মোবাইল কোর্ট নিয়ে।

এনায়েত সাহেব ভাল করেই জানেন এই দুনিয়াতে খাঁটি ব্যবসা করে ভাত পাওয়া সম্ভব না। প্রচুর ডেট এক্সপায়ার্ড ওষুধ ছিল দোকানে। গ্রামের মানুষ তো আর এত সব বুঝবে না। চালিয়ে দেয়া যায় ভাল মত। তাছাড়া ওষুধের যে এক্সপায়ার্ড ডেট থাকে, সেটার কিছু দিন পর পর্যন্ত ওষুধ ঠিক থাকে।

অযথা দিন তারিখের হিসাব ধরে ভাল ওষুধ ফেলে দেয়ার কোনো মানে হয় না। এনায়েত সাহেবের মত দিলিপও বিষয়টা বোঝে। সিভিল সার্জন আর মেজিস্ট্রেট আসার পর ছেলেটা কায়দা করে সব কিভাবে যেন হাত করে নিয়েছে। অথচ সেবারেই এই বাজারের সব চেয়ে বড় বড় চারটা ফার্মেসিতে সিল গালা করে দিয়ে গেছে মোবাইল কোর্ট। দিলিপ যে কিভাবে সামলেছে সেদিন এনায়েত সাহেবের কাছে বিরাট রহস্য।

আরেকটু হলে স্ট্রোক করে বসতেন তিনি সেদিন। এই দিলিপ থাকায় বেঁচে গেছেন। না হলে জেল তো হতোই, পাঁচ দশ লাখ টাকা জরিমানাও হয়ে যেতো। “মরিয়ম মেডিক্যাল হল” সে দফায় বেঁচে যাওয়ার পর বড় করে মিলাদ দিয়েছিলেন বাজার মসজিদের। দিলিপকে দশ হাজার টাকা বখশিসও দিয়েছিলেন।

এনায়েত সাহেব দিলিপের দিকে তাকিয়ে আছেন, চার্জারের আলো মুখে পড়ছে না দেখে বোঝা যাচ্ছে না তিনি বিরক্ত না শান্ত মুখে তাকাচ্ছেন। তবে ছেলেটাকে বসতেও বলছেন না। অবশ্য বারান্দায় তাঁর এই ঝুলন চেয়ার ছাড়া বসার মত আর কিছু নেই। টুল আছে, কিন্তু ওটার উপরে পানের বাটা রাখা। পায়ের প্যান্টের ভাঁজ খুলে ঝাড়ছে ছেলেটা শব্দ করে।

যেন ঝাড়া দিলেই পানি বেরিয়ে শুঁকিয়ে খট খটে হয়ে যাবে। বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করছে নাকি দিলিপ? ওষুধটা দিয়ে চলে গেলেই তো পারে। এমনিতেই তো ভিজে আছে। শুঁকালেই কি আর না শুঁকালেই কি? মরিয়ম ওর এ বাড়ীতে আসা পছন্দ করে না। হিন্দু দেখতে পারে না মরিয়ম।

মনোয়ার একে বাড়িতে পাঠালেই খুব বিরক্ত হয় মরিয়ম। মেঘলা বড় হয়েছে। হুট হাট করে এ রকম জোয়ান একটা ছেলের বাড়ীতে আসাটা ঠিক না। মনোয়ারটা যত দিক যাচ্ছে তত গাধা হচ্ছে। মরিয়ম রাগ করে জেনেও দিলিপকে বাসায় পাঠায় এটা সেটা নিয়ে যেতে কিংবা বাজার করে পাঠায়।

এনায়েত সাহেব ভাবলেন একবার ভেতরে বলবেন একটা চেয়ার অথবা মোড়া এনে দিয়ে যেতে দিলিপকে। ফার্মেসিতে কাজ করে বলে সামান্য বসার মত সৌজন্য বোধটুকু দেখানো যাবে না- এটা ঠিক না। কিন্তু কিছু বললেন না। অলস চোখে বাহিরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলেন। দিলিপ হাতের পলিথিনটা নিয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।

থাকুক। এনায়েত সাহেব দিলিপের দিকে তাকাচ্ছেন না। ছেলেটার দিকে তাকালেই মনে হয় সারাক্ষণ কিছু না কিছু ফন্দি আঁটছে মনে মনে। ছেলেটাকে থাকার জন্য ফার্মেসির পেছনেই একটা টিনের ঘর দেয়া হয়েছে। মনোয়ারই থাকতে বলেছে ওখানে।

এনায়েত সাহেবের সেটা পছন্দ না। যদিও ছেলের সঙ্গে এ নিয়ে তর্ক করতে যাননি। মনোয়ার সংসার ভাল না বুঝলেও ব্যবসা ভাল বোঝে। মানুষও ভাল চেনে। দিলিপ যে টুক টাক চুরি টুরি করে না- তা না।

সে যে প্রায়ই ওষুধের প্যাকেট থেকে দু এক ফাইল গায়েব করে দিয়ে সপ্তাহে বন্ধের দিনে শহরে চলে যায় অন্য ফার্মেসিতে বেচার জন্য- এনায়েত সাহেব সে খবরও রাখেন। অবশ্য চার হাজার টাকার বেতনে যে কারোই পোষাবে না; এটা সত্য। এনায়েত চৌধুরীও নিজের ছেলেকে বলেছিলেন চার হাজারে দিলিপের না হলে আরেকটু বাড়িয়ে দিতে- যাতে চুরি চামারি না করে। মনোয়ার সে কথা কানে তোলেনি। এনায়েত সাহেবকে সোজা সাপ্টা ভাষায় বলে দিয়েছে, “আব্বা, যার হাত টানের অভ্যাস আছে- তারে চাইর ক্যান চল্লিশ হাজার দিলেও ফাইল চুরি করে বন্ধের দিন শহরে বেচতে চলে যাবে।

তার থেকে যা আছে- থাকুক। চুরির মালের হিসাব আমি আগেই হাতে রাখে মাসের লাভের হিসাব তুলি। দিলিপ দুই ফাইল চুরি করা চোর। তিন ফাইল সরাইতে গেলে এসব ছেলে পেলের হাত কাঁপা কাঁপি শুরু হয়। ” এনায়েত সাহেব আর ঘাটতে যাননি ছেলেকে।

অবশ্য মনোয়ার যে ভুল কথা বলেছে- তাও না। দিলিপ আসলেই বড় চুরি করা চোর না। এ জন্য ব্যবসায় খুব একটা হের ফের হয় না কখনো। তাছাড়া মনোয়ার হচ্ছে ব্যবসার পোকা। সিগারেটের ধোঁয়ার নিচে অলস ভাবে ডুবে থাকা এই ছেলে এক ফার্মেসির ব্যবসা করেই এর মধ্যে শহরে ছয় শতক জমি কিনে ফেলেছে।

ছাগল চড়ানোয় জাতে রাখাল ভাল। হুজুর, কবিরাজে হয় না। এনায়েত সাহেবের ছেলে জাত রাখাল। ধোঁয়ার নিচে বসেই সব করে ফেলে। দিলিপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে।

ছেলেটা যে থেকে থেকে শীতে কাঁপছে- লক্ষ্য করেছেন এনায়েত সাহেব। একটা তোয়ালে এনে হাত মুখ মুছতে দেয়া যেতো। কিন্তু বিচিত্র কারণে তিনি দিলিপের প্রতি অদ্ভুত একটা অবজ্ঞা দেখিয়ে যাচ্ছেন। বৃষ্টি সামান্য ধরে এসেছে। দরজার পর্দা সরানোর শব্দ হতেই পাশ ফিরে তাকালেন এনায়েত চৌধুরী।

মেঘলা একটা ছোট ট্রেতে করে চা নিয়ে এসেছে। মুখটানিচের দিকে করে রেখেছে। তাকাচ্ছে না আশে পাশে। এক হাতে পানের বাটা’টা তুলে ট্রেটা রেখে দিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল। এনায়েত সাহেব ট্রেটার দিকে তাকিয়ে সামান্য অবাক হলেন।

দুটো কাপে চা দেয়া। সাথে এক পিরিচ বিস্কিট। দুটো কাপ কেন? মেঘলাও কি তাঁর সঙ্গে খেতে চেয়েছিল? কিন্তু সে তো কখনো এনায়েত চৌধুরীর সঙ্গে বসে চা খায় না। তাহলে আরেকটা কাপ কার জন্য? দিলিপের জন্য নাকি? মেঘলা কখন দেখলো যে দিলিপ এসেছে? নড়ে চড়ে উঠে বসলেন এনায়েত সাহেব। বেশ অসন্তুষ্ট গলায় দিলিপকে ডাকলেন, “দিলিপ? চা নিয়া যাও।

” দিলিপ হাসি মুখে এগিয়ে এলো। এখনো কাঁপছে ছেলেটা। গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ। তৃষ্ণার্তের মত কাপটায় চুমুক দিল সশব্দে দিলিপ। এনায়েত সাহেবের মুখ চূড়ান্ত বিরক্তিতে ছেয়ে গেল, থম থমে গলায় বললেন, “দিলিপ?” “জ্বি স্যার?” “শব্দ করে চা খাবা না।

মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট হল তরল খাদ্য শব্দ ছাড়া পান করবে সে। অন্যান্য প্রাণীরা শব্দ করে তরল জিনিস খায়। ” দিলিপ দাঁত বের করে হাসল, “জী স্যার। আসলে শীত ধরে গেছিল দেখে জোরে আয়েশে টান দিছিলাম। ” এগিয়ে এসে বিস্কিট তুলে নিয়ে আরো শব্দ করে কামড় দিল।

এনায়েত সাহেব চায়ের কাপ হাতে অন্য দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। এই রোগা পটকা ছেলেটাকে কেন যেন তিনি সহ্য করতে পারছেন না। “দিলিপ?” “জ্বি স্যার?” “চা বিস্কিট খাওয়া শেষ হলে ওষুধ রাখে ফার্মেসিতে চলে যাও। মনোয়ার একলা বসে আছে অনেকক্ষণ যাবত। ” “জ্বি স্যার, এখনি চলে যাবো।

” ঝক ঝকে দাঁত বের করে আবার হাসি দিল দিলিপ। এনায়েত সাহেব চুমুক দিতেই মুখ বিকৃত করে ফেললেন, চা’টা এত তিতা লাগছে কেন? মেঘলা কি চা বানাতে পারে না? বৃষ্টি কমে এসেছে। টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে এখন। দিলিপ প্যান্টের পা গুঁটিয়ে ছাতা হাতে চলে যাচ্ছে। এনায়েত সাহেবদের বাড়ীটার ডানদিকের রাস্তাটা বাজারে চলে গেছে।

একটু ঝোপঝাড় বেশি এদিকটায়। জংলা ধাঁচের রাস্তা। ইট ফেলবে ফেলবে করেও ফেলা হয়নি। বৃষ্টি হলেই প্যাঁক প্যাঁক করতে থাকে কাঁদাতে। দিলিপ সাবধানে টর্চ হাতে দেখে দেখে পা ফেলছে।

পা পিছলে যেতে যেতে বেঁচেছে দুবার। বাকি রাস্তাটা ঠিকমত যেতে পারলে হয়। স্যান্ডেলের তলাটা কাঁদা লেগে পুরু হয়ে গেছে। পা ফেলতে গেলেই মনে হয় স্যান্ডেল ওখানেই আটকে যাবে। ওঠানো আর হবে না।

জংলার মত ঘন ঝোপের জায়গাটার সামনে এসে গেছে। এই বৃষ্টির মাঝেও চার পাঁচটা জোনাকি ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে। ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে উড়ছে এদিক ওদিক। দিলিপ হঠাৎ টর্চ নিভিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। জোনাকিগুলো অদ্ভুত ভাবে ঘিরে ধরেছে তাকে।

বিচিত্র একটা বৃত্তের মত তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। আবছা অন্ধকারে সমস্ত অবয়বই জড় পদার্থ। জোনাকীগুলোর কাছে দিলিপও সেরকম। স্থির অবয়বে পতঙ্গের আকর্ষণ বেশি। দিলিপ মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে।

কিন্তু জোনাকিদের দিকে তাকিয়ে নেই সে। পেছনে ফিরে এনায়েত সাহেবের বাড়ীটার দিকে চেয়ে আছে দিলিপ। এত দূর থেকেও কেন যেন মনে হল পশ্চিম দিকের একটা জানালার পর্দা সামান্য সরিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারের মাঝেও এই পথটার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে মানুষটা। স্থির, নিশ্চল...... ধীরে ধীরে সরল একটা হাসিতে ভরে গেল দিলিপের মুখটা।

মেঘলা ওর বিছানার পাশের জানালাটার ধারে চুপচাপ বসে আছে। ঘরের ভেতর এক কোনায় একটা মোম জ্বলছে। বাসার সব চার্জার লাইট ঠিক নেই। এ জন্য মোম জ্বালাতে হয় কারেন্ট গেলেই। নষ্ট চার্জারগুলো ঠিক করাবে করাবে বলেও নেয়া হচ্ছে না বড় ভাইয়ার।

মোমের হলদেটে শিখা বাতাসের নড়া চড়ায় তির তির করে কাঁপছে। সেই সাথে কাঁপছে ঘরের সমস্ত ছায়াগুলো। যেন হাঁটা চলা করে বেড়াচ্ছে ছায়াগুলো জীবন্ত প্রাণীর মত। জড় বস্তুগুলোর জীবনের মাঝে একমাত্র জীবিত প্রাণীটি অসার হয়ে বসে রয়েছে জানালাটার পাশে। পর্দাটা সামান্য ফাঁক করে ঘুট ঘুটে অন্ধকারের মাঝে বাজারের দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটা দিয়ে কাঁপতে থাকা হলুদ আলোটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে নিজের অজান্তেই।

ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে আলোটা....... মেঘলার চোখে মুখে তীব্র একটা যন্ত্রণার ছাপ ফুটে রয়েছে স্পষ্ট ভাবে। আলোটা মিলিয়ে যাচ্ছে কেন? নাকি অন্ধকারে কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে ওখানে? মেঘলা খুব সাবধানে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে পর্দাটা ছেড়ে দেয়। মোমের আলোতে ওর ঘরে অসংখ্য ছায়ার অদ্ভুত ছন্দে নাচ শুরু হয়েছে। অপলক চোখে মোমবাতিটার শিখার দিকে তাকিয়ে আছে মেঘলা। তারপর ধীরে ধীরে ওর ওড়নাটা হাতের ওপর থেকে সরিয়ে নিতে থাকলো...... তীব্র একটা দৃষ্টিতে হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে রইলো মেঘলা।

ছায়ার নাচের নাট্যশালার একমাত্র বেঁচে থাকা মেয়েটার দীঘির মত চোখের কিনার ছাপিয়ে ওঠা জলের খবর টের পায়নি কেউ। দেয়াল জুড়ে ছায়ার জীবন প্রাপ্তির মহা সুখে উল্লাসে মত্ত সব। ঠোঁট কামড়ে চোখের পানি আটকানোর কোনো ছায়া বোধ হয় দেয়ালে পড়েনি। তাহলে হয়ত ছায়ার জগৎটাও আচমকা স্থির হয়ে যেত। মেঘলা কোনো শব্দ না করে হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে।

টপ্‌ টপ্‌ করে পড়তে থাকা নোনা জলে ক্রমশ সাদা হয়ে আসতে থাকা হাতগুলোয় বড় অবহেলায় বিচিত্র নকশা কেটে যা ছায়ানটের অগোচরে....... (পরের পর্বে সমাপ্ত) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।