আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নদীর নাম সুরমা - ৩ (শেষ পর্ব )



সুরমাপাড়ের মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামে সুরমাপাড়ের জনপদ অসীম বীরত্ব ও গৌরবমণ্ডিত অধ্যায় রচনা করেছে। সিলেট জেলাসহ সুরমা নদীর দু-পাড়ের অসংখ্য পাহাড়-টিলা, চা-বাগান, আর হাওড়-বাওড় পরিবৃত থাকায় এই অঞ্চল ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে প্রতিরোধ ও গেরিলাযুদ্ধের উপযুক্ত স্থান। সুরমা নদীর পাড়ে কানাইঘাট থানা সদর দপ্তর ছিল, যা সামরিক দিক থেকে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে পাকবাহিনী সুবিধা করতে পারেনি। এখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনের পরিকল্পনা ও সফল বাস্তবায়ন করে সহজেই ফিরে আসতে পারত।

চাঁদনিঘাটে ব্রিজের কাছাকাছি এলাকায় পাকবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এক মিছিলের ওপর গুলি চালালে লুন্দু মিয়া নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সুরমা নদীর দক্ষিণ তীরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা সমবেত হয়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পক্ষত্যাগী দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের এল.এম.জি ম্যান সুরমা সেতুর উপর গুলিতে নিহত হন। এসময় পাক-সেনারা নদী পারাপারের চেষ্টা থেকে বিরত হয়। সিলেট শহরে ২৮ মে ১৯৭১ এক দুঃসাহসিক অপারেশন সংঘটিত হয়।

শহরের নাইওরপুল এলাকায় পাকসেনা ভর্তি একটি জিপ লক্ষ করে অপারেশনটি ঘটানো হয়েছিল। বাঙালি যোদ্ধারা রাত ১.১৫ মিনিটে আলি ওয়াকিউজ্জামান সড়কের উত্তর পাশে ১৫ ফুট উঁচুতে অবস্থিত ইলেকট্রিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে পাক-সেনারা অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও এই অপারেশন মুক্তিযোদ্ধাদের মনে অপরিসীম সাহস সঞ্চার করে। (রফিকুল ইসলাম সিলেটের মুক্তিযুদ্ধ:সুচনা পর্ব-সি.ই. ঐ,পৃ.-৭৫০) মেজর শওকত আলী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন,“সুরমা নদীতে আমরা ৫০টির মতো পাকিস্তানী জলযান দখল করি। এই জলযানের মধ্যে জাহাজ, বার্জ, স্পীডবোট, ইত্যাদি ছিল।

ফলে নদীপথে পাক-সেনাদের ছাতক এবং সুরমা নদী এলাকাতে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তানীরা কেবল সিলেট থেকে সড়কপথে ছাতক এবং সুনামগঞ্জে সরবরাহ অব্যাহত রাখে। ’’(সুকুমার বিশ্বাস, সিলেটে মুক্তিযুদ্ধ : মে-ডিসেম্বর ১৯৭১/সি.ই.ঐ,পৃ.৭৫৮) এমনই হাজারো ঘটনার সাক্ষি সুরমা নদী আজো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সুরমা নদীর সাথে যুক্ত মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে লিপিবদ্ধ করতে গেলে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সমৃদ্ধ একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি হতে পারে। সুরমা নদীর নৌকা অতীতে বর্ষাকালে সুরমা নদীতে জাহাজ চলাচল সম্ভব হলেও শীতকালে তা সম্ভব ছিল না ।

শীতকালে সুরমা নদী সংঙ্কীর্ণ এবং অগভীর হওয়ার কারণে জাহাজ চলাচলের যথেষ্ট অসুবিধা হতো। অন্যদিকে আবার সাধারণ নৌকা সারাবছর চলাচল করতো। এছাড়াও যখন বর্ষাকালে অনেক অঞ্চল পানিতে ডুবে থাকার কারণে এই নৌকাই ছিল এ অঞ্চলের যোগাযোগের একমাত্র বাহন। এজন্য নৌকা তৈরির শিল্পও ছিল এই অঞ্চলের একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ। কাঠের যোগান যথেষ্ট থাকায় নৌকা তৈরি লাভজনক উদ্যোগ বলে পরিগণিত হয় ।

সিলেটে দুই ধরনের নৌকার প্রচলন ছিল, যা অন্য কোথাও ছিল না । এই নৌকাসমূহ লাখাই পালওয়ার এবং খায়ৈ নৌকা নামে প্রসিদ্ধ ছিল। বালাগঞ্জ ও হবিগঞ্জ সুরমা উপত্যকায় নৌকা তৈরির প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। প্রাচীন যুগে সুরমাপাড়ে নৌকা ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়। সিলেটে নির্মিত রণতরী ও জাহাজের খ্যাতি ছিল বলেই হয়ত লাউড়াধিপতিকে রাজস্বের বদলে সমরতরী প্রদান করতে হতো।

(বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাস, পৃ. ২০০) সিলেটের পাহাড় ও জঙ্গলে নৌকা ও জাহাজ নির্মাণের উপযোগী ভাল কাঠ পাওয়া যেত । লিন্ডসে স্থানীয় কারিগরদের দিয়ে একটি বড় জাহাজ বহর তৈরী করেছিলেন । সবচেয়ে বড় জাহাজখানা ১৭ ফুট পানি ভেঙে চলত এবং ৪০০ টন মাল বহনে সক্ষম ছিল। এ জাহাজে ১৮ টি কামান বসানোর ব্যবস্থা ছিল । (মো. আব্দুল আজিজ, সিলেটের অর্থনৈতিক ইতিহাস, বৃ.সি.ই-২০২) সুরমা নদীর মাছ একসময় সুরমা নদীতে প্রচুর মাছ ধরা হতো এবং এই মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হতো।

শুঁটকি মাছের ব্যবসা ছিল খুবই লাভজনক। বিক্রেতারা একসাথে বহু ক্রেতার নিকট থেকে দাদন নিয়ে কারবার করতো । সিলেট জেলার পশ্চিমাঞ্চলে অধিকাংশ ভূমি জলমগ্ন থাকায় সেখানে প্রাচীনকাল থেকেই মৎস্য ব্যবসা প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। ১৯০২-০৩ সালে তৎকালীন সরকার শুঁটকি ও তাজামাছ রপ্তানি করে ৬৬,৯০০ টাকা রাজস্ব আয় করেছিলেন । তৎকালিন সময়ে শুধু সুনামগঞ্জ থেকেই বছরে ৫ লাখ মণ শুঁটকি ও এক লাখ মণ তাজামাছ রপ্তানি হতো ।

সুরমাপাড়ের কৃষিশস্য সুরমার দু-পাড়ের পাহাড়, টিলা ও সুবিস্তর সমভূমিতে বিভিন্ন ধরনের শস্য উৎপাদিত হয়। ফলে কৃষিই এই অঞ্চলের অন্যতম জীবিকা। অতীতে সুরমার দু-পাশের গ্রামগুলি ছিল সিলেটের অর্থনৈতিক ভিত্তি। সুরমার দু-পাড়ের গ্রামগুলিতে উৎপন্ন শস্যগুলো হলো-- চা , পাট, রিয়া, ইক্ষু, তৈলবীজ, বাঁশ ও বেত , রাবার ও লাক্ষা। চা : ১৮৩১ সালে সিলেটে সর্বপ্রথম চা উৎপাদন শুরু হয়।

১৯০১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১,৩২,৮৩৪ একর জমিতে চা চাষ হতো। বাংলাদেশ চা সংসদের বার্ষিক বিবরণী (১৯৯১-৯২) তে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৯২ সালে সিলেট জেলার ২০ টি বাগানের ৪,৮২৮.৬৯ হেক্টর জমি থেকে ৩৭৮৬ কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে । পাট : জার্মান যুদ্ধের পর রাশিয়ান শনের আমদানি বন্ধ হবার ফলে পাটের চাহিদা বেড়ে যায়। ফলে ভারত সরকার বঙ্গদেশের বাইরেও পাট চাষের জন্য কতগুলি সম্ভাব্য স্থান খুঁজতে থাকে । এক পর্যায়ে বঙ্গের নিকটস্থ আসাম পাট চাষের উপযুক্ত স্থান হিসেবে সরকারের কাছে পরিগণিত হওয়ায় গোয়ালপাড়া ও সিলেট জেলার সুরমাপাড়ের বিস্তর সমতল ভূমিতে পাট চাষ শুরু হয়।

১৯০৩ সালে সিলেটে প্রায় ১০,০০০ একর জমিতে পাটের চাষ আরম্ভ করা হয়। (সি.ই.ও ঐ. ৩৬০) রিয়া : রিয়া নামক এক প্রকার আঁশজাতীয় গাছের চাষও এ অঞ্চলে পূর্বে প্রচলিত ছিল । ধীবররা তাদের বাগানের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে এটা রোপন করতো এবং অন্য বনাঞ্চলেও এই গাছ পাওয়া যেত । ইক্ষু : সুরমাপাড়ের শস্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আখ বা ইক্ষু। এ অঞ্চলে গুড়ের চাহিদা পূরণই আখ উৎপাদনের অন্যতম কারণ ।

ধোলা খাগড়ি, লাল খাগড়ি ও বোম্বাই খাগড়ি এই তিন প্রকার ইক্ষু এই অঞ্চলে পাওয়া যেত। তৈলবীজ : সুরমার দুপাড়ে তৈলবীজ হিসেবে সরিষা, তিসি, ও তিলের চাষের প্রচলন রয়েছে। ১৯০১ সাল ৩৭,০০০ একর জমিতে সরিষা, ৭০,০০০ একর জমিতে তিসি ও ৪,০০০ একর জমিতে তিলের চাষ করা হয়। (প্রিয় গোস্বামী, সুরমা উপত্যকার শিল্প ও বাণিজ্য, সি.ই.ঐ-৩৫০) অষ্টাদশ শতাব্দীতে সিলেটের কৃষিজাত উৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যে ধান-তুলা, পান-সুপারি ও নারকেলই ছিল প্রধান। বিভিন্ন প্রকার ফলের মধ্যে কমলালেবু, আম, বাতাবিলেবু , সাতকরা প্রভৃতির নাম করা যায়।

এসময়ে বি¯তৃত চাষ পদ্ধতি (অথাৎ বেশি উৎপাদনের জন্য বেশি পরিমাণে জমি চাষ) প্রচলিত ছিল। কৃষকেরা ছিল দরিদ্র এবং তাদের ছিল শিক্ষার অভাব। (সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যয়,বাংলার আর্থিক ইতিহাস,পৃ.৪৭) সুরমাপাড়ের প্রাকৃতিক দুর্যোগ “২৯ সালে সিলেট ও কাছাড় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যাকবলিত হয় । বন্যা, মড়ক ও দুর্ভিক্ষ নিবারণে সিলেটের সরকারী বেসরকারী প্রতিটি সংস্থা এগিয়ে আসে । এই দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রমোদচন্দ্র দত্ত সর্বশক্তি নিয়োগ করেন।

প্রমোদ চন্দ্র রেডক্রস সমিতির সভাপতি ছিলেন” (সি.মা.সি.মা,পৃ.২৫৩) এই বন্যাকে সিলেটে ‘বড়পানি’ বা ‘ধলাপানি’র বন্যা বলা হয়। এই বন্যা এক মাসেরও বেশি সময় ছিল। বন্যার পানিতে সিলেটের অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে যায়। মানুষ গাছের ডালে, ঘরের চালে আশ্রয় নেয়। ভেসে যায় জীব জানোয়ার।

এই বন্যার সময়েই সিলেটবাসী প্রথম ‘কচুরী পেনা’ বা জার্মানী পেনার সাথে পরিচিত হয়। জানা যায় কোন এক জার্মান মহিলা কচুরী পেনার ফুলের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কচুরী পেনা নিয়ে আসেন তার স্বামীর কর্মস্থল মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলে । মণিপুরের ‘লোগতাক হ্রদে’ কচুরীপানা আবাদ করা হয়। কিছুদিনের মধ্যে হ্রদটি পানায় ভরে যায়। ১৯২৯ সালের বন্যার সময় মণিপুরের লোগতাক হ্রদের বাঁধ ভেঙ্গে যায়।

ফলে হ্রদের কচুরীপানা বরাক নদী ধরে সুরমা ও কুশিয়ারা হয়ে সিলেটের বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলে ভেসে আসে। এই কচুরীপানা হাওর ও নীচু ভূমির ফসল নষ্ট করে দেয়। জার্মান মহিলা কর্তৃক আনিত বলে সিলেট বিভাগের লোকেরা এই কচুরীপানাকে ‘জার্মানী পেনা (ফেনা)’ বলে। এছাড়া ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪ সালে সারা বাংলাদেশের মতো সিলেটেও ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। এই বন্যাগুলোতে উজান থেকে প্রচণ্ড বেগে বরাক নদী হয়ে পানি এসে সুরমা ও কুশিয়ারা দিয়ে প্রবেশ করে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা ঘটায়।

এই বন্যাগুলোতে সিলেটের রেলস্টেশন, বিমানবন্দরের রানওয়ে সহ সিলেটের সাথে দেশের যোগাযোগের সকল রাস্তা ডুবে যায়। এছাড়া পঞ্চদশ শতাব্দীতে সিলেটে ভীষণ খরায় দুর্ভিক্ষ, মড়ক ও অনাচার সংঘঠিত হয়েছিল বলে জয়ানন্দ রচিত ‘চৈতন্যমঙ্গল’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। এসময় অনেক মানুষ সিলেট ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। সপ্তদশ শতকেও বড়বড় বন্যা হয়েছে । ১৭৮২ সালে সুরমা উপত্যকায় প্রায় দশদিন অনবরত বৃষ্টি হওয়ায় ভীষণ বন্যা দেখা দেয়।

এই বৃষ্টিতে সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে মানুষের ঘরবাড়ি, গরু-মহিষ ইত্যাদি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। লিন্ডসের বর্ণনামতে এই বন্যায় সিলেট জেলার এক তৃতীয়াংশ লোক মারা যায়। ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ শাপলা, শালুক ও ঘাসপাতা খেয়েছে। (সি.মা.সি.মা, ১০০) ১৭৮৫ ও ৮৭ সালে পুনরায় সিলেটে বন্যা হয় এবং জানমালের প্রচুর ক্ষতি হয়। সুরমার দুর্দশা সুরমা নদী বছরে প্রচুর পরিমাণে পলি-বালি-কাদা বহন করে আনে, যার পরিমাণ বছরে প্রায় ৩৭ লক্ষ টন।

বালির মধ্যে মোটা কণা থাকায় নদীটি বিভিন্ন স্থানে হাওর অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এর বিপুল অংশ বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়ে । ফলে সুরমার গভীরতা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। ১৯৬৩ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড মন্তব্য করেছে যে, পুরাতন সুরমা সম্ভবত বেশি পানি বহন করে না। ১৯৭০ সালের সিলেট ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ার-এর তথ্য অনুযায়ী পাইন্দা থেকে মারকুলি পর্যন্ত নদীর অবস্থার অবনতি ঘটেছে। ১৯৯০ সালের প্রাপ্ত তথ্য মতে সুরমা নদীর মাত্র ১০ শতাংশ পানি পুরাতন খাত দিয়ে প্রবাহিত হয় ।

নদীটি মৃতপ্রায় হয়ে যাওয়ায় নদীর দু-পাড়ে ইতিমধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আবু আলী সাজ্জাদ হোসাইন তার সুনামগঞ্জ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,‘‘শাল্লা দিয়ে দিরাই অঞ্চলে ইতিমধ্যেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সুরমার আজমিরীগঞ্জে বিরাট মরুভূমির মত বালুকাময় স্থান সৃষ্টি করে এর নিঃসরণমুখ থেকে নদীটি হয়ে পড়েছে বিচ্ছিন্ন । ফলে সুরমার স্রোত এখন উল্টো বইছে। এর প্রভাব বাড়তে বাড়তে সুনামগঞ্জের দিকে আসছে।

শাল্লা-দিরাই ও জগন্নাথপুর থানায় ব্যাপক অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা । এ সমস্ত অঞ্চলের কৃষকেরা বছরের পর বছর তাদের জলাবদ্ধ জমিকে স্বাভাবিক করতে পারছে না । এ অবস্থা চলতে থাকলে এ সমস্ত অঞ্চল থেকে জনবসতি উঠে যেতে পারে। ’’ সুরমা নদীতে বর্তমানে শুকনা মৌসুমে অনেক জায়গায় পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায়। বর্ষাকালে যেমন সুরমার পানি দু-কূল উপচিয়ে জনপদ ভাসিয়ে দেয় তেমনি শুকনা মৌসুমে এ অঞ্চলে দেখা দেয় পানিশূন্যতা ।

বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হলে সুরমা নদীর উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই। শুকনা মৌসুমে সুরমা নদীর পানির একমাত্র উৎস ভারতের বরাক নদী থেকে আসা পানি। মণিপুর ও আসামের পাহাড়ের ঝর্ণা থেকে খুব অল্প পরিমাণের পানি বরাক হয়ে কুশিয়ারা ও সুরমায় প্রবাহিত হয়। মণিপুরের টিপাইমুখে বাঁধ দিলে শুকনো মৌসুমে সুরমায় আর কোনো পানি আসবে না । ফলে সুরমা শুকিয়ে এ অঞ্চলে সৃষ্টি হবে বিরূপ প্রভাব; এমনকি মরুকরণের সূচনা হতে পারে।

সুরমা নিয়ে সরকারের ভাবনা সুরমা নদীকে নিয়ে সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। প্রকল্পগুলো হচ্ছে-- আপার সুরমা-কুশিয়ারা প্রকল্প, নদীর তীর সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্প, জরুরী দুর্যোগ ক্ষয়ক্ষতি ও পুনর্বাসন প্রকল্প এবং ওয়ামিক প্রকল্প। আপার সুরমা-কুশিয়ারা প্রকল্পের অবস্থান সিলেট জেলার সদর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, কানাইঘাট, ফেঞ্চুগঞ্জ ও জকিগঞ্জ। এ-প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নকাল ২০০১-০২ হতে ২০০৫-০৬ অর্থবছর পর্যন্ত হলেও পরবর্তীতে তা সংশোধিত হয়ে ২০০১-০২ থেকে ২০০৯-১০ পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে এই প্রকল্পটি ২০০১-২০১২ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল উদ্দেশ্য হলো ৫৩,৮২০ হেক্টর এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিস্কাশনের মাধ্যমে ১০,৫০০ হেক্টর এলাকায় সেচ সুবিধা দিয়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা। এই প্রকল্পের আওতায় অমলসিদ থেকে সুরমার ডানতীর বরাবর ৫৮.১২ কি.মি. এবং বামতীর বরাবর ৮৪.৯৫ কি.মি. বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ২০টি স্লুইসগেটের মধ্যে সুরমা নদীর সাথে যুক্ত ১৬ টি এবং কুশিয়ারার সাথে যুক্ত ৪টি। সুরমা নদীর স্লুইস গেট-এর মধ্যে মুরি রেগুলেটর, মুচি রেগুলেটর, সাদিপুর রেগুলেটর, বেরাকহাই রেগুলেটর অন্যতম। এই প্রকল্পের আওতায় জকিগঞ্জ উপজেলায় একটি পাম্প স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে।

বন্যার ও বৃষ্টির পানি দ্রুত নিস্কাশনের জন্য সদাখাল, কাকুরাখাল, খরাতিখাল, ধনুভাঙাখাল, পাগলীখাল, রামপুরখাল, রহিমপুরখাল, চেঙেরখাল, সেনাপতিরখাল, মুরিখাল, মুচিখাল, সাদীকুলখাল, বিরাখাইখাল, ও রামেরখাল পুনর্খনন করা হবে। আপার সুরমা-কুশিয়ারা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকার ইতোমধ্যে সিলেট সদর, গোপালগঞ্জ, বিরানীবাজার, কানাইঘাট, ফেঞ্চুগঞ্জ ও জকিগঞ্জ উপজেলায় মোট ২৬১.৫৩ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করেছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নীট ৩৫,৬০০ হেক্টর চাষযোগ্য জমিসহ মোট ৫৩,৮২০ হেক্টর এলাকাকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিস্কাশন সুবিধা প্রদান এবং ১০,৬০০ হেক্টর এলাকাকে সেচ সুবিধা দেয়া হবে। তার মধ্যে ৫,৬০০ হেক্টর এলাকা পাম্প স্টেশন থেকে সেচসুবিধা পাবে। নদীর তীর সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্পটিতে বর্তমানে ৪র্থ পর্বের কাজ চলছে।

জরুরী দুর্যোগ ক্ষয়ক্ষতি ও পুনর্বাসন প্রকল্প ২০০৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ওয়ামিক প্রকল্প ২০০৭ সাল থেকে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা আজো শুরু হয়নি। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি চলতি বছরেই শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সুরমার সংহার রুখবোই বন্যাপ্রবণ সুরমার তীরে বাঁধ নির্মাণ অনেক আগে থেকেই হয়েছে। অমলসিদ থেকে সুরমার বামতীর বরাবর নির্মিত বাঁধটি সবসময় অক্ষত থাকেনি।

অনেক অংশ এমনিতে ভেঙে গেছে। অনেক জায়গায় মানুষ নিজে ভেঙেছে। সুরমার পশ্চিমতীরে উনিশ শতকের প্রথমদিকে কয়েক স্থানে বাঁধ ছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১৮১৫ সালের দিকে সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণ পরিত্যাগ করে। তখন থেকে নদী আপন খেয়ালে চলতে থাকে।

তাতে জনসাধারণ অসুখী হয়নি। তাঁরা দেখেছিলেন যে, বন্যার ক্ষতি অনেক গুণ পুষিয়ে যাচ্ছে পলি সঞ্চয়ের দ্বারা। (ড.ড.ঐঁহঃবৎ,ড়ঢ়.পরঃ.৩০০) কানাইঘাট থেকে সিলেট শহর পর্যন্ত প্রসারিত সুরমা নদীর অংশ থেকে কয়েকটি খাল নির্গত হয়ে হাওরে জল নিস্কাশন করত। সেধরনের বাহিয়া গাং, ভাটখাল ও ভাজাঞ্চিখাল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও নতুন খালও কাটা হয়েছে।

আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে মৌলভী আবদুল হামিদ সুরমা-কুশিয়ারার সংযোগ স্থাপনের জন্য গোলাপগঞ্জ থেকে দুই মাইল দীর্ঘ একটি খা লখনন করেছিলেন। এটি পরিচিত ছিল মৌলভীর খাল নামে। (প্রাগুক্ত) কালের বিবর্তনে মানুষ নিজের প্রয়োজনে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে চলেছে। বহু সংগ্রাম করে মানুষ আজ নদীর নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে নিয়েছে। সুরমা নদীর ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।

নদীর বক্রখাতগুলো সোজা করে কমিয়ে ফেলা হচ্ছে নদীর গতিপথ। নদীর দু-ধারের খালগুলোর মুখ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। স্লুইসগেট তৈরি করে জলপ্রবাহে বাধা দেয়া হচ্ছে। নদীর প্রবাহকে বাধা দিলে নদী প্রাকৃতিক নিয়মে আবার তার নতুন পথ খুঁজে নেয়। তখন হয়তো নদী অস্থির আচরণ করে দু-কূল ভাসিয়ে লণ্ডভণ্ড করে দেয়।

তাই প্রয়োজন নদীর সাথে সন্ধি, নদীকে ভালোবাসা। কেননা, বাংলাদেশ নামক বদ্বীপটি গঠিত হয়েছে সুরমার মতো অন্যান্য নদীবাহিত পলি জমে জমে। নদী না-থাকলে হয়তো আমরা থাকব না, আমার দেশও থাকবে না, থাকবে না আমার সভ্যতা। (সমাপ্ত)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.