আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডুমুর গাছের ভুত



আমরা তিনজনই ডুমুর গাছে ভুত দেখতাম। তবে কখনো কখনো দুই জন দেখতাম। গা কেমন শিঁউরে উঠতো। চারিদিকে ক্ষেত আর ক্ষেত। ওদিকে কোনো বাড়ি ঘর নেই।

বিশাল প্রান্তরে একদম একা দাঁড়িয়ে থাকতো একটা ধেঁড়ে ডুমুরের গাছ। অনেকেই বলতো গাছটা না কি তিনি তাঁর জন্ম থেকেই দেখছেন। আমিও কিন্তু তাই দেখেছি। এখন অবশ্য কেউ দেখতে চাইলে আর দেখতে পারবে না। হতে পারে আমি বা আমরা তিনজন নেই এ কারণে।

বা হতে পারে সেই ধেঁড়ে ডুমুর গাছের ভুতটা তাঁর দেশে চলে গেছে তাই গাছটিও আর নেই। আচ্ছা এ কথা পরে বলছি। ধানক্ষেতের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ডুমুর গাছটি কিছুদুর পেরুলেই বড় ধরণের একটা বিল পাওয়া যেত। বিলটির নাম ছিলো কাঁইয়ার বিল। এখনো আছে।

সেখানে প্রতিদিন চা পাখি, হট্টিটি, গোদরঘোষ, পারল, সাদা লাল বক খেলা করে বেড়াতো। আমরা প্রায়ই মায়ের আদেশ অমান্য করে তিনজনই গলা ধরে সেই সব পাখিদের খেলা দেখতে যেতাম। কখনো কখনো বিলের হাঁটু জলে নেমে পদ্ম ফুলের ঢ্যাপ (বীজ) তুলে তিন জনে ভাগ করে খেতাম। কী যে মজা হতো! মাঝে মাঝে আবার সেই কাঁইয়ার বিলেই বাবার সঙ্গে পাখি মারতে যেতাম। বাবা এয়ারগান দিয়ে খুব পাখি শিকার করতেন।

আর আমরা কাঁদা জলে দৌড় দিয়ে বাবার শিকার করা পাখি গুলে তুলে আনতাম। তবে এখন আর পাখি শিকার করা হয় না। এয়ারগানটা এখনো আছে। বাবাও সুস্থ্য আছেন। কিন্তু সেই এয়ারগান আর বাইরে বের করা হয় না।

হয় না হয়তো সেই ডুমুর গাছটি নেই বলে। কিংবা সেই ভুতের দেশে ভুত চলে গেছে বলে। কিংবা আমি নেই তাই। অথবা আমাদের একদম কালো কুচকুচে ছাগলটি নেই বলেও হতে পারে। হ্যা, আমাদের একটা ছাগল ছিলো।

আর আমরা সাত ভাইয়ের মধ্যে একদম শেষের পিঠাপিঠি তিন ভাই সেই ছাগলটির দেখাশোনা করতাম। রাখাল জীবন। খুবই ভালো লাগতো সে সময়টা। আমি, ফুয়াদ ভাই আর মুন ভাই তিনজনে হাতে নকুল দানার প্যাকেট নিয়ে বিকেলে বেড়িয়ে পড়তাম ছাগল খুঁজতে। নকুল দানা চিবোতে চিবোতে আর আজগুবি গল্পের ঝুড়ি খুলে ক্ষেতের আইলে আইলে হাঁটতাম।

সকালে ছাগলটিকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসতাম। ছাগলটিকে কখনো পেতে দেরি হলে আমাদের খুব মন খারাপ হতো। আর তারাতারি পেয়ে গেলে আমরা তিন জনই সেই ডুমুর গাছের নিচে গিয়ে বসতাম। বিভিন্ন ধরণের কথা বলতাম। কত স্বপ্ন, কত কথা কতটা দু:খ ছিলো তখন মনে।

অনেক দিনের কথা। তা আজ আর খুব একটা স্বচ্ছ ভাবে মনে পড়েনা। মুন ভাই ছিলো গাছের পোকা। কোন গাছে পাখি বাসা বেধেছে, কোন পাখির বাসায় কতটি ডিম, কতটি বাচ্চা তা একদম ঠোটের আগায় থাকতো তাঁর। আমাদেরকে তা পেরে পেরে দেখাতো।

তাই আমরা যখনই ডুমুর গাছের তলায় যেতাম তখনই সে পইপই করে গাছের মগডালে উঠে যেত। ওই গাছটাতে লাল টকটকে এক ধরণের ফল ধরতো। সে নিজে খেতো আর টুপ টুপ করে একটা করে ফল আমাদের জন্য নিচে ছুঁড়ে দিতো। আমরাও মজা করে খেতাম। তবে শর্ত ছিলো যে, এই কথা মাকে কখনোই বলা যাবে না।

আমরা কখনো তা বলতামও না। একটা সময় হুট করে মুন ভাই গাছের মধ্যে হাওয়া হয়ে যেত। কেমন একটা শব্দ করতো। ভুতের মতোন। ভয় পেতাম খুব।

কান্নাকাটি করলে তারপর নেমে আসতো। তারপর আমাকে কোলে তুলে নিয়ে আবারও আইল ধরে বাসার দিকে হাঁটা শুরু করতো। আমি সবার ছোট ছিলাম বলে সবাই আমাকে আদর করতো। এখনো করে তবে মুন ভাই ছাড়া। তখন আমি টু য়ে পড়ি।

সকাল বেলায় আমার জুতার ফিতা বেধে দিতো মুন ভাই। তারপর মেজ ভাই স্কুলে পৌঁছে দিতো। এভাবেই কেটে গেলো দুই দুইটা বছর। রাখাল জীবনের জন্য মাঝে মাঝে সবার ওপর রাগ হতো। কিন্তু এক ধরণের মজাও পেতাম আমরা।

এক সময় আমাদের ছাগলটিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষমেষ হারিয়ে গিয়েছিলো আমাদের সেই কালো কুচকুচে ছাগলটি। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন আমরা। বিশেষ করে মুন ভাই। সেই থেকে ওই কাঁইয়ার বিল আর ডুমুর গাছের নিচে যাওয়া আমাদের বন্ধ হয়ে গেলো।

বন্ধ হয়ে গেলো পদ্ম ফুলের ঢ্যাপ খাওয়া। তারপরও মন মানতো না। পুরো বিকেলটাই অবসর ছিলো। ও বলাইতো হয়নি। আমরা গ্রামের কারো সঙ্গে খেলতে যেতাম না।

তবে খেলা দেখতাম। তাই মাঝে মাঝে ডুমুর গাছের নিচে ঢুঁ মেরে আসতাম আমরা তিন ভাই। একদিন গিয়ে দেখলাম সেই ডুমুর গাছটি আর নেই। আমরা অনেক খোঁজাখুজি করলাম। কিন্তু নাহ্, কোথাও গাছটিকে পেলাম না।

মুন ভাই আর ভুতের ভয় দেখাতে পারবেনা ভেবে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম সেদিন। কিন্তু কেন যেন মুন ভাইয়ের মনটা বেশ ভারী হয়েছিল গাছটিকে না পেয়ে। তারপর ব্যর্থ মনে বাসায় ফিরে পড়তে বসলাম। এরপর থেকে আর আর ওই ডুমুর গাছের রাস্তায় কখনোই যাওয়া হয়নি আমার, আমাদের। তখন থেকে বিকেল বেলায় হাত মুখ ধুয়ে আমাদের বাসার জাম্বুরা গাছের তলে টঙয়ের ওপর বসে মায়ের কাছে মন দিয়ে বাবার গল্প শুনতাম।

বারবার রোমাঞ্চিত হতাম আমরা। মা কখনো বিরক্ত হতেন না। কিন্তু একদিন বাবা অফিস থেকে ফিরে বলা নেই কওয়া নেই মুন ভাইকে খুব করে মারতে শুরু করলেন। এর আগে বাবা কোনো দিন কারো গায়ে হাত তোলেন নি। মুন ভাই পাগলের মতো কান্নাকাটি শুরু করলো।

সাথে আমিও ফুয়াদ ভাই। বাবার অভিযোগ ছিলো মুন ভাই টাকা চুরি করেছে। থাক সেসব কথা। তার কিছুদিন পর এক ঝড়ে আমাদের সুপারী বাগানের সবচেয়ে বড় সুপারী গাছটার মাতা ভেঙ্গে যায়। পরের দিন মুন ভাই ওই গাছে ওঠর জন্য জেদ ধরে বসলো।

মা কিছুতেই না। কারণ সেদিন আমরা কেউই বাসায় ছিলাম না। তারপরও মুন ভাই গো ধরে গাছে ওঠেই ছেড়েছে। গাছে উঠে মাকে ডেকেছিলো সেদিন। মা ভয় পেয়ে গাছের নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

কিন্তু একটু পরেই কে যেন সেই গাছ থেকে মুন ভাইকে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছিলো। হয়তো সেই ডুমুর গাছের ভুতটা। শুইয়ে দিয়েছিলো এ জন্য বললাম যে, মুন ভাইয়ের গায়ে কোনো ধুলাবালি ছিলো না। তারপর মুন ভাই আর কোনো দিন কথা বলে নি। তাঁর সেই হাসিটিও আমি আর দেখিনি।

খুব একটা কল্পনায়ও আসেনা সেই হাসিটা। আমাদের ছেড়ে আজকের এই দিনে সে চলে গেছে অন্য কোনো দেশে। অন্য কোনো সুখের রাখাল জীবনে। আজকের দিন এলে আমার মা পাগলের মতো হয়ে যান। আমরা তাঁকে বোঝাতে পারি না।

আমরাও বুঝিনা। তারপর অনেকটা বছর পেরিয়ে গেলো। আজ মনে পড়ছে সেই ডুমুর গাছের ভুত, ছাগল আর কাঁইয়ার বিলের পাখিদের কথা। ভাইয়া তুমি ভালো থেকো। আমাদেরও মনে রেখো............ void(1);


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।