আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আব্বাস কিয়ারোস্তামির মুখোমুখি

ঘর! ফেরা হয়নি আমার ঘর!

আব্বাস কিয়ারোস্তামীর মুখোমুখি সাক্ষাৎকার গ্রহীতা- ডেভিড স্টেরিট অনুবাদ-নাসিমুল হাসান ইরানের চলচ্চিত্রকে যিনি প্রায় একক প্রচেষ্টায় বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন, চলচ্চিত্রের দর্শক ও বোদ্ধাদের অভিভূত করে দিয়েছেন এক নতুনতর ভাষা ও দর্শনের আলোকে, আকিরা কুরাসাওয়ার চোখে সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর তার অভাব অনুভূত হওয়ার কোন সুযোগ যিনি দেননি, তিনি আব্বাস কিয়ারোস্তামী ব্যতিত আর কেউ নন। ১৯৮৯ সালের ‘ক্লোজ আপ’ চলচ্চিত্রটি দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে সদর্প প্রবেশ কিয়ারোস্তামী করেছিলেন তা পরিপূর্ণতা পায় তার অনন্য সাধারণ চলচ্চিত্র ‘টেস্ট অফ চেরী’ র কান চলচ্চিত্র উৎসবে সর্বোচ্চ পুরস্কার 'পাম ডে অর' অর্জনের মাধ্যমে। চলচ্চিত্রটির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে এমন একজন ব্যক্তিকে নিয়ে যে তার জীবনের ইতি টানতে চাইছে আত্মহত্যার মাধ্যমে এবং এটি ঘটাতে সে তিনজন আগন্তুকের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। একদম শেষ অংশে দেখা যায় অভিনেতা ও পরিচালকসহ সবাই যেখানে আত্মহত্যা সংগঠিত হওয়ার দৃশ্যটি আছে সেখানে ফাইনাল টেক নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অনেক চলচ্চিত্র সমালোচকের পক্ষে মুভির এসব ব্যাপার গলধ:করণে জটিলতা দেখা দেয়।

তাদের মতে এখানে কোন সমাধানের পথ বের না করে আরও বেশী ধাঁ ধাঁ ও প্রশ্নের দিকে দর্শককে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তার পরবর্তী মুভি ‘দ্যা উইণ্ড উইল ক্যারি আস’ এ সেই সমালোচক দল ফিরে আসে। তারা মুভিটির কাহিনীর গঠন, চরিত্র ও সামগ্রিক জটিলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এসব সমালোচনা আদৌ ধোপে টেকেনি। ইরানের চলচ্চিত্র নিয়ে যারা সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধিটুকু ধারণ করেন তারা জানেন যে তাঁর ‘টেস্ট অফ চেরী’ এবং দ্যা উইণ্ড উইল ক্যারি আস’ বিশ্ব চলচ্চিত্রের দু’টি মাইলফলক মুভি।

‘দ্যা উইণ্ড উইল ক্যারি আস’ মুভিটির শিরোনাম ও চিত্রনাট্যের ছোট কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ নেয়া হয়েছে প্রয়াত ফারসী কবি ফরুখ ফারুখজাদের একটি কবিতা থেকে। এর কাহিনীতে দেখা যায় একজন ফিল্মমেকার এমন একটি ritual রেকর্ড করতে গ্রামে আসে যা মূলত একজন বৃদ্ধ মহিলার মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় যখন সে বৃদ্ধা মৃত্যুর কাছে হার স্বীকার না করে জীবন ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এই মুভির বিভিন্ন দেখা-অদেখা চরিত্র, প্রাচীন ও আধুনিক যুগের অদ্ভুতুড়ে সব যোগাযোগ পদ্ধতি, একের পর এক রহস্যময় ঘটনা পরিক্রমা এবং সর্বোপরি এর কাব্যিক দার্শনিক রূপ দর্শকের চেতনায় গাঢ় প্রভাব বিস্তার করে। আব্বাস কিয়ারোস্তামীর সাক্ষাৎকারটিতে তাঁর চলচ্চিত্রের পদ্ধতি, বৈশিষ্ট্য, সমালোচনা এবং দর্শকের মনে এসব চলচ্চিত্রের প্রভাব কিরূপ এসব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

সাক্ষাৎকারগ্রহীতা ডেভিড স্টেরিট একজন বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক এবং একইসাথে লঙ আইল্যাণ্ড ইউনিভার্সিটির একজন স্বনামধন্য প্রফেসর। স্টেরিট এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন যখন কিয়ারোস্তামী সান ফ্রান্সিসকো ফ্রাস্টিভাল হতে আজীবন সম্মাননাস্বরূপ আকিরা কুরাসাওয়া অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন এবং যেহেতু কুরাসাওয়া স্বয়ং কিয়ারোস্তামীর কাজ নিয়ে উপস্থিত প্রসংসা করেছেন, স্টেরিট তার প্রশ্ন শুরু করেন কুরাসাওয়ার কাজের সাথে কিয়ারোস্তামীর কাজের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে কি-না এই প্রশ্ন নিয়ে। কিয়ারোস্তামীঃ মোটেও না। আমার মনে হয় যেসব চলচ্চিত্র নির্মাতা একটি নির্দিষ্ট ধারার চলচ্চিত্র তৈরি করে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার অন্য একজন চলচ্চিত্রকারের কাজ পছন্দ করতেই পারে। যেসব ধরুন ‘দ্যা গডফাদার’ মুভিটি আমি খুবই পছন্দ করেছি এবং অনেকেই এটি জেনে বিস্মিত হয়েছে যে আমি যে ধারার চলচ্চিত্র তৈরি করি তাতে কিভাবে আমি এমন একটি মুভিকে পছন্দ করেছি।

কিন্তু মুভির মজাটা আসলে এখানেই। স্টেরিটঃ সিনেমাকে কি এখনও এই সময়েও ‘জাতীয়’ একটা কাঠামোতে ফেলা যায় না-কি আপনি মনে করেন সিনেমার অনেক বেশি আন্তর্জাতিকীকরণ হয়ে গেছে? কিয়ারোস্তামীঃ দেখুন প্রত্যেকটা মুভিরই একটা নিজস্ব সত্তা বা পরিচয় আছে যা সম্পূর্ণভাবে তার নিজের। মুভি তৈরি হয় মূলত আমরা যারা মানুষ আছি এদের ঘিরেই। পৃথিবীর প্রত্যেকটা জাতি, ধর্ম, ভাষা, জীবনাচরনের দিক থেকে ভিন্ন হলেও একটা সাধারণ ব্যাপার সবার মধ্যেই আছে। আমাদের রক্ত চলাচল, নার্ভাস সিস্টেম, আমাদের চোখ একইভাবে কাজ করে, একইভাবে আমরা কাঁদি-হাসি-ব্যাথা পাই।

যদি আমরা সিনেমাকে, সিনেমার বিষয়কে ভাগ করতে চাই তা সম্ভব মানুষের আনন্দ-বেদনা নিয়ে কথা বলে। স্টেরিটঃ আপনার বেশিরভাগ মুভিতেই দেখা যায় যে গল্প বা চরিত্রগুলো সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা দেয় না। একইসাথে আপনাকে এটিও বলতে শোনা গেছে যে- সিনেমার দর্শক নিজেও পুরো প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ধারণা তৈরির দায়িত্ব পুরোপুরি আমাদের উপর এবং এটি আমরা প্রত্যেকেই করব ভিন্নভাবে। এই যে প্রত্যেকেই নিজের মত চিন্তা করবে এর সাথে আপনি মানুষ হিসেবে আমরা যে একই প্রকৃতির এই ব্যাপারটিকে কিভাবে মেলাবেন? কিয়ারোস্তামীঃ কঠিন প্রশ্ন।

মানুষের চিন্তা ভাবনা কিন্তু বিভিন্নরকম আর আমি চাইনা আমার দর্শকেরা ‘ক্রসওয়ার্ড পাজল’ সমাধানের মত কোন সমাধান টানুক। যদি কেউ ভুল একটা মানেও বের করে তাতেও আমার মুভির মূল্য ঠিক থাকবে। মুভিতে আমি শূন্যস্থান এজন্য খালি রাখিনা যে মানুষকে তা পূরণ করতে হবে বলে পূরণ করতে হবে। বরং আমি এটা এজন্যে খালি রাখি যে মানুষ যেন তার নিজের ধ্যান ধারণা দিয়ে, তারা যেভাবে চায় সেভাবে তা পূরণ করতে পারে। শিল্পের অন্য শাখাগুলো যেমন- কবিতা, পেইন্টিং, ভাস্কর্য, সংগীত থেকে যদি বিমূর্ত ধারণা অর্জন করা যায় তা সিনেমাতেও সম্ভব।

আমি মনে করি যে সিনেমা ‘সপ্তম শিল্প’ এবং অবশ্যই এটিকে সবথেকে পরিপূর্ণ বলতে হবে এজন্য যে এটি অন্যগুলোকে একীভূত করে। বলতেই হবে, যে শিল্প হওয়া উচিৎ ছিল তা নাহয়ে সিনেমা এখন শুধু গল্প বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। স্টেরিটঃ আপনার মত ধারণা পোষণ করেন এমন কিছু ফিল্মমেকার আছেন এবং তারা এমন ফিল্ম তৈরি করতে চায় যা সত্যিকার অর্থে কোন গল্প বলে না- যেগুলোকে বিমূর্তই বলা চলে, সেটা ফর্ম বা কালার বা মুভমেন্ট যে কোন কিছু নিয়েই হতে পারে, ছবির বদলে একটা ব্যাখ্যা তুলে দরে। এমনটা করতে ইচ্ছে হয়নি? কিয়ারোস্তামীঃ প্রত্যেক মুভিরই কিছু একটা গল্প থাকা প্রয়োজন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল কিভাবে সেই গল্পটা বলা হল- এটা হওয়া উচিৎ কবিতার মত, এবং এটাকে দেখতে হবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে।

আমি এমন অনেক মুভি দেখেছি যেগুলো আমাকে কোন আকর্ষণ করেনি বা আমার ভেতরে কোন অনুভূতির সঞ্চার করনি, কিন্তু সেসব মুভিতে এমন কিছু মুহুর্ত ছিল যা আমার জন্য নতুন জানালা খুলে দিয়েছে, আমার কল্পনাশক্তিকে সমৃদ্ধ করেছে। অনেক মুভি আছে যেগুলো আমি অর্ধেক দেখে আর দেখিনি কারণ আমার মনেহয়েছে আমার সমাপ্তি ওখানেই হয়ে গেছে। মুভিটা সম্পর্কে আমার অনুভূতি ছিল পরিপূর্ণ। আর যদি আমি শেষ পর্যন্ত মুভিটা দেখতাম পুরো ব্যাপারটাই নষ্ট হতে পারত, কারণ এটা আমাকে বলতেই থাকত আর বিচার করতে বাধ্য করত যে কে ভাল লোক, কে মন্দ, আর এরপর কি হতে পারে। আমি মুভিকে নিজের মত করে শেষ করতে চাই।

স্টেরিটঃ আপনি এইমাত্র যা বললেন তা কিন্তু একজন ঔপন্যাসিক যেভাবে উপন্যাস লেখেন তার চেয়ে একজন কবি যেভাবে কবিতা খেলেন তার সাথে মিলে যায়। মজার ব্যাপার হল যে আপনার মুভি ‘দ্যা উইণ্ড উইল ক্যারি আস’ এর টাইটেল ও চিত্রনাট্যের কিছু অংশ কবিতা থেকে নেয়া। এর মানে কি এই যে আপনি কাব্যিক মুভির দিকে সরে আসছেন? কিয়ারোস্তামীঃ অবশ্যই। আমার মনে হয়, যে মুভি একটা গল্প বলে তার চেয়ে অনেক বেশীদিন টিকে থাকবে কাব্যিক চলচ্চিত্র। বাড়িতে আমার যে লাইব্রেরী আছে সেখানে উপন্যাস আর গল্পের বইগুলোকে একদম নতুন মনে হয় কারণ সেগুলো একবার পড়ে আমি রেখে দেই, কিন্তু আমার কবিতার বইগুলো সমস্ত ঘরে ছড়ানো-ছিটানো থাকে কারণ ওগুলো আমি বার বার পড়ি।

কবিতা সব সময় আমাদের থেকে দৌড়ে পালাতে চায় তাদের ধরে রাখতে পারা খুব কঠিন এবং প্রতিবার যখন কেউ কবিতা পড়বে পরিস্থিতি ও পরিবেশের উপর নির্ভর করে ভিন্ন একটা স্বাদ সে পাবে। অথচ একটা উপন্যাসের ক্ষেত্রে একবার পড়ে ফেললেই সব স্বাদ নিয়ে নেয়া সম্ভব। অবশ্যই এই কথা সব রকম উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এমন সব গল্প আছে যেগুলোতে কাব্যিক ছন্দ পাওয়া যায়, ঠিক যেমনটি অনেক কবিতার ক্ষেত্রেও উপন্যাসের মত স্বাদ পাওয়া যায় এবং এটি একবার পড়ে ফেললেই শেষ। ওটা দ্বিতীয়বার পড়ার প্রয়োজন হবে না।

এটা অনেকটা স্কুলে যেরকম আমাদের কবিতা মুখস্ত করতে হয়েছে সেরকম। ওখানে আমাদের কবিতার সত্যিকার মর্ম বুঝানোর চেষ্টা করা হয়নি বরং কবিতার দ্বারা আমাদেরকে শিক্ষা দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। স্টেরিটঃ ফিল্ম আর কবিতার মধ্যে একটা পার্থক্য হল বেশিরভাগ মানুষ একবার বা দুইবার দেখেই একটা ফিল্মকে বুঝতে পারে, যা কবিতার প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভিন্ন, যেখানে আপনি বলছেন আমাদের বার বার ফিরে আসতে হয়। তাহলে এই কাব্যিক চলচ্চিত্র কিভাবে দর্শকের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবে? দর্শকরা একটা ফিল্ম দেখতে নিশ্চয়ই বার বার সিনেমা হল যাবে না। আপনি কি আশা করেন আপনার মুভি দেখতে দর্শকেরা কয়েকবার সিনেমা হলে যাবে? কিয়ারোস্তামীঃ আমি খুবই স্বার্থপর হব যদি আমি দর্শকদের বলি একবারের বেশি মুভি দেখতে।

এটা বললে হয়ত মনে হবে যে আমার মুভির মার্কেটিং করতে চাইছি। আমি আসলে জানিনা আমি কেন এভাবে মুভি বানাই হয়ত এভাবেই বানাতে জানি। যখন আমি মুভি তৈরি করছি তখন এর ফলাফল নিয়ে চিন্তা করি না, মানুষ এটাকে একবার না-কি একাধিকবার দেখবে। আমি এটা তৈরি করে ফেলি, জীবনকে এরই সাথে মিলিয়ে নিই, ফলাফল পছন্দদায়ক হোক বা না হোক। অনেক দর্শকই হয়ত অসন্তুষ্ট হয়ে সিনেমা হল থেকে বের হয়ে আসবে কিন্তু তারা মুভিটাকে ভুলতে পারবেনা।

আমি জানি তারা ডিনারের সময় এই মুভি নিয়ে আলোচনা করবে। আমি চাই তারা আমার মুভি নিয়ে একটু হলেও বিচলিত হয়ে পড়–ক, এর থেকে কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করুক। স্টেরিটঃ আপনি এমন একটি বিশেষ গোত্রের একজন যারা নিজস্ব একটি চিন্তাধারা বা দর্শনে বিশ্বাস করে এবং সে অনুযায়ী মুভি বানায়। এটি দর্শককে পরিচয় করিয়ে দেয় আরও চ্যালেঞ্জিং ধারার সিনেমার সাথে। প্রায় প্রতিটি মুভি থেকেই ্আপনার কাজ সম্পর্কে কমবেশি ধারণা পাওয়া যায়।

কিয়ারোস্তামীঃ আমি বিশ্বাস করি যে এমন সিনেমা তৈরির সুযোগ আজ থেকে বছর বিশেক আগেও ছিল না। বর্তমানে যেসব মুভি আসছে, এসব দেখে দেখে দর্শকরা যারপরনাই বিরক্ত এবং তারা ভিন্ন কিছু চায়। অবশ্যই ইরানেহয়ত এমন মুভি একটা সিনেমা হলে চলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হয়ত চলে দু’টিতে, গতানুগতিক কাহিনীর মুভিগুলো দেখবেন হাজার খানেক প্রেক্ষাগৃহে চলছে। কিন্তু আমি সন্তুষ্ট। বেশিরভাগ মানুষই সহজবোধ্যতা চায় তারা চায় উত্তেজিত হতে, কাঁদতে, হাসতে এবং আমরা কাব্যিক সিনেমার প্রতি এই উৎসাহ আশা করতে পারিনা।

আমি নিজের সাথে তুলনা করছিনা, কিন্তু পিকাসোর ছবি যদি নিলামে তোলা হয় কয়জন সেটা একশ ডলারে কিনবে? কারো মধ্যে আর্ট সম্পর্কে বাস্তবধর্মী আকাক্সক্ষা থাকলেই সেটা সম্ভব, এটি কোনভাবেই বিনোদনের সাথে সম্পর্কিত নয়। সাধারণ মানুষ এই ছবির জন্য মূল্য দিতে রাজী হবে না কারণ তারা সত্যিকার অর্থে জানেনা ওটা কি এবং কি বলার চেষ্টা করছে। স্টেরিটঃ ‘দ্যা উইণ্ড উইল ক্যারি আস’ মুভিতে যা আমাকে সবথেকে আকৃষ্ট করেছে তা হল এর অনন্য টেনশন, সংলাপ, চরিত্রগুলো যা একইসাথে পার্থিব ও অপার্থিব। কয়েকটা স্তরে যদি মুভিটাকে ভাগ করা যায় এবং যদি একটাকে বেছে নেয়া হয়, আমরা গ্রামটার ভেতরের যোগাযোগের কথা বলতে পারি- যেখানে মানুষেরা একজন অপরের সাথে কথা বলে, পণ্য দেয়া-নেয়া করে এবং ঠিক এর বিপরীত আমরা সেলফোনের ব্যবহার দেখতে পাই যার তরঙ্গ মূলত বাতাসই বয়ে নিয়ে যায়। আমি খুবই আগ্রহের সাথে জানাতে চাইছি যে অপার্থিবের সাথে আপনি কিভাবে পার্থিব জীবনকে সম্পর্কিত করলেন।

আপনার মুভিতে পার্থিব ও অপার্থিবের মধ্যে কি ধরনের টেনশন কাজ করেছে? কিয়ারোস্তামীঃ সত্যি কথা বলতে গেলে এখনও মুভিটা আমি ভাল করে দেখিনি। গত একবছর মুভিটা আমি দেখেছি শুধু টেকনিশিয়ান হিসেবে আর আমার মনে হয় আমি এর প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। তাই আমি সত্যিকার অর্থে একে বিচার করতে পারবনা। আমার একজন দর্শক আমাকে বলেছে যে এই মুভিটা ‘আত্মা’ নিয়ে, সেইসব মানুষদের নিয়ে যারা চলে গেছে, যাদের কোন অস্তিত্বই নেই। এই মুভির ক্ষেত্রে বলা যায় যে লোকটা মাটি খনন করে চলেছে অথবা যে বৃদ্ধা মৃত্যুশয্যায় রয়েছে।

আমরা তাদের জীবনকে দেখিনা। আপনি যেমনটা বললেন যে মুভিটার পার্থিব দিকগুলির পাশাপাশি একটি অপার্থিব অস্তিত্বও রয়েছে। আমরা কিছু চরিত্রকে দেখতে পাই না, কিন্তু আমরা তাদেরকে অনুভব করি। এর মানে হল এখানে থেকেও না থাকার একটা প্রবণতা রয়েছে। আমি মনে করি এটাই এই মুভির প্রধান থিম।

স্টেরিটঃ থেকেও না থাকা? আপনি এটাকে ব্যাখ্যা করতে পারেন। কিয়ারোস্তামীঃ এরকম মুভির ক্ষেত্রে দেখা যায় আমরা দর্শক হিসেবে নিজেরাই কিছু তৈরি করে নেই আমাদের অভিগ্গতা হতে, মূলত: সেসব জিনিস যা আমরা দেখতে পাই না বা যা দেখা যায় না। এই মুভিতে ১১টি চরিত্র আছে যাদের দেখতে পাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত আপনি জানছেন যে আপনি তাদের দেখেননি, কিন্তু আপনাকে অনুভব করতে হবে যে তাদের আপনি জানতেন বা বুঝতেন। আমি এমন সিনেমা তৈরি করতে চাই যা না দেখিয়েও অনেক কিছু দেখাবে।

যা বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ মুভি থেকেই অনেক আলাদা। এসব মুভি পুরোপুরি পর্নোগ্রাফিক না হলেও পর্নোগ্রাফির মতনই কারণ এগুলো এত বেশি দেখিয়ে ফেলে যে তা আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতাকে, চিন্তার সম্ভাবনাকে দূরে ঠেলে দেয়। আমার লক্ষ সৃজনশীলতা ও কল্পনাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের মাথাকে যতটা সম্ভভ সুযোগ দেয়া যায় ততটা দেয়া। আমি চাই প্রত্যেকে তার মধ্যেকার সুপ্ত ভাবনাকে প্রকাশের একটা সুযোগ পাক, যে ভাবনার অস্তিত্ব সম্পর্কে তারা অজ্ঞাত ছিল। ইরানে একটা পুরনো কথা আছে, কেউ যখন কোন কিছুর দিকে গভীর একাগ্রতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে তখন বলা হয়- ‘ওর চোখ দু’টি এবং আরও দু’টি ধার নিয়েছে'।

ধার করা চোখ দুটিই আমার প্রয়োজন, দর্শক চোখ দু’টি ধার নেবে দৃশ্যের বাইরে যা আছে তা দেখার জন্য। যা আছে এবং যা নেই তা দেখার জন্য। স্টেরিটঃ দর্শকেরা এই চ্যালেঞ্জটাকে ভিন্ন ভিন্নভাবে নেবে। কিন্তু আপনার শ্রেষ্ঠ দর্শকদের কথা যদি বলি তাদের চিন্তা কিরূপ হবে বলে আপনি আশা করেন? এটা কি মুভিটার শূন্যস্থানগুলো পূরণ করার কোন প্রশ্ন, নাকি আপনি যেমনটি আগে বললেন যে এটি আত্মা নিয়ে? অতিরিক্ত দুটি চোখ ব্যবহার করে আমাদের কিসের আমন্ত্রণ জানান হচ্ছে? কিয়ারোস্তামীঃ এটা নির্ভর করে দর্শকের অভিজ্ঞতা ও মানসিক যোগ্যতার উপর। আমি নিজে পুরোপুরি নিশ্চিত নই।

এটা নির্ভর করে গল্পের শূন্যস্থানগুলো ভরাট করতে দর্শকের ইচ্ছাশক্তির উপর, আরও গভীরভাবে চিন্তা করার উপর। অনেক দর্শকই আমি যা তৈরি করেছি তার থেকে মুভিটাকে বেশি পছন্দ করেছে এবং এটা তাদের ছবি দেখার পদ্ধতি থেকেই এসেছে। তারা আমার মুভিকে ব্যবহার করেছে তাদের ভেতরকার ভাবনাকে বের করে আনতে। স্টেরিটঃ আর কোন্ কোন্ চলচ্চিত্রকার এমন কাজ করছে বলে মনে করেন? কিয়ারোস্তামীঃ হু জিয়াও-জিয়েন একজন। তারকোভস্কির মুভি আমাকে পার্থিব জীবন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলে এবং ওরগুলিই আমার দেখা শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক মুভি।

তার অনেক কাজেই স্বপ্নের জীবন সরাসরি মুভিতে চলে এসেছে যা কেলেনির অনেক কাজেও দেখা যায়। থেও অ্যাঙ্গেলোপোলাসের মুভিগুলির বিশেষ কিছু মুহূর্তে আধ্যাতিকতা এসেছে। যদি সাধারণ কথায় বলতে হয় মুভি আর আর্টের উচিৎ আমাদেরকে প্রতিদিনকার জীবন থেকে দূ’রে নিয়ে যাওয়া, ভিন্ন একটা অবস্থায় নিয়ে যাওয়া, যদিও এই প্রতিদিনের জীবনই সবকিছুর উৎস। এটা এমন কিছু যা আমাদেরকে শান্তি দেয়। রূপকথার গল্পের দিন শেষ।

স্টেরিটঃ 'টেস্ট অফ চেরী’র প্রধান চরিত্রকে দেখা যায় যে সে পার্থিব জীবন থেকে পালাতে চাইছে। একজন গতানুগতিক ধারার পরিচালক হয়ত এটাকে একটা মনস্তাত্ত্বিক গল্পের রূপ দিত, কিন্তু আমার মনে হয় না আপনার গল্প মনস্তাত্বিক গল্পের উপর, কারণ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা কখনই এটা ভালভাবে বুঝতে পারি না। বলা যায় এই মুভিটাও পৃথিবীর গণ্ডির বাইরে, পার্থিব জীবন থেকে দূরের এবং এই মুভিতেও আমরা পার্থিব ও অপার্থিবের মধ্যেকার চৈনমনকে অনুভব করতে পারি। কিয়ারোস্তামীঃ বিভিন্ন দর্শক মুভিটা নিয়ে বিভিন্ন মতামত দিয়েছে। ইসলামে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ এবং এটি নিয়ে কোন কথাও বলা হয় না।

কিন্তু কিছু ধার্মিক দর্শকও এই মুভি পছন্দ করেছে কারণ তারা আপনি যা বললেন তা অনুভব করেছে, তারা মনে করেছে ‘স্টেট অফ চেরী’ আরও স্বর্গীয় কোন কিছুর দিকে যাত্রা, যা এই পার্থিব জগতের বাইরে। একদম শেষ দৃশ্যে দেখা যাবে মৃত্যুদৃশ্যের পরও চেরী ফুলে চারপাশ উদ্ভাসিত, হয়ত এটা বুঝাতে চাইছে যে স্বর্গের দরজা খুলে গেছে। সে কোন খারাপ কাজ করেনি, এটা ছিল একটা স্বর্গীয় মুর্হূত। স্টেরিটঃ বিষয়বস্তুর কারণেই বলছি মুভিটা সেন্সরবোর্ডে কোন সমস্যার মুখে পড়েনি? কিয়ারোস্তামীঃ মুভিটা নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা ছিল, কিন্তু কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করে আমি তাদেরকে বুঝাতে সমর্থ হই যে এটা আত্মহত্যা নিয়ে কোন মুভি নয়, আমাদের জীবনকে আমরা কিভাবে চালাতে চাই মুভিটা সে পছন্দ নিয়ে। যার মধ্যে একটা ইচ্ছা এটা হতেই পারে যে- কেউ যে কোন মুহূর্তে তার জীবনের সমাপ্তি টানতে পারে।

আমাদেরকে এমন একটা দরজা দেওয়া হয়েছে যা আমরা যে কোন সময় খুলতে পারি, কিন্তু আমরা সচরাচর সেদিকে পা বাড়াইনা। যেহেতু আমাদের এই দরজাটা দেওয়া হয়েছে, আমি বলব এটা বিধাতার মহানুভবতা। তিনি দয়াবান এবং এজন্যেই তিনি আমাদের এই পছন্দটি দিয়েছেন। কর্তৃপক্ষ আমার ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট ছিল। ফ্রেঞ্চ রোমানিয়ান দার্শনিকই এম. কিওরানের একটা কথা এক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করেছে: “যদি আত্মহত্যা করার কোন সম্ভাবনা না থাকত, তাহলে হয়ত অনেক আগেই আমি নিজেকে খুন করতাম”।

মুভিটার সম্পূর্ণটুকুই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নিয়ে, পছন্দ নিয়ে। জীবনকে কিছুতেই আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়নি। মুভির মূল কথা এটিই। স্টেরিটঃ এই মুভির বাইরে, আপনি কি আপনার মুভিতে ইরানিয়ান সেন্সরশিপ পরিস্থিতির প্রভাব অনুধাবন করেন? কিয়ারোস্তামীঃ এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। ইরানে এতবছর ধরে কাজের মধ্যে এই বিষয়টি নিয়ে আমি খুব সংবেদনশীল এবং এটা একটা জায়গা পর্যন্ত আমাকে প্রভাবিত করেছে।

যদিও আমার মুভিগুলো সেন্সরের কাঁচির হাত থেকে বাঁচতে পেরেছে, খুব সম্ভবত তা এ কারণে যে সেন্সরবোর্ড বুঝতে পারেনি মুভি থেকে কি সেন্সর করতে হবে। আমার মনে হয় একটা মুভি তখনই ভাল বলে পরিগণিত হবে। যখন সেন্সর বুঝতে পারে না যে কি সেন্সর করা প্রয়োজন। যদি কোন মুভির একটা অংশ সেন্সর কেটে নেয়, তাহলে এটুকু কাটাই উচিৎ, কারণ সেন্সর তা বুঝতে পেরেছে। স্টেরিটঃ শেষ প্রশ্ন।

সবাই জানে যে আপনি কোন স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করেন না বরং হয়ত কিছু খসড়া হাতে থাকে। একদম শেস মিনিটে গিয়ে আপনি অভিনয় আর সংলাপ নির্ধারণ করেন। এভাবে কাজ করার সুবিধা কী? কিয়ারোস্তামীঃ স্পটে সংলাপ তৈরি করতে হয় এজন্যে যে আমি যাদের সাথে কাজ করি তারা অভিনয়ে প্রফেশনাল নয় এবং তাদের জন্য এর থেকে ভাল কোন উপায় নেই। আমার মুভিতে কিছু দৃশ্য দেখে আমিও সবার মত হতবাক হই। আমি অভিনেতাদের কোন সংলাপ দিইনা, কিন্তু যদি একবার তাদেরকে দৃশ্যটা বুঝিয়ে দেয়া যায়।

তারা হয়ত এমন জায়গা থেকে কথা বলতে শুরু করে যে জায়গা আমি চিন্তাই করিনি। এটা একটা চক্রের মতন আমি জানিনা এর শুরু বা শেষ কোথায়, আমি জানিনা আমি তাদের কিছু বলছি কিনা, নাকি তারা আমাকে শিখতে বলছে। প্রায় ১০০০ বছর আগের পুরনো একটা কবিতা এ সমন্ধে বলে গেছে, যখন সিনেমার অস্তিত্ব ছিল না। কবিতার মেটাফোরটা একটা প্রাচীন মেলা নিয়ে করা হয়েছে যা অনেকটা পোলোর মতন। এমন একটা সৃজনশীল কাজে অভিনেতা হল বলটার মতন যা আমি অনুসরণ করছি একটা লাঠি হাতে, আমি তার দিকে যখন তখন দৌড়ে যাচ্ছি।

এখান থেকে যে ব্যাপারটা বুঝতে হবে তা হল- বলটা কিন্তু আমাকে ঠিকই দৌড়িযে নিচ্ছে। * নাসিমুল হাসান চলচ্চিত্র কর্মী জাহাঙ্গীরগর স্টুডেন্টস ফিল্ম সোসাইটি


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.