আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্মৃতির শহর- বগুড়া



চাকরী জীবনে ঢোকার পর বগুড়া আমার প্রথম কর্মস্থল। সে হিসেবে এ শহরের প্রতি আলাদা একটা টান আছে। যদিও বিদেশে আসার আগে মাত্র তিন-চার মাস সময় ছিলাম বগুড়ায়। প্রতি রবিবার মহাখালী টার্মিনাল থেকে বাসে উঠতাম, আবার বৃহস্পতিবার অর্ধবেলা শেষে ঝুলতে ঝুলতে ঢাকা এসে পৌঁছাতাম। এক রকম দৌড়ের উপরেই কেটে গেছে বগুড়া থাকাকালীন সময়।

তবে এ সময়ই আসলে আমি বাংলাদেশের প্রকৃত রূপ দেখেছি। এর আগে আমার দৌড় ছিল শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং বাংলাদেশের আরো অল্প কিছু শহর-গ্রামে কালেভদ্রে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভ্রমণ। বগুড়া থেকে বাংলাদেশের ‘আসল’ রূপ কীভাবে দেখেছি তা বলার আগে আমার চাকরীটাই একটু ব্যাখা করি। আমাদের কাজ ছিল বাংলাদেশের পৌরসভাগুলোতে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং বা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা। চারটা জোন বা অঞ্চলে এ পৌরসভাগুলো ভাগ করা হয়েছিল।

বগুড়া ছিল ‘রাজশাহী’ জোনের হেডকোয়ার্টার। সে হিসেবে বগুড়ায় ছিল মূলত উত্তরাঞ্চলে আমাদের আস্তানা। কিন্তু এখান থেকে প্রায় প্রতিদিনই যেতে হতো উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত সব পৌরসভায়- পার্বতীপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, সৈয়দপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, গোবিন্দগঞ্জ, আরো কত নাম। এক রাজশাহী ছাড়া মনে হয় উত্তরাঞ্চলের প্রায় ছোট-বড় সব শহরেই গিয়েছি (রাজশাহী শহরে সিটি কর্পোরেশন থাকায় আমাদের আওতার বাইরে ছিল)। এ সময় কাজকর্ম তেমন না করলেও কাজের খাতিরে এ ঘোরাঘুরিটুকু আমি বেশ উপভোগ করেছি।

মনে হয়েছে, এতদিনে আমি মাটির কাছাকাছি বাংলাদেশের আসল রূপ দেখতে পেলাম। তবে আজ শুধু বগুড়ার কথা। কথায় বলে মক্কার মানুষ নাকি হজ্জ পায় না। বগুড়ায় থেকেও তাই আমার তেমনভাবে বগুড়ায় থাকা হয় নি। তাছাড়া, বগুড়া পৌরসভা হিসেবেও অন্যান্য পৌরসভার চেয়ে বেশ অগ্রসর।

তাই আমাদের এখানে ‘ঠেলা’ দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন ছিল না। তবে শহরে থাকলে বিকেলে বা সন্ধ্যায় একটু ঘোরাঘুরি হতোই। ভোজনরসিক হিসেবে বগুড়ায় আমার সবচেয়ে প্রিয় হল এখানকার হোটেলের খাবার। আমি এ পর্যন্ত যত জেলা শহরে গিয়েছি বগুড়ার হোটেলই আমার কাছে সেরা মনে হয়েছে। বিশেষ করে ‘আকবরিয়া’ আর তার উল্টোদিকে যে খাবার হোটেল ছিল (নাম ভুলে গেছি) তার স্বাদ ছিল অতুলনীয়।

মাঝে মাঝে বৈচিত্রের জন্য জলেশ্বরীতলার ‘পদ্মা ফুডসে’ যেতাম। জলেশ্বরীতলার কাছাকাছি মালতীনগর জায়গাটা ছিল বেশ ছিমছাম (এখানকার মালতীরাও অন্য এলাকার মালতীদের চেয়ে একটু বেশি ইশমার্ট ছিল )। তবে শহর হিসেবে বগুড়া খুব ঘিঞ্জি। ছোট শহরে রাস্তায় যদি জ্যামে আটকা পড়ে থাকতে হয়, সেটা সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার। বগুড়ায় এটা নৈমিত্তিক ঘটনা।

বিশেষ করে সাত মাথা আর আকবরিয়ার কাছাকাছি এলাকায় সবসময় জ্যাম লেগে থাকত। আকবরিয়ায় খেতে গেলে তাই খাবারের সাথে 'জ্যাম ফ্রি'- কমপক্ষে দেড়-দুই ঘন্টার মামলা। সে তুলনায় আমাদের আবাসস্থল (এবং কর্মস্থল) নামাজগড় ছিল মোটামুটি কম ঘনবসতিপূর্ণ। নামাজগড়ে বা এর খুব কাছেই ছিল তারেক ভাইয়ার অভিজাত আবাসিক হোটেল- ‘সেফওয়ে’ নাম সম্ভবত। যা হোক, ঢাকা থেকে প্রথম যেদিন বগুড়া গিয়েছিলাম সেদিনই একটা বেশ ভালো সাইজের ধরা খেয়েছিলাম।

আমি ও আমার এক সহপাঠী একসাথে চাকরিতে জয়েন করতে গিয়েছিলাম। ঢাকা অফিস থেকে আমাদের বলা হয়েছিল বগুড়ায় অফিসের কোয়ার্টারেই আমরা থাকতে পারব। বগুড়া গিয়ে জানলাম- কোয়ার্টারে এখন গণমান্য অতিথিরা আছেন, আমাদের কিছুদিন পরে উঠতে হবে। অগত্যা আমরা তল্পিতল্পা নিয়ে পাশের এক হোটেলে গেলাম থাকার জন্য। তখন বিশ্বকাপ ফুটবল চলছে।

চাকরীর জন্য খেলা দেখতে পারব না- এটা ভেবে মন বেশ খারাপ। হোটেলে রুম পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখলাম একটা আস্ত টিভি রুমে শোভা পাচ্ছে। আমরা ম্যানেজারকে গিয়ে বললাম এ রুমই আমাদের চাই। ভাড়া দিয়ে রুমে এসে দেখি বেয়ারা টিভিটা ঘাড়ে করে আমাদের রুম থেকে নিয়ে যাচ্ছে। বেয়ারাকে পাকড়াও করে জিজ্ঞেস করলাম- টিভি নিয়া কই যাও? ব্যাটা দাঁত কেলিয়ে বলল ‘টিবির বাড়া চল্লিশ টেকা, ম্যানেজাররে দিয়া আসেন, আমি টিবি নিয়া আইতাসি’।

শুনে আমাদের মাথা হট । ম্যানেজারকে গিয়ে বললাম, ‘আমরা যখন রুম দেখসি তখন তো টিভি ছিল- তার মানে টিভিসহ রুম ভাড়া নিসি, আর ভাড়া দেওয়ার সময় আলাদা করে টিভির ভাড়ার কথা তো বলা হয় নাই, এখন টিভি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন?’ ম্যানেজার মনে হয় আমাদের কথা শুনে পাত্তাই দিল না- ‘টিভির ভাড়া চল্লিশ টাকা, আপনাদের এখানে না পোষাইলে অন্য হোটেল দেখেন’। আরে কী বেয়াদব! ‘আচ্ছা আমরা অন্য হোটেলে যাব, আমাদের ভাড়ার টাকা ফেরত দেন’। ম্যানেজার মনে হয় আকাশ থেকে পড়ল- ‘কীসের ভাড়ার টাকা! জমার খাতায় একবার টাকা জমা হলে আর ফেরত দেয়া হয় না। আপনারা সব হোটেলে খোঁজ নিয়ে দেখেন।

এখানে এটাই নিয়ম’। আরে, এ তো মহা বাটপাড়! আমরা তখন চিল্লাপাল্লা শুরু করলাম- ‘আমাদের টেকা দেন, আমরা এলজিইডির লোক, আমাদের টাকা মেরে আপনি থাকতে পারবেন না’। ব্যাটা এবার তার আসল চেহারা বের করল- ‘এলজিইডির গুষ্টি কিলাই, মেহমান আইসেন মেহমানের মতো থাকেন, আমাগো লগে গ্যাঞ্জাম করলে এলজিইডিই উড়ায় দিমু’। বুঝলাম, ব্যাটা এখানকার মাস্তান গোছের। চাকরীটা যখন এখানে করতে হবে, তখন লোকালদের সাথে ঝামেলায় না জড়ানোই ভাল।

আমরা কথা না বাড়িয়ে অন্য হোটেলে গেলাম। পরদিন বসের কাছে রিপোর্ট করলাম। বস স্থানীয় প্রভাবশালী এক কর্মকর্তার কাছে আমাদের পাঠালেন। উনি আশ্বাস দিলেন আমাদের টাকা উদ্ধার করে দেবেন। কিন্তু সে টাকা আমরা আর পাই নি।

বগুড়াবাসী মাইন্ড খাইয়েন না। বগুড়ায় এরকম অভিজ্ঞতা তিন মাসে আরো হয়েছে- খাবার বিল দেয়া থেকে শুরু করে, ফোনের বিল, রিক্সাভাড়া- সবকিছুতেই প্রথমে কিছু না কিছু বাটপাড়ির খপ্পরে পড়েছিলাম। একটা মজার ঘটনা দিয়ে শেষ করি। বগুড়ায় বেশ কিছুদিন হোটেলে হোটেলে কাটানোর পর এক সময় ডাক পেলাম অফিসের গেস্ট হাউসে থাকার। বুয়াকে আগেই বলে গিয়েছিলাম আসছে সপ্তাহ থেকে আমি গেস্ট হাউসে থাকব এবং খাব।

নির্দিষ্ট দিনে ঢাকা থেকে বগুড়া পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। বুয়া রান্নাঘর বন্ধ করে চলে যাচ্ছে। আমাকে দেখে তরকারী আবার টেবিলে এনে দিল এবং বলল সবার খাওয়া হয়ে গেছে আমি যেন খাওয়া শেষে সব উঠিয়ে রান্নাঘর বন্ধ করে দেই। তরকারি বলতে ভাতের সাথে চিংড়ি মাছ আর ডাল। আমার মাথায় তখনো বুয়েটের হল সিস্টেম ঘোরাফেরা করছে।

আমি ভাবলাম এখানে বোধহয় বুয়েটের হলের মতো প্রতিবেলায় রান্না হয়। এখন বাটির সব চিংড়ি মাছ আমাকেই সাবাড় করে উদ্ধার করতে হবে। আমি আরাম করে চিংড়ি খেতে লাগলাম এবং শেষে ক্লান্ত ও দয়াপরবশ হয়ে বুয়ার জন্য বাটিতে দু-তিনটা চিংড়ি রেখে দিলাম। এরপর বাটি সব রান্নাঘরে তুলে অফিসে গেলাম। রাতে সব বাসিন্দারা মিলে একসাথে খেতে বসেছি।

আমার বসও বসেছে আমার পাশে। বুয়া সেই চিংড়ির পাতিল এনে হাজির করল। এক এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (নাম ভুলে গেছি) তো চিংড়ির পাতিল দেখে মহা হাউকাউ শুরু করল- ‘আজ সকালেই বাজার থেকে এতগুলা চিংড়ি কিনে আনলাম। আর এখন মাত্র আছে এই দুই-তিনটা!’। আমি তো লজ্জায় শেষ।

কিছু বলতেও পারছি না। বুয়া আমাকে দেখিয়ে বলল- ‘সব শেষে তো এই স্যার খাইসেন, তখনো তো অনেক চিংড়ি আছিল’। আমি কিছু বলার আগে ওই অফিসার আবার চিল্লান দিলেন-‘আরে থামো তুমি, এই স্যার কি এতগুলা চিংড়ি খাইসে নাকি! নিশ্চয়ই এই কাম ওই বদ অডিটের লোকগুলা করসে, টেবিলে চিংড়ি দেখে সব সাবাড় করে দিসে’। তখন অডিট করার জন্য ঢাকা থেকে অডিট বিভাগের কিছু কর্মকর্তা এসে গেস্ট হাউসে ছিল এবং আমাদের পাশের রুমে এরা তখন দরজা বন্ধ করে হৈ-হল্লা করছিল। অফিসের লোকজন এমনিতেই অডিটওয়ালাদের পছন্দ করে না, এখন সুযোগ পেয়ে তুমুল গালিগালাজ শুরু হল।

আমি মাইনকার চিপায় পড়ে মুখ বন্ধ রাখলাম। একে তো নতুন এসেছি, তার ওপর না বুঝে করসি আকাম। বসও বইয়া আছে পাশে। আয়রনি হলো, নতুন বাসিন্দা হিসেবে আমাকেই বাকি চিংড়িগুলো গলাধঃকরণ করতে হলো; ঐ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমার পাতেই চিংড়িগুলো তুলে দিলেন। এমন অপরাধী হয়ে আর কখনো খেয়েছি বলে মনে পড়ে না।

তবে এই পাপ শেষ পর্যন্ত চাপা থাকে নি। আমি চাকরি ছাড়ার পর সবার কানেই এ বেয়কুফির খবর পৌঁছে গিয়েছিল। কীভাবে গেল, সে কথা না হয় চাপাই থাক। ---------------------------------------------------------- চট্টগ্রাম দিয়ে স্মৃতির শহর শুরু করেছিলাম। একটু বৈচিত্র আনতে অন্য শহরেও হানা দিলাম।

এরপর যদি লিখি, আবার হয়ত চট্টগ্রাম। তবে মাঝে মাঝে অন্য শহরও আসতে পারে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।