আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্মৃতির দৌড় , দৌড়ের স্মৃতি : গল্পে , অনুভবে (১৯৮৮-১৯৯৪)

আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার ব্লগখানি কৌতুহল ভরে

কৃতজ্ঞতার , বাবার ভালবাসার : দৌড়ুনোর প্রথম স্মৃতি .... স্মৃতির ক্যালেন্ডারে ৮৮ সালের মার্চের এক সকাল , সকালের সৌম্য ভেঙে শহরের আকাশ জুড়ে এক ঝাঁক ইরাকী বোমারু বিমান । শহরের নাম কেরমানশাহ ,আমরা সে শহরে অতিথি , ইরান থেকে দেশে বেড়াতে আসার জন্য আমাদের যাত্রা , সে যাত্রাপথে সেই সকালেই কেরমানশাহে আমাদের প্রবেশ । কেরমানশাহে তখনও গাড়ি থেকে নামার ফুসরত মেলেনা আমাদের , হঠাৎ গগনবিদারী সাইরেন , পরক্ষণেই সব এলোমেলো , কি করে গাড়ি থেকে নেমে আসি বাবার কোলে , অতটুকুন ক্ষয়ে যাওয়া স্মৃতি । রাস্তাজুড়ে এলোমেলো গাড়ি , সব গাড়ির দরজা খোলা ,দরজা খুলে নেমে আসা মানুষের স্রোত , সে স্রোতের একজন আমার বাবা , বাবার কোলে এক হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখা আমি , অন্য হাতে মায়ের হাত , মায়ের চোখে অঝোর জল , মায়ের কোলে আধো বোলে আমার ছোট ভাই । দু'ধারের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মানুষের ঝাঁক , চোখে মুখে আতঙ্ক , গাড়ির হর্ণ , সাইরেন .... , প্রাণপণে রুদ্ধশ্বাসে সবার ছুটে চলা ।

খানিক দূরে ডানে বামে কনক্রীটের আন্ডারগ্রাউন্ড বাংকার , বেঁচে থাকার আশ্রয় । ছু'টে চলা স্রোতগুলো সেগুলো সেখানে মিশে যেতে দেখি । সেই আমার প্রথম, প্রথম ভীষণ গতি , ছু'টে চলার প্রথম স্মৃতি । বাবার পায়ে আমার প্রথম দৌড় , ছুটে চলার নকশায় প্রথম ফোঁড় । কি নাম সে স্মৃতির ? পিতৃত্বের , ভালবাসার নাকি কৃতজ্ঞতার ।

ছোট জীবনের , জীবনের মায়ার: তারপর .... জীবন হাতে নিয়ে নিজের ছোট পায়ে দৌড়ুনোর স্মৃতিটা খোদাই হতে বড়জোড় আর একবছর লাগে । রোজ বিকেলের খেলার সাথীটির নাম ইদ্রিস । এক বিকেলে কি খেয়ালে নিজের পোষা বদরাগী কুকুরটি আমার পেছনে লেলিয়ে দেয় । সে বয়সে , এতটুকুনই যেন আমার কাছে মৃত্যুর হাতছানি । রুদ্ধশ্বাসে আমি ছুটে চলি , পেছনে ছুটে আসে ইদ্রিসের কুকুর ।

বাসা পর্যন্ত পথটা অসীম দূরত্বের মনে হয় , এতদিনেও সে অনুভূতি আজও ফিকে হয়ে যায়না । আমার প্রাণশক্তি যেন ফুরিয়ে আসে , শেষ বিন্দুটুকু ঢেলে দিয়ে বাসার দ্বারে পৌছে যাই , কিন্তু ঘরে ঢোকা হয়না । স্টিলের চৌকাঠে আমার ছোট কাঁধ আটকে যায় । পুরো বাসা কাঁপিয়ে দ্বারের সামনে আমি নিথর হয়ে ছিটকে পড়ি । আচমকা ঘটনায় কুকুরটাকে ঘাবড়ে গিয়ে পালিয়ে যেতে দেখি ।

উড়ে চলার: দৌড়ের মাঝে উড়ে চলার স্বপ্নের স্থপতির নাম ইকারুস । স্কুলে যেতাম না বলে , ঘরে বসেই ইকারুসের গল্প পড়ে , গ্লাইডারে ভর করে আকাশে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখি । আমাদের হসপিটাল কম্পাউন্ড ঘেঁষেই একটা গাঁ , সে গাঁয়ে মাত্র কয়েকটা ঘর , ঘর পেরুলেই হেলানো পাহাড় । বসন্তে লাল সাদা হলুদ অজানা নামের ফুলে , আর নাম জানা টিউলিপ ফুলে সে পাহাড় রঙিন কার্পেট জড়িয়ে নেয় । বিকেলে বন্ধুদের সাথে সে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে , দু'হাত দুপাশে আদিগন্ত ছড়িয়ে দিতাম , পাগুলো শিথিল করে ঢাল বেয়ে শুরু হত আমার দৌড় ।

বাতাসে ভেসে , উড়ে চলার স্বপ্নে রঙ মেখে পৌছে যেতাম পাহাড়ের পাদদেশে । পাশের শহরের হসপিটালের ডাক্তার আংকেলরা মাঝে মাঝে বেড়াতে আসেন । তাদের ছোট ছেলেমেয়েগুলির বেশ ক'জনা আমার সমবয়েসী । তাদেরই একজন জুনায়েদ । এক উপলক্ষে জুনায়েদরা বেড়াতে আসলে আমি ঐ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওকে উড়তে শেখাই ।

উড়ে চলার সে দৌড় জুনায়েদও ভালবেসে ফেলে । তারপর একদিন গাঁয়ে বড় বড় বুলডোজার আসে । পাহাড়ের ঠিক মাঝ চীরে তৈরি হয় রাস্তা । পাহাড় বেয়ে আমার ছুটে নেমে আসার গল্পও ফুরিয়ে যায় । লজ্জার: জুনায়েদরা আবার আসে , পাহাড়ের চূড়াতেও ওঠে ।

কিন্তু ভুলে যায় সে রাস্তার কথা । হেলানো বলে , পাহাড়ের চূড়া থেকে পুরো পাহাড় দেখার জো নেই , সে না দেখাই কাল হয়ে দাঁড়ায় , কিছু বুঝে উঠার আগেই ও নিচের দিকে ছুটে যায় । ঢাল বেয়ে নিচে দৌড়ে গিয়ে দেখি , রাস্তার উপর অসহায় ভাবে ও পড়ে আছে । সে যাত্রায় খুব বড় ক্ষতি হয় না , ওর হাঁটু আর হাতে বেশ ক'জায়গায় ছলে যায় , ঘরে ফিরে সবার সামনে বলে আর কখনও আমাদের বাসায় আসবে না । কি ভেবেছিল সেদিন সবাই ? সবাই কি জানত কি হয়েছিল ? নাকি আমার দোষ ভেবে নিয়েছিল সবাই ? শেষ পরিচ্ছদটা আজও অজানা.... কিন্তু সে দৌড় নিয়ে আমার লজ্জার রেশটা বেঁচে রইবে চিরকাল ।

রক্তের : পরের গল্পটার দিনক্ষণ অজানা । আমার প্রিয় ইরানী বন্ধুটির নাম নাসের , সেই নাসেরই মাঝে মাঝে ক্রোধে অন্যরকম হয়ে ওঠে । ইরানের রুক্ষ মাটিতে ছড়িয়ে থাকা কোটি পাথর টুকরো আমাদের খেলার নিত্য সঙ্গী । একদিন পাথর নিয়ে খেলতে খেলতে আমার হাত ছিটকে একটু টুকরো গিয়ে নাসেরের পায়ে আঘাত করে বসে । কিছু হয়নি বলে খেলা থামে না , বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করেই নাসেরের সজোরে ছুঁড়ে দেয়াএকটা পাথরের টুকরো আমার চোখের ঠিক নিচে এসে লাগে ।

হঠাৎ করেই পৃথিবীটা যেন অন্ধকার দেখি , বাসার দিকে দৌড়াতে শুরু করি । ছুটে চলার ফাঁকে টপটপ করে পড়া রক্তের ফোঁটায় আমার সাদা কেডস লাল হয়ে যেতে দেখি । আয়নার সামনে দাঁড়ালে চোখের নিচে সেই ক্ষতের রয়ে যাওয়া খানিক দাগ আজও রক্ত ঝরানো ছুটে চলার স্মৃতি হয়ে ফিরে আসে। গর্বের , অহঙ্কারের : ইরান ছেড়ে শেষ যেবার দেশে ফিরি , তার দিন কয়েক পরেই দক্ষিণ এশিয়া জয় করে নেয় বাংলাদেশের এক তরুণ । দৌড়ে উপমহাদেশ জয় করা সে তরুণের নাম বিমল চন্দ্র তরফদার , টিভি স্ক্রিনে দেখা সে দৌড়ের রেশ না কাটতেই , স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয় ।

পরীক্ষা শেষে চেহারা মনে থাকা , নাম না জানা বুড়ো এক শিক্ষক বিশাল হলরুম ভর্তি ছেলে মেয়েকে এসে জিজ্ঞেস করেন দ্রুততম মানবের কথা । হয়ত ইতস্তত হওয়ার বোধ থেকে বা না জানার ভয় থেকে কারও হাত ওঠেনা । দোটনার মাঝে আমার হাতটা উঠে যায় । বিমলের কথা বলতেই স্যার এসে আমার চুল নেড়ে দেন , আজ প্রথমবার স্বীকার করে নিই সেদিন আমার ভীষণ গর্ব হওয়ার কথা। বিমলের সে দৌড় অহঙ্কারের ভাগীদার হয়ে গর্বের যে অনুভূতি আজও হয় , সে দৌড়ের স্মৃতি কি কোনদিন মলিন হবে ? .


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।