আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার ও সাম্প্রতিক সাহিত্য

নিয়তি অনতিক্রম্য

[ এই লেখাটি এর আগে ২০০৮ সালে একটি পুঁজিবাদ বিরোধী সেমিনারে পঠিত হয়েছিল । পরবর্তীতে "কুঁড়েঘর" পত্রিকার ফেব্রুয়ারী ২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ] বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার ও সাম্প্রতিক সাহিত্য শিল্পে জীবন উঠে আসে- এ এক অবধারিত সত্য। কখনও শিল্পীর সচেতনায় কখনও বা অজান্তেই। শিল্পীর অজান্তেই হয়ত ধরা পড়ে সমাজ এবং রাষ্ট্র।

তাই শিল্পী (বা সাহিত্যিক) নিজে রাষ্ট্র বা অর্থনীতিকে বাদ দিলেও, শিল্প ঠিকই ধারণ করে সামষ্টিক জীবনকে। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যে বিভেদ যে দ্বন্দ্ব তারই এক ঠুনকো ছদ্মবেশী সমাধান বিশ্বায়ন। সমস্ত পৃথিবীকে এক করে ফেলার চেষ্টা, যেন পুঁজিবাদের বাজার আরও বড় হয়। সোজা কথায় বেনিয়া সাম্রাজ্যের আরও বিস্তার ঘটে। সে চেষ্টা যখন রাষ্ট্রনায়কদের প্রত্যক্ষ সমর্থন পায়, জনসাধারণের তখন আর কিছু করার থাকে না।

সাম্রাজ্য বাড়ানোর সেই চেষ্টার দলিল থেকে যায় অনেক জায়গায় সবচেয়ে শক্তিশালী দলিল থেকে যায় সাহিত্যে, শিল্পে। ব্যক্তিজীবনকে তুলে ধরতে গিয়ে, শিল্প তখন রাষ্ট্রীয় এক মেরুকরণকে বাদ দিতে পারে না। ফলে বাঙালী উপন্যাসের মধ্যবিত্ত নায়ক তখন পশ্চিমা পণ্যের ব্যবসায় নামে, আর উপন্যাসের পার্শ্ব চরিত্র চাকরীর খোঁজে বিদেশে পাড়ি জমায়। সাহিত্যে উপস্থাপিত হয় বিশ্বায়ন। রক্ষণশীল বাঙালী পরিবার তার ঘরের দরজা খুলে দেয় বিশ্বায়নের স্রোতের কাছে।

জীবন যেহেতু বদলে যায় নিরুপায় লেখককে তখন চিরাচরিত রক্ষণশীল ধারা বাদ দিয়ে, নতুন জীবন দর্শনকে টেনে আনতে হয়। বিশ্বায়নের প্রভাব সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে উপন্যাসেই। কারণ গল্প বলতে হলে পারিপার্শ্বিকতাকে বাদ দেয়া চলে না। পারিপার্শ্বিকতার উপাদানগুলো তখন নিজে থেকেই স্থান করে নেয় উপন্যাসের জমজমাট গল্পের ভেতর। বিশ্বায়নের স্পষ্টতম প্রভাব উপন্যাসে ঘটলও সাহিত্যের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ কবিতায় তার প্রভাব ঘটে সবার আগে।

ভাষার কারুকার্যের দক্ষতায় কবিতার কোন তুলনা নেই আর ভাষার পরিবর্তন বিশ্বায়নের জন্য অপরিহার্য। এক বিশ্বের স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না যদি না ভাষাকে একটা মোটামুটি কাছাকাছি জায়গায় আনা যায়। ফলে রাষ্ট্রীয়ভাবেই প্রচারিত হয় বিদেশী ভাষার মাহাত্ম বিদেশী ভাষার জয়গান। বিদেশী ভাষার বিপুল প্রচার কবিতায় নিটোল ভাষাকেও আক্রমন করে। ফলে প্যারিসের নাগরিক যন্ত্রণা টের পাওয়া যায় মফস্বলের বাঙালী কবিতায়।

আমাদের এ সময়ের কবিতা জটিল হয়ে উঠবার এটি একটি প্রধান কারণ। কবি তখন আর শুধু নিজস্ব কাব্যিক বাস্তবতার জগতে ডুবে থাকে না তার চিন্তাজগতে স্থান করে নেয় আন্তর্জাতিক রাজনীতি, মধ্যপ্রাচ্যের সংকট, পশ্চিমা নারীবাদ উত্তর আধুনিকতার তত্ত্ব আর কত কী। কবিতার শান্ত, নিরুপদ্রব ছোট্ট আকাশটুকু হারিযে যায়। কবিতার শান্ত আকাশে তখন হানা দেয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। আমাদের নিজস্ব গণমাধ্যম এমনিতেই কালো টাকার বিষে নীলবর্ণ।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সরব উপস্থিতি বাঙালী গণমাধ্যমকে করে ফেলে আরও কোনঠাসা। টিকে থাকার অবধারিত পরাজয়ের সংগ্রামে সে শুরু করে নির্লজ্জ বেশ্যাবৃত্তি। শাড়ি পরা তরুণী উপস্থাপিকাকে তখন জিন্স পরতে হয়, তার বৃদ্ধ বাঙালী পিতাকে সব মেনে নিয়ে বলতে হয় এটাই জগতের নিয়ম। কথাটা মিথ্যে নয়। শক্তিমানকেই অনুসরণ করতে হয় ঠিক যেমন আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো অনুসরণ করে চরে বিদেশী চ্যানেলগুলোকে।

শক্তিমানকে অনুসরণের সেই রীতি হয়ত আমাদের সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অবধারিত। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। বিখ্যাত বাঙলা উপন্যাসগুলো নিয়ে অসংখ্য স্বার্থক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার মাথা নত করেছেন বাঙালী উপন্যাসিকের জমজমাট গল্পের কাছে। কিন্তু ঘড়ির কাটা উল্টোদিকে ঘোরায় সময় হয়ত হয়ে এসেছে।

হয়ত ভবিষ্যতের কোন স্বার্থক চলচ্চিত্রকে অবলম্বন করে তৈরী হবে সেকালের সবচেয়ে স্বার্থক উপন্যাসটি। সাহিত্যিক মেনে নেবেন চলচ্চিত্রের শক্তিকে। কিন্তু আমাদের আশঙ্কা ওখানেই। যে চলচ্চিত্রকে আঁকড়ে ধরবেন লেখক তা কি বাংলা সিনেমা নাকি বাংলা ভাষার তৈরী আমেরিকান সিনেমা, যে সিনেমায় মুখোমুখি বাঙালী এবং মুখোশের আড়ালে একটি পশ্চিমা শরীর। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাছে আমরা যদি হেরে যাই তবে তা হওয়াই স্বাভাবিক।

নীরবে পরাজয় মেনে নিলে ঝামেলা অনেক কমে। কিন্তু আমি জানি প্রত্যেক সমাজেই কিছু শক্তিমান মানুষ থাকে আর আমাদের শক্তিমানেরা এ পরাজয় এত সহজে মানতে চাইবেন না। মরণাপন্ন রোগীকে যেমন স্যালাইন দিয়ে বাঁচাতে হয়, বিশ্বায়নের আক্রমনে মৃত্যুপথযাত্রী বাঙালী সাহিত্যকেও আজ তেমনি স্যালাইন দিয়েই বাঁচাতে হবে। বিশ্বায়নের সাথে আমাদের লড়াইয়ের শুরুটা হয়ত ভাষাগত আধিপত্যের লড়াই দিয়েই শুরু হবে। ভাষাগত আধিপত্যের লড়াইয়ে বাংলাকে জয়ী করতে পারলে সাহিত্যের সুরক্ষা এমনিতেই হবে।

আমাদের ভাষাটি যদি শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গবেষণায় বিষয় হয়ে থাকে তবে বুঝতে হবে আমাদের পরাজয় ঘটে গেছে। বাংলাকে জিততে হবে মাঠে ময়দানে, জয়ী হতে হবে গণমানুষের কাছে, সবচেয়ে বেশি করে গণমাধ্যমে। বাংলাকে যুদ্ধ করতে হবে অসংখ্য বিদেশী ভাষার সাথে যে ভাষাগুলো বিশ্বায়নের অন্যতম হাতিয়ার। এই যুদ্ধের উৎকৃষ্ট উপায় ভাষার সহজীকরণ। জনপ্রিয়তার open secret হচ্ছে সরল প্রকাশভঙ্গী।

বিদেশী শব্দ বাংলায় ঢোকাতে হবে উদারভাবে, কিন্তু বাংলা ভাষার স্বাভাবিক মানুষকে ঠিক রেখে। বিশ্বায়নের প্রবক্তারা নিজেদের অর্থনৈতিক দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যই টেনে এনেছেন আরেক অর্থনৈতিক তত্ত্ব - যার নাম মুক্তবাজার। আসলে ওটাই উদ্দেশ্যে, বিশ্বায়ন তো উপায় মাত্র। বাজার উন্মুক্ত না হলে সহস্র কোটি ডলারের কর্পোরেট হাউসগুলোর পতন অনিবার্য। পৃথিবীর কোন দেশেই বাজার পুরোপুরি উন্মুক্ত নয়।

রাষ্ট্রই নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়। তার উল্টাটা হলে মুশকিল। রাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রের নাম আইন। রাষ্ট্র ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগ করে কারণ অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে উপদেশে বিশেষ কাজ হয় না। দৃশ্যমান না হলেও পুঁজিপতিরা জানে মুক্তবাজারের সবচেয়ে বড় শত্র“ রাষ্ট্রীয় আইন।

কিন্তু এই শত্র“তার মূল রহস্য অন্য কোথাও। রাষ্ট্রীয় আইন হঠাৎ করে তৈরী হয় না তার পেছনে থাকে সাধারণ মানুষের সমর্থন তাদের আশা আকাঙ্খা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি থাকে তাদের অধিকার। মুক্তবাজারের তত্ত্ব তাই রাষ্ট্রীয় আইনের সরাসরি বিরোধীতা করে না। রাষ্ট্রীয় আইনকে সশ্রদ্ধ সালাম জানানোর পামাপাশি শুরু হয় আইন বিরোধী সংস্কৃতির প্রচারণা শুরু হয় গণমানুষের মনোজগত দখলের প্রতিযোগিতা আইন মানুষের বাহ্যিক কার্যকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও মানুষের চিন্তাজগতে তার কোন সরাসরি প্রভাব নেই।

মনোজগত দখলের অন্যতম উপায় হচ্ছে মানুষের বিনোদন জগতে নিজের অবস্থান তৈরী করা। এ নীতির একদম সরাসরি প্রয়োগ দেখা যায় ক্রিকেটের স্পন্সরশিপে। ক্রিকেটের চিরাচরিত সবুজ মাঠটুকু এখন আর মোটেই সবুজ নয়। সেখানে এখন সোল নীল লোগোর উপস্থিতি - কর্পোরেট সাম্রাজ্যের বিজয় পতাকা। আমাদের সামনে উপস্থিত হয় মুক্তবাজারের ক্রিকেটীয় রূপ।

অস্বীকার করার উপায় নেই - প্রচারের কৌশল হিসেবে অসাধারন। এই যে বিজ্ঞাপনের বিপুল আয়োজন এ কিন্তু নিছক প্রচার নয় - বরং একটি ভোগবাদী জীবনদর্শণের ইশতেহার। রাজনীতিতে যেমন ভোটযুদ্ধ, ব্যবসায়ীদের তেমনি বিজ্ঞাপনযুদ্ধ। আমাদের সৌভাগ্য সেই ভোগবাদী জীবন দর্শন যত সহজে ক্রিকেট মাঠ দখল করতে পারে, তত সহজে সাহিত্যের অঙ্গনকে দখল করতে পারেনা। সাহিত্যের নিজস্ব জগতে প্রত্যেক শিল্পী ঐশ্বরিক ক্ষমতা উপভোগ করেন আর ঈশ্বরকে পরাজিত করতে পারার মত শক্তি আজও তৈরী হয়নি।

সাহিত্য জগতের এইসব ক্ষুদে ঈশ্বররা, মুক্তবাজার অদ্ভুত ব্যবস্থার মধ্যেও অনেক সময়ই নিজ গুণে স্বাধীন থেকে যায়। তাই মুক্তবাজার সংস্কৃতি সাহিত্যকে দখল করতে পারে না ঠিকই কিন্তু প্রভাবিত করে অবশ্যই। মুক্তবাজার অর্থনীতি সাহিত্যকে যতটুকু প্রভাবিত করে কোন এক আশ্চর্য কারণে অনেক সময়ই তা পুঁজিবাদ বিরোধীতায় রূপ নেয়। এর কৃতিত্ব অনেকটাই সাহ্যিত জগতের দূরদর্শী লেখকদের যাদের কল্যাণে আমরা অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরোধীতাকারী কিছু সাহসী মানুষ পেয়েছি। অরুন্ধতী রায় থেকে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক পর্যন্ত সবার কণ্ঠেই আজ মুক্তবাজার বিরোধীতার অস্পষ্ট সুর।

বিরোধীতার সেই সুর অস্পষ্ট হলেও একেবারে দূর্বল নয়। বিশালকৃতি দৈত্যের সাথে যুদ্ধের এ হচ্ছে প্রস্তুতি পর্যায়। মুক্তবাজার ব্যবস্থার এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে প্রযুক্তি। হাতের মুঠোয় কথা বলার যন্ত্র পেয়ে মানুষ মুগ্ধ হয়। আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি।

প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের সরল পার্থক্যটুকু আমরা আজও সাধারণ মানুষকে বোঝাতে পারিনি। আমাদের এই অর্থনৈতিক কাঠামোতে বিজ্ঞানের জন্য সামান্যতম জায়গাটুকুও নেই অথচ প্রযুক্তি পণ্যের ছড়াছড়ি। কে না জানে আজকের প্রযুক্তি বহু বছরের নিরবিচ্ছিন্ন বিজ্ঞান সাধনার ফসল। এর কারণ সহজবোধ্য। প্রযুক্তি বিক্রয়যোগ্য, বিজ্ঞান তা নয়।

প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, মুক্তবাজার এবং তার পাশে সাহিত্য - এ এক অদ্ভুত মিথস্ক্রিয়া। প্রযুক্তিকে মুক্তবাজার নিজেই আপন করে নিয়েছে আর সাহিত্য তার নিয়ন্ত্রণাধীন হয়। এই চতুর্ভুজ সম্পর্কের মাঝখানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিজ্ঞান। আমাদের সাহিত্য প্রযুক্তির মাহাত্ম্য প্রচারে যতখানি গুরুত্ব দিয়েছে, বিজ্ঞানের জন্য ততটুকু মনোযোগ দেয়নি। এই প্রভাবটুকু মুক্তবাজারে অর্থনীতির।

গল্প উপন্যাসের চরিত্ররা ফোনে কথা বলে, টিভি দেখে, কিন্তু খুব ক্ষেত্রেই বিজ্ঞান পড়ে। প্রযুক্তির কাছে পরাজয় ঘটে বিজ্ঞানের। ফসল ঘরে তোলার আনন্দে আমরা এতই বিভোর যে পরবর্তী চাষবাসের কথা প্রায় ভুলতেই বসেছি। এবার এ আলোচনার ইতি টানবার পালা। এক নৈরাজ্যকর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অস্পষ্ট আলোচনা শেষে কোন স্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল।

তবুও আমার সাময়িক সিদ্ধান্ত এই যে, এখন সময় নিয়ন্ত্রিত মুক্তবাজার ব্যবস্থার। বর্তমান বিশ্বের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দার দিকে তাকালে মনে হয়, হয়ত আমার মুক্তবাজার অর্থনীতি থেকে অর্ধমুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে যাত্রা শুরু করেছি।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.