রাজাকার ও তাদের বংশধরেরা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ঠাই পাবে
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন। জানা গেছে, ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য গোপনে তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করার চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যের ভিসা পাওয়ার জন্য সব আইনি প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়েছে। জানা গেছে, লন্ডনে পেঁৗছামাত্র তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন জানাবেন।
গোলাম আযমের দেশত্যাগের বিষয়টি কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে মনিটর করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে সমন্বয় করছেন গোলাম আযমের ইংল্যান্ড প্রবাসী ছেলে নাবিল আল আযমী। এমনকি দলের বাংলাদেশ অংশের নীতিনির্ধারণী মহলকে এ ব্যাপারে অন্ধকারে রাখা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জোরালো হয়ে উঠলে প্রথমবার গোলাম আযমকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। সে সময় নির্বাচনে বিজয়ী হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে_আওয়ামী লীগের এ রকম ঘোষণায় উদ্বিগ্ন পরিবারের সদস্যরা ইংল্যান্ডে গোলাম আযমের রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের সম্ভাব্যতা যাচাই করেন।
২০০৮ সালের ২৮ এপ্রিল গোলাম আযম ভিসার জন্য বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনে আবেদন করেন।
আবেদন প্রক্রিয়া গোপন রাখা হয় এবং বাহক মারফত আবেদনপত্র পেঁৗছে দেওয়া হয়। পরে ব্রিটিশ দূতাবাসের গুলশান ১-এ অবস্থিত ভিসা ফ্যাসিলিটেশন সেন্টারে (ভিএফএস) এসে গোলাম আযম তাঁর অঙ্গুলির ছাপ দিয়ে যান। ভিএফএসে গোলাম আযমের উপস্থিতি গোপনীয়তার সঙ্গে সম্পন্ন হয়। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ দূতাবাসের এই ভিসা ফ্যাসিলিটেশন কেন্দ্রটি একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক সংস্থা দ্বারা পরিচালিত। ২০০৮ সালের ভিসার আবেদনটি ব্রিটিশ হাইকমিশন প্রত্যাখ্যান করলে নাবিল আযমীর পক্ষ থেকে যুক্তরাজ্যে 'অ্যাসাইলাম অ্যান্ড ইমিগ্রেশন ট্রাইব্যুনাল'-এ আপিল করা হয়।
গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হলে, গোলাম আযম আবার ভিসার জন্য আবেদন করলে সে আবেদনও প্রত্যাখ্যাত হয়।
এ সময় নাবিল আযমী অ্যাসাইলাম অ্যান্ড ইমিগ্রেশন ট্রাইব্যুনালে আবার আপিল করেন। এবার আপিল করার সময় আপিলের রায় যাতে গোলাম আযমের পক্ষে আসে, এ জন্য নাবিল আযমীর ব্যবস্থাপনায় জামায়াত সমর্থিত কয়েকজন ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজার এবং পাকিস্তানি একজন নাগরিককে যুক্ত করা হয়।
আইনি লড়াইয়ের পর ইমিগ্রেশন বিভাগের বিচারক গত এপ্রিল মাসের শুরুতে গোলাম আযমকে যুক্তরাজ্যে তাঁর ছেলে নাবিল আযমীর কাছে যাওয়ার জন্য ভিসা দিতে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসকে আদেশ দেন।
লন্ডনের একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, এই আদেশটি যাতে দ্রুত নিষ্পন্ন হয় এ জন্য আদেশের কপি গোলাম আযমের পক্ষ থেকে ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনের কাছে পাঠানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লন্ডনে জামায়াতের সঙ্গে জড়িত এই সূত্রটি জানিয়েছে, ভিসা পেলে গোলাম আযম যাতে নির্বিঘ্নে দেশত্যাগ করতে পারেন, সে জন্য সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের প্রশাসনের ভেতরে কিছু লোক কাজ করছেন; এমনকি গোলাম আযমের পাসপোর্টের মেয়াদ ২০০৯ সালের জুলাই মাসে শেষ হয়ে গেলে সম্প্রতি তাঁর পাসপোর্টটিও সরকারের কোনো বাধা ছাড়াই দ্রুত নবায়ন করা হয়েছে বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।
লন্ডনের তরুণ ইমিগ্রেশন আইনজীবী মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, 'আপিল বিভাগে জেতার পর গোলাম আযমের ভিসা পেতে আর কোনো অসুবিধা নেই। তিনি ইতিমধ্যে ভিসা পেয়ে গেছেন বলে আমরা ধারণা করছি। আমরা যত দূর জানি, যুক্তরাজ্যের বিচার বিভাগে ভিসা পাওয়ার জন্য নাবিল আযমী যে আপিল করেছেন এবং বিজয়ীও হয়েছেন, সেটি বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ জানেন না।
এমনকি সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে বাংলাদেশে অবস্থিত কোনো দূতাবাসকে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সতর্কীকরণ বার্তাও দেওয়া হয়নি। গোলাম আযম যুক্তরাজ্যে এলে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁকে এখানে রেখে দেওয়া খুব কঠিন কাজ নয়। তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় দাবি করলে তাঁর আবেদনটি এ দেশের আইন অনুসারে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। সাধারণত ৭০ বছরের বেশি বয়সী কোনো ব্যক্তি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করলে মানবিক কারণে তাঁর আবেদন বিবেচনা করা হয়। '
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে লন্ডনে জনমত সংগঠনের অন্যতম নেতা এবং আমারব্লগডটকম -এর প্রধান নির্বাহী সুশান্ত দাসগুপ্ত এই প্রতিবেদককে বলেন, 'গোলাম আযমের চার ছেলে লন্ডনে বাস করেন।
তাঁরা এখানকার জামায়াত নেতা এবং আন্তর্জাতিক লবিগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। আমরা আশঙ্কা করছি, গোলাম আযম যদি কোনোক্রমে বাংলাদেশ ত্যাগ করে এ দেশে এসে পেঁৗছান, তাহলে তাঁকে আর কখনোই বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিয়ে বিচার করা যাবে না। '
এ ব্যাপারে কালের কণ্ঠ অফিস থেকে ২০ জুন সন্ধ্যা ৭টা ৪৪ মিনিটে লন্ডনে নাবিল আযমীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে এক ব্যক্তি প্রথমে নিজেকে তাঁর চাচা পরিচয় দিয়ে এই প্রতিবেদকের কাছে রিপোর্টের বিষয়বস্তু জানতে চান। প্রতিবেদক এ ব্যাপারে নাবিল আযমীর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা পোষণ করলে তিনি জানান, নাবিল আযমী ব্যস্ত আছেন। তাঁর নাম জানতে চাওয়া হলে পরে তিনি নিজেকে গোলাম আযমের ছোট ছেলে সালমান আল আযমী পরিচয় দেন।
গোলাম আযমের লন্ডন যাওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রথমে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে অস্বীকার করেন। পরে তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশন সম্পূর্ণ অনায্যভাবে গোলাম আযমকে ভিসা দিতে অস্বীকার করলে তাঁরা লন্ডনে পারিবারিকভাবে আপিল করেন এবং মাস দুই আগে তাঁরা সে আপিলে বিজয়ী হয়েছেন। তিনি আরো জানান, আপিলের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ হাইকমিশন গোলাম আযমের পাসপোর্ট চাইলে তা জমা দেওয়া হয়েছে। দূতাবাস ভিসা দিয়েছে কি না_এ ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান।
গোলাম আযম লন্ডনে স্থায়ীভাবে থাকার চেষ্টা করবেন কি না_এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এটি নিছকই পারিবারিক ভ্রমণ।
ভিসা পাওয়ার পর সরকার যদি তাঁকে দেশের বাইরে যেতে বাধা দেয়, তাহলে পারিবারিকভাবে তাঁরা কোনো পদক্ষেপ নেবেন কি না প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, এ ব্যাপারে এখনো কোনো চিন্তাভাবনা করা হয়নি। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করে গোলাম আযমের বিচার শুরু হলে তাঁরা লন্ডন থেকে আইনি সহায়তা দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা করছেন কি না_এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এ রকম কোনো পরিকল্পনা এখনো তাঁদের নেই।
এদিকে লন্ডনের সূত্রটি নিশ্চিত করেছে, যদি নাবিল আযমীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গোলাম আযম ভিসা পেয়ে ইংল্যান্ডে পেঁৗছতে পারেন, তাহলে সেখানে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার পক্ষে আবেদন করবেন তাঁর আরেক ছেলে আমীন আল আযমী। পারিবারিকভাবে বাবাকে সন্তানের সঙ্গে রাখার ব্যাপারে সাধারণ মাইগ্রেশন আইন অথবা রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন, এই দুইভাবেই আবেদনের আইনগত ও রাজনৈতিক বিষয় খতিয়ে দেখা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করা হবে বলেই প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করা হলে এ থেকে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত জামায়াতের বাকি নেতারাও ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক মহলে রাজনৈতিক সহমর্মিতা লাভ করবেন বলে তাঁরা ধারণা করছেন। এ ব্যাপারে আমীন আল আযমী ইতিমধ্যেই কয়েকজন ইমিগ্রেশন আইনজীবীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন বলেও সূত্রটি জানিয়েছে। উল্লেখ্য, এর আগে গোলাম আযম একাধিকবার লন্ডনে গিয়ে আমীন আল আযমীর তত্ত্বাবধানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন।
এ ব্যাপারে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) শফিউল্লাহ বীর উত্তম এমপি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে দালাল আইন করেছিলেন। সেই আইনে সব চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
গোলাম আযমসহ চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীরা তখন দেশের বাইরে পালিয়ে থেকে গ্রেপ্তার এড়িয়ে ছিলেন। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর সেই উদ্যোগ এখনো বলবৎ আছে। সুতরাং গোলাম আযমসহ চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের অবিলম্বে সরকারের হেফাজতে নিয়ে আসা দরকার। এসব চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে, সে জন্য দেশের সব বিমান ও স্থলবন্দরে সতর্কতা জারি করাই যথেষ্ট নয়। বিদেশি সব দূতাবাসেও অবিলম্বে তাদের তালিকা পাঠানো প্রয়োজন, যাতে কোনো দেশ তাদের ভিসা না দেয়।
'
গোলাম আযমের বিদেশ ভ্রমণের উদ্যোগের কথা শুনে ওয়্যার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, 'আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো কোনোভাবেই এই চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ভিসা প্রদান করতে পারে না। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো জেনেভা কনভেনশন এবং জেনোসাইড কনভেনশনে সই করেছে। তারা কোনোভাবেই একজন যুদ্ধাপরাধীকে ভিসা দিতে পারে না। '
তিনি বলেন, 'গোলাম আযম এ দেশের প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের একজন।
তিনি যদি কোনোক্রমে দেশের বাইরে যেতে পারেন, তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রহসনে পরিণত হবে। ১৯৭১ সালে আমরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধীদের দেশের বাইরে যেতে দেওয়ায় তাদের আর বিচারের মুখোমুখি করতে পারিনি। গোলাম আযম যদি এখন দেশের বাইরে যেতে পারেন, তাহলে তাঁর বিচার করাও সম্ভব হবে না। '
তিনি অবিলম্বে সব চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।