আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেকল ভাঙা সংস্কৃতি (পর্ব - ৩)

মানুষ, এটাই আমার পরিচয়...

শেকল ভাঙা সংস্কৃতি (পর্ব - ১) শেকল ভাঙা সংস্কৃতি (পর্ব - ২) কয়েকদিন আগে কলেজস্ট্রীটের একটি বইয়ের দোকানে গিয়েছিলাম। দোকানের মালিক আমার এক পুরাতন বন্ধু। ভারতবর্ষের বিভিন্ন সাম্যবাদী দলের কোন একটির তিনি একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য। আমাকে দেখে তিনি খুব খুশি হয়ে সাদরে বসতে বললেন, কুশল জিজ্ঞাসা করলেন এবং হাঁক দিলেন, ‘বিষ্ঞু, একটু চায়ের ব্যবস্থা করতে পারবি?’ বিষ্ঞু নামক কোন একজন ভৃত্যস্থানীয় ব্যক্তি বইয়ের আলমারীর আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘নগেনের দোকান তো বন্ধ হয়ে গ্যাছে। চা আনতে হলে মোড়ের থেকে আনতে হবে।

‘ বন্ধু বললেন, ‘তাই যা না রে! অশোকবাবু বহুদিন বাদে এসেছেন। ‘ বিষ্ঞু খানিকটা অনিচ্ছা সহকারে বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। যাই। পয়সা দিন। ‘ তার প্রসারিত হাতে কিছু খুচরো পয়সা দিয়ে বন্ধু বললেন, ‘শোন, তিন কাপ নিস।

তুইও এক কাপ খাবি। ‘ বিষ্ঞু কিছু না বলে বেরিয়ে গেল। এই পর্যন্ত পড়ে পাঠকের কোথাও কি কেন বিষয়ে খটকা লাগল? খুব সম্ভবত লাগে নি। অথ এই ঘটনাভিত্তিক সামান্য বিবরণের মধ্যে আমাদের সমাজ-সম্পর্কিত এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সত্য স্পষ্টভাবে জ্বলজ্বল করছে। এখনও বোধহয় নজরে পড়ছে না, তাই না? চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিই।

ক্রিয়াপদের ব্যবহারগুলো লক্ষ্য করুন। আমার বন্ধুর ক্ষেত্রে আমি ক্রিয়াপদ ব্যবহার করছি ‘বললেন’ ‘দিলেন’ ইত্যাদি। বিষ্ঞুর ক্ষেত্রে লিখেছি ‘বলল’, ‘গেল’ ইত্যাদি। আরো লক্ষ্য করে দেখুন, বিষ্ঞুকে উদ্দেশ্য করে আমার বন্ধু যখন বলছেন তখন তাকে সম্বোধন করেনে ‘তুই’ বলে। আমরা সমাজে কিছু লোককে আপনি বলে এবং অন্য কিছু লোককে তুমি বা তুই বলে এতই অভ্যস্ত যে তা নিয়ে কখনও চিন্তাই করি না।

নি:শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই ওই আচরণ আমাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়। আমার বন্ধু সাম্যবাদী। আমিও তাই। সাম্যবাদের মূল কথাই হলো সর্বমানুষের প্রতি সমদৃষ্টি। সাম্যবাদী সমাজে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে সব মানুষই সমপরিমাণ সুযোগ-সুবিধা পাবে।

ধনী-দরিদ্রের ভেদ যে থাকবে না তা অবশ্য নয়। কিন্তু সেই ভেদ নির্ভর করবে যোগ্যতার ভেদেরে উপর। যোগ্যতর, অধিকতর কর্মকুশল ব্যক্তি সাম্যবাদী সমাজে অধিকতর আয়ের ভাগী হবে। কিন্তু আয় ও জীবনমানের ভেদ থাকলেও সাম্যবাদী সমাজে মানুষে মানুষে মর্যাদায় কোন ভেদ থাকবে না। সব মানুষই সমপরিমাণ মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী হবে।

আমাদের সমাজ মোটেই সাম্যবাদী নয়, যদিও সাম্যবাদকে লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছে সবকয়টি রাজনৈতিক দল। আমাদের দেশের সব মানুষ সমপরিমাণ সুযোগ-সুবিধা মোটেই পায় না। তাদের আয় ও জীবনমানের প্রভেদও তাদের যোগ্যতার উপর নির্ভর করে না, করে সম্পত্তির মালিকানা ও অন্যান্য বিষমভাবে বন্টিত সুযোগ-সবিধার উপর। এই সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ভেঙে পরিবর্তন করে সাম্যবাদী আদর্শের সংঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে তোলার কাজ এখনো অনেক পড়ে রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে সেই লক্ষ্যে পৌছান যাবে বলেও ভরসা করা যায় না।

তা সত্ত্বেও ওই লক্ষ্যের সংগ্রাম চলছে এবং চলবে। সামজকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলতে অনেক সময় লাগবে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই কাজকে আদর্শ হিসাবে মেনে নিয়েছে যারা তারা বর্তমান সমাজের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন শ্রেণী ও স্তরের মানুষদের কী চোখে দেখে, তদের সঙ্গে কী রকম আচরণ করে তার উপর ওই সংগ্রামের সাফল্য অনেক পরিমাণ নির্ভরশীল। আমার যে রাজনৈতিক বন্ধুটির কথা দিয়ে প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছি তিনি যে দরিদ্রদরদী তা প্রকাশ পায় তাঁর ভৃত্যটিকে নিজের জন্যও এক পেয়ালা চা কিনতে বলার মধ্যে। তিনি মনে মনে কামনা করেন, যেন সমাজের সকলেই সমান সুযোগ-সুবিধা পায়।

সেই কারণে যদিও তাঁর এবং আমার জীবনের মান বিষ্ঞু নামক ভৃত্যটির জীবনের মানের চেয়ে অনেক উন্নত তথাপি ওই চা খাওয়ার সামান্য ব্যাপরটিতে তাঁর স্বতপ:প্রণোদিতভাবে মনে হয়, আমরা দু-জনে চা খাব, বিষ্ঞু তা এনে দেবে, বিষ্ঞুও এক পেয়ালা চা খাক না। এই মনোভাব অবশ্যই খুব সাধু। কিন্তু তিনি যে তাকে ‘তুই’ সম্বোধন করলেন তাতে কি কোন মনোভাবই প্রকাশ পেলো না? পেলো বৈ কি! এতে এই মনোভাবটা প্রকাশ পেলো যে, আমি ও আমার বন্ধু-আমর ভদ্রশ্রেণীভুক্ত, বিষ্ঞু তা নয়। ‘ছোটলোক’ শ্রেণীভুক্ত। অবশ্য ‘ছোটলোক’ কথাটি আজকাল আর আমাদের অনেকেই ব্যবহার করতে ভালবাসি ন।

কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা ধরেই নিই যে, আমাদের ভদ্রলোকদের জন্মগত অধিকার আছে বিষ্ঞুর মতো ছোটলোকদের নাম ধরে ডাকার এবং তুমি বা তুই বলে সম্বোধন করার। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত উচ্চবর্ণ ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নতস্তরের ব্যক্তিরা খেটে খাওয়া মানুষদের শুধু যে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতেন, নাম ধরে ডাকতেন, তাই না-কথায় কথায় কারণে-অকারণে গালিগালাজ করাটাও তাদের মধ্যে ছিল খুবই সাধারণ। কয়েক-দশক আগেকার গল্প উপন্যাসে একালের তরুণ পাঠকেরা দেখতে পাবে কত অনায়াসে বাবুশ্রেণীর ব্যক্তিরা খেটে-খাওয়া মানুষদের মূর্খ, অকর্মণ্য, নির্বোধ ইত্যাদি বলে বিশেষিত করেছেন, এমন কি ‘হারামজাদা’ জাতীয় নিছক গালাগালিও তাদের কথাবার্তার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করে থাকছে। (চলবে) (লেখাটি উৎস মানুষ সংকলন এর “শেকল ভাঙা সঙস্কৃতি” বই থেকে নেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে পুরো বই-টি তুলে ধরব।

কারণ, এ বইটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের সবার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি বই বলে আমি মনে করি। )

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।