আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকাকে বাঁচানোর এখনই সময়

আমার আমি নাই

মশিউর রহমান রুবেল :: ক্রমাগত জনচাপে কাঁপছে ঢাকা। চারদিকে মানুষ আর মানুষ। মানুষের ভারে ন্যুজ্ব ঢাকা আজ মৃত্যুর দারপ্রান্তে উপনীত। এই মুহূর্তে রাজধানী ঢাকার লোকসংখ্যা কত? এর সঠিক কোন পরিসংখ্যা নেই কারো কাছেই। তারপরও বাড়ছে মানুষ।

ঢাকামুখী মানুষের স্রোত যেন থেমে নেই। যার ফলে রাজধানীর উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত আর ক্রমাগত জনচাপে ক্রমান্বয়েই মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হচ্ছে আমাদের প্রাণপ্রিয় চারশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকা। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরীর লোকসংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি। ২০০১ সালের রেকর্ড অনুযায়ী ঢাকার প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করতেন ৭ হাজার ৯শ’ ১৮ জন। বর্তমানে কত লোক বাস করে তার সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই কোথাও।

তবে ২০২৫ সালে ১৫৩০ বর্গকিলোমিটারের ঢাকায় লোকসংখ্যা হবে ৩ কোটিরও বেশি। জনসংখ্যার দিক থেকে ঢাকা বিশ্বের দশম বৃহৎ শহর। জাতিসংঘ জনসংখ্যা বিভাগের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে জাপানের রাজধানী টোকিওর পরেই দ্বিতীয় স্থানে থাকবে ঢাকা। ঢাকার পরে থাকবে ভারতের বাণিজ্য নগরী মুম্বাই। ওই হিসাব অনুযায়ী তখন ঢাকা মহানগরীর লোকসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে দুই কোটির ওপরে।

গবেষকেরা বলছেন, প্রতিদিন নতুন করে ২ হাজার ১শ’ ৩৬ জন ঢুকে পড়ছে রাজধানীতে। আর বছর শেষে যুক্ত হচ্ছে ৭ লাখ ৮০ হাজার নতুন মানুষ। যে হারে মানুষ বাড়ছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না রাজধানীর নাগরিক সুবিধা। যার ফলে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও যানজটের সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে, এটা যেমন সত্য তেমনি সত্য উপচেপড়া জনসংখ্যার কারণে নগরীতে হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে নগরায়নও। নগরবাসী পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন, বর্জ্য অপসারণ, পরিবহন, যানজট, অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভয়াবহ সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে প্রতিনিয়তই।

আগামী ২০১৫ সাল নাগাদ এসব সমস্যা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা সহজেই অনুমেয়। এদিকে, অপরিকল্পিত নগরায়নের মতো রাজধানী ঢাকা শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নেই কোন সমন্বয়। নেই উৎপাদিত বর্জ্যরে সঠিক কোনো হিসাবও। সিটি কর্পোরেশনের হিসাব মতে, রাজধানী ঢাকা শহরে দৈনিক উৎপন্ন ৩ হাজার ২শ’ মে. টন বর্জ্যরে প্রায় সবটুকুই ডাম্পিং করা হয়। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাংকের মতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন মজুদ হচ্ছে প্রায় ৭ হাজার মে. টন বর্জ্য।

এরমধ্যে মাত্র ৩ হাজার ৮শ’ মে. টন বর্জ্য ডাম্পিং করা হয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ওয়াসা মাত্র ৩০ শতাংশ বর্জ্য নিষ্কাশন করে। ওয়াসা দাবি করেছে, তারা নিষ্কাশন করে মাত্র ২০ শতাংশ বর্জ্য। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রথম রিপোর্টে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দেয়া তথ্য মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। এমনকি দায়িত্বে অবহেলার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

ওই রিপোর্টে দেয়া তথ্য মতে, ঢাকা শহরের মাত্র শতকরা ৩ ভাগ এলাকায় ওয়াসা পরিচালিত সুয়ারেজ লাইন আছে। গত বছর অথাৎ ২০০৯ এর হিসাব অনুযায়ী উত্তরা, মিরপুর, শ্যামলীসহ অনেক এলাকায়ই সুয়ারেজ লাইন নেই। এসব এলাকায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কে ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে ড্রেনের মাধ্যমে সুয়ারেজ লাইনে বর্জ্য নিষ্কাশন করা হচ্ছে। বাড়ি নির্মাণের অনুমোদন দেয়ার পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) পরবর্তীতে ওই বাড়ি অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী হয়েছে কিনা তা আর খতিয়ে দেখে না বলে একই রিপোর্টে বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ওই বাড়িতে সেফটি ট্যাংকি আছে কি নেই তা আড়ালে পড়ে যায়।

যদিও এ ব্যাপারে রাজউক জানিয়েছে, তাদের কাজ শুধু লে-আউটের পরিবর্তন হয়েছে কিনা সেটি দেখা। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে ওয়াসার মহাব্যবস্থাপকের দেয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, ঢাকার মানুষের ব্যবহৃত পানির শতকরা ৮৭ ভাগ ভূমির গভীর থেকে তোলা হয়। এ কারণে প্রতি বছর ২ থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। সাথে সাথে খাল, জলাধার ইত্যাদি দিন দিন ভরাট হয়ে যাওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতে নগরী জুড়ে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, সুয়ারেজ লাইনের ময়লা পানি আর বৃষ্টির পানিতে একাকার হয়ে নদীতে গিয়ে পড়ছে।

নদীর পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। নদীর পানি বিশুদ্ধকরণ করে সরবরাহ করতে পারছে না ঢাকা ওয়াসা। ওই রিপোর্টে বলা হয়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের মূল কারণ এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন কো-অর্ডিনেটিং বডি নেই। সমন্বয় থাকলে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ করা সহজ হতো বলে উল্লেখ করা হয়। যার ফলে এই ঢাকা শহর ক্রমেই দূষণ আর দখলের নগরীতে পরিণত হয়েছে।

নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে ভূমিদস্যুরা জলাধার দখল করে উঠছে সুউচ্চ অট্টালিকা। যে যেখানে পারছে দখল করে নিচ্ছে। দখলের তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা শহরের বর্জ্যে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকায় ঢাকা সিটি করপোরেশনের মধ্যে উৎপাদিত বর্জ্য ফেলে জলাধারগুলো ভূমিদস্যুরা দখল করে নিচ্ছে। এতো গেল দখল আর দুষণ প্রক্রিয়া।

এবার আসা যাক বর্তমান জনসংখ্যার পরিসংখ্যানে, বর্তমানে ঢাকা শহরে কত মানুষের বাস, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যেমন কঠিন তেমন দু:সাধ্যও বটে। ‘নগরায়ণ ও বাংলাদেশে উন্নয়ন’ (আরবানাইজেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ) শীর্ষক প্রবন্ধে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেছেন, ঢাকা শহরে এক কোটি ৩০ লাখ লোকের বাস। নিপোর্টের পরিচালক (গবেষণা) আহমেদ আল-সাবির জানিয়েছেন, সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। কেউ দেড় কোটি বললেও ভুল হবে না। তিনি বলেন, এক কোটি ৩০ লাখের কম হবে না এটা জোর দিয়েই বলা যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক নূর-উন-নবী ‘জনসংখ্যা ও বাংলাদেশে শহুরে প্রবৃদ্ধি’ (পপুলেশন অ্যান্ড আরবান গ্রোথ ইন বাংলাদেশ) প্রবন্ধে বলছেন, ২৫ বছরে ঢাকা শহরের মানুষ চারগুণ বেড়েছে। ১৯৮০ সালে মানুষ ছিল ৩২ লাখ। ২০০৫ সালে ছিল এক কোটি ২৫ লাখ। তিনি বলছেন, ২০১৫ সালে মানুষ হবে এক কোটি ৭৯ লাখ। বর্তমানে ঢাকা শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৭ হাজার ৭শ’ মানুষ বাস করে।

জনসংখ্যা গবেষকেরা বলছেন, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৪ শতাংশ। শহরাঞ্চলে এই বৃদ্ধির হার চার শতাংশ। আর ঢাকা শহরে এই বৃদ্ধির হার ছয় শতাংশ। এর অর্থ, এক বছরে সাত লাখ ৮০ হাজার মানুষ বাড়বে এই শহরে। এদিকে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় ঢাকা শহরে মানুষ আসা বন্ধ হয়নি।

আগামীতেও বন্ধ হওয়ার তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন বা কর্মসংস্থানের পাশাপাশি নদী ভাঙন, গ্রামাঞ্চলে কাজের সংকট, জলবায়ুর পরিবর্তন-এসব কারণে মানুষ আসার পরিমাণ বরং আরও বাড়ছে। কিন্তু মানুষ বাড়লেও ঢাকা শহরে নাগরিক সুবিধা সে হাবে বাড়ছে না। বাড়ছে না রাস্তা। বরং যেসব সেবা আছে তাও ক্রমেই বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

যা সম্প্রতি রাজধানীর বেশ কিছু চিত্র দেখলেই বুঝা যায়। যানজট আর একটু বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা। স্থবির হয়ে পড়ে পুরো রাজধানী। যার ফলে একটি কথা আমাদের সবার মনে রাখতে হবে, মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে অস্ত্রোপচার কক্ষের টেবিলে রেখে সময়ক্ষেপণ মানেই রোগীর মৃত্যুকেই ত্বরান্বিত করা। কাজেই এ মুহূর্তে আর বিতর্ক নয়।

আর নয় কালক্ষেপণ। আমাদের চারশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকাকে বাঁচানোর এখনই সময়। স্বাধীনতার আগেও এই শহরে ৪৭টি খালের অস্তিত্ব ছিল। বেশির ভাগ খালের প্রস্থ ছিল ১৫০ ফুটের বেশি। স্বাধীনতার পর মাত্র তিন যুগের ব্যবধানে জলাধার দখলকারী ভূমিদস্যু থাবায় রাজধানী ঢাকা মহানগরী এলাকার ২৫টি খাল বিলুপ্ত হয়েছে।

তালিকা থেকে মুছতে শুরু করেছে একের পর এক খালের নাম। বর্তমানে ২২টি খালের সে অস্তিত্ব রয়েছে তাও ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। কোন কোন এলাকায় এসব খাল বর্তমানে নালা বা ড্রেন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আমরা রাজধানীতে যারা বসবাস করছি তাদের সবার মুখে একই ভাষ্য ‘রাজধানী ঢাকা বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। দিন দিন হারাচ্ছে এর ঐতিহ্য।

’ কিন্তু সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মহানগরীকে পৃথিবীর দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ শহর হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। খবরটি আতঙ্কের। অবশ্য এর আলামত ইতঃপূর্বে টের পাওয়া গেছে। ঢাকার খাল আর আশপাশের নদীগুলো ময়লার ভাগাড় দখল দূষণের শিকার। তার ওপর ক’দিন পর পরই আসছে অগ্নিকাণ্ড আর ভবন ধস খেলা।

যার পরিণাম নির্মম ও অসহায় মৃত্যু। আর কত মানুষের মৃত্যু হলে ঢাকা নিরাপদ হবে? এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারও কাছেই। আর এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে অবশ্যই চলমান যথেচ্ছাচার থামাতে হবে। আসতে হবে পরিকল্পিত নগরায়নের পথে । চারশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই ঢাকা শহর তথা রাজধানীকে বাঁচাতে কালক্ষেপন না করে, কারো প্রতিহিংসা চরিতার্থ বা ব্যক্তিস্বার্থ নয়, সব সিদ্ধান্তই আসতে হবে জনগণ তথা নগরবাসীর স্বার্থে।

তাই ঢাকাকে ও ঢাকার মানুষকে বাঁচাতে আমাদের সবাইকে আন্তরিকতার সাথে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থের সংঙ্কীণ মানসিকতার উর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.