আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রিয়তমেষু

একদা ছাদ ছিল। ফলে মাধবী ঝুঁকে পড়লে ফুটপাথের ফরিদুল ঈশপের হরিণশিশুর মতো করুণ নয়নে তাকিয়ে থাকতো। ‘বিকেলে দেখা কোরো’ এই চিরকূটটি খাতার ভেতর গুঁজে দিয়ে তবলার তরুণ মাষ্টারও অপেক্ষার যুপকাষ্ঠে নিজেকে সঁপে দিত। তখন পিলসুজে বাতির যুগ; এডিসনের বিজলির দেখা পায়নি আমাদের মফস্বল। সেমিনার করে পরিবেশ সংরক্ষনের কচকচানিও শুরু হয়নি।

ফলে গাছেরা নিরাপদে ছিল। আর তাদের কোলে, কদম্বরেণু বিছিয়ে ফুলশয্যা নিত প্রেমিক যুগল। যারা বাংলায় একটু ভাল,তাদের আংরেজির কষিটানা খাতায় বংশবিস্তার করতো নানান ইচ্ছের প্রেমপত্র। অধিকাংশ বাঙালি প্রেমিক তখনো মনের কথা গুছিয়ে মুখে ফোটাতে পারেনি। তাদের তো অপেশাদার সহকারি লাগবেই,সত্যান্বেষী শার্লক হোমসের যেমন ডাঃ ওয়াটসন।

কম্পিউটারের জানলা খোলা না থাকায় মেয়েদেরও সে-সব চিঠি পড়ার সুযোগ ছিল। তারপর কোন ঝড়ে পাল্টে গেল দিনগুলো ? ফেসবুক প্রোফাইলে তোমার ছবিটা দেখেই চিনতে পেরেছি জানো, প্রিয়তমেষু। তারপর রাতভর স্মৃতির ভেতর প্রবল হাওয়ায় হাঁটতে হাঁটতে, নিজস্ব বিদ্যাসুন্দরে, নিষ্ঠ ভাষ্করের মতো গড়েছি তোমায়। মনে মনে মেহেদি নকশার মতো রেখা ও রঙের আঁচড়ে তোমার চিবুক, ঘাড়, বুক ছুঁয়ে শরীরের প্রতি ঘাটে ঘাটে তানপুরার জলধ্বনি শুনতে শুনতে যেন পুনর্জন্ম হলো আমার ! ইঁদুর টিপে বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠিয়েও যখন দেখলাম তুমি এড়িয়ে যেতে চাইছ ফেলে আসা সম্পর্ক, ঠিক তখনই মনে হল কী লাভ তোমার বিবাহিত জীবনে অযাচিত বিপদ ডেকে এনে! কিন্তু, নাছোড়বান্দা মনকে ভুজুং-ভাজুং দিয়ে যতই চোখ রাঙানিতে রাখি সে কি আর আমার কথা শোনে! তাই দেখো না, উল্টো দিকের ফ্লাটের মুন্নি যখন বেপরোয়া বাসন্তিক আঁচলে বদনামি ঝারি মারছে রাতুলের চোখে চোখ রেখে,পাশের বাড়ির পলাশ-জারুল যখন বুটিক পাঞ্জাবির লম্বা ঝুল নিয়ে প্রেমিকাদের সঙ্গে ভোকাট্টা দুপুরের মিষ্টি তাপ আহরণে মশগুল,স্বরসতী পুজোর পিরিতকুসুম সকালে তখন স্রেফ তোমাকেই ভাবছি। জড়ানো যামিনী পটের স্মৃতির ভাঁজ খুলতে খুলতে কেবল ভাবছি আর সুদীর্ঘ টেক্সট লিখছি এফ বিতে।

জানি, পুড়ে যাওয়া পাতার অক্ষর ফের লেখা যায়না। তবু বলি, এই সরলমতি বান্দার টেক্সটের রিপ্লাই করো একটা। প্লিজ,প্রিয়তা প্লি-ইজজ! ওই যাঃ! তোমাকে ‘প্রিয়তা’ বলে ফেললাম! আমার কী দোষ? তুমিই তো এমন এক দিনে ভালবাসার খরস্রোতে ভাসিয়েছিলে আমাকে। ফাগুনের আগুন লাগা সকালে রক্ষনশীলতার চৌকাঠ টপকে আমাকে চিলেকোঠায় টেনে নিয়ে চুমু খেতে খেতে শিখিয়েছিলে,ব্যস্ততার সময় বড় নাম কেমন করে ছোট্ট করে ডাকতে হয়! সেই প্রথম আমি কোনও মেয়েকে চুমু খেয়েছিলাম জানো! সে অবশ্য কম বেশি সব বাঙালির-ই প্রথম চুমু খাওয়া বাসন্তী আর হলদে পাঞ্জাবীর মাতাল প্রেমের দিনটিতে। প্রিয়তমেষু তুমি এখন কোথায় গো ? বিয়ের পর আর যোগাযোগ রাখতে চাওনি বলে এড়িয়ে চলতে জানি।

তাই তোমাদের নতুন ফ্যাটের ঠিকানাও আমার কাছে অজানা। ঠিকানা জানলে সত্যি সত্যিই এক্ষুনি চলে যেতাম জানো। এক্ষুনি ! তোমাকে প্রিয়তা নামে খুব ডাকতে ইচ্ছে করছে সেই প্রথমবারের মতো! কলেজ জীবনের এক বন্ধুর এফ বি ফ্রেন্ডলিষ্টে সেদিন হঠাৎ করেই তোমাকে ফিরে পেলাম। কত বদলে গেছ তুমি! ভ্রমর চোখে উধাও সেই চাহনি। উধাও, তোমার জোৎস্না নেভানো আলো! লাউডগা চিবুকে এখন দাপুটে রাজত্ব করছে অন্য কারো লালির পরত , প্রসাধনীমাখা ত্বকে লেমিনেটেড জৌলুস! হয়তো আমার দেখার ভুল।

অথবা আমার চোখ দুটি বদলে গেছে একদা বৃস্টিস্নাত সাহারা থেকে বিরান মরুভূমির মতো। আচ্ছা, প্রিয়তমেষু, তুমি কেমন আছ? তুমি তো জানো লোক-লৌকিকতার বালাই আমি কোনওদিনও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারিনি। তোমাদের দুজনকে পাশাপাশি মানিয়েছে খুব। বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমায় কোথায় গিয়েছিলে, পাহাড়ে? নাকি হারিয়ে খোঁজা সেই সময়ের প্রতিজ্ঞা পূরণে ফুলশয্যার রাতেই একশো চুম্বন এঁকেছো হঠাৎ দখল নেয়া মানুষটির গালে ? বলতে পারো, পাহাড় ভাল, না সমুদ্দুর ? শিমুলতলীর ছায়া নিবিড় আমবনে চুড়ান্ত বালখিল্যে সেই একসঙ্গে নাম লেখা গাছটা এখনও... ! একবার ঈদের দিন যমুনার বালি চিকচিক পাড়ে দু’জনে কত ছবি তুলেছিলাম। চোখের জ্যোতিতে ফোল্ডারটা চিবিয়ে চিবিয়ে প্রায় ছোবড়া বানিয়ে ফেলেছি ! তবুও আঁশ মেটেনা।

পাড়ার মধ্যে ডানপিটে মেয়ে বলে পরিচিত ছিলে তুমি। গুরুজনেরা তোমাকে এড়িয়ে চলতে বলত। তুমি জানো সেসব দৈববাণী আমি শুনিনি, সেই তোমার সঙ্গে স্কুল পালিয়ে একবার...তুমি হয়তো ভুলেই গেছ.... সে সব। ক্লাসটিচারের সই নকল করে পালিয়েছিলাম। তুমিও যেন কী একটা বানিয়ে বলেছিলে বাড়িতে ? ওহ, মনে পড়েছে।

বোধহয় বলেছিলে, ‘নীলাঞ্জনাদের বাড়ি যাচ্ছি। প্র্যাকটিক্যাল খাতাটা ধার নিতে । ’ এখন তোমার প্র্যাকটিক্যাল জীবনে শুধুই স্বপন। আচ্ছা,বিয়ের পর স্বপনদা কি সেই আগের মতোই আছে? দেশজুড়ে এত পরিবর্তন ঘটে গেল,জানোয়ারদের ফাঁসির প্রশ্নে তরমুজের ফালির মতো দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেলাম আমরা, একভাগ জেগেছে শাহবাগে,আরেকভাগ শীতনিদ্রায়,বাকি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ হয়তো আমার মতো ঝিম মেরে আছে গৃহযুদ্ধের অপেক্ষায় ! একবার সুযোগ পেলে ডালিমকুমার হয়ে ঠিকই তোমাকে স্বপনদার টুপিধারী রাজনীতির বন্দিশালা মুক্ত করে আনবো! তুমি দেখে নিও। না চাইলে,স্বপনদাকেই দেখো।

পার্টির গোপন মিটিং সেরে রাত করে সে এখনো বাড়ি ফেরে,তাই না ? তোমাকে খুব ভালবাসে না? তুমিও বাসো? প্রিয়তমেষু, তুমিও! তোমার মনে আছে সেবার রাত সাড়ে এগারোটার সময় ঈদের চাঁদ দেখার কথা? আমি ভুলিনি আজও। সে এক বয়স ছিল ! তখন ঈদের আগে শরীরে মাঞ্জা দেয়ার লড়াই শুরু হত যেন সাত দিন আগে থাকতে। তোমরা মেয়েরা যেমন শাড়ি,ব্লাউজ আর ম্যাচিং করে গয়না কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়তে, আমরা ছেলেরাও। পাঞ্জাবির সঙ্গে এঁটো জিন্স নাকি ঢিলে পাজামা ? বিকেলে কী পরব সেই নিয়েও মনে মনে ড্রেস রিহার্সাল সেরে রাখতাম! আর এতক্ষণে সেই সব চোগা-চাপকান চাপিয়ে পিচ ঢালা রাস্তায় শুরু হয়ে যেত র‌্যাম্পের মডেল হওয়ার মিথ্যে কসরত। কি কামিনীকাঞ্চন দৃষ্টি নিয়েই না আমায় দেখতে তুমি ! বাইরে না বেরুলে তুমি হয়তো বাসায় থাকতে,সখিদের নিয়ে আলপনা আঁকতে ব্যস্ত সময় পার করতে।

আমি মাঝে-মধ্যে গিয়ে ফল কাটায় সাহায্য করতাম। কখনো টের পেয়েছ, ফল কাটার ফন্দিতে,নুয়ে পড়া আলপনা দেয়ার নির্লজ্জ নিষ্ঠায় ভিতরে ভিতরে আমি চুরমার হয়ে যেতাম। তুমি হয়তো জানতেই না, রাতুল-মুন্নিকে,পলাশ পর্যায়ত্রক্রমে নীলু আর ঋতপাকে দেখত। ছন্নছাড়া আমি শুধু ভিখিরির চোখে দেখতাম তোমাকে। বিশ্বাস করো,শুধু তোমাকে।

তুমি কখন অনলাইনে থাকো? টেক্সট-এ তো অন্তত আমরা কথা বলতে পারি! সত্যি কথা বলব, ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট কেন প্রত্যাখান করেছে, তা আমি জানি। অধিকার ছেড়ে দিয়ে অধিকার রাখতে যাওয়ার মতো মানুষ তো তুমি নও.। তাই হৃদয় গহনে চাপা পড়া আগ্নেয়গিরিকে ফের জাগাতে চাওনি। কিন্তু মাঝে-মধ্যে কি উথাল-পাতাল ঢেউয়ে তছনছ হয়না তোমার সংসার পট? মনটা কি একছুটে বেরিয়ে পড়তে চায়না হারিয়ে যাওয়া নীলপদ্মের খোঁজে ? আমার এমন হয়তো,তাই। যাই যাই শীত ঠেলে বাসন্তী রং শাড়ি আর হলদে পাঞ্জাবির এখন তুমুল প্রেম চলছে শহুরে হাওয়ায়।

তোমাকে টেক্সট করতে করতেই চোখ গেল অদূরে পার্কের মাঠে। আলতুশি রোদ গড়িয়ে পড়ছে দিব্যি। এই সময়টায় আমার গ্রামের মাঠে আলের পর আল জুড়ে বিস্তার করতো আদিগন্ত সর্ষে ফুলের হলদিবাড়ি। একবার রোজার সময় তোমার জন্য মুঠো ভর্তি এনে দিয়েছিলাম, সঙ্গে কোঁচাভর্তি বনকুল। তুমি চোখ নাচিয়ে বলেছিলে, ‘এমা! সময় হয়নি তো এখনও।

ইফতারের আগে খাই কী করে !’ ফ্লাটের নিচ থেকে ইন্দ্রানি সেনের ‘ভালবাসি ভালবাসি’ কানে আসছে। সঙ্গে বাড়িওয়ালার ছেলের ভুল উচ্চারণে গেয়ে চলার চেষ্টা। জানো প্রিয়তমেষৃ বুকের মধ্যে মনখারাপের হাওয়া বইছে। এ বোধহয় দখিনা হাওয়া। ঠিক সেই ফুল-চন্দন আর শরীরী ভুর ভুর গন্ধের ওপারে তোমার পাট ভাঙা শাড়ির আড়ালে পা গুটিয়ে বসে থাকার মতো।

তোমার ভিজে চুলে বাসমতীর সুবাসে অপুর্ব কালবৈশাখী দেখে আমার মন কেমন করত। নিমগ্নতায় সম্মিলিত ঠোঁটের চুড়ান্ত অরাজকতার পর দুজনেই তাই উদাস হয়ে যেতাম! লেখা থামিয়ে তেমন করে উদাস হতে ইচ্ছে করছে প্রিয়তমেষু। ইচ্ছে করছে, এই দ্বি-প্রহরে দুরের পানে তাকিয়ে থাকি। এখন এমনি করে তাকিয়ে থাকতেই দিন কাটে। আসলে সয়ে গেছে।

যাই এখন। দয়া করে,একটা রিপ্লাই করো। ভাল থেকো। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।