আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শহীদের মৃত্যু নেই…



শহীদের মৃত্যু নেই… কলমের ডগা যখন কাগজ ছুঁয়ে এগোতে চাইছে এই লেখার জন্যে, মৃত্যুর সঙ্গে কঠিন লড়াইয়ে তখন হেরে গেছেন অরবিন্দ ধর। খবরও থমকে গেছে যাদবপুরের বেসরকারী হাসপাতাল চত্বরে। তখনও জানতেন না বাবা ভুবন চন্দ্র ধর। জানতেন শুধু হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে প্রতি সেকেণ্ডে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা তাঁর ছেলের গায়ে ‘কুখ্যাত দুষ্কৃতী’র তকমা লাগাবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। আর জানতেন হয়তো আজই তাঁদের ছেলে খোয়াবে ক্ষতবিক্ষত পা।

তবুও শোকে পাথর হয়ে যাওয়া বৃদ্ধ দম্পতি ঘৃণা উগরে দিতে কাকভোরে ভোটের লাইনে। স্ত্রী বেলা ধরকে নিয়ে যাদবপুরের পাটুলি এলাকায় কেন্দুয়া মহেন্দ্রনাথ গার্লস হাইস্কুলের ২১নং বুথে। যে স্কুলের সিড়িতে আজও ছেলের রক্তের চাপা দাগ মোছে নি। যে বুথে আজও টের পাওয়া যায় ছেলের শরীরের সেই অতি আপন তাজা গন্ধ। সেই বুথেই দিনের শুরুতে ভোট দিলেন ভুবন চন্দ্র ধর, বেলা ধর।

পাটুলি এলাকার অত্যন্ত জনপ্রিয় সি পি আই (এম) কর্মী অরবিন্দ ধরের (বাপী) প্রতিটি ফোঁটা রক্তের হিসেব বুঝে নিতে ভোট দিলেন এলাকার মানুষ। এটাই যাদবপুর। যেখানে ছেলের প্রাণের থেকেও বড় বামপন্থার জন্য লড়াই। যেখানে জীবনের অভিজ্ঞতায় নিরক্ষর মেহনতী মানুষও বোঝেন বামপন্থাকে দুমড়ে মুচড়ে দেওয়ার জটিল ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রই বটে।

নয়তো বামপন্থী কর্মীর রক্ত দেখে ফের লালায়িত চোখে রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কেন বলতে যাবেন ‘ঐ সি পি আই (এম) কর্মী কুখ্যাত দুষ্কৃতী’। বিষাক্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে কেন বলবেন, ‘পুলিস গুলি না চালালে পুলিসই খুন হয়ে যেতো’। পুলিসের প্রতি হঠাৎ এতো দরদ কেন? নাকি, শুধুমাত্র পুলিসকেও খেপিয়ে তোলার ষড়যন্ত্র! তৃণমূল নেত্রীর চোখে অরবিন্দ ধর গুরুতর অপরাধী। অরবিন্দ দাগী অপরাধী। অপরাধ হলো এই, সে সি পি আই(এম)-এর সামনের সারির কর্মী।

অপরাধ হলো, সে পাটুলি সেন্ট্রাল ক্লাবের অন্যতম সংগঠক আবার লাল ঝাণ্ডা কাঁধে মিছিলে হাঁটে, গলা ফেড়ে স্লোগান হাঁকে। অপরাধ তার, এলাকার মানুষের নানা বিপদ-আপদে পাশে থাকে। থাকে মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করার লড়াই‍য়ে। তৃণমূল নেত্রীর চোখে এমন অরবিন্দ দাগী অপরাধী তো বটেই! কী বলছেন ২১নং বুথের ভোটাররা। তখন প্রায় পৌনে তিনটে।

সকাল থেকেই নির্বিঘ্নে, অবাধ, শান্তিপূর্ণ, স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসাহ নিয়ে ভোটদাতাদের লাইন ছিল চোখে পড়ার মতো। অরবিন্দ ধর ওরফে বাপি ধর তাঁর ভোটার কার্ড ‍‌(নম্বর ডব্লিউ বি/১৮/১০৮/৪৮০০৩৩) নিয়ে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়েছিলেন। তখন প্রায় শেষপর্ব, ভোটদাতাদের লাইনও তেমন ছিল না। আচমকাই এক জওয়ানের রাইফেলের গুলি লাগে অরবিন্দ ধরের বাঁ পায়ে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

রাস্তার ধারে তাঁর শরীরের লাল রক্তের স্রোত ভেসে যায়। বাইরে থাকা মানুষজন ছুটে আসেন। পুলিসের গাড়িতেই দ্রুততার সঙ্গে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার জন্য পিয়ারলেস হাসপাতালে। সেখানেই জীবনের দীর্ঘ লড়াইয়ের সমাপ্তি। যাদবপুর ভুলে যায়নি ওপার বাংলা থেকে শেকড় ছেঁড়া মানুষের যন্ত্রণার অতীত কথা।

সেদিন পাশে ছিল এই লালঝাণ্ডাই। জীবন যন্ত্রণাকে সয়ে নিয়ে তিল তিল করে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে কমিউনিস্ট পার্টির জীবনসঙ্গী হওয়া। প্রতিদিন, প্রতিমূহুর্তে বদলে যাওয়া জীবন। আজও এখানকার মানুষের স্পর্ধিত, গর্বিত উচ্চারণ বামপন্থাই। তাই স্কুল জীবন থেকে ছাত্র রাজনীতির হাতেখড়ি হওয়া ছেলে অরবিন্দকে আরো বৃহত্তর লড়াইয়ে এগিয়ে দিয়েছেন ভুবন চন্দ্র ধরের পরিবার।

যে পরিবার আজ প্রিয় বাপীকে হারিয়ে শোকস্তব্ধ, কিন্তু বামপন্থার লড়াইয়ে একচুল সরে না এসে দাঁড়িয়েছে ভোটের লাইনে। এই লড়াইকে তো কুর্নিশ জানাতেই হয়। কারো কারো চোখে ঝলসে উঠছে বিগত শতকের সাতের দশকের লালসা। বাঘ অথর্ব হলে নাকি মানুষখেকো হয়। রাজনীতিতে, দর্শনে অথর্ব হলে মানুষ-মারার নীতি নিতে হয়।

কিন্তু, ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর। নির্মম। তার নির্মাতা রচয়িতাকেও সে ক্ষমা করে না। আর তা দস্তুরমতো জানে বহু সংগ্রামে স্নাত আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গ। জানেন কান্নায় ভেঙে পড়া স্ত্রী মীরা ধর।

৩২জন শহীদের রক্তে ভিজা এ মাটি জানে ‘দুষ্কৃতী’ শব্দের অর্থ কী? তাই শোকস্তব্ধ যাদবপুর বলছে, জঙ্গলের আইনেও এরকম কাপুরুষতা চরম ধিকৃত। যে চরম নৃশংসতা, ক্রূরতা, নির্মমতা আর ঘৃণ্য মনুষ্যত্ব হার মানায় পশুত্বকেও। আর অরবিন্দ ধরের মতো কতো সাথী প্রতিদিন, প্রায় প্রতিদিন রক্তের দেনা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। প্রতিদিন কত সাথীর শরীরে অস্ত্র লেখার কত আশ্চর্য ধরন। বুলেট কিংবা ধারালো নানা শস্ত্র কি বিচিত্র আঁক রেখে যায় আমার অগণন সাথীর শরীরে।

তবে তাঁর বন্ধ অথবা তবুও খোলা চোখের সঙ্গে আর কোনো কথা কয় না দুনিয়ার আলো। এ সব ছবি তো আমাদের প্রতিদিনের সকালের মুখপটের উপর আছড়ে পড়ে। অথবা শহীদের শরীর ঘিরে তার পরিজনদের জমায়েত, বুক ছেঁড়া হাহাকারের আলোকচিত্রের প্রায় একই ধরন! পাটুলি বি ব্লকের মসজিদ পাড়ায় অলি, তস্য গলি পেরিয়ে এক চিলতে ঘরের শূন্যতার ছবিও তাই। কিছু মৃত্যু পাখির পালকের চেয়েও হালকা। হালকা হাওয়ায় ভেসে যায় অনায়াসে।

আবার কিছু মৃত্যু হিমালয়ের চেয়েও ভারি। অটল। রক্তক্ষরণ হয় অবিরত। সে মৃত্যু শুধু বুক ভাঙা বেদনায় শিহরিত করে না, প্রদীপ্ত করে অমিত তেজে। দুনিয়ার কোনও অ্যাশল্ট রাইফেল, কোনও ধারালো অস্ত্রের আঘাতই তাঁকে ধ্বংস করতে পারে না।

কমরেড অরবিন্দও তাই। শহীদের মৃত্যু নেই। কোনও ভাবাবেগ নয়। স্থির প্রত্যয়ের কথা। এঁরা ন-হন্যতে।

অবিনাশী। কিউবার জাতীয় বীর হোসে মার্তি আজ থেকে একশ বছর আগে বলেছিলেন, ‘পাথরের পরিখার চেয়েও শক্তিশালী হলো আদর্শের পরিখা। ’ মার্তির সেই কথাই একুশ শতকে গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে ব্যক্ত করেছেন ফিদেল — ‘‌অস্ত্রের চেয়েও আদর্শ অনেক বড়, তা সে যতই আধুনিক ও শক্তিশালী অস্ত্রই হোক না কেন। ’ আর এই আদর্শের জন্যই হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছে এই বাংলা, এই যাদবপুর। এগিয়ে চলেছে, ‘সর্বদা বিজয়ের লক্ষ্যে।

’ কমরেড অরবিন্দের মতো।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.