আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রজন্ম

সে এক পাথর আছে কেবলই লাবণ্য ধরে ...
১. আসাদ সাহেবের মনে বিপুল উত্তেজনা । উত্তেজনার তোড়ে অল্প অল্প কাঁপছেন তিনি , বৃদ্ধ মানুষ ; শরীর আর আগেকার মত চাপ সইতে পারে না ... বাসা থেকে পাড়ার ক্লিনিক , আসতে আসতে হাঁফ উঠে গেছে তার । ক্লিনিকের বেঞ্চে একমনে তসবী গুণতে থাকা মোমেনা বেগম আড়চোখে তাকান স্বামীর দিকে .... উদভ্রান্ত দেখায় আসাদ সাহেবকে ... চয়ন জন্মের সময়্ও এমন হয়েছিল .... আকাশের দিকে খানিক তাকিয়ে থাকেন আসাদ সাহেব ... "এখনো আসছেনা কেন চয়ন ? " খবর পাঠানো হয়েছে অনেক আগেই , হয়তো জ্যামে আটকে গেছে । ঢাকা শহরের যে অবস্থা , আর চয়নের অফিসও অনেক দূরে ....হঠাৎই পেইন উঠল রিমির , তাড়াহুড়ো করে আনা হলো এখানে । বাসায় মানুষ নেই কোনো ... কাজের ছেলেটাও ছুটিতে ।

হঠাৎ ঝড়ের বেগে ক্লিনিকে ঢুকল চয়ন .. শার্টের একটা বোতাম খোলা , কেমন যেন বোকা বোকা লাগছে .... " রিমি কই ? " একটা হাত তুলে তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা চালালেন আসাদ সাহেব । " ভয় পাবার কোন কারণ নেই , ডাক্তার বলেছে সব ঠিক আছে ...." উত্তেজনার চাপ সামলাতে না পেরে চেয়ারে বসে পড়ল চয়ন । এ এক আশ্চর্য সময় ... একটি নতুন জীবন , আসছে ... পৃথিবীর আলোতে মুখ আসছে নতুন এক ... তাকে স্বাগত জানাতে উন্মুখ তার ভালোবাসার মানুষগুলো ... যারা অনেক স্বপ্ন বুনেছে তাকে ঘিরে ... আবার মানুষগুলো উদ্বিগ্ন তার জন্য , সে কি পারবে ঠিকভাবে আসতে ... কোথাও কোন সমস্যা হবে না তো ? সে কি পারবে এই অস্বাভাবিক পৃথিবীতে একজন স্বাভাবিক শিশু হয়ে জন্মাতে ? এক এক করে সব আত্নীয়স্বজন আসতে শুরু করল ছোট্ট ক্লিনিকটাতে ... এক এক করে অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল গলির মুখে ... সবার চোখে উৎকন্ঠা , সবার চোখে প্রত্যাশা । দুপুর ১ টা ১৫ মিনিটে জন্ম নিল আবির ... ২. আবির খেলছে । একরাশ রোদ খেলা করছে ওর মাথাভরা চুলে , দেবশিশুর মত চাহনি ... এখন কিছুটা আধো আধো কথা বলতে পারে .... আসাদ সাহেব ভালুক সেজে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছিলেন নাতিকে ।

বড় আদরের নাতি তার ; ভয় না পেয়ে বরং আবির হেসে লুটোপুটি খায় ... ভারি আমোদ লাগে তার ... দাদুর দাড়ি ধরার চেষ্টা করে সে । " বাবা , একটা কথা বলার ছিলো " চোখ তুলে তাকান আসাদ সাহেব .... চয়নকে দেখে অবাক হন । ছেলের সাথে আজকাল বলতে গেলে কথাই হয় না তার ... ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে চয়ন । দেখাই হয়না ... সকালে অফিসে যায় , ফেরে সেই রাতে ... আবির সদ্য হাঁটতে শিখেছে , ওর সাথেই সারা দিন কাটে বুড়োবুড়ির । "বল , বাবা " " আগে বলি প্লিজ কথাটা অন্যভাবে নিয়ো না ।

মা কে বললে অযথা কান্নাকাটি করবে , তাই তোমাকেই বলছি । " উপক্রমনিকা গুছিয়ে নিল চয়ন । "বল" একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করার চেষ্টা করেন আসাদ সাহেব । " বাবা , রিমি একটা নতুন বাসা নিতে চাচ্ছে । এখানে ওর অনেক সমস্যা হচ্ছে , তোমাকে তো আগেই বলেছি .... আর , মা'র সাথেও ওর রিলেশনটা ঠিক ভালো যাচ্ছে না ।

তোমাকে তো বলেছি আগেই ......." একটানা কথা বলে চলে চয়ন । কথাগুলো ভীষণ অচেনা শোনায় আসাদ সাহেবের কানে । এমন না যে শব্দগুলো অচেনা , .... কিন্তু কথাগুলো আর শুনতে মন চাইছেনা । চয়ন , এই কি তার ছেলে ... আম পাড়তে গিয়ে হাত ভেঙ্গে ফেলল , সাইকেল কিনবার জন্য বাসা ছেড়ে মামাবাড়িতে পালিয়ে গেল ..... স্কুলে মারপিট করে কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলল ... এই কি সেই ? ভীষণ , ভীষণ অচেনা মনে হয় ছেলেকে তার । সময় কি এভাবেই অচেনা করে দেয় প্রিয় মানুষকে ... সকালের রোদগুলো পুড়িয়ে দেয় চেনা মুখগুলো .... একটি স্বপ্নকে পুঁজি করে বাঁচে যে মানুষ , তার নিয়তি কি স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় আদিষ্ট ? জীবনকে বড় সস্তা , বড় তুচ্ছ লাগে আসাদ সাহেবের ..... বিকেলে ভ্যানে জিনিসপত্র সাজিয়ে চলে যায় চয়ন আর রিমি .. বড় খারাপ লাগে , বুকটা ভেঙ্গে যায় , কিছু করার নেই ; যে যাবে , তাকে যেতে দিতে হয় ।

বড় কান্নাকাটি করেন মোমেনা ... খারাপ লাগে আবীরের জন্য । স্কয়ার ফিটের হিসেবে মাপা ফ্ল্যাটে কি করছে ছোট্ট ছেলেটা ? ৩. সারাদিন ভাবতে থাকেন আসাদ সাহেব .... বাতের ব্যাথাটা খুব কষ্ট দিচ্ছে , মাঝে মাঝে কষ্টে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার । এমন একটি বয়স , যখন শরীর আর কোন কথা শুনতে চায় না । আত্নসমর্পণ , অসহায় আত্নসমর্পণ ... নিয়তির কাছে । পরশু ফোন করেছিলো চয়ন , থাইলান্ডে বেড়াতে যাচ্ছে ....সবাই মিলে ।

দোয়া চাইলো ... টাকা লাগবে কিনা জানতে চাইলো । " কিছু লাগবেনা আমার .. জীবনে অনেক পেয়েছি , আর কিছুই লাগবেনা " বিড়বিড় করেন আসাদ সাহেব । কিন্তু , ছোট্ট আবিরকে দেখতে মন চায় ... মোমেনা তিলের নাড়ু করেছিল ; গোটা দশেক লুকিয়ে রেখেছে নাতির জন্য ... নিয়ে একবার যাওয়া দরকার , আসুক ওরা , সময় করে যাওয়া যাবে একবার । কত কিছু করবার ছিলো জীবনে .. সারাজীবন শুধু টাকার পেছনে ঘোড়ার মত দৌড়ে এখন ভীষণ ক্লান্ত লাগে নিজেকে ... অর্থহীন মনে হয় সবকিছু , কার জন্য , কিসের জন্য এই বেঁচে থাকা ... এই রোজগার , এই ভালোবাসা ... এই বাঁধন ? পেনসনের টাকা তুলতে গেলে ঘুষের আশায় লোভী একদল চেহারা দেখতে হয় ... তবুও ওটাই শেষ ভরসা ... নাহলে চলবে না আর ... নামায পড়ে কুরআন নিয়ে বসেন মোমেনা বেগম , শূন্য বাসা ভরে যায় তার নিচু স্বরে .... বাজার করা হয়নি আজ তিনদিন । রান্না করবার জন্য কিছুই নেই ।

বাজারে যেতে হবে , ভাবতেই খারাপ লাগে আসাদ সাহেবের ... অথচ না গেলে না খেয়ে থাকতে হবে ... চেয়ারের হাতল ধরে ওঠবার চেষ্টা করেন তিনি , হঠাৎ কে যেন খামচে ধরে বুকের বামপাশটা ... কোন শব্দ হয় না , নিঃশ্বাস আটকে যায় আসাদ সাহেবের ... শূণ্যে কিছু খামচে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তিনি ... অন্ধকার .. এতো অন্ধকার আসলো কখন ? বাতাসে ভাসে অচেনা কিছু আয়াতের সুর ....... ৪. ২০ বছর পরে একদিন । সকালের নাস্তা শেষে একমনে নাতির কম্পিউটারে ছবি দেখছেন চয়ন চৌধুরী ... " তুমি চেন এটা কে ... এটা হলো গ্রিণ গবলিন ...আর ওর পাশে স্যান্ডম্যান .... আরে না না ওরা হিরো হবে কেন .... ওরা তো পচা .... তুমি কিচ্ছু জান না ........ " ...ভীষণ বিরক্ত হয় সিফাত দাদুর অজ্ঞানতায় । হঠাৎ ছেলেকে তার দিকে আসতে দেখেন তিনি । ... নতুন অফিস নিয়েছে আবির , এখন দেখাই পান না ছেলের । "কিছু বলবি , বাবা " " ড্যাড , প্লিজ ব্যাপারটা অন্যভাবে নিয়ো না .......... "
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.