আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলা কবিতার ছিন্ন পথ / সাজ্জাদ শরিফ

নাড়ি ছায়া , জাগি স্বপ্নের আভায়

 প্রবন্ধ বাংলা কবিতার ছিন্ন পথ সাজ্জাদ শরিফ | তারিখ: ৩০-০৭-২০১০ চেক সাহিত্যিক মিলান কুন্ডেরার একটি কথা দিয়ে শুরু করা যাক। দ্য কারটেইন নামে তাঁর একটি বইয়ের মূল বিষয়বস্তু, নিতান্ত সরল করে বললে, সাহিত্য ও যাপনের মধ্যেকার নিহিত সম্পর্ক। আর এ সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে তিনি টেনে এনেছেন নিজের রাজনৈতিক-ভৌগোলিক বিস্তর অভিজ্ঞতা। এক জায়গায় প্রসঙ্গান্তরে বলেছেন, সাহিত্য সমালোচক যখন কথা বলেন, তখন তার অবস্থান যেন নিশ্চয়তায় দৃঢ়। যেন বা তিনি দাঁড়িয়ে আছেন পোডিয়ামে, প্রবল আত্মবিশ্বাসে নিজের মত জানিয়ে দিচ্ছেন সামনে বসে থাকা শ্রোতৃমণ্ডলীতে।

অথচ যিনি সাহিত্যরচনায় নিবিষ্ট, সাহিত্য নিয়ে কিছু বলার সময় তাঁর যেন সংশয়ের শেষ থাকে না। এ যেন একজন শিল্পীর নিমন্ত্রণ করে কাউকে তাঁর নিজের স্টুডিওতে নিয়ে যাওয়া, তাঁর শেষ-হয়ে-যাওয়া ও এখনো-শেষ-না-হওয়া ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দোলাচল ও ভঙ্গুর অনুভূতি ভাগ করে নেওয়া; নিজের অভিজ্ঞতা শিল্পরসিকের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা। আমাদের মতো কোনো কবিতা-লিখিয়ের পক্ষেও এর ওপরে ওঠা সম্ভব নয়। ফলে কবিতা-লিখিয়ে হিসেবে কবিতার খতিয়ান লিখতে বসলে সেই ভঙ্গুর ও দ্বিধাগ্রস্ত মনের ছাপ লেখায় এসে পড়তে বাধ্য। একজন কবির অনিবার্য নিয়তি এই যে তাঁর সময়ে কবিতা যে অব্দি এসে পৌঁছোয়, সেখান থেকেই তাঁকে শুরু করতে হয়।

আবার একই সঙ্গে এ কথাও সত্য, সেই পর্যায়টি পেরিয়ে যেতে না পারলে তাঁর পক্ষে নিজের কবিতা লেখাও সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। সকল অর্জন ও বিসর্জনসমেত কবিতার ইতিহাসের একটি ভার এভাবে প্রত্যেক কবির হাতেই এসে পৌঁছোয়। কুন্ডেরা তাঁর লেখাটিতে প্রস্তাব করেছেন, সমাজ-রাজনীতির ইতিহাস ও সাহিত্যের ইতিহাস বিচ্ছিন্ন ও সমান্তরাল দুটি ধারা। কিন্তু বর্তমান লেখকের ধারণা, দুটো ইতিহাসই যেহেতু মানুষ নিজের হাতে গড়ে তোলে, তাই একটা আরেকটার মধ্যে ঢুকে যেতে বাধ্য। এক থেকে আরেকটাকে আলাদা করা অসম্ভব।

সে ইতিহাসের জটিলতা বাদ দিয়ে এ সময়ের কবিতাকে বুঝতে পারাও অসম্ভব। কোনো কোনো আলোচক এ সময়ের কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে যে কথাগুলো বলে থাকেন, সেগুলোকে মোটা দাগে সারমর্ম করে দুটো লক্ষণে নামিয়ে আনা যায়। এর একটি হলো কবিতায় ঠাট্টার ভঙ্গিমা নিয়ে আসা, আরেকটি হলো ভাষাকে নানা দিক থেকে ভেঙে দেওয়ার একটি অবিরাম চেষ্টা। সাহিত্য-সমালোচকেরা বলেছেন ‘ঠাট্টা’। আমরা ‘ভাঁড়ামি’ও বলতে পারি।

একদল কবি গুরুগম্ভীর নানা বিষয়কে পরিহাসবাণে জর্জরিত করে ফেলছেন। এই ভাঁড়ামিকে খাটো করে দেখা একেবারেই ঠিক হবে না। যখন কোনো সার্বিক কর্তৃত্ববাদী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, ধারণা বা মূল্যচেতনা সমাজে একমেবাদ্বিতীয়ম হয়ে ওঠে, কবির পক্ষে তখন ভাঁড় ছাড়া আর কিসের ভূমিকা নেওয়া সম্ভব? ভাষার ব্যাপারটি আরও কিছুটা জটিল। তার পরেও এ দুটোই তো কবিতার বাইরেরই লক্ষণ। এসব পেরিয়ে আমাদের কবিতার ভেতরের দিকে, ইতিহাসের মধ্যে বিবর্তিত হওয়ার সময় তার মধ্যে কী ঘটেছে—তার দু-একটি সামান্য লক্ষণের দিকেও একটু ফিরে তাকানো দরকার।

বিভিন্ন লেখক ও আলোচক আমাদের সাম্প্রতিক কবিতার অর্জন নিয়ে আলোচনা করছেন, ভবিষ্যতেও করবেন। কিছু কিছু অর্জন আমাদের কবিতার আছে নিশ্চয়। আমরা আজ বরং চোখ ফেরাই আমাদের কবিতার কিছু বিসর্জন, ছেদ বা বিচ্যুতির দিকে। এটি যদি আমাদের কবিতার সমালোচনা হয়, তবে একজন কবিতা-লিখিয়ে হিসেবে তা আত্মসমালোচনার অধিক কিছু নয়। ২. নিজের মধ্যে কবিতার কিছু বিচ্যুতি ঘটেছে পৃথিবীজুড়েই, বিশ্ব-ইতিহাসের ধাক্কায়।

যেমন কবিতার উপভোগে ইন্দ্রিয়ের বদল ঘটেছে। মুদ্রণযন্ত্রের উদ্ভবের কারণে কবিতা উপভোগের উপায় হিসেবে মুখ ও কানের সম্পর্ককে প্রতিস্থাপন করে অভ্যুত্থান ঘটেছে চোখের। শ্রুতির জায়গা নিয়েছে দৃষ্টি। মুদ্রণযন্ত্রের কল্যাণে স্মৃতির অসীম গুরুত্ব লোপ পাওয়ায় কবিতা বেপরোয়া হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে। তবে এর ফলে অতিদ্রুত আমরা সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি প্রায় হারিয়ে ফেলেছি, তা হচ্ছে কবিতার শ্রাব্যগুণ—তার নিহিত সুর।

কিন্তু আমাদের বিষয় একান্তই বাংলা কবিতার ইতিহাস। বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক বিচ্যুতির কথা বলার জন্য আমাদের দ্রুত পেছনের ইতিহাস ঘুরে আসতে হবে। আমাদের কবিতার গত কয়েক দশকের বিচ্যুতি অনতি-অতীতের সেসব বিচ্যুতির ভিত্তির ওপরই গাঁথা। উপন্যাস নিয়ে বইটির একটি রচনায় পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায় বলেছিলেন, উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে আমরা দুটো আধুনিকতার উন্মেষ দেখেছি। কথাসাহিত্য ও কবিতায় প্রথমে এ উন্মেষ ঘটেছিল যথাক্রমে টেকচাঁদ ঠাকুর ও ঈশ্বর গুপ্তের হাতে।

দ্রুতই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে বিকশিত ভিন্নতর এক আধুনিকতা আগের এ আধুনিকতাকে অতিদ্রুত চাপা দেয়। আমরা আমাদের আলোচনা কবিতার মধ্যেই সীমিত রাখব। আরও পরে আমরা দেখেছি, ১৯৩০-এর দশকে কলকাতায় আরেকটি আধুনিকতা এসে উনিশ শতকের দ্বিতীয় আধুনিকতাটিকেও স্থানচ্যুত করে। একটি বিষয় লক্ষ করার মতো, আধুনিকতার এই তিন তরঙ্গের কোনোটিতেই প্রধানত বাঙালি মুসলমানের এবং গৌণত—প্রবল প্রতাপশালী মধুসূদনকে মনে রেখেও বলছি—পূর্ববঙ্গের তেমন অংশগ্রহণ ছিল না। এর লম্বা লম্বা কারণ আছে।

আমরা মোটা দাগে দুটো কারণের কথা বলব, নাসারা উপনিবেশের বিরুদ্ধে—ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রণোদনা থেকে—মুসলমানদের দীর্ঘ অসহযোগ এবং কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে পূর্ববঙ্গীয়দের চেয়ে নিজেদের উঁচু করে দেখার আত্মঅহমিকা। ফলে দীনেশচন্দ্র সেন অনেক উচ্চাশা নিয়ে সাহিত্য আলোচনা করতে গেলেও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁদের দুজনের আলোচনা আলু-পেঁয়াজের দরদামের বাইরে নিয়ে যান না; আর দীনবন্ধু মিত্রের নাটকে পূর্ববঙ্গের বাঙাল জমিদার চরিত্রটি কলকাতায় পৌঁছে মদ গিলে ও মাগিবাড়ি গিয়েও বাবুদের পঙিক্ততে উঠে বসতে না পারার জন্য আক্ষেপ করে মরে। আমাদের বক্তব্য, এই তিন-তিনটি আধুনিকতা কবিতা থেকে ব্যাপক অর্থে বাংলা কবিতার বৃহত্তর পাঠকশ্রেণীকে এবং সুনির্দিষ্ট অর্থে হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় জনগোষ্ঠী ও পূর্ববঙ্গ-পশ্চিমবঙ্গের বিচ্ছিন্নতাকে প্রকট করে তুলছিল। লক্ষ করবেন, ১৯৩০-এর দশকের সময়কাল থেকে যে সংকলনগুলো বেরোতে শুরু করে, সেখানে নতুন এ কবিতার সঙ্গে বাংলা কবিতার দীর্ঘ ঐতিহাসিক পরম্পরারও ছেদ ঘটতে দেখা যায়। এসব সংকলনের প্রতিটিরই শুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়ে।

নতুন বাংলা কবিতা যেন ভুঁইফোড় একটি ব্যাপার। আর এর ইতিহাস শুরু হলো এই মুহূর্ত থেকে। রবীন্দ্রনাথের অবস্থানও এসব সংকলনে অনেকটা হংসমধ্যে বক যথা। নিষ্ঠুর হলেও হুমায়ুন আজাদের এ অবস্থান যথার্থ যে, এসব সংকলনে রবীন্দ্রনাথ রীতিমতো খাপছাড়া। আধুনিকতাবাদী কবিতার সকল সূচকেই অত্যন্ত খাপছাড়া আরও দুজন কবির কথা উল্লেখ করা যায়: কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীন।

এঁদের নিয়ে সংকলকদের অস্বস্তি চোখ এড়িয়ে যাবার মতো নয়। অন্য আর যাঁর ভুক্তি নিয়ে জটিল বিতর্ক তোলা যেতে পারে, তিনি জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দের চোরাফাঁদ ও রহস্য ভেদ করতে এখনো বহু বাকি। সে প্রসঙ্গ অন্যত্র। ৩. রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে কাটাছেঁড়া হওয়া এ অঞ্চলে দ্রুতই কিছুটা দৌড়ে, কিছুটা হাঁপিয়ে, আধুনিকতার লোকাল বাসে উঠতে উঠতে পূর্ববঙ্গের কবিদের ১৯৪০ থেকে পঞ্চাশের দশক লেগে যায়।

যদি ঐক্যের দিকে তাকাই, রাজনৈতিক সীমান্তের এপারের-ওপারের কবিদের এই প্রথম ঐক্য ঘটল একই নন্দনবৃত্তের পরিধির মধ্যে। কিন্তু বিচ্যুতি কোথায় ঘটল, সেটাই এবার দেখার বিষয়। কবিরা দল বেঁধে লেখেন না। ফলে এখানেও কবিদের মধ্যে ব্যতিক্রম আছেন। আমরা কথা বলব কবিতার প্রধান ধারাটি নিয়ে, যার সূত্রপাত ঘটেছিল শামসুর রাহমানের মধ্য দিয়ে।

শিক্ষিত মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত আবেগ শামসুর রাহমানের কবিতায় ঠিকরে পড়তে শুরু করেছিল। তিনি এমন একটি কবিতার ভাষা তৈরি করেছিলেন, যা কবিতাকে বহুগম্য করে তোলে। সে ভাষা দ্রুত কবিসমাজের একটি ব্যসনে পরিণত হয় এবং অর্ধশতক ধরে বাংলাদেশের কবিতায় রাজত্ব করে। স্বাধীনতার দশকখানেক পরে কেউ কেউ আপত্তি করতে শুরু করেন, কবিতা নিছক স্লোগান হয়ে পড়ছে। এরপর কবিতার যে উপপ্লব শুরু হয়, তাতে ব্যষ্টিক অভিজ্ঞতা কবিতা থেকে নির্বাসিত হতে শুরু করে।

গত প্রায় ৩০ বছরে কবিতা যে দিকে ঝুঁকেছে, তাতে ব্যক্তির বাইরের জগৎ ক্রমাগত রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। আমাদের ধারণা, শামসুর রাহমানের নেতৃত্বে কবিতার যে ধারাটি প্রতাপশালী হয়ে উঠেছিল, সেটিকে ১৯৮০-র দশকের কবিরা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি। তাই সে সংকটের বেশ অনেকটা সমাধান তাঁরা করেছেন বটে, কিন্তু জন্ম দিয়েছেন নতুনতর মহাসংকটের। ১৯৮০-র দশকে ‘সময়’ নামে তরুণ আঁঁকিয়েদের একটি গোষ্ঠীও নতুনতর চেতনা নিয়ে চিত্রকলার আঙিনায় হাজির হয়। চিত্রশিল্পীর মূল প্রকরণ যে রেখা আর রং, স্বভাবগতভাবেই তা বিমূর্ত।

ফলে চিত্রকরেরা শুরুই করেন প্রকরণগত নির্বস্তুকতা থেকে। কাগজ বা ক্যানভাসে সমতলীয়ভাবে একটিমাত্র রং লেপে দিয়েও যে দর্শকচিত্তে সংবেদনশীলতা জাগিয়ে তোলা সম্ভব, রুশ বংশোদ্ভূত মার্কিন শিল্পী মার্ক রথকোর চিত্রকর্মে তার অজস্র নজির ছড়িয়ে আছে। ‘সময়’ গোষ্ঠীর শিল্পীরা—সমসাময়িক বিমূর্ত শিল্পকলার মাত্রাতিরিক্ত দাপটে অস্থির হয়ে ও নান্দনিক অসারত্বে সায় না পেয়ে—যাত্রা শুরু করেছিলেন এর বিপরীতে। মুশকিল হচ্ছে, কবি আর চিত্রকরের শিল্পযাত্রা মূলগতভাবেই বিপরীত। কবির উপাদান যে শব্দ, সেটি পানির মতো স্বচ্ছ।

কেউ ‘আম’ বললে বাংলাভাষী সকল মানুষই বর্ণগন্ধস্বাদসহ সুনির্দিষ্ট একটি ফলকেই বুঝবেন। তার বাইরে অন্য কিছু কেউ বুঝবেন না। শব্দের এই স্বচ্ছতার বিনাশ না ঘটিয়ে, অভিধানের অর্থ থেকে শব্দকে সরিয়ে না দিয়ে কবির পক্ষে তার কবিতা রচনা শুরু করাই সম্ভব নয়। এই জায়গাটিতে একটি পুরো ভাষাগোষ্ঠীর বিপরীতে কবির একার লড়াই। কিন্তু কেন এ লড়াই? কারণ তিনি তাঁর ভাষাগোষ্ঠীকে এমন একটি অভিজ্ঞতা তাঁর কবিতার মাধ্যমে ফিরিয়ে দেবেন, যা এই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনো রূপ পায়নি; যে উপলব্ধি এই ভাষাসমাজে এখনো অপ্রস্ফুটিত।

কবিতার জন্ম আমাদের ভাষাভূত ও অভিজ্ঞতার অন্তর্গত স্থিতাবস্থার বাইরে থেকে। প্রতিটি সার্থক কবিতাই সে কারণে বিপ্লবী। কারণ তা স্থিতাবস্থাকে নাড়িয়ে দেয়। আমাদের ধারণা, গত ৫০ বছরে প্রতাপশালী হয়ে থাকা শামসুর রাহমান-প্রণোদিত কাব্যভাষাটি কবিতার এই মৌলিক ভিত্তি থেকে সরে এসেছিল। ১৯৮০-র দশকে ‘সময়’ গোষ্ঠীর সমসাময়িক কবিদের মধ্যে এর বিপরীত এক প্রতিক্রিয়া জেগে ওঠে।

কিন্তু তাঁদের পথ চলতে শুরু করতে হয় এ সময়ের চিত্রশিল্পীদের ভাবনার বিপরীত পথে। ‘সময়’ গোষ্ঠীর শিল্পীরা আসতে চেয়েছিলেন বিমূর্ত থেকে মূর্তে, অবয়বহীনতা থেকে অবয়বের দিকে। আর এ সময়ের কবিরা যাত্রা করলেন বস্তুভার থেকে নির্বস্তুকতার দিকে, অর্থ থেকে অর্থভারমুক্তির দিকে। গত ৩০ বছরে আমাদের কবিতায় প্রধানত যা ঘটেছে, এক কথায় বললে, সেটি কবিতাকে তার বাগ্যন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, আগেই বলেছি, কবিতা এক নতুনতর মহাসংকটে পড়েছে।

এর মাধ্যমে সাম্প্রতিক কবিতায় এক নিরুদ্ধ অন্তর্জগতের উন্মীলন ঘটেছে। অন্তর্জগতের অভিজ্ঞতা প্রকাশে পারঙ্গম হয়ে উঠেছে আমাদের কবিতার ভাষা। কিন্তু একই সঙ্গে এ কবিতার কাছে আস্তে আস্তে রুদ্ধ হয়ে পড়েছে বাইরের বৃহত্তর জগৎ। কিন্তু কাকে বলে বাইরের জগৎ? ভেতরের জগৎই বা বলে কাকে? এর উত্তর খুঁজতে চাওয়ার আগে শুরুতেই যে পটভূমিটি রচনা করেছি, সেই সময়ের কিছুটা আগে আমাদের একটু ফিরে তাকাতে হবে। লোকায়ত বাংলার দর্শন কখনো ভেতর আর বাহিরকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেনি।

বিচ্ছিন্ন করে দেখেনি বাংলার আদি কবিতাও। আধুনিকতাবাদের হাত ধরে এই ভেদ বাংলা কবিতায় অনুপ্রবেশ করেছে। বাংলা কবিতার দ্বিতীয় যে আধুনিকতার উন্মেষ মধুসূদন দত্তের হাতে ঘটেছিল, তাতে পশ্চিমের অভিষেক ঘটেছে, কিন্তু এই ভেদ তখনো স্পষ্ট রূপ পায়নি। কারণ প্রেরণার প্রধান উৎস তখনো ছিল পশ্চিমের শিল্প-বিপ্লবেরও আগের সেই কালপর্বের সাহিত্য, যাকে আমরা বলি ধ্রুপদি বা চিরায়ত, যখন জগৎ ও চেতনাকে আলাদা আলাদা করে দেখার ঝোঁক শুরু হয়নি। শিল্প-বিপ্লবোত্তর সাহিত্যের প্রবল প্রভাব বাংলা কবিতায় পড়তে শুরু করল ১৯৩০-এর দশক থেকে।

বাংলা কবিতার তখন আরেক নতুন আধুনিকতার কাল। আমাদের কবিতায় জগৎ ও চেতনাকে ওতপ্রোতভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটি এ সময় ফিকে হয়ে যেতে শুরু করল। এ দুটোকে আলাদা করে চেতনাকে আমরা একমাত্র উপাস্য করে তুললাম। জগৎকে ঠেলে সরিয়ে দিলাম দূরে। বুদ্ধদেব বসুর মতো নতুন কবিতার নেতা লিখলেন, ‘ছেড়ে দাও জগতেরে, যাক সে যেখানে যাবে।

’ এর ফল হলো এই যে ‘বাইরে’র অভিজ্ঞতা তুলে ধরার ভাষা আমাদের হাত থেকে ছুটে গেল। রুদ্ধ হয়ে গেল তার ক্রমবিকাশ। পরে আমাদের মধ্যে যাঁরা সে চেষ্টা করলেন, তাঁদের কবিতায় যেন আর কোনো সুর বাজল না। এ অভিযোগও হয়তো ফেলে দেওয়া যাবে না যে সে ধরনের অধিকাংশ কবিতায় অভিজ্ঞতার সততাও ছিল কম। একটি কবিতার বইয়ের নামই ধরা যাক, একা নই, পেছনে মানুষ।

বইটির শিরোনামে কবির অভিপ্রায়ে কোনো রাখঢাক নেই যে একটি প্রবল জনস্রোতে তিনি আসছেন। কিন্তু শিরোনামটিতে অন্য যে কথাটি প্রচ্ছন্ন তা হলো, সে জনস্রোতেও জনতা থাকবে তাঁর পেছনে, তিনি হবেন তাদের সবার নেতা। আমাদের অনেক সংগ্রামী কবিতার গন্তব্য কবিদের এমনতর উচ্চম্মন্যতায়। আমরা বলছিলাম সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় মানুষের ভেতরের আর বাইরের জগতের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার এবং অন্তর্জগৎটিই একমাত্র কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা। দুনিয়ার আর কোথাও কবিতার এমন বিধ্বংসী কাণ্ড আর দেখা যাবে না।

সাম্প্রতিক আরব কবি আদোনিস থেকে মার্কিন কবি ইমামু আমিরি বারাকা—সবার কবিতায় জগৎ ও চেতনার ভেদের এই কৃত্রিম বর্ণপ্রথা তছনছ হয়ে ভেঙে পড়েছে। কথা এবার গুটিয়ে আনা যাক। ইহুদি বংশোদ্ভূত ওলন্দাজ দার্শনিক বারুখ স্পিনোজা মানতেন, জগৎ আর চেতনায় আমরা যে ফারাক করি, সেটি নিছক এক বিভ্রম। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে তিনি বরং বলেন, আদতে এ দুইয়ের মধ্যে কোনো ফারাকই নেই। বৃত্তচাপের মতো একটি বাঁকা রেখার দুই পাশে উত্তল আর অবতল যেমন পরস্পরের সাপেক্ষে অস্তিত্বময়।

এক পাশে উত্তল আছে বলেই আরেকটি পাশ অবতল। জগৎ আর চেতনার সম্পর্ক সে রকম অবিচ্ছিন্ন। দুইয়ে মিলে এক অভিন্ন সত্তা। শিল্প-বিপ্লবে উন্মুখ ইয়োরোপ স্পিনোজাকে নেয়নি; নিয়েছিল ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তেকে, জগৎ আর চেতনার মধ্যে ফারাকের যিনি ছিলেন মূল মন্ত্রণাদাতা। এতে শিল্প-বিপ্লবোত্তর কালে উপনিবেশের যুগ পত্তনের একটি দার্শনিক ভিত্তি পাওয়া গিয়েছিল।

আমাদের কবিদের মন সেই ভেদনীতি থেকে এখনো সরে আসতে পারেনি। জগৎ আর চেতনার একের মধ্যে অপরের একাকার হয়ে যাওয়া দশাটিকে আমাদের কবিতার ভাষায় আবার যে দিন আমরা আত্মস্থ করতে পারব, বাংলা কবিতা হয়তো সে দিন আরেকটি নতুন ইতিহাসের মধ্যে প্রবেশ করবে। প্রথম আলো সাহিত্য সাময়িকী / ৩০ জুলাই ২০১০ ছবিটি - রণজিৎ দাস এর

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।