আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের সংস্কৃতির পরিচয়



মানুষের বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি, মন-মানসিকতা এবং জীবন লক্ষের চেতনার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে জীবনবোধ এবং তারই প্রকাশ সংস্কৃতি। কেবলমাত্র সাহিত্য বা শিল্পকলার মধ্যেই সংস্কৃতি সীমাবদ্ধ নয়। সংস্কৃতি গোটা জীবন পরিব্যাপ্ত। কলকাতার 'সাহিত্য সংসদ' প্রকাশিত অশোক রায়ের 'সমার্থ শব্দকোষে' সংস্কৃতির সমার্থ শব্দগুলো লিখেছেন-কালচার, কৃষ্টি, তমদ্দুন, মার্জনা, পরিশীলন, পরিমার্জন, অনুশীলন, সভ্যতা, শিষ্টতা, রুচিশীলতা, রুচি, সুরুচি। 'সংস্কৃতি' শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ঈঁষঃঁৎব. প্রসেফর জিল্লুর রহমান সম্পাদিত ইধহমষধ অপধফবসু ঊহমষরংয উরপঃরড়হধৎু তে ঈঁষঃঁৎব শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে-সংস্কৃতি, কৃষ্টি, মানব সমাজের মানসিক বিকাশের প্রমাণ।

একটি জাতির মানসিক বিকাশের অবস্থা। কোনো জাতির বিশেষ ধরনের মানসিক বিকাশ। কোনো জাতির বৈশিষ্ট্যসূচক শিল্প সাহিত্য, বিশ্বাস, সমাজনীতি। ঞুষড়ৎ তার প্রিমিটিভ কালচার গ্রন্থে লিখেছেন-ঈঁষঃঁৎব রং ঃযধঃ পড়সঢ়ষবঃব যিড়ষব যিরপয রহপষঁফবং শহড়ষিবফমব, নবষরবভ, ধৎঃ, সড়ৎধষ ষধ,ি পঁংঃড়স ধহফ ড়ঃযবৎ পধঢ়ধনরষরঃরবং ধহফ যধনরঃং ধপয়ঁরৎবফ নু সধহ ধং ধ সবসনবৎ ড়ভ ঃযব ংড়পরবঃু. 'সংস্কৃতি' শব্দটি উঁচু শ্রেণীর বৌদ্ধিক পারদর্শিতা এবং আত্মিক শুদ্ধির প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে। সে কারণেই একজন সংস্কৃতিবান মানুষ বলতে আমরা শিক্ষিত, পরিশীলিত, নান্দনিক প্রজ্ঞাসমপন্ন সুচারু ও ভদ্র কোনো ব্যক্তিকে নির্দেশ করি।

কিন্তু 'সংস্কৃতি' বলতে আবার জীবনচর্চার একটি প্রক্রিয়াও নির্দেশিত হয়, মানুষ নিজের জীবনে যার ব্যবহারিক চর্চা করে থাকে। সমগ্র জীবন দর্শন হিসেবে সংস্কৃতির পদ্ধতিগুলি শিক্ষা ও সূক্ষ্ম বোধের অগি্নতে পরিশুদ্ধ হয়ে স্ফটিকের চেহারা ধারণ করে। সে জন্য যে দেশে বৃহৎ সংখ্যক পণ্ডিত ব্যক্তি লেখক, বিজ্ঞানী, স্থপতি-এসব শ্রেণীর মানুষ বেশি সংখ্যায় বসবাস করেন। সে দেশের সংস্কৃতিকে খুব উচ্চশ্রেণীর বলে ধরা হয়। সংস্কৃতি চর্চার উপাদান ভেদের কারনে, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সংস্কৃতিও ভিন্ন হয়।

'উচ্চশ্রেণীর সংস্কৃতি' ও 'নিম্নশ্রেণীর সংস্কৃতি' 'লেখ্য সংস্কৃতি' ও 'কথ্য সংস্কৃতি' 'বৃহৎ ঐতিহ্য' ও 'ক্ষুদ্র ঐতিহ্য', 'ধ্রুপদী সংস্কৃতি' ও ' লোকসংস্কৃতি'-এসবই এই বৈষম্যের ফলে সৃষ্ট। ক্রোবার এবং ক্লুকহোন সংস্কৃতির সংজ্ঞায় বলেছেন, ঈঁষঃঁৎব রং ঢ়ৎড়ফঁপঃ, রং যরংঃড়ৎরপধষ; রং ংবষবপঃরাব; রং ষবধৎহবফ; রং নধংবফ ঁঢ়ড়হ ংুসনড়ষং; ঢ়ৎড়ফঁপঃ ড়ভ নবযধারড়ঁৎ. আমরা বাংলাদেশি, বাংলা ভাষাভাষী। শুধু তাই নয়, আমরা মুসলিম। সুতরাং আমাদের সংস্কৃতি জীবনের বাস্তব প্রতিফলস্বরূপ। দুই ঈদ উদযাপন, কুরবানী দেয়া এগুলো সংস্কৃতির অংশ, তেমনি একুশ উদযাপন, নববর্ষ উদযাপনও সংস্কৃতির বাইরে নয়।

তবে হঁ্যা, কতটুকু করা যাবে, কতটুকু যাবে না সেই বিচারে মানদণ্ড মুসলমানদের জন্য ইসলাম। সুতরাং ভালবাসা দিবস, থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনসহ এগুলোতে যা করা হয় ধর্ম তার বৈধতা দেয় না। এগুলো অপসংস্কৃতি। জীবনের রয়েছে সুখ-দুঃখ, শান্তি-সংঘাত, সাফল্য- বৈকল্য প্রভৃতি বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি, তেমনি জীবনের প্রতিবিম্ব হিসেবে সংস্কৃতিরও রয়েছে একটা বহুমাত্রিক বিস্তৃত পরিসর। এ ব্যাপক দৃষ্টিকোণ থেকেই ইদানীং সামাজিক সংস্কৃতি, নৈতিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রভৃতি বিভিন্ন নামের চল শুরু হয়েছে।

সুস্থ সংস্কৃতি ও অসুস্থ সংস্কৃতি বলেও একটি ধারণা চালু আছে। সংস্কৃতির ইংরেজি প্রতিশব্দ কালচার। ইংরেজি সাহিত্যে কালচার কথাটার প্রথম ব্যবহার করেন ফ্রান্সিস বেকন ষোল শতকের শেষভাগে। তাঁর মতে, বিজ্ঞানের কাজ যেখানে প্রকৃতির প্রতি অনুগত থেকেই প্রকৃতিকে জয় করা, সেখানে শিল্প-কাব্য-সাহিত্য তথা কালচারের লক্ষ সুকুমার বৃত্তির অনুশীলন দ্বারা মানবমনকে প্রকৃতির যান্ত্রিক বন্ধন থেকে যুক্ত করা সৃজনশীল মার্জিত জীবনের সন্ধান দেয়া। কর্ষণ (কালটিভেশন) বা চাষবাসের মাধ্যমে একটা জমিকে যেভাবে ফসল উৎপাদনের উপযোগী করে তোলা হয়, তেমনি কৃষ্টি বা সাংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে মানুষের অপরিশীলিত চিন্তা-ভাবনা ও আচার-আচরণকে পরিশীলিত এবং সত্য-সুন্দর-কল্যাণের চর্চায় উদ্বুদ্ধ করা হয়।

বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়, "উদ্ভিদের পক্ষে কর্ষণ যাহা, মানুষের পক্ষে স্বীয় বৃত্তিগুলির অনুশীলন তাহাই। এ জন্য ইংরেজিতে উভয়ের নাম ঈঁষঃঁৎব. ফ্রান্সিস বেকন থেকে শুরু করে ম্যাথু আর্নল্ড, ইমারসন প্রমুখ পাশ্চাত্যে এবং বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বাংলা সাহিত্যে সংস্কৃতির সংজ্ঞার্থ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। তাঁদের মতামতে কিছু পার্থক্য থাকলেও একটি বিষয়ে তাঁরা সবাই ছিলেন একমত, আর সেটি হলো এই যে, সংস্কৃতি মাত্রই সর্বতোভাবে একটি অন্তরলোকের ব্যাপার-সংস্কৃতি মানে মানসিক অনুশীলন, সুরুচি ও শিষ্টাচারের চর্চা। তবে এ অর্থে সংস্কৃতির উৎপত্তি যদিও ব্যক্তিগত সুরুচি ও শিষ্টাচারে, এর বহিঃপ্রকাশ ও ব্যাপ্তি ঘটে সঙ্গীতে, কাব্যে, সাহিত্যে, ললিতকলায়, ধর্মে ও দর্শনে। নানা ধরনের সামাজিক সংঘাত বর্ণভেদ, শ্রেণীভেদ, লিঙ্গভেদ বা গোষ্ঠী-পরিচয়ভেদ সংস্কৃতিকে জীবনচর্চার অন্যতম উপাদান হিসেবে কাজ করতে বাধা দিয়েছে।

কেননা সামাজিক বৈষম্য সংস্কৃতি চর্চার উপাদানগুলিকে সমস্ত মানুষের কাছে সমানভাবে পেঁৗছে দেয় না। অনেকে সংস্কৃতির প্রসঙ্গটি ধর্ম বা ঐতিহ্যের সাথে অনেক কম সম্পর্কযুক্ত ভাবেন, শ্রেণীর সাথে সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে বলেন। অথচ মুসলিমদের সংস্কৃতি চর্চা, ইসলামী সংস্কৃতির সাথে অর্থাৎ ধর্মের সাথে অনেক বেশি সম্পর্কযুক্ত। 'সংস্কৃতি' দেশের অন্তরঙ্গকে শাসন করছে, তাতে আবার নিয়ন্ত্রণ করছে সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি। খুব নরমভাবে বললে, 'বিশ্বায়ন' বলা হচ্ছে এটাকেই।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।