আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আবদুস সালামঃ ভাষা সৈনিক

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

আবদুস সালাম একজন ভাষা সৈনিক। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছেন। ভাষা শহীদ আবদুস সালামের জন্ম ১৯২৫ সালের ২৭নভেম্বর। ফেনী জেলার (শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে) দাগনভুঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নের লক্ষণপুর গ্রামে।

বাবা ফাজিল মিয়া। মা দৌলতের নেছা। ৪ ভাই ৩ বোনের মধ্যে সালাম সবার বড়। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। প্রাথমিক পড়াশুনা শেষে তিনি মাতুভূঞা করিম উল্যাহ স্কুলে ভর্তি হন।

ওই স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণী পাশ করে দাগনভুঞার কামাল আতাতুর্ক হাই স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। নবম শ্রেণীতে পড়ালেখা চলাকালীন সময় জেঠাতো ভাই হাবিবের সহযোগীতায় সালাম পরিবার স্বচ্চলতার লাভের স্বপ্নে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় এসে ৫৮, দিলকুশা, মতিঝিল ডাইরেক্টর অব ইন্ডাষ্ট্রিজ কমার্স এ পিয়নের চাকুরীতে যোগদান করেন। বাস করতেন নীলক্ষেত ব্যারাকে। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে সালাম কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে যান।

ছুটি শেষে ঢাকায় চাকুরী স্থলে ফিরে আসেন। ফেব্রুয়ারী মাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা ছিল উত্তাল। এ আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছিল সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিস আদালতে এবং রাজপথের সবখানে। ভাষা আন্দোলনের ঢেউ সালামকে আলোড়িত করে। বাড়ি থেকে এসে পত্র-পত্রিকা পড়ে এবং লোকজনের কাছে শুনে তিনি ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন।

ভাষার দাবিতে ছাত্রদের মিছিল-মিটিং ও লিফলেট বিলিতেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। ৫২’ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা দেশে আন্দোলনের প্রস্তুতি দিবস। ওই দিন সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমনেসিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত) গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত শুরু হতে থাকে। সকাল ১১ টায় কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ শুরু হয়। ২০ ফেব্রুয়ারী পাকিস্থান সরকার ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিকে তছনছ করে দেয়ার জন্য ঢাকাতে সমাবেশ, মিছিল-মিটিংযের উপর ১৪৪ ধারা জারি করে।

সকালের দিকে ১৪৪ ধারা ভংগের ব্যাপারে ছাত্র-রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. এস এম হোসেইন এর নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক সমাবেশ স্থলে যান এবং ১৪৪ ধারা ভংগ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন। বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সময় ধরে উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন এবং গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভংগের পক্ষে মত দিলেও সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় বাংলার দামাল ছেলেরা দমনমূলক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। উপস্থিত সাধারণ ছাত্ররা স্বত:স্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভংগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয়।

অধিকার আদায়ের দাবিতে শত শত বিদ্রোহী কন্ঠে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” বলতেই পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবি এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর মাষ্টার্সের ছাত্র), রফিক উদ্দীন, এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুণ মারা যায়। রফিক, জাব্বার, বরকত, শফিক সহ নাম না জানা আরও অনেকের সাথে সালামও সেদিন গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ সালামকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। সে দিনই সন্ধ্যায় টেলিগ্রামে সালামের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে সালামের বাবা ফাজিল মিয়া, জেঠাতো ভাই হাবিব উল্যাহ ও প্রতিবেশী মকবুর আহমদ ২২ ফেব্রুয়ারী সকালে ঢাকায় ছুটে আসেন।

প্রায় দেড় মাস ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে ওই ৭এপ্রিল তিনি মারা যান(সূত্র : ৮ এপ্রিল, দৈনিক আজাদ)। শহীদ সালামের চাকুরী স্থলে তার ছোট ভাই আবদুস সোবহান স্থলাভিষিক্ত হন। স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠানটি শিল্প দপ্তরে রূপান্তরিত হয়। সালামের রক্ত মাখা শার্ট সহ আরো কিছু স্মৃতি সাবলিত ট্রাংকটি স্বাধীনতার কয়েক বছর পর সিধেঁল চোর নিয়ে যায়। সালামের শেষ স্মৃতি দু খানা ছবি ছিল তা ফেনীর আওয়ামী লীগ নেতা খাজা আহমদকে প্রয়োজনে দেয়া হয়।

তার মৃত্যুর পর সে ছবির খোঁজ করে পাওয়া যায়নি। ১৯৯৯ সালের ১৮ নভেম্বর ফেনী জেলা পরিষদের অর্থায়নে ফেনী শহরের মিজান রোডে অবস্থিত কমিউনিটি সেন্টার ভাষা শহীদ সালামের নামে নামকরণ করা হয়। ২০০০ সালে ফেনী জেলার একমাত্র স্টেডিয়াম ভাষা শহীদ সালামের নামে নামকরণ হয়। শহীদ সালামের জন্মস্থান লক্ষ্মনপুর গ্রামের নাম পরিবর্তন করে সরকারী ভাবে সালাম নগর হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ২০০০ সালে সরকার শহীদ আবদুস সালামকে মরনোত্তর 'একুশে পদক' প্রদান করেন।

২০০৭ সালে ২১ ফেব্রুয়ারী দাগনভুঞা উপজেলা মিলনায়তন 'ভাষা শহীদ সালাম মিলনায়তন' নামে নামকরণ করা হয়। এছাড়া ভাষা শহীদ আবদুস সালামের স্মৃতি রক্ষায় সালাম নগর গ্রামে ৬৩ লাখ ৮০ হাজার ২৫৮ টাকা ব্যয়ে একটি স্মৃতি গ্রন্থাগার ও জাদুঘর নির্মান কাজ শেষ হয়েছে।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.