আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুগন্ধি রুমাল (ছোটগল্প, কিন্তু ছোট নয়)

এটা আমার জন্য অনেক সুখকর যে, আমি এখন ব্লগ ও ফেইসবুক থেকে নিজেকে আসক্তিমুক্ত রাখতে পারছি। পরিবার ও পেশাগত জীবনের কর্মব্যস্ততা অনেক আনন্দের। ... ব্লগে মনোযোগ দিতে পারছি না; লিখবার ধৈর্য্য নেই, পড়তে বিরক্ত লাগে।

শেষ পর্ব আমি দুদিকে মাথা নেড়ে বলি, স্যরি, আই কা'ন্ট হেল্প ইট। আচ্ছা বাবা, আমি বুঝতে পারছি যে আপনি আমাকে নোট করে দিবেন না।

ব্রিলিয়ান্ট ছাত্ররা ইউজুয়ালি এ রকম সেলফিশই হয়ে থাকে (হেনা হেসে হেসে বলতে থাকে)। তবে আমাকে কিন্তু অবশ্যই একটু কাজ করে দিতে হবে। বলুন। আমার কাছে চারপাঁচটা নোট আছে। আমার বান্ধবীদের কাছ থেকে ফটোকপি করে এনেছি।

আপনি ও-গুলো কনসাল্ট করে সম্পূর্ণ নতুন ভাবে নোট তৈরী করবেন। এবং অবশ্যই সেটা আপনার জন্য, আমি শুধু তার ফটোকপিটা চাইছি। কোন অসুবিধা আছে? আমাকে তো দেখছি না খাটিয়ে ছাড়ছেন না! অন্তত আমার জন্যও কি একটু কষ্ট করা যায় না? বলতে বলতে হেনার কণ্ঠস্বর নরম ও গাঢ় হয়ে আসে। হেনা আমাকে একগাদা হাতে লেখা নোট দিয়ে দিল। ও-গুলো ঘেঁটে ওর জন্য স্বতন্ত্র নোট প্রস্তুত করতে হবে।

আমার জন্য এ কাজটি নিতান্ত বিরক্তিকর ও কষ্টদায়ক। এর আগে পরের জন্য কেন, আমার নিজের জন্যও কোন নোট করিনি। তাই বলে যে আমি পরীক্ষায় আশানুরূপ ভালো নম্বর পাইনি তা কিন্তু নয়। বাজারের বই থেকে মুখস্থ করা উত্তর প্রশ্নপত্রের প্রয়োজন অনুযায়ী লিখে দিয়েছি। সামান্য বুদ্ধি খাটাতে হয়েছে তা স্বীকার করছি।

কিন্তু একেবারে ভরাডুবি হয়নি। কিন্তু হেনার জন্য আমাকে কষ্ট করতে হবে বইকি। তবে কাজটা যে একটুখানি নয় তা হেনা নিজেও বোঝে। সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরুর আগেই আমি বাংলা দ্বিতীয় পত্রের সিলেবাসভুক্ত নাটক 'রক্তাক্ত প্রান্তর' নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। নোট বানানোর খাতিরে পুরো বইটা আমাকে পড়ে হৃদয়ঙ্গম করতে হলো, বইয়ের ভিতরে দেয়া পটভূমিকা, সমালোচনা, চরিত্র-আলোচনা সব কিছু আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে হলো।

তারপর হেনার দেয়া হাতে লেখা নোটগুলো পড়তে শুরু করলাম। সবসুদ্ধ আমার পড়াশুনার ব্যাপ্তি এতখানি হলো যে 'রক্তাক্ত প্রান্তরের' ওপর একটা ডক্টরেট ডিগ্রী পাবার মত যোগ্যতা অর্জন হয়ে গেলো। এক 'রক্তাক্ত প্রান্তরের' ওপর নোট করতে আমার দুই সপ্তাহের মত লেগে গেল। ইতোমধ্যে সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে। হেনাদের বাসায় যাই।

টিনাকে পড়াই। হেনার সংগে মাঝে মধ্যেই দেখা হয়। তবে আজকাল ওরা কেউ টিনাকে পড়াবার সময় সামনে বসে পাহারায় থাকে না। আমি যা বুঝতে পেরেছি তা হলো প্রথম সপ্তাহটি আমার জন্য 'প্রবেশনারী পিরিয়ড' ছিল। তাতে যে আমি অত্যন্ত সাফল্যের সাথে উতরে গেছি আমার প্রতি আজকাল এ বাড়ির সবার মনোভাব দেখেই তা বুঝতে পারি।

হেনা খুব বুদ্ধিমতী। আমি বিব্রত হবো ভেবে সে মাঝখানে নোটগুলোর ব্যাপারে কোন খোঁজ খবর নেয়নি। সপ্তাহ দুয়েক পরে যখন ওর হাতে সবগুলো নতুন নোট এবং পুরনো নোট এক সঙ্গে দিলাম হেনা আনন্দ ও বিসময়ে হতবাক হয়ে গেল। বললো, সবগুলো নোট করে ফেলেছেন? আমি বলি, সময়টা একটু বেশি নিয়ে ফেললাম। হেনা বলে, আমি তো ভেবেছিলাম তিন চার মাসের আগে এগুলো শেষই করতে পারবেন না।

আমি তৃপ্তির হাসি হাসতে থাকি। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই হেনা জানালো, আমি যে নোটগুলো বানিয়েছি সেগুলো অসম্ভব ভালো নোট হয়েছে। হেনার প্রশংসায় আমি উদ্বেলিত হতে থাকি। মাস তিনেক কেটে যায়। ইতোমধ্যে হেনাকে ফার্ষ্ট ইয়ারের বাংলা-ইংরেজির ইম্পর্টেন্ট নোটগুলো করে দিতে হয়।

সেকেণ্ড ইয়ারেরও লিটারেচারের নোটগুলো প্রস্তুত করার জন্য 'দায়িত্বপ্রাপ্ত' হই। এরপর হেনা একদিন হঠাৎ করে একটা প্রস্তাব দিয়ে বসলো। বললো, স্যার, আমাকে পড়াতে কি আপনার কোন আপত্তি আছে? আমি দুটি কারণে ভীষণ লজ্জা পাই। প্রথমত, হেনা প্রথমবারের মত আমাকে 'স্যার' সম্বোধন করলো। এতদিন কথা হয়েছে কিন্তু তাতে কোন সম্বোধন ছিল না।

দ্বিতীয়ত, আমি আর সে একই ক্লাসে পড়ি, তাকে আমি কিভাভে প্রাইভেট পড়াই? মাঝে মাঝে একত্রে বসে আলোচনা করা যেতে পারে। তবে পড়ানোর সাথে টিউশনির সম্পর্ক আছে, টিউশনির সাথে টাকা পয়সার লেনদেনের প্রশ্ন জড়িত। হেনাকে পড়ালে বেশ লজ্জায় পড়তে হবে। হেনা কি বুঝে সঙ্গে সঙ্গে বলে বসলো, নিয়মিত না। এই ধরেন মাঝে মাঝে আমরা দু-একটা সাবজেক্ট নিয়ে টিউটরিয়াল ডিসকাশন করলাম।

তাতে আমার যেমন লাভ হবে আশা করি আপনার তেমন ক্ষতি হবে না। আমি বললাম, আসলে আপনাকে পড়াবার মত যোগ্যতা কি আমার আছে? আপনি একটা ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী। হেনা সঙ্গে সঙ্গে আজও বলে উঠলো, শাট আপ। খালি দুষ্টুমির কথা! হেনাকে পড়াতে আমার কোন আপত্তি নেই - আমি এই মর্মে তাকে কোন আশ্বাস না দিলেও সে মাঝে মধ্যেই বই নিয়ে চলে আসে। তবে সে খুব বুদ্ধিমতী, টিনাকে পড়ানো শেষ হলেই সে আসে।

টিনা ছুটি নিয়ে চলে যায়, হেনা পড়তে শুরু করে। হেনার প্রথম পাঠটি ছিল ফিজিক্সের চৌম্বক ক্ষেত্রের ওপর একটা গাণিতিক সমস্যা। ঐ সাবজেক্টটা আমি কয়েকদিন আগে পড়া শেষ করেছি, অতএব সমাধান বের করাটা সহজ হবে বলেই আশা করলাম। হেনা বললো, আজ সারাটা দিন এই অংকটার ওপর মাথা ক্ষয় করলাম। কিচ্ছুতেই কিছু হয় না।

আমি সমস্যাটা পড়লাম। আমার বইয়ে এই সমস্যাটা নেই। তবে এটা যে অত্যন্ত কঠিন সমস্যা তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমি বিসমিল্লাহ বলে শুরু করলাম। এত বড় সমাধান আমি ফিজিক্সে এর আগে করিনি।

আমার কলম ছুটে চলছে। হেনা গালে হাত দিয়ে এক ধ্যানে খাতার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর হাতের কাছে বইটি। মাঝে মাঝে বইয়ের দিকে তাকায়, ওখানে উত্তর দেয়া আছে। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর অংক শেষ করে মাথা সোজা করে বসলাম।

হেনা মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, স্যার, আপনি যে কত ব্রিলিয়ান্ট তা আপনি জানেন না। আমার ফিজিক্সের টিউটর গত তিন দিন ধরে ঘাঁটাঘাঁটি করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। জেদ করে আমি নিজেই আজ সারাদিন কম পক্ষে বিশ বার এটা করার জন্য এ্যাটেম্প নিয়েছি। আর আপনি মাত্র এক বারের মাথায়ই..... আমি যদিও খুব গদগদ হয়ে উঠি, কিন্তু বলি, একটা অংক নিয়ে এত যুদ্ধ করার কারণ কি? তাছাড়া এটা পরীক্ষায় আসবেও না, এত বড় অংক পরীক্ষায় আসে না। হেনা আভিভূতের মত আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

এরপর থেকে আমার কাছে হেনার পড়ার কৌশলটা পাল্টে গেল। তার যখন আমার সাহায্যের প্রয়োজন পড়তো সে আমাকে বলে দিত, স্যার, আগামীকাল অমুক সাবজেক্টের অমুক চ্যাপ্টারটা আমাকে বোঝাবেন। একটু প্রিপারেশন নিয়ে আসবেন। আমি যথা আজ্ঞা কাজ করতাম। দিন চলতে থাকে।

হেনা আমাকে নিয়মিত কষ্ট দেয় না, মাঝে মাঝে দেয়। এভাবে একদিন পড়ানোর সময় হেনা প্রশ্ন করে বসে, স্যার, আপনি এত ভালো বাংলা শিখলেন কোত্থেকে? আপনার বাংলা নোটগুলো পড়ে মনে হয় যে, আপনার লেখাগুলোই অরিজিনাল, আর অরিজিনাল লেখাগুলো আপনার নোট। বলে সে মুগ্ধ চোখে মিষ্টি হাসে। আমি বলি, আপনার কথা বুঝতে পারছি না। যেমন ধরুন '১৪০০ সাল' কবিতাটি।

আপনার নোট পড়ে যতটা মজা পাই, অরিজিনাল কবিতাটা পড়ে ততখানি পাই না। আমি হেনাকে থামিয়ে দিয়ে বলি, খবরদার, এ কথা যেন আর কেউ না শোনে। তাহলে রবীন্দ্রনাথকে অপমান করার দায়ে আপনার জেল হয়ে যাবে। হেনা খুব বিগলিত হয়ে যায়। অত্যন্ত নিগূঢ় স্বরে সে বলে ওঠে, স্যার, আপনাকে আমার কি যে ভালো লাগে! আমি থতমত খেয়ে নিজেকে সামলে নিই।

এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখি কেউ শুনলো কিনা। তবে মনে মনে আকাশে উড়াল দিলাম। হেনার মত একটি মেয়ে, যাকে দেখলে মনে হয় কবিতার মত রমণীয় একটি মেয়ে, যাকে কেবল স্বপ্নে পাওয়া যেতে পারে, কল্পনায় ভাবা যেতে পারে (অন্তত আমার জন্য), আমাকে নাকি সেই মেয়েটির খুব ভালো লাগে! আমি বারবার হেনার এই কথাটি বলবার ভঙ্গি মনের পর্দায় উদ্ভাসিত দেখতে পেলাম। আমার মনের মধ্যে বিপুল আবেগ আর আনন্দ সঞ্চারিত হতে থাকলো। জীবনে প্রথম বারের মত একটি মেয়ে আমার প্রতি অকৃত্রিম ভাবাবেগ প্রকাশ করেছে।

আমি ধন্য। হেনার জন্মদিনে নিমন্ত্রণ পেলাম যথারীতি। সন্ধ্যায় বাসায় ঢুকেই দেখি বাড়িটি আলোতে ঝলমল করছে, আমন্ত্রিত অতিথিদের হাস্যকোলাহলে সরগরম। হেনাদের পুরনো একতলা বাড়িটি পুরনো জমিদার বাড়ির মতই। বোধ হয় মাত্র বছর খানেক হয়েছে বাড়িটির সংস্কার করা হয়েছে।

রংয়ের চকমকি না থাকলেও বাড়িটিতে বেশ আভিজাত্যের ছোঁয়া পাওয়া যায়। বাড়ির মাঝখানে উঠোন। উত্তরের দিকে তিনটি কক্ষ, পশ্চিমেও তিনটি, দক্ষিণ দিকের বিশাল ঘরটি ড্রইং রুম। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে হেনার বাবা আমাকে হাসি মুখে স্বাগত জানালেন। সালাম বিনিময়ের কালেই হেনাকে দেখতে পেলাম।

অতিশয় ধবধবে ফর্সা একটা শাড়ি পরেছে হেনা, তার চুলের বেণীতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা দারুণ মানিয়েছে। সে যখন মিষ্টি হেসে সামনে এসে দাঁড়ালো আমার মনে হলো এ কোন মানবী নয়, একটা জলজ্যান্ত পরী, যার রূপের ছটায় চারদিক আলোকোজ্জ্বল হয়ে আছে। ভালো আছেন? আমি জড়তাগ্রস্ত স্বরে হেনাকে জিঞ্চাসা করি। সে তেমনি হেসে জবাব দেয়। আমার পেছনে আরো কয়েক জন মেহমান এলেন।

তাঁরা খুব মিষ্টি সুরে হেনাকে বলতে লাগলেন, হ্যাপি বার্থ ডে টু হউ। হেনাও ততোধিক মিষ্টি সুরে বলে, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ। আমি হঠাৎ খুব লজ্জা পেতে শুরু করি। হেনাকে উইশ করিনি সেজন্য নয়, অন্য একটা কারণ আছে। সদ্য যে মেহমানগণ এলেন, তাঁদের প্রত্যেকের হাতে উপহার।

এক মহিলা তাঁর উপহারটা হেনার হাতে তুলে দিতেই সে খুব সুন্দর করে থ্যাংক ইউ বলে ওঠে। আমি লজ্জা পেতে থাকি, পেতেই থাকি। আমার হাতে কোন উপহার নেই। উপহারের কথা আমার মনের মধ্যেই আসেনি। হেনা অপরাপর মেহমানদের দিকে চলে যায়।

হেনার বাবা আমাকে নিয়ে ড্র্রইং রুমের দিকে রওনা দিলেন। উঠোনের এক পাশে, প্রবেশ পথের কিনারে একটি টেবিল রঙিন চাঁদর দিয়ে ঢেকে রাখা আছে। তার ওপর সুদৃশ্য মোড়কে রং বেরংয়ের নানা উপঢৌকন। একটা উঠতি বয়সী তরুণ চেয়ার নিয়ে পাশে বসে উপহার আর উপহার প্রদানকারীদের নামের তালিকা প্রস্তুত করছে। আমি লজ্জা পাচ্ছি, কারণ আমি ছেলেটির পাশ দিয়ে ড্রইং রুমের দিকে যাচ্ছি, সে আমার দিকে তাকালো, আমি তাকে কোন উপঢৌকন হস্তান্তর করিনি।

সে কি আমার নামও লিপিবদ্ধ করে রাখছে? কারা কারা উপহার দিল না তাদেরও একটা হিসাব রাখা জরুরী। তা থেকে বিনে পয়সায় খাওয়া অতিথিদের পরিচয় পাওয়া যায়। হেনা মেহমানদের সাথে হেসে হেসে কুশলাদি বিনিময় করতে লাগলো। হেনাকে আজ দারুণ সুন্দর লাগছে। আমার খুব ইচ্ছে করছে ওর সাথে কথা বলতে, গল্প করতে।

কিন্তু তা সম্ভব নয়, এত মানুষের ভিড়ে হেনাকে একা নিরিবিলিতে পাওয়া সম্ভব নয়। আমার মনে হলো, আজ যদি হেনা আমাকে বলে, স্যার, আসুন আমাকে কয়েকটা অংক করে দিয়ে যান, আমি তাকে আজ খুব যত্ন করে অংক করাবো। রক্তাক্ত প্রান্তর যে একটা সার্থক ট্র্যাজেডি এ ব্যাপারে এখন আমার চেয়ে বেশি ঞ্চানী কোন ছাত্র-শিক্ষক নেই। এটা নিয়ে আমার মত এত পড়াশুনা কেউ করেননি। আমি যখন অতি প্রাঞ্জল ভাষায় হেনাকে এসব ব্যাখ্যা করে বোঝাব সে তখন মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে।

এক সময় অস্ফুট স্বরে বলবে, আপনাকে আমার কি যে ভালো লাগে স্যার! আচ্ছা, আপনি এত ভালো কেন? অমায়িক স্বভাবের ভদ্রলোক হলেন হেনার বাবা। বাড়ির গেইট থেকে আমাকে ইস্কর্ট করে একেবারে ড্রইং রুমের ভিতর পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। সেখানে আরো অনেক নামী দামী অভিজাত শ্রেণীর অতিথিবর্গ উপবিষ্ট ছিলেন। আমি যাঁর পাশে বসলাম হেনার বাবা আমাকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন - ইনি হেনার জুলুজির টিচার। গাজী আজমল সাহেব।

তাঁকে মুহূর্তে চিনে ফেললাম এবং সঙ্গে সঙ্গেই একেবারে সংকুচিত হয়ে গেলাম। তাঁকে সালাম দিয়ে বললাম, স্যার, আমার নাম মোঃ আবুল হোসেন। ঢাকা কলেজে পড়ি, সেকেন্ড ইয়ার সায়েন্স। হেনার ছোট বোন টিনাকে পড়াই। গাজী আজমল সাহেব, সারা দেশ জুড়ে ইন্টারমিডিয়েট শ্রেণীর জন্য অনিবার্য এবং বিখ্যাত বিরাটাকৃতির বায়োলজী পাঠ্যপুস্তকটির যিনি সহোদর গাজী আজমত সাহেবের সাথে যুগ্মভাবে প্রণেতা, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, অমায়িক ভঙ্গিতে মধুর হাস্যে যখন আমার সাথে করমর্দন করলেন, আমি ধন্য হয়ে গেলাম।

আমি তাঁর কত নাম শুনেছি। আমার দোহার উপজেলায় তাঁর বাড়ি। তাঁর গ্রামের নাম জয়পাড়া। বাড়ি গিয়ে জয়পাড়া গেলেই আমি তাঁদের বাড়ির কাছ দিয়ে ঘুরে আসি - মনে মনে গর্ব করে বলি, আমাদের এলাকার একজন প্রখ্যাত অধ্যাপক, যিনি একটা দারুণ বই লিখেছেন, সারা দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা সেই বইটি পড়ে। আরো কত বড় বড় বই হয়তো তিনি লিখে থাকবেন যার সম্বন্ধে আমার সম্যক ধারণা নেই।

আমি তাঁর পাশে বসে থেকে যদিও গর্ববোধ করছিলাম, আবার ক্রমশ ছোট থেকে ছোটতর হচ্ছিলাম। কি ব্যাপক বিষয় নিয়ে এঁরা আলোচনায় মগ্ন হলেন - ওয়ার্ল্ড অর্ডার, মিডল ইষ্ট পিস প্রসেস, প্রসপেক্টস্ অব সার্ক, ফরেইন রিলেশনস অব বাংলাদেশ, পোভার্টি এলিভিয়েশন অব বাংলাদেশ, ওয়াটার শেয়ারিং প্রবলেম উইথ ইন্ডিয়া, ইত্যাদি। এসব বিষয়ে আমার জ্ঞান থাকা তো দূরের কথা, এর অনেক গুলো বিষয়ই আমি জীবনে প্রথম শুনলাম। আস্তে আস্তে আরো জানতে পারলাম, এর মধ্যে ঢাকা ভার্সিটির এক প্রফেসর আছেন, বদরুন্নেছা কলেজের এক প্রভাষক। এক কোণে অবশ্য একটি তরুণ ছেলে, আমার মত এতখানি গোবেচারা নয়, তবে মাঝে মধ্যে সেও আলোচনায় অংশগ্রহণ করে।

এক পর্যায়ে আমি বুঝতে পারলাম সে বুয়েটের ছাত্র। ঝলমল রূপে হেনা প্রবেশ করলো। খুব সাধারণ কয়েকটা অলংকার সে পরেছে - এতেই মনে হলো হেনা একটা অসাধারণ রূপসী মেয়ে, স্বপ্নে একে দেখলে ভাবতাম সে একটা পরী, যে এখনই হাত এগিয়ে দিয়ে বলবে, আমার হাত ধরো। তার হাত ধরলে সে আমাকে নিয়ে মেঘের রাজ্যে পাড়ি দিয়ে পরীর দেশে গিয়ে নামবে। হাস্যোচ্ছল হেনা সালাম জানিয়ে সবার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলো।

আমি আজমল স্যারের পাশে বসা। হেনা তাঁকে অভিমানী সুরে বললো, ম্যাডামকে নিয়ে এলেন না কেন স্যার? ম্যাডামকে কতদিন দেখি না। আরেক স্যারকে সে বললো, স্যার, আপনার শরীরটা কিন্তু শুকিয়ে যাচ্ছে। কথা অবশ্য বেশি দূর এগুলো না। হেনার বাবা এসে বললেন, মা, সবাইকে নিয়ে চল।

সব রেডি। হেনা উজ্জ্বল হেসে আজমল স্যারের হাত ধরে বললো, স্যার আসেন। প্রকান্ড একটা কেক বানানো হয়েছে। কেকের চারপাশে অনেকগুলো মোমাবাতি জ্বলছে। পেছনে দেয়ালে চমৎকার শৈল্পিক অক্ষরে লেখা আছে - Happy Birth Day to Hena. কেকের পেছনে ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে হেনা।

ওর এক পাশে আজমল স্যার। আরেক পাশে ওর বাবা। হেনা ডাকলো, সজল স্যার - সজল স্যার - সজল স্যার এখানে আসুন। ঢাকা ভার্সিটির সজল স্যার ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। হেনা চারদিকে তাকিয়ে আরো কয়েক জনকে ডাকলো।

আসলে সবার নাম ধরে ডেকে সে নিশ্চিত হচ্ছে এখানে উপসিহত আছেন কিনা। কিন্তু যাঁকেই ডাকা হচ্ছে না কেন, তাঁরা কিন্তু সবাই হেনার ঠিক চোখের সামনে দাঁড়ানো। তারপরও তাঁদেরকেই সম্বোধন করার অর্থ হলো সে যে তাঁদেরকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে এটাই বুঝিয়ে দেয়া। আজমল স্যার বললেন, এবার কেক কাটো। উপবিষ্ট সবাই সুর করে গেয়ে উঠলেন, হেপি বার্থ ডে টু ইউ হেপি বার্থ ডে টু ইউ হেপি বার্থ ডে টু ইউ হেনা হেনা বললো, বাবা, স্যার আমার সাথে ছুরি ধরুন।

তাঁরা হেনার হাতের ওপর হাত রেখে আবার গেয়ে উঠলেন, হেপি বার্থ ডে টু ইউ - সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও। কেক কাটা হলে প্রথমে হেনা স্যারের মুখে কেক তুলে দিল। স্যার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন। তারপর বাবার মুখে, মার মুখে, আরো কয়েকজন স্যার ও আত্মীয়ের মুখে সে কেক তুলে দিল। তারপর কেটে কেটে প্লেটে তুলে একেক জনের হাতে কেক তুলে দিতে থাকলো।

হেনা একেকটা প্লেটে কেক তোলে আর একেক জনের নাম সম্বোধন করে। আমার দিকে চোখ পড়ে, মাঝে মাঝেই পড়ে। আমি আঁতকে ওঠি, এই বুঝি সে আমাকে ডাকে। অনেক পরে, যখন আমি মনের সাথে প্রবল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলাম, ঠিক তখনই হেনা ডাকলো, আরে আবুল স্যার, চুপচাপ দূরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? সামনে আসুন। মুহূর্তে আমার চোখ ফেটে অশ্রু বের হবার উপক্রম হলো।

অনেক কষ্টে অশ্রু সংবরণ করে আমি হেনার দিকে এগিয়ে যাই। হেনা আমার হাতে প্লেটটি তুলে দেয়ার মুহূর্তেই তার দৃষ্টি পড়ে সজল স্যারের দিকে, স্যারের প্লেট খালি হয়ে গেছে। আমার হাতে প্লেট তুলে দিয়েই সে সহাস্যে সজল স্যারের সামনে গিয়ে হাজির হয়; বলে, স্যার, প্লেট দিন, আরো কেক দিই। সেকেন্ড ইয়ারের টেষ্ট পরীক্ষার আগের মাস থেকে আমি টিউশনি বন্ধ করে দিলাম। এখন আমার নিজের পড়ার দিকে নজর দিতে হবে।

এইচ.এস.সি-র পর আবার টিনাকে পড়ানো শুরু করলাম। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি। মাঝখানে হেনাকে প্র্যাকটিক্যাল খাতায় সচিত্র নোট করে দিতে হয়েছিল। এগুলো করতে হেনার বেশ বিরক্ত লাগে, সময়ের অপচয় হয়। তাই সে ওগুলো আমাকে দিয়ে করিয়েছিল।

টিনাকে পড়ানো ছাড়া আপাতত আমার হাতে আর অন্য কোন কাজ নেই। দুঘন্টার বদলে কখনো কখনো প্রায় চার ঘন্টার মত সময় দিয়ে ফেলি টিনাকে। আরেকটি কথা না বললেই নয়। পড়াশুনার প্রতি টিনার আকর্ষণ পূর্বাপেক্ষা বহুগুণ বেড়েছে। পঞ্চম শ্রেণীতে আগের তুলনায় অনেক বেশি ভালো রেজাল্ট করে সে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে।

এর পেছনে যে একমাত্র আমার অবদান ও প্রচেষ্টা কাজ করেছে তা টিনার মা-বাবা বার বার বলে থাকেন। টিনাকে পড়ানোর সময় হেনা খুব একটা সামনে আসে না। যদিও বা কখনো আসে, সে একবার উঁকি দিয়ে এক ঝলক হেসে চলে যায়। মাঝে মধ্যে আবার হয়তো একটা বই হাতে করে ঢুকে পড়ে। সে একমনে কিছুক্ষণ হাতের বইটি পড়ে, আবার বের হয়ে যায়।

টুকিটাকি ছোট খাট যে দু-চারটা কথা হয় তা মনে ধরে রাখার মত নয়। একদিন অবশ্য পরীক্ষার ব্যাপার স্যাপার নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। হেনা বলেছিল, পরীক্ষা কেমন হলো আপনার? ভালো। আপনার? ভালো নয়? কেন? ম্যাথ্স ফার্ষ্ট পেপারে ৬ নম্বরের একটা অংক কাটা গেছে। মাত্র একটা? এখনো পর্যন্ত তাই মনে হচ্ছে।

আপনার? আমার যে কতগুলো সঠিক হয়েছে আমি তারও হিসাব রাখিনি। আমি হাসতে হাসতে বলি। হেনা বলে, আপনি তো একজন ব্রিলিয়ান্ট বয়, এ ষ্টুডেন্ট অব ঢাকা কলেজ, রেজাল্ট বের হবার পর দেখা যাবে যে ষ্ট্যান্ড করে বসে আছেন। আমি দাঁতে জিভ কেটে বলি, সর্বনাশ। আমার তো দেখি পালাতে হবে।

কেন? আপনি আশা করে আছেন আমি ষ্ট্যান্ড করবো, পরে দেখা যাবে আমি ফেল করে বসে আছি। মুখ দেখানো যাবে? আপনি খুব বিনয়ী। ইউ আর সো কাইন্ড। নট মি, র্যাদার ইউ হ্যাড বিন সো কাইন্ড টু মি। কেন, কিভাবে? আপনার নোটগুলো আমাকে খুবই কাজে দিয়েছে।

আরেক দিন হেনার সাথে বহুক্ষণ বেশ অন্তরঙ্গ আলাপ হলো। পাঠ্যপুস্তকের পড়াশুনার বাইরে অন্য বিষয় নিয়ে। তবে নিশ্চয়ই প্রেম নিয়ে নয়। এখন তো অফুরন্ত অবসর। কি করেন? হেনা জিজ্ঞাসা করে।

ছাত্রী পড়াই। বলেই দুজনে একত্রে হেসে ওঠি। বই পড়ার অভ্যাস নেই? গল্প-টল্প? হেনা জিজ্ঞাসা করে। এক কালে পড়তাম বইকি। এখন পড়তে ইচ্ছে করে না।

কার বই বেশি পড়েছেন? শরৎচন্দ্রের। সুনীল, বুদ্ধদেব গুহ, বৈমাত্রেয় দেবী, হুমায়ূন আহমেদ - এঁদের বই পড়েননি? মনে পড়ে না। আসলে বই পড়ার সময় লেখকের নামটা দেখে নেয়ার অভ্যাস আমার কখনো ছিল না। হেনা হেসে দিল। বললো, খুব অদ্ভূত তো।

আপনার মত একটা মেধাবী ছাত্র এঁদের বই পড়েনি শুনলে কেমন যেন খটকা লাগে। কোথায় আপনি ইংলিশ থ্রিলার পড়বেন, ওয়ার্ল্ড ফ্যামাস লিটারেচার পড়বেন, সেখানে আপনি বাংলা সাহিত্যই পড়েন না। আচ্ছা, আপনাকে দেখে তো এতখানি বেরসিক মনে হয় না। হাসতে হাসতে হেনা বলতে থাকে। আমি কিছুটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে বলি, অবশ্য আশুতোষ, ফাল্গুনী, নীহার রঞ্জন গুপ্ত এঁদের লেখা বই কিছু কিছু পড়েছি।

আপনি জ্ঞশাপমোচনঞ্চ পড়েছেন? না, তবে জ্ঞচিতা বহ্নিমানঞ্চ পড়েছি। ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের লেখা। একটা চমৎকার বই। 'শাপমোচন'ও কিন্তু একটা বিখ্যাত বই। কিন্তু এত বই পড়বো কোত্থেকে? বই কিনতে টাকা লাগে না? টাকা দিয়ে কিনে তো আর বই পড়া হয়নি! যখন যারটা সামনে পেয়েছি, অমনি নিয়ে পড়েছি।

বলেই আমি হেসে ফেলি, হাসে হেনাও। হেনা বলে, আমার কাছে প্রচুর বই আছে। শখ থাকলে নিয়ে পড়তে পারেন। কয়েকটা এনে দিব? আমাকে দেখি জোর করে পড়িয়ে ছাড়বেন। আপনার সাথে আর পারা গেল না।

দিন, যতগুলো খুশি দিতে পারেন। আমি হাসতে হাসতে বলি। হেনা আমার জন্য চার পাঁচটা বই নিয়ে এল। এর মধ্যে একটি হলো বিমল মিত্রের দুই খন্ডের 'কড়ি দিয়ে কিনলাম'। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'এখানে ওখানে সেখানে', বকিগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে গেলাম।

এতগুলো বই যখন বগল দাবা করে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম তা দেখে আমার নিজের যেমন হাসি পাচ্ছিল, হেনাও তেমনি কৌতুকপূর্ণ চোখে মিটিমিটি হাসছিল। আসলে বই পড়ার প্রতি আমার তেমন কোন ঝোঁক নেই। কাজেই বইগুলো এনে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে রেখে অন্য কাজে আত্মনিয়োগ করি। দু-তিন দিন পর রাতে একটি বই পড়া শুরু করলাম। প্রথমে মজা পাইনি, তারপরও যেহেতু একটি মেয়ের হাত ছুঁয়ে বইগুলো আমার কাছে এসেছে তাই পড়তে শুরু করলাম, ধীরে ধীরে তাতে মগ্ন হতে চেষ্টা করলাম।

এটি জ্ঞশামোচনঞ্চ। শেষ পর্যন্ত বেশ উৎসাহের সাথেই বইটি পড়া শেষ করলাম। তারপর আরেকটা শুরু করলাম, শেষও করলাম। জ্ঞকড়ি দিয়ে কিনলামঞ্চ একটি বৃহদাকার বই। ওটি সবার শেষে পড়বো বলে মনসিহর করলাম।

সপ্তাহ তিনেক পরে বিছানায় শুয়ে হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে কড়ি দিয়ে কিনলাম বইটি টেনে নিলাম। দুহাতে বইটি উঁচু করে ধরে যেই পৃষ্ঠা খুলতে গেছি অমনি ভিতর থেকে এক টুকরো সাদা কাপড় আমার বুকের ওপর পড়লো-- সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত একটা মিষ্টি ঘ্রাণ আমার নাকে এসে লাগলো। ওটি একটা সাদা রুমাল। আমি বইটি পাশে নামিয়ে রেখে রুমালটি হাতে নিই। ভাঁজ খুলতেই ভুরভুর করে আরো ঘ্রাণ বেরুতে লাগলো।

ভাঁজ খুলে দেখি চারদিকে আলপনা আঁকা সুদৃশ্য ধবধবে রুমালটির মাঝখানে একটি বৃন্তসহ রক্তজবা ফুল, তার ডান দিকে সুন্দর করে ইংরেজি অক্ষরে লেখা, ঐ কষৎন ঢষয়. সহসা আমার বুক ভরে যায়, বিপুল আবেগ আর আনন্দে আমার হৃদয় নেচে ওঠে। মনে মনে বলি, জ্ঞ আমি ইহাকে পাইয়াছিঞ্চ। হেনার বুদ্ধিমত্তায় আমি যারপরনাই চমৎকৃত হই। আমাকে সে ভালোবাসে এ কথাটি সে মুখ ফুটে সরাসরি খুলে বলতে লজ্জা পায়। তাই সে একটি কৌশল অবলম্বন করেছে, আমার জন্য একটি রুমাল বুনেছে।

রুমালের গায়ে ~েশল্পিক অক্ষরে সে তার ভালোবাসার কথাটি লিখে দিয়েছে। গুঁটি গুঁটি অক্ষরে লেখাগুলো খুব সুন্দর ফুটে আছে। অবশ্য এটি হেনা নিজ হাতে বুনেছে। ওর মাঞ্চর মত গম্ভীর মহিলার দ্বারা এ যে অসম্ভব তা বলাই বাহুল্য। অন্য কাউকে দিয়েও লেখানো হয়নি।

নিজের মনের ভালোবাসার কথাটি 'আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে' নিজেকেই রচনা করতে হয়, তাতেই সবচাইতে বেশি আনন্দ। এদ্বারা হেনার একটা সুন্দর শিল্পী মনেরও পরিচয় মেলে। আমি শুনেছি, যাদের হাতের লেখা সুন্দর তাদের মনটাও তত সরল, তেমনি যাদের হাতে সুন্দর শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয় তাদের মনটাও হয় ততখানি সুন্দর আর অম্লান। হেনার মত এমন একটা সুন্দর মনের মেয়ের সাথে প্রেমের সম্ভাবনা জাগ্রত হওয়ায় আনন্দ আর গর্বে আমার অন্তর ভরে উঠতে থাকে। আমি ভাবলাম, এ রুমালটি প্রকাশ্যে আমার হাতে পৌঁছে দিতে হেনার খুব লজ্জা হয়।

তাই সে বুদ্ধির আশ্রয় নিয়ে আমাকে চার পাঁচটি বই পড়তে দিয়েছে, বইয়ের ভিতরে লুকিয়ে রুমালটি গুঁজে দিয়েছে, যাতে বই পড়তে পড়তে আমি রুমালটি খুঁজে পাই, আর রুমালটি পেয়েই বুঝতে পারি যে আমাকে হেনা ভালোবাসে! হেনার বুদ্ধির কথা ভাবতে খুব আশ্চর্য লাগে। আসলে হেনা যে আমার প্রতি একান্ত সদাশয় এটা আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল, তার বিভিন্ন কথাবার্তায়, আমার প্রতি আচরণে ও মনোভাবে। অথচ উল্টো ওর জন্মদিনে ওর প্রতি আমি মনক্ষুন্ন হয়েছিলাম আমার সঙ্গে ততটা অন্তরঙ্গ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলেনি বলে। এত মানুষের সামনে কি মেয়েরা প্রেমিকের সাথে অত খোলামেলা ভাবে কথা বলতে পারে? এটা আমার বোঝা উচিৎ ছিল। হেনাকে নিয়ে আমি কল্পনার জাল বুনতে শুরু করি।

হেনা আমার পাশে বসে আছে। আমার মুঠোর ভিতরে হেনার দুটি হাত। আমরা জোছনা রাতে ছাদের কিনারে বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি। 'এমন চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো, সে মরণ স্বরগ সমান। ' আমি আরো একটা বিষয় লক্ষ্য করিনি, হেনার কাছ থেকে বইগুলো আনার পর হেনা একদিনও আমার সামনে এসে দাঁড়ায়নি।

এটাই স্বাভাবিক। মেয়েরা সচরাচর লজ্জাবতী। ভালোবাসার রুমালটি আমাকে দেয়ার পর ওর চোখে মুখে লজ্জা জেগে উঠেছে, তাই সামনে আসতে পারছে না। আমি রুমালটি নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নিতে থাকলাম। এত সুন্দর ঘ্রাণ! আচ্ছা, রুমালে এত সুগন্ধ হয় কোত্থেকে? মেয়েরা যে কোন কিছু এমনি ছুঁয়ে দিলেই কি তাতে ঘ্রাণ লেগে যায়? আমার রুমমেট প্রায়ই একটা কবিতা আবৃত্তি করে, 'বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে একদিন বরুনা বলেছিল....।

' এটা নাকি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা একটি বিখ্যাত কবিতা - 'কেউ কথা রাখে না'। একই সুনীল একদিকে ঔপন্যাসিক, অন্যদিকে কি দারুণ কবি, যার কবিতার টুকরোটি এখন আমাকে ভাবনার রাজ্যে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দ্বাদশ শ্রেণীর এক বোবা প্রেমিক আমি এসব ভাবতে থাকি আর কবি হতে থাকি.....বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে একদিন হেনা বলেছিল, আমি তোমাকে আজন্ম ভালোবাসি..... হেনাদের বাড়িতে যাই। টিনাকে পড়াই। হেনা পড়ার ঘরে আসে না।

আমার মনটা আনচান করতে থাকে । এতখানি নিষ্ঠুর কেন হেনা? টিনাকে জিজ্ঞাসা করি, হেনা কি বাড়িতে নেই? হ্যাঁ, বাড়িতেই। দেখি না যে, অসুস্থ নাকি? আপু সুস্থ আছে। ডাকবো? না, থাক। পরদিন পড়াবার সময় হেনা এসে হাজির।

আমাকে নাকি খুঁজছিলেন? হেনা উজ্জ্বল হেসে জিজ্ঞাসা করে। আমি ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হয়ে উঠি, অথচ খুব স্বাভাবিক স্বরে বলি, আজকাল যে দেখাই যাচ্ছে না! হেনা বলে, এ্যাডমিশন টেষ্টের প্রিপারেশন নিচ্ছি তো। সামনে সপ্তাহেই রেজাল্ট বের হচ্ছে, জানেন তো? রেজাল্ট বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই এ্যাডমিশন টেষ্টের হিড়িক পড়ে যাবে। তাই একটু রিভিশন দিচ্ছি। আসলে আপনার মত ব্রিলিয়ান্ট নই তো, সব ভুলে গেছি।

আমি কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলি। হেনা চলে যায়, যাওয়ার সময় ওর ঠোঁটে একটু রহস্যময় হাসির রেখা ফুটে ওঠে, লাজরাঙ্গা সেই হাসি। কি সুন্দর একটা খেলা চলছে আমাদের মধ্যে। হেনা জানে তার রুমাল আমি পেয়ে গেছি। আমি জানি সে আমাকে ভালোবাসে।

হেনাও নিশ্চিত আমি তাকে না ভালোবেসে পারি না। অথচ আমরা কেউ বাইরে এ ভালোবাসার কথাটি প্রকাশ করছি না। এক সপ্তাহ নয়, দু সপ্তাহ পরে রেজাল্ট বের হলো। আমি আমার রেজাল্টে সন্তুষ্ট। যেমন প্রস্তুতি, তেমন পরীক্ষা আর তেমন রেজাল্ট।

আমি জানি, আমি আরেকটু চেষ্টা ও পরিশ্রম করতে পারলে মেধা তালিকায় হয়তো আমার সহানটা হয়ে যেতে পারতো। যাকগে সেকথা। এটা আমার নিজের পরিশ্রমের ফল, ভাগ্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। পরদিন হেনাদের বাড়িতে গেলাম। হেনাদের বাড়িতে প্রচুর মেহমান।

আজকে কোন অনুষ্ঠানাদি আছে নাকি? থাকলে তো আমাকে জানানো হতো। হেনা ষ্ট্যান্ড করেছে। সম্মিলিত মেধা তালিকায় পঞ্চদশ স্থান অধিকার করেছে সে, মেয়েদের মধ্যে ষষ্ঠ। নিজের রেজাল্টে হেনা খুব একটা সন্তুষ্ট না। তার কলেজের সহপাঠিনী ঋতু, এস.এস.সি-তে যার অবস্থান ছিল সতের, (এস.এস.সি-তে হেনার বারতম স্থান ছিল, অবশ্য তা আমার জানা ছিল না) আর সেই ঋতু হেনাকে ডিঙ্গিয়ে মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে উঠে গেছে।

হেনার নাকি আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছে। হেনার একজন স্যার ওকে সান্ত্বনা এবং উপদেশ দিচ্ছেন। আরো কয়েকজন আত্মীয় স্বজন হেনাকে পরিবেষ্টন করে আছেন। আমি হেনাকে দেখতে পাচ্ছি না। ভিড় ঠেলে ভিতরে যাওয়া যায় না।

কিছুক্ষণ পর হেনার স্যার চলে গেলেন। আমার ওপর হেনার দৃষ্টি পড়ে, ততক্ষণাৎ সে উজ্জ্বল হেসে বলে, আরে কি খবর? ভালো। শুনেছেন তো আমার খবর। রেজাল্টটা খুব পঁচা হলো। মনের মত হলো না।

ইচ্ছে করছে নিজের মাথাটা নিজেই ফাটাই। আমি হাসি। হেনা বলে, ষ্টার পেয়েছেন তো? মুহূর্তে আমার মুখটা ম্লান হয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে বলি, হ্যাঁ, স্টার অবশ্য পেয়েছি। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঢাকা কলেজের একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রের জন্য হেনার প্রশ্নটা হওয়া উচিৎ ছিল, 'ষ্ট্যান্ড করেছেন তো?' ও কি তাহলে জানতো যে ষ্ট্যান্ড করার কোন ক্ষমতা আমার মধ্যে নেই? মনে পড়ে, হেনা একবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার স্কুল, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড, এস.এস.সি-র রেজাল্ট সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।

এস.এস.সি-তে আমি একটা সাধারণ ষ্টার মার্ক্স পেয়েছিলাম। তা নিয়ে এইচ.এস.সি-তে ষ্ট্যান্ড করা যায় না, এটা সে ভালো করেই জানতো। সপ্তাহ খানেক পর যখন টিনাদের বাড়িতে গেলাম, টিনা এই প্রথম বললো, স্যার, আজ আর পড়বো না। কেন? শহীদ ভাইয়া এসেছেন। শহীদ ভাইয়া কে? আমাদের ফুফাতো ভাই।

বাড়ি কোথায়? অষ্ট্রেলিয়া। মানে? অষ্ট্রেলিয়ায় চাকুরি করেন। বলে সে ভুলের জন্য লাজুক হাসি হাসে। আমি বলি, পড়া মিস করাটা কি ঠিক হবে? আমরা আজ বাইরে বেড়াতে যাব। কোথায়? বুড়িগঙ্গা নদীতে।

সাঁতার জানো? না। যদি নৌকা ডুবে যায়? ডুববে না, আমরা আগে কত গেছি! কার সাথে যাবে? শহীদ ভাইয়া নিয়ে যাবেন। শহীদ ভাইয়াকে নিয়ে হেনার বাবা হাসি মুখে ঘরে ঢুকলেন। তাঁকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ গল্প গুজব হলো।

শহীদ সাহেব বের হবার পর হেনার বাবা বললেন, ও আমার একমাত্র বোনের একমাত্র ছেলে। মাস তিনেকের মধ্যেই ওদের বিয়ের ব্যাপারটা সেরে ফেলবো ভাবছি। আমি কিছু না বুঝে তাকিয়ে থাকি। হেনার বাবা বলেন, হেনার এ্যাডমিশনটা শেষ হলেই বিয়েটা সম্পন্ন করে ফেলবো। আমার মাথা ঘুরে যায়, কিন্তু সামলে ওঠি।

আমি আজকাল যে কোন পরিস্থিতিতে খুব দ্রুত সামলে উঠতে পারি। হেনার বাবা উঠে চলে গেছেন খেয়াল করিনি। হঠাৎ দেখি সামনে দাঁড়িয়ে হেনা, সে সলজ্জ হাসছে। আমি হেনার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসি। হেনা বসে দু-একটি টুকিটাকি কথা বলছে।

সে কি যেন বলতে চায়, ইতস্তত করছে। সে খুব সাবধানী, তার শহীদ ভাইয়ের সম্পর্কে কোন কথাই সে তুলছে না। আমি হেনার মনের ব্যাপারটা সামান্য আঁচ করতে শুরু করি। বলি বলি করেও এতদিন যে কথাটি সরাসরি খুলে বলতে পারেনি, আজ কি হেনা তা-ই বলতে চায়? ভালোবাসা একটা কঠিন সমস্যা, সহজে বলা যায় না, অথচ খুব সহজেই তা অনুভব করা যায়। কবিতার মত একটি মেয়ে হেনা, তাকে আমি কত আগে পেয়েছি, আমার সকল মন-প্রাণ তার জন্য উৎসর্গ করে দিতে প্রস্তুত হয়ে বসে আছি, যেমন বসে আছে হেনা নিজেও, অথচ এ দুটি চোখে কি অপরিসীম লজ্জা এসে ভিড় করে আছে, না পারছি আমি বলতে, না পারছে হেনা।

ভালোবাসা কেন এত বোবা হয়? ভালোবাসা কত অসহায়! শহীদ নামক এক অতি ভদ্রলোকের জন্য হেনা বাল্যকাল থেকে বাগদত্তা, অথচ মাত্র এক কিংবা দেড় বছরের মধ্যে নদীর স্রোতের মত তার মনের গতিপথও ভিন্ন পথে বাঁক নিল। হেনা খুব নরম স্বরে বলে, স্যার, কিছু মনে করবেন না, একটা কথা বলবো? আবেগে আমার মাথায় ধরে না এখন হেনা কোন্ কথাটি বলতে পারে। এক. হতে পারে হেনা বলবে, স্যার, শহীদ ভাইকে আমি আর ভালোবাসি না, ভালোবাসি আপনাকে। আপনি আমাকে নিয়ে পরীর রাজ্যে উড়ে চলুন। দুই. হতে পারে হেনা বলবে,......নাহ্।

আর কিছু ভাবতে পারি না। হেনা খুব কাতর স্বরে বলে, শহীদ ভাইয়ার জন্য, অর্থাৎ আমার ফুফাতো ভাইয়ের জন্য একটা সুন্দর রুমাল বানিয়েছিলাম, ওটা পাচ্ছি না। আমার যদ্দুর মনে পড়ে আমার কোন এক বইয়ের মধ্যে রেখেছিলাম। গতকাল থেকে খুঁজছি। কোথাও নেই - আপনাকে যে বইগুলো দিয়েছি, আজ হোস্টেলে গিয়ে একটু যদি ওগুলো খুঁজে দেখেন..... আমি দাঁড়িয়ে আমার ডান পকেটে হাত ঢুকাই।

এই সুগন্ধি রুমালটি আমি প্রতিদিন পকেটে নিয়ে ঘুরেছি। আমি অনেক সুযোগ খুঁজেছি, কোন এক ফাঁকে আমার পকেট থেকে এটি বের করে হেনাকে দেখাব, হেনা, এই দেখ, তোমার ভালোবাসা জড়ানো সুগন্ধি মাখানো রুমালটি আমার হস্তগত হয়েছে। তুমি আমাকে ভালোবাস, ভালোবসি ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.