আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পিলখানা হত্যাকাণ্ড! বাংলাদেশে যারা শক্তিশালী-সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী চায় না, তারাই এ কাজ করিয়েছে।



পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা বছর গড়াল। এখন বলা হচ্ছে, ডাল-ভাতের জন্য এত বড় বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে। হয়তো তদন্তে এটাই পাওয়া গেছে। কিন্তু বিশ্বাস করা কষ্টকর যে শুধু ডাল-ভাতের জন্য এতগুলো লোক মারা যাবেন। যাঁরা তদন্ত করেছেন, তাঁরা আসল ঘটনা বের করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।

আমার মনে হয়, আসল অপরাধীরা পালিয়ে গেছে। যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল, তারা হয়তো নেই। বিডিআর সৈনিকেরা হয়তো হুজুগে যোগ দিয়েছেন। হুজুগে বাঙালি তো। হয়তো তাঁরা গুলি করেছেন, অনেক কিছুই করেছেন।

কিন্তু এতগুলো সেনা কর্মকর্তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা, পরিবারের সদস্যদের ওপর নির্যাতন করা—এ কাজ জওয়ানেরা (সোলজার) করেছেন, সেটা বিশ্বাস করা কষ্টকর। বাংলাদেশে যারা শক্তিশালী-সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী চায় না, তারাই এ কাজ করিয়েছে। হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদেরই লোক। দুর্নীতির জন্য যাঁদের ডাল-ভাত কর্মসূচি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের কেউ কেউ হয়তো এর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু বাইরের লোক কারা ছিল, কেউ জানতে পারেনি।

আমি বিডিআরের তত্কালীন ডিজি শাকিল আহমেদকে বলেছিলাম জওয়ানদের এসব কাজে না লাগাতে। সেনারা এসব কাজ করতে গৌরব বোধ করে না। এমন কিছু জওয়ান হয়তো বাইরের লোকেদের সঙ্গে ছিলেন। গুলিও হয়তো চালিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা লোক মারবেন কেন? লোক মেরেছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক।

এখন তো বিচারের কথা শোনা যাচ্ছে। বিচার যত তাড়াতাড়ি করা যায়, তত ভালো। ইতিমধ্যে এক বছর হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীতে বা সশস্ত্র বাহিনীতে চাকরি করে সরাসরি কিছু বলা যায় না। কিন্তু মনে মনে ক্ষোভ থেকে যায়।

সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কোন দিক দিয়ে হয়, তার ঠিক নেই। কাজেই ওই ক্ষোভটাকে যত দূরীভূত করা যায়, ততই ভালো। যত তাড়াতাড়ি করা যায়, তত ভালো। আর এ জন্য যত তাড়াতাড়ি বিচার করা যায়, তত ভালো হবে। ঘটনার সময় একটা বেসামরিক সরকার ছিল।

তারা বিষয়টিকে বেসামরিক দিক থেকে দেখেছে। সামরিক লোকজন বিষয়টিকে সামরিকভাবে দেখবে। আমি সামরিক পেশার লোক, তাই আমি মনে করি, তখনই অ্যাকশনে যাওয়া উচিত ছিল। তারপর পুরো ব্যাপারটা এত দেরি হয়ে গেল যে, যারা ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা পালানোর সুযোগ পেয়ে গেল। কিন্তু যদি কিছু সময় দিতে হয়, তাহলে এলাকাটা তো ঘিরে রাখতে হবে, যাতে কেউ পালাতে না পারে।

কিন্তু এটা করা হলো না। তাদের পালানোর সুযোগ দেওয়া হলো। তারা তো পালিয়ে গেল। আর, যাঁরা আত্মসমর্পণ করেছেন, তাঁরা তো হুজুগের লোক। ওই হুজুগের লোক আত্মসমর্পণ করেছেন।

এর মধ্যে হয়তো হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া কেউ কেউ থাকতে পারেন। হয়তো তাঁরা লুটপাটে অংশ নিয়েছেন। তবে হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন কি না, সেটা বলা মুশকিল। কিন্তু আসল যারা খুনি, তারা পালিয়ে গেছে। তখন যদি ওই এলাকা ঘিরে রাখা হতো, তাহলে তারা পালাতে পারত না।

আর প্রথম যখন আত্মসমর্পণ করার সময় চলে গেল, তখনই অ্যাকশনে যাওয়া উচিত ছিল। বলা হলো, অ্যাকশনে যাওয়া যায়নি। কারণ জায়গাটা জনবসতির মধ্যে। অনেক লোক হতাহত হতে পারে। এটা কোনো কারণ নয়।

চারপাশে দেয়াল আছে। সেনারা যাঁরা যাবেন, তাঁরা তো আকাশে গুলি করবেন না। তাঁরা লক্ষ্যবস্তুর ওপর গুলি করবেন। বিডিআরের এতো সাহস ছিল না যে তারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করবে। কয়েকটি ট্যাংক ঢুকিয়ে দিলে তখনই হয়তো তাঁরা আত্মসমর্পণ করে ফেলতেন।

আর টেলিভিশনে যেসব অস্ত্র দেখানো হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কোনো গোলাবারুদই ছিল না। সাধারণ মানুষ না জানতে পারে, কিন্তু সেনাবাহিনী জানে যে, ওগুলোর মধ্যে কোনো গোলাবারুদই নেই। আর মারা যাবে কে? চারপাশে তো দেয়াল। গুলি লাগলে দেওয়ালে গিয়ে লাগবে। আর তারা যদি গুলি চালায়, তাহলে সেনাদের দিকেই মারবে।

আমার মনে হয়, ভুল ওখানে হয়েছে। খুব বেশি সময় নষ্ট করা হয়েছে। বিডিআরের নাম আগেও অনেকবার বদল হয়েছে। পোশাকও বদল হয়েছে, তাদের ভূমিকাও বদল হয়েছে কিছু কিছু। কাজেই নতুন যে বদল হয়েছে, এর মধ্যে আহামরি কিছু করা হয়নি।

তবে বদল করার হয়তো যুক্তি আছে। কারণ, গ্রামগঞ্জের অনেকে হয়তো বিডিআরের এই পোশাক পছন্দ করবে না। লোকজন বলবে যে এই বিডিআর লোক মেরেছে। আর এখন তো মানুষ সব ভুলে যাচ্ছে, কাজেই পোশাক বদল না করলেও চলত। নাম বদল না করলেও চলত।

তবে বদলে খারাপ কিছু নাই। আর পুনর্গঠনে কিছুটা মাথা ভারী হয়ে গেছে। কিন্তু আসল যে দাবি, সেটাই তো করা হয়নি। বিডিআরের সদস্যরা চেয়েছিলেন, তাঁরা একদিন কর্মকর্তা হবেন। সেটা তো করা হলো না।

ফলে ১৫-২০ বছর পর আবার কোনো ঘটনার শঙ্কা থেকেই গেল। বিডিআর বাহিনীকে কীভাবে ব্যবহার করা হবে, এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। বিডিআরের দুটো ভূমিকা—একটা শান্তির সময়, অন্যটা যুদ্ধের সময়। অতীতে ছিল, শান্তির সময় বিডিআর সীমান্ত রক্ষা করবে আর যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করবে। সে জন্য তাদের সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণেরও দরকার ছিল।

আর, যে জন্য সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা বিডিআরে আসতেন। পাকিস্তানেও এটা আছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য আছে। ভারতে সেনাবাহিনী এত বিরাট যে তাদের বর্ডার ফোর্সের দরকার হয় না। বাংলাদেশে আনসারকে দিয়ে যে কাজ করানো হয়, ভারতে বর্ডার ফোর্সকে দিয়ে সেই কাজ করানো হয়।

বাংলাদেশে তো এতো ফোর্স রাখা সম্ভব নয়। তাই বিডিআর রাখা হয়েছে। তারা সেনাবাহিনীর শক্তি বাড়াবে। সে জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিডিআরের ডিএডিরা মনে করেন যে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা বাজে লোক।

তার কারণও আছে। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা সেখানে যান, দু-তিন বছরের জন্য। তাঁরা এটিকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেন না। কারণ তাঁর ভবিষ্যত্ ক্যারিয়ার আর্মিতে। জওয়ানেরা (সোলজার) মনে করেন, বিডিআরের কর্মকর্তারা তাঁদের মধ্যে থেকে হলে তাঁরা বেশি সুবিধা পাবেন।

এ জন্যই তাঁরা নিজেদের অফিসার চান। আমি একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সেটা অবশ্য অনেক দেরিতে দেওয়া হয়েছে। বিডিআরে যদি সেনা কর্মকর্তাদের রাখা হয়, তাহলে সেনাদেরও সেখান থেকে আসতে হবে। সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন উইং আছে।

সেনাবাহিনীতে বর্ডার গার্ড নামে একটা উইং রাখলে ভালো হয়। তারা বর্ডার গার্ড করবে, আর কিছু করবে না। তাদের সবকিছু হবে সেনাবাহিনী থেকে। তাদের প্রশিক্ষণসহ সবকিছু দিয়ে সীমান্তে পাঠানো হবে। তারপর অবসরের সময় সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেবে।

তবে এটার আইনি দিক কী, সেটা আমি জানি না। অনেক দেশই পছন্দ করবে না যে তাদের সীমান্তে সেনাবাহিনীর লোক থাকবে। কারণ সেনাবাহিনীর লোক থাকলে তাদের অসুবিধা হয়ে যায়। মিয়ানমারে এত দিন সেনাবাহিনীর লোক ছিল। তারপর ভারতেরও অনেক অনেক জায়গায় সেনাবাহিনীর লোক আছে।

 লে. জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আতিকুর রহমান: সাবেক সেনা প্রধান ও বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।