আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জাগরণ

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে....

গল্পটা শোনার পর বিস্মিত অন্তু প্রশ্ন করেছিল দাদুকে, “কিন্তু পাথর মানুষের মতো প্রাণ পায় কি করে ?” একটু গম্ভীর হয়ে দাদু বলেছিল,“ পায় রে দাদুভাই, পায়। মানুষ পাথর হতে পারলে, পাথর মানুষ হতে পারবে না কেন?...” আজ অনেক দিন পর কৈশোরে দাদুর কাছে শোনা সেই গল্পটা মনে পড়ে অন্তুর, একটি নব্য স্বাধীন দেশের গল্প - হাজারো মুক্তিকামী বীরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর দেশটি পুনরুদ্ধার করেছিল তার স্বাধীনতা। মুক্তিলাভের পর বীর যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন স্বরুপ দেশটি জুড়ে গড়ে তোলা হয় বহুসংখ্যক পাথরের মূর্তি। সেই মূর্তির সামনে দাড়িয়েই মুক্ত দেশের অধিবাসীরা শপথ নেয় তাদের স্বপ্নের দেশ গড়ার। কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়; কিছু কাল পরেই ক্ষমতালোভী কিছু অধিবাসীর অজস্র অনাচারে ক্ষত-বিক্ষত হয় দেশটি, ঘটে লক্ষ্যচ্যুতি।

যে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে অর্জিত হয়েছিল তাদের স্বাধীনতা, তাদেরই অনুসারীরা ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে দেশটিতে। অপর দিকে সাধারণ অধিবাসীরা হয়ে পড়ে মৃয়মান; প্রতি পদে অত্যাচারিত হচ্ছে জেনেও, কোন এক অজানা কারণে তারা নিশ্চুপ-নিশ্চল-নিথর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। অনিশ্চয়তার অসীম অন্ধকারে নিমোজ্জিত হতে থাকে দেশটির ভবিষ্যত। এ-ভাবেই চলতে থাকে সময়... হঠাৎ-ই একদিন বিস্ময়ে মূর্ছা যাবার উপক্রম হয় অধিবাসীদের, তারা লক্ষ্য করে - দেশের সব বিশ্বাসঘাতক-লুটেরা-কুচক্রীদের কারা যেন এক রাতের ভেতর হত্যা করেছে একে একে, তাদের পরিচিত একজন অনিষ্টকারীও আর জীবিত নেই ! নির্বাক হয়ে যায় সবাই - কারা ঘটালো এ-হত্যাকান্ড? কিভাবে? হত্যাকারীদের সন্ধান চলতে থাকে সারা দেশ জুড়ে, কিন্তু সামান্যতম কোন নমুনাও রেখে যায় নি হত্যাকারীরা! তবে কারা? নিরলস সন্ধান চলতে থাকে... তবে আশ্চর্য একটি বিষয় অচিরেই দৃষ্টিগোচর হয় অধিবাসীদের – সমগ্র দেশ জুড়ে তৈরী করা তাদের বীর যোদ্ধাদের মূর্তিগুলি উধাও হয়ে গেছে! মূর্তিগুলির সামান্যতম ধ্বংসাবশেষেরও চিহ্ন নেই কোথাও ! কিছুদিন পর নজরে আসে আরেকটি বিস্ময়! মূর্তিগুলি যে স্থানে দন্ডায়মান ছিল, তার পাদদেশে খোদাই করে লেখা – “ তোমরা পার নি, কিন্তু স্মরেছিলে; তারই প্রতিদান। ” আজ থেকে বছর সাতেক আগে গল্পটি শুনেছিল অন্তু, যে বয়সে বাস্তব আর রূপকথার পার্থক্য নির্ণয় বেশ দূরুহ ।

দাদুকে অনেক প্রশ্ন করেছিল অন্তু, আর দাদুও কথায় কথায় গল্পটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিল অন্তুর কাছে। সেই অল্প বয়সেই অন্তু বুঝতে পারতো ওর নিজের দেশের অবস্থাও গল্পের দেশটির থেকে ভিন্ন কিছু নয়। প্রায়ই বাবাকে বলতে শুনতো – “এ-দেশের আর কিছু হবে না, সব পচেঁ গেছে’’। আসন্ন অন্ধকারের প্রচ্ছন্ন আভাস আর দেশের মানুষের ক্রমবর্ধমান নিস্ক্রিয়তা কিছুটা হলেও কষ্ট দিত অন্তুকে, যদিও কোন কিছুই ঠিক স্পষ্ট ছিল না ওর কাছে। সেই সময়টাতেই দাদুর বলা গল্প মূর্তির জাগরণে মনে মনে বিশ্বাসী করে তুলেছিল ছোট্ট অন্তুকে।

আজও মনে পড়ে কি অধীর অপেক্ষায় সে স্কুল মাঠের কোনায় মুক্তিযোদ্ধার মূর্তিটার সামনে দাড়িয়ে থাকত গল্পটি শোনার পর থেকে। অন্তু তাকিয়ে থাকতো আর ভাবতো – মূর্তিটা যখন মানুষ হয়ে যাবে, তখন কি ওর শরীরে রক্ত বইবে? ওর চুলগুলো কি সাদা থেকে কালো হয়ে যাবে? ওর হাতের পাথুরে বন্দুকটা খেকে কি সত্যি সত্যিই গুলি বের হবে? মাঝে মাঝে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্তুর মনে হত মূর্তিটা যেন একটু কেঁপে উঠলো! ভয় পেত অন্তু, কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারতো – কই না তো! মূর্তি তো মূর্তির জায়গাতেই আছে। বাবার সাথে শহরে বেড়াতে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের আরও অনেক মূর্তি দেখতে পেত অন্তু। অন্তুর বিশ্বাস আরও প্রগাঢ় হচ্ছিল বহু সংখ্যক মূর্তি দেখে – মূর্তিগুলো একজোট হলে ওদের রোখে কার সাধ্য! দিন চলে যেতে থাকে, দেশে বিষবাষ্প ছড়াতে থাকে ধ্বংসকারীর দল ; কিন্তু কোথাও জাগরণের সামান্য আভাসটুকুও নেই – না মানুষের, না মূর্তির। এরই মাঝে একদিন অন্তুর বড় ভাইকে ধরে গিয়ে প্রচন্ড মারধর করে দুষ্কৃতকারীরা - তার দোষ সে নিয়মিত পত্রিকায় স্বাধীনতার কথা লিখতো, মুক্তির কথা লিখতো, শত্রুদের নিশিহ্ন করার কথা লিখতো।

অন্তুর মনে পড়ে, ভাইয়ের কথা শুনে সেদিন এক দৌড়ে স্কুল মাঠের সেই মূর্তিটার সামনে চলে গিয়েছিল ও; অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, “মানুষ কত শক্ত পাথর হলে তোমরা জাগবে ?” না, তার পরেও মূর্তি জাগেনি, জাগেনি মানুষও। যত দিন গেছে, মূর্তিরা তত মলিন হয়েছে – শরীরে পাখির বিষ্ঠা জমেছে তাদের, ধরেছে দীর্ঘ সব ফাটল; মানুষের বিদ্রোহী-সত্ত্বার উপরও জমেছে স্থবিরতার স্তর, ফাটল ধরেছে সততার দৃঢ় মূলে। আজ দীর্ঘদিন পর স্কুলের মাঠে মূর্তিটার সামনে এসে দাড়িয়েছে অন্তু, আশেপাশে আরও অনেক মানুষ। না, এখন আর অন্তু ছেলেবেলার মত নেই, কবেই সে সব বিশ্বাস উবে গেছে! তবে আজ চোখের সামনে যা দেখছে, তাতে সেই দিনগুলির কথা মনে না হয়ে পারে না। মুক্তিযোদ্ধার সেই মূর্তিটা মাটিতে ভেঙে পড়েছে, আর তার হাতের বন্দুকের বেয়নেটটা এফোড়-ওফোড় করে দিয়েছে মধ্যবয়স্ক একজন মানুষের শরীর।

মৃত ব্যক্তিটি এলাকার কুখ্যাত এক দুর্বৃ্ত্তকারী রাজনীতিবিদ, একটু আগেই মূর্তিটার নীচে দাঁড়িয়ে ভাষন দিচ্ছিল উচ্চকন্ঠে। হঠাৎ-ই মূর্তিটা পিছন থেকে ধ্বসে পড়ে তার উপর। অন্তু প্রায় নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে সেই অভাবনীয় দৃশ্যটির দিকে, যেভাবে তাকিয়ে থাকতো সেই কৈশোরে – জাগরণে বিশ্বাসের সেই দিনগুলিতে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।