আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুগন্ধি রুমাল :: প্রথম পর্ব

এটা আমার জন্য অনেক সুখকর যে, আমি এখন ব্লগ ও ফেইসবুক থেকে নিজেকে আসক্তিমুক্ত রাখতে পারছি। পরিবার ও পেশাগত জীবনের কর্মব্যস্ততা অনেক আনন্দের। ... ব্লগে মনোযোগ দিতে পারছি না; লিখবার ধৈর্য্য নেই, পড়তে বিরক্ত লাগে।

আমরা যে হাইস্কুলে পড়তাম তার নাম মালিকান্দা। আমাদের গ্রামের নাম ডাইয়ারকুম।

আমাদের গ্রাম থেকে মালিকান্দা হাইস্কুলের দূরত্ব দেড় মাইলেরও বেশি। সে-স্কুলে আবার দুই শিফ্টে পড়ানো হতো। সকালের শিফ্টে মেয়েদের, আর দুপুরের শিফ্টে ছেলেদের। আমাদের গ্রামের আমরা তিন জন সমবয়সী - আমি, নুরু ও জসিম, সব সময় গলায় গলায় থাকতাম, স্কুলেও যেতাম একসাথে। ক্লাস শুরু হওয়ার প্রায় ঘন্টা খানেক আগে বাড়ি থেকে রওনা দিতে হতো।

ও-বয়সে আমাদের তিন জনের কারো কোন হাতঘড়ি ছিল না, বাড়িতেও ছিল না কোন দেয়ালঘড়ি, এমনকি আমাদের নিকট প্রতিবেশী কারো কাছেও কোন ঘড়ি ছিল না। সময়ের আন্দাজ করতে হতো সূর্যের অবস্থান দেখে। তাতে যে সময়ের খুব একটা হেরফের হতো তা কিন্তু নয়। তবে গ্রীষ্মের সময়ে ঠিকই গন্ডগোল লেগে যেত। সময় পার হয়ে যাচ্ছে মনে করে তড়িঘড়ি ঘর থেকে বের হয় উর্ধ্বশ্বাসে স্কুলমুখে ছুটতাম; স্কুলে গিয়ে দেখতাম মেয়েদের শিফ্ট তখনো ভাঙেনি।

কিংবা রাস্তায় কারো হাতে ঘড়ি দেখে সময় জিজ্ঞাসা করলেই দেখা যেত যে ক্লাস শুরু হওয়ার তখনো বেশ সময় বাকি। মেয়েদের শিফ্ট ভাঙবার আগেই স্কুলে পৌঁছে গেলে স্কুল গেইটের সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা ভিন্ন গত্যন্তর ছিল না। তবে মাঝে মাঝে আমরা বাজারে চলে যেতাম। স্কুল থেকে বাজারে যেতে মাত্র দু-মিনিটের পথ। আমরা বাজারে গিয়ে সাইকেল চালনা শিখতাম।

নুরু ছিল সবচাইতে বুদ্ধিমান ও কথায় পটু। কিন্তু সাইকেল চালাতে গিয়ে সাইকেলের চেইনে আটকে গিয়ে ও সবচাইতে বেশি পা কাটতো, নখ ফাটাত। জসিম আমার চাইতে কিছু কম বোকা নয়, তবে ওর হাত পা-ও আমার চাইতে কিছু কম ভাঙেনি। সাইকেল চালনা শেষে তিন জনে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে স্কুলের দিকে ছুটতাম, পাছে আবার এ্যাসেম্বলি প্যারেড শুরু হয়ে যায়। আমরা তখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি।

গ্রীসমকালের ঘটনা। আমরা তিন জন - আমি, নুরু ও জসিম বারবার সূর্যের দিকে তাকাই আর সময় পার হয়ে যাচ্ছে ভেবে দ্রুত পায়ে স্কুলের দিকে ছুটে চলি। কখনো মৃদু দৌড় দিই। মেইন রোডে উঠে দেখি আমাদের আগে পিছে অন্য কোন স্কুলগামী ছাত্র নেই। আমরা নিশ্চিত আজ ঢের বিলম্ব হয়ে গেছে--প্রথম ক্লাসটি নিশ্চয়ই এতক্ষণে অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে।

বেতিয়ে স্যার আজ আমাদের পিঠের চামড়া তুলে নিবেন। আমরা তিন জনে ত্রস্ত পায়ে প্রায় দৌড়ে ছুটতে লাগলাম। স্কুল গেইটে পৌঁছেই একেবারে আহম্মক বনে গেলাম। গেইটের দারোয়ান মুচকি হেসে আমাদের উদ্দেশ্যে বলে বসলো, এত্তো সকালে স্কুলে আইছো ক্যান? বাড়িতে মন টিকে না? তার কথায় আমরা ভীষণ লজ্জা পাই। কিন্তু নুরু হলো দারুণ বুদ্ধিমান।

দারোয়ানের হাতে বইগুলো সঁপে দিয়ে নুরু তাকে বলে, চাচা, বইগুলো রাখো তো। আমরা সাইকেল চালনা শিখতে যাচ্ছি। নুরুর উপসিহত বুদ্ধিতে আমরা চমৎকৃত হই; আমার আর জসিমের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে আনন্দ জেগে ওঠে। দারোয়ানকে শুনিয়ে শুনিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে নুরু বলে, ধূর, তোদের জন্য লেট হয়ে গেল। আরো আধ ঘন্টা আগে আসতে চেয়েছিলাম, তোরা এলি না।

এলে প্রায় পাক্কা এক ঘন্টা সাইকেল চালানো যেত। নুরুর কথায় আমি আর জসিম পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি এবং প্রচুর মজা পাই। আসলে নুরুর মত পণ্ডিত সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা অনেক। সেদিন আমরা পুরো এক ঘন্টা সাইকেল চালনা শিখলাম। তারপরও দেখি ক্লাস শুরু হতে আরো আধ ঘন্টার মত বাকি।

পরিশ্রান্ত ও ঘর্মাক্ত অবসহায় স্কুল গেইটে এসে দেখি সবেমাত্র মেয়েদের শিফ্ট ভাংলো। দারোয়ানের কাছ থেকে বই নিয়ে আমরা তিনজন গেইটের উল্টো পাশে একটি বাঁশ ঝাড়ের নিচে দাঁড়ালাম। সেই বাঁশ ঝাড়ের পাশেই একটি পুকুর ছিল। কচুরিপানায় পুকুর ভর্তি। একদল লোক সেই পুকুরের কচুরিপানা তুলছিল, তীরে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট বহু ছেলেমেয়ে কচুরিপানার ঝোপের মত শিকড়গুচ্ছের ভিতর কই মাছ খুঁজছিল।

আরো বহু ছেলেমেয়ে সেই দৃশ্য দেখছিল। নুরু মিয়া কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল টের পেলাম না। তবে আমি আর জসিম পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে কচুরিপানা উত্তোলন ও তা থেকে কই মাছ খোঁজার দৃশ্য দেখতে লাগলাম, একান্ত নিবিড় চিত্তে। এই আবু! হঠাৎ আমার নাম ধরে ডেকে কে যেন আমার কাঁধে হাত রাখে। ঘুরে তাকিয়ে দেখি হাসিনা আপু।

আমাদের গাঁয়ের হাসিনা আপু খুব মেধাবী ছাত্রী। প্রায় আট-দশ গ্রামের মেয়েরা এই স্কুলে পড়ে, এবং এত মেয়েদের মধ্যে তাঁর রোল নম্বর বরাবরই এক হয়ে থাকে। হাসিনা আপু আমাকে খুবই স্নেহ করেন। যখনই তাঁর সাথে দেখা হয় তখনই আমাকে ডেকে অনেক উপদেশ দিয়ে থাকেন; আমার পড়াশুনার ব্যাপারে জিঞ্চাসাবাদ করেন, এমন কি আমাদের বাড়ির ব্যাপারেও নানা বিষয়ে খোঁজ-খবর নেন। আমাদের তিন জনের বাড়িই গ্রামের একেবারে উত্তর মাথায়, আর হাসিনা আপুদের বাড়ি একেবারে দক্ষিণে।

হাসিনা আপু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোমার নতুন মা তোমাকে আদর করেন তো? আমার মা মারা গেছে অনেক দিন। ভাই-বোন আর সংসারের দেখ-ভাল করা একা বাবার পক্ষে খুব কষ্টকর ছিল। আমার ফুফু আর চাচীরা তাই জোর করে বাবাকে আবার বিয়ে করিয়েছেন। আমি বললাম, মা আমাকে খুব আদর করে। শুনে হাসিনা আপু খুব খুশি হলেন।

তারপর হেসে হেসে বললেন, ঠিকমত পড়াশুনা করছো তো, নাকি খালি ঘুড়ি উড়াও? আমি মাথা নিচু করে নরম স্বরে বললাম, করি। তুমি কিন্তু আমাদের গ্রামের গর্ব। ফার্ষ্ট হতে পারলে চারদিকে আমাদের গ্রামের নাম ছড়িয়ে পড়বে। বুঝেছ? জ্বি। আর তোমাকে না বলেছি যখন যা লাগে আমাকে বলবে? বলোনি কেন? আপুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি।

আপু আবার বলেন, অংক-টংক সব পারো তো? না পারলে আমার কাছে চলে এস। তারপর আপু আরেকটু নিচু হয়ে ফিসফিস করে আমার কানে কানে বললেন, তোমাকে একটা স্যান্ডেল কিনতে বলেছিলাম না? টাকা নেই? আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি পরশু বিকেলে আমাদের বাড়িতে এস। আমি স্যান্ডেল কিনার টাকা দিব। তারপর সোজা হয়ে বললেন, একদম বোকা ছেলে! কিচ্ছু বলতে চায় না। আচ্ছা চলি---- দেখা হবে, কেমন? আমি হাসিনা আপুর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

আপুকে আমার কি যে ভালো লাগে! আমার কত সাধ হয়, যদি আমার এমন একটা আপু থাকতো, একদম আমার মায়ের পেটের আপু, তাহলে সে আমাকে কত্তো আদর করতো--হাসিনা আপুর মত। হাসিনা আপুর মত সেই আপুটি স্কুলে পড়তো, হাসিনা আপুর মত তারও ক্লাসে রোল নম্বর হতো এক এবং আমারও যাতে রোল নম্বর এক হয় সেজন্য সেই আপুটি আমাকে অনেক অনেক উপদেশ দিত--আমার রোল নম্বর এক হতো--তখন আমাদের গ্রামের নামডাক চারদিকে ছড়িতে পড়তো। ওটা কিরে? জসিমের কথায় ওর দিকে ফিরে তাকাই। দেখি জসিম উপুড় হয়ে মাটি থেকে একটা সাদা মত ভাঁজ করা কাপড়ের টুকরো তুলে আনছে। ওটি তুলেই সে ঝাড়া দিয়ে ভাঁজ খুলে ফেলে।

দেখি চারদিকে সুন্দর আলপনা আঁকা, মাঝখানে রঙিন ফুল তোলা একটি সুন্দর রুমাল। হাসিনা আপুর রুমাল। জসিম বলে। এখানে আসলো কোত্থেকে? আমি বলি। মনে হয় কথা বলার সময় পড়ে গিয়েছিল।

জসিম বলে। রুমালটা খুব সুন্দর রে! বলেই জসিমের হাত থেকে রুমালটা আমার হাতে নিয়ে আমি নেড়ে চেড়ে দেখি--আর অকসমাৎ আমার নাকের মধ্যে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ এসে লাগে--আমার মনে হলো এমন স্বর্গীয় ঘ্রাণ বোধ হয় ত্রিভুবনের অন্য কোথাও নেই। আমি রুমালটি নাকের কাছে নিয়ে দীর্ঘ টান দিয়ে দিশেহারা হয়ে যাই-- এবার জসিমের মুগ্ধ হবার পালা। আমার হাত থেকে ফেরত নিয়ে সে ওটা ওর নাকের কাছে ধরে তেমনি দীর্ঘ এক টান দিয়ে বলে, ইশ, কি সুন্দর খুশবো রে? জসিম বলে, বাড়িতে গিয়ে আপু রুমাল না পেয়ে খুঁজবে না? আমি বলি, এক কাজ কর, এক দৌড়ে আপুকে রুমালটা দিয়ে আয়। জসিম চিন্তিত ভাবে বলে, তুই যা।

আমি তো আর তোর মত দৌড়াতে পারি না। আমার বই ধর। আমি বলি। জসিমের হাতে আমার বই গছিয়ে দিয়ে রুমালটি নিয়ে ভোঁ ভোঁ করে হাসিনা আপুর দিকে ছুটলাম। আপুকে পেয়ে তাঁর হাতে যখন রুমালটি দিলাম আপু ওটা হাতে নিয়ে হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

তারপর বললেন, তুমি তো দেখি আস্ত পাগল ছেলে! একটা রুমাল দেবার জন্য কেউ এতখানি দৌড়ে আসে? আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বলি, এত সুন্দর একটা রুমাল হারিয়ে গেল বলে আপনার মন খারাপ হবে না? তাই জসিম বললো দিয়ে আয়। আপু হেসে দিয়ে বললেন, পাগল! তারপর রুমালটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, এত কষ্ট করে তুমি রুমালটা ফেরত দিতে এসেছ, আমি খুবই খুশি হয়েছি। খুশি হয়েই এটা তোমাকে আমি উপহার দিলাম, কেমন? আমি বিসিমত হয়ে বলি, এত সুন্দর একটা রুমাল আপনি দিয়ে দিবেন? কি দারুণ ঘ্রাণ রুমালটার মধ্যে! আপু খিল খিল করে হেসে উঠে বলেন, এটা তো দিলামই, যদি এবার ফার্ষ্ট হতে পারো তাহলে তোমাকে এর চেয়েও সুন্দর একটা রুমাল দিব। এখন যাও, এ্যাসেম্বলি তো পাবে না, তাড়াতাড়ি যাও। আমি রুমালটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আবার বলি, আপু, এটা নিয়ে যান।

আমাকে পরে দিলেই হবে--। আরে ধূর বোকা--যাও-- বলেই আপু চলে গেলেন। স্কুলে এসে দেখি এ্যাসেম্বলি প্যারেড শুরু হয়ে গেছে। সবাই সিহর দন্ডায়মান। কেউ এক চুল নড়ছে না।

এ অবসহায় ঢোকা যায় না। এ্যাসেম্বলি প্যারেডে অনুপসিহত--শাস্তি অবধারিত। অবধারিত শাস্তি ভোগ শেষে ক্লাসে ঢুকলাম। বসলাম জসিমের পাশেই। বসতে না বসতেই জসিম আমার দিকে করুণ চোখে তাকালো, তারপর আরো করুণ স্বরে জিঞ্চাসা করলো, রুমালটা ফেরত দেসনি? জানলি কি করে? দেখছিস না কত ঘ্রাণ! আপু ওটা আমাকে উপহার দিয়েছে।

জসিমের মুখটা ম্লান অন্ধকার হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর প্রায় কাঁদ কাঁদ হয়ে সে বলে বসলো, রুমালটা আমাকে দিয়ে দে না! আমি পকেটের ভিতর থেকে বের করে রুমালটা জসিমের হাতে দিয়ে দিলাম। কৃতঞ্চতায় জসিম এতই বিহ্বল হয়ে পড়লো যে আমার মনে হলো ওর যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে এই একটা সুগন্ধী রুমালের বিনিময়ে সে আমাকে তামাম পৃথিবী দান করে দিত। পরীক্ষায় আমি ফার্ষ্ট হতে পারলাম না। নয়ন নামক একটা ছেলে মাত্র পাঁচ নম্বরের জন্য আমাকে ডিঙ্গিয়ে ফার্ষ্ট হয়ে গেছে।

হাসিনা আপু আমার ওপর কি যে অভিমান করলেন - প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম হলো। বললেন, তোমার সাথে আমি আর কোন দিনই কথা বলবো না। আমারও সেদিন খুব কান্না পেয়েছিল। হাসিনা আপু যদি আমার সাথে জীবনে আর কথা না বলেন তাহলে আমিও বাঁচবো না। এই বেঁচে থাকা আমি চাই না।

এস.এস.সি পরীক্ষায় হাসিনা আপু খুব ভলো রেজাল্ট করলেন। প্রথম বিভাগ তো পেলেনই, পুরো সেন্টারের মধ্যে প্রায় পাঁচশত ছাত্রীর মধ্যে তিনি প্রথম হলেন। রেজাল্ট বের হবার পর আপু স্কুলে এলেন সবার সাথে দেখা করতে। আপুর সাথে কথা বলার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা ভিড় করে ফেললো। কিন্তু আমি আপুর সাথে কথা বলতে গেলাম না।

আপু বলেছিলেন তিনি আর আমার সাথে কথা বলবেন না। আমারও ক্রমশ জেদ চাপতে থাকলো। আমাকে ফার্ষ্ট হতেই হবে। কিন্তু পরের বারও আমি ফার্স্ট হতে পারলাম না। অন্য কোন বারও না।

ক্লাসে আমার অংশগ্রহণ ও পারদর্শিতা দেখে বরাবরই সবাই নিশ্চিত থাকে পরীক্ষায় আমি ফার্ষ্ট না হয়ে যাই না। কিন্তু রেজাল্ট বের হলে দেখা যায় খুব অল্প নম্বরের জন্য আমি নয়নের পেছনে পড়ে গেছি। এজন্য নয়নও খুব কম ব্যথিত নয়। পরীক্ষার ফল বের হলে আমি যখন খুব ম্লানমুখো হয়ে থাকতাম, তখন নয়ন আমাকে প্রচুর সান্ত্বনা আর অনুপ্রেরণা দিত। জসিম আর নুরুর পরে হাইস্কুলের জীবনে একমাত্র নয়নই ছিল আমার 'প্রাণের বন্ধু'।

ও জানতো আমি কিভাবে লেখাপড়া করি। আসলে আমার জন্য লেখাপড়া করাটা ছিল বাড়ির আসল কাজের বাইরে একটি অতিরিক্ত কাজ। বাড়িতে পড়ার জন্য তো সময়ই জুটতো না। সকালে ঘুম থেকে উঠে মাঠে ঘাস কাটতে যাই, গরু চড়াতে যাই, কখনো বাবার সাথে ক্ষেতে লাঙ্গল চষি, জমিতে শক্ত ইটা ভাঙ্গি। মাঠ থেকে ফিরে তাড়াতাড়ি গোসল সেড়ে হাতেমুখে দুমুঠো পান্তা গুঁজে স্কুলের দিকে ছুটি; জসিম আর নুরু আমার জন্য রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে।

বিকেলে স্কুল থেকে ফিরেই আবার মাঠে যাই গরু নিয়ে। ঘাস কাটি। ক্ষেত নিড়াই। ইটামুগুড়ে ইটা ভাঙ্গি। কেরোসিনের অভাবে রাতে বেশি সময় ধরে বাতি জ্বেলে পড়তে পারি না।

মাঝে মাঝে নয়ন শখ করে আমার সাথে গরু চড়াতে যেত। আমার হাত থেকে কাঁচি নিয়ে ঘাস কাটতে চেষ্টা করতো, মুগুড় কেড়ে নিয়ে ইটা ভাঙতো। কিন্তু পারতো না, যা-ও পারতো তাতে ওর হাত ফুলে লাল হয়ে যেত। আমি ঘাস কাটতাম, ক্ষেত নিড়াতাম, নয়ন আমার পাশে পাশে বসে থেকে আমার জন্য আফসোস করতো। বলতো, তুই আমার চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী রে! আমি সারা দিনরাত পড়ি, তুই তো দেখি পড়বার সময়ই পাস না।

তারপরও তোর রেজাল্ট কত ভালো! হাসিনা আপুর সাথে দেখা করতে সাধ হয়। কিন্তু আমি পরীক্ষায় ফার্ষ্ট হতে পারিনি আজও। তাঁকে মুখ দেখাবার আমার কোন পথই নেই। হাসিনা আপুর সাথে তারপর আমার আর কোন যোগাযোগই রইল না। এস.এস.সি-র পর আপু শহরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হলেন, এইচ.এস.সি-তে যথারীতি ভালো রেজাল্ট করলেন।

তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। আমি তাঁর সব খোঁজ খবর রাখি, শুধু হাসিনা আপুই আমাকে ভুলে গেছেন। মাঝে মাঝে আপুর কথা মনে করে আমি খুব কাঁদতাম। আপুকে কতদিন দেখি না, দেখতে খুব সাধ হয়। দেখবোই বা কিভাবে, আপু থাকেন শহরে শহরে, কালেভদ্রে বাড়িতে আসেন খবর পাই, আমি তাঁর সাথে দেখা করতে যেতে পারি না।

আর কেনই বা দেখা করতে যাব, আমার কথা কি আপুর মনে আছে? মনে থাকলে তো অন্তত একবার আমাকে খবর দিতেন, আবু, আমাকে এসে দেখে যাও। খবরই বা দিবেন কেন? আপু কি আমাদের বাড়িতে এসে একবার আমাকে দেখে যেতে পারতেন না? আমি তাঁকে দেখার জন্য কতটা উদগ্রীব হয়ে আছি! হাসিনা আপুর গায়ে হলুদের দিন আমার দশম শ্রেণীর প্রি-টেষ্টের রেজাল্ট বের হলো। নয়নের চেয়ে ৮০ নম্বর বেশি পেয়ে আমি প্রি-টেষ্টে প্রথম হয়েছি। আমাকে কেউ অতিক্রম করে ফার্ষ্ট হলে আমি তার সাথে সহজ ভাবে মিশতে পারতাম না। কিন্তু নয়নই সর্বাগ্রে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানালো।

বললো, তুই দেখিস, এস.এস.সি.-তে তুই অনেক বড় রেজাল্ট করবি। আমার জন্য শুধু এতটুকু দোয়া রাখিস আমি যেন তোর পিছে পিছে থাকতে পারি। আমার প্রতি সেদিন নয়নের যে অভিব্যক্তি দেখেছি সেজন্য আমি সারাজীবন ওর কাছে কৃতজ্ঞ। রেজাল্ট পেয়েই আমি ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠলাম, আমি আজ আপুর সাথে দেখা করবোই। আমি আজ আপুর সামনে সগর্বে দাঁড়িয়ে বলবো, আপু, আমি এবার পরীক্ষায় ফার্ষ্ট হয়েছি।

বলুন, আমি কি একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র নই? আমার জন্য কি আপনার একটুও গর্ববোধ হয় না? আমি সারাদিন দোটানার মধ্যে থাকলাম - আপুর সাথে দেখা করবো কি করবো না। আমার মনে একবার অভিমান দেখা দিল, আমি নিজে থেকে আপুর সাথে দেখা করতে যাব না। আমার রেজাল্টের খবর নিশ্চয়ই এতক্ষণে আপুর কানে পৌঁছে গেছে। আমার ফার্ষ্ট হওয়ার সংবাদে আপু খুব আনন্দিত হবেন। সাথে সাথে আমাকে ডেকে পাঠাবেন।

পরে আমার ভুল ভাংলো, আপুর আজ গায়ে হলুদ। বাড়িময় কত ব্যস্ততা। এত কিছুর মধ্যে আমার পরীক্ষা আর ফলাফলের ব্যাপারে ভাববার কোন ফুরসত কি আপু পাবেন? তাঁকে কে-ই বা দিবে এই খবর? আরো একটা জিনিস অবশ্য আমি ভাবলাম, আমার কথা আপুর মনে আছে কিনা তা-ই বা কে জানে? তার চেয়ে বরং আমি নিজে থেকেই তাঁদের বাড়িতে গিয়ে উঠি। একেবারে সামনে গিয়ে যখন দাঁড়াবো - আপু খুশিতে অভিভূত হবেন। আমার মনের মধ্যে আরো একটা ব্যাপারে ক্রমশ অভিমান ঘনীভূত হতে থাকলো।

একদিন আপু আমাকে অনেক ভালোবাসতেন, আমি জানি। সেই আপু আজ কি করে আমার কথা এভাবে ভুলে যেতে পারলেন? আজ তাঁর গায়ে হলুদ, তাঁর জীবনের সবচাইতে মধুর সময়, আনন্দের ঘটনা, আপুর জীবনের এমন একটা আনন্দঘন সময়ে আমাকে কি আমন্ত্রণ করা উচিত ছিল না? আমি হাসিনা আপুদের কোন কুটুম্ব নই, তাতে কি? কিন্তু আপু যে আমার কতখানি অন্তর জুড়ে আছেন আর কেউ না জানুক, তিনি নিজে তো সেই কথা জানেন। তারপরও আপু কিভাবে আমার কথাটা একেবারে ভুলে থাকতে পারলেন? এতটা নির্দয় হলেন কিভাবে আমার হাসিনা আপু? অবশ্য এরও একটা ব্যাখ্যা আমি দাঁড় করিয়ে ফেললাম। হয়তো আপু ঠিকই আমার খোঁজ খবর করেছিলেন। কে জানে, হয়তো কাউকে দিয়ে আমার জন্য খবরও পাঠিয়ে থাকবেন, হয়তো মনের ভুলে আমাকে আর সেই খবরটা পৌঁছে দিতে পারেননি।

সকল ভাবনার অবসান ঘটিয়ে সন্ধ্যার দিকে হাসিনা আপুদের বাড়িতে গেলাম। সারা বাড়ি সরগরম, আলোতে ঝলমল। মেয়েদের ছুটাছুটি, কলকল খলখল হাসি। দুয়ারের এক কোণে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের মঞ্চ করা হয়েছে। কিছু পরে আপুকে ওখানে এনে বসানো হবে।

বরপক্ষের মানুষ এসেছে কন্যার 'সাজনী' নিয়ে। তা দেখতে দক্ষিণের ঘরে মহিলাদের উপচে পড়া ভিড়। ঐ ঘরে কেবিনের ভিতরে নাকি হাসিনা আপু তাঁর বান্ধবীদের সাথে গল্প করছেন, সেই সঙ্গে বরের বাড়িরও কয়েকটা মেয়ে যোগ হয়েছে। এত মানুষের ভিড় ঠেলে আমি ভিতরে কি করে যাই? আরে আবু যে, কেমন আছ? জাহাঙ্গীর ভাই, হাসিনা আপুর বড় ভাই আমাকে দেখে সহাস্যে কলকলিয়ে উঠলেন। অত্যন্ত অন্তরঙ্গ ভাবে কাছে এসে দাঁড়ালেন।

বললেন, খুব খুশি হলাম ফার্ষ্ট হয়েছ শুনে। জাহাঙ্গীর ভাই কারো লেখাপড়ার ব্যাপারে খোঁজ খবর রাখবেন এতটা আশা আমরা কখনো কেউ করি না। এসব ব্যাপারে তিনি খুব উদাসীন মানুষ। তাই আমি মনে মনে নিশ্চিত হলাম, সেই জাহাঙ্গীর ভাইও যেহেতু আমার রেজাল্ট জেনে গেছেন, হাসিনা আপুও নিশ্চিত এটা জানেন। আমি ঠিক বুঝে নিলাম, আমার রেজাল্টের ব্যাপারে হাসিনা আপু বাড়িময় সবাইকে বলে বেড়িয়েছেন, জাহাঙ্গীর ভাই হয়তো তাঁর কাছ থেকেই এটা জানতে পেরেছেন।

আমার অভিমান পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে জেগে উঠতে থাকলো, জানা সত্ত্বেও আমাকে আপু খবর দিলেন না? তাহলে আর তাঁর সাথে দেখা করা যায় না। জাহাঙ্গীর ভাই আমার সাথে আলাপ শুরু করলেন। ভিতরে ভিতরে আমি অভিমানে ফুলে উঠছিলাম, এখনই, এ মুহূর্তেই এ বাড়ি ত্যাগ করে চলে যাব। আর কোনদিনই আপুকে দেখা দিব না। কেউ যদি আমাকে দেখার জন্য পাগলও হয়ে যায়, তবুও না।

জাহাঙ্গীর ভাইয়ের আলাপ শেষ হয় না, আমিও ছুটে পালাতে পারি না। কি একটা কাজের জন্য জাহাঙ্গীর ভাই একবার উঠে গেলেন, আমিও সুযোগ পেয়ে কেটে পড়লাম। এরপর কয়েকটা দিন আমার মন খুব খারাপ ছিল। তিন সপ্তাহের জন্য স্কুল ছুটি। কোন কিছুতেই মন বসে না।

বই খাতা ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। ঘুড়ি ওড়ানো আমার চিরকালের শখ। বড় একটা ধাউস ঘুড়ি বানালাম। ঘুড়িতেও মজা নেই। পোলো নিয়ে আড়িয়াল বিলে মাছ ধরতে যাই, বড়শিতে মাছ ধরি - কোন কিছু আমার ভাল লাগে না।

এভাবে দশ বার দিন কেটে যায়। পড়ার চেয়ারে হেলান দিয়ে একদিন দুপুরে ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুমের মধ্যে দেখি আমি মেঘের দেশে চলে এসেছি। কত উঁচু নিচু পাহাড়ের মত এই মেঘের দেশ! সূর্যের আলোতে মেঘগুলো কত যে সাদা বলার মত না। আশ্চর্য, আমি দেখি আমার একটা ছোট নৌকা আছে - সেই নৌকায় বৈঠা বেয়ে বড় বড় ঢেউয়ের ওপর দিয়ে আমি মেঘের ওপর ছুটে বেড়াচ্ছি।

সহসা আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, কে যেন আমার নাক ধরে টানছে। প্রথমে ঝাপসা চোখে তার চেহারা চেনা যায় না। চোখ ডলে পরিসকার করে আমি অবাক হয়ে যাই - এ যে হাসিনা আপু! হাসিনা আপু গত পাঁচ বছরে আরো কতো সুন্দর হয়েছেন! আমি ধড়ফড় করে উঠে বসি। আপুর চেহারায় দারুণ অভিমান ভেসে ওঠে। তিনি বলেন, আমাকে চেন? বলো তো কে? হাসিনা আপু - আমি একেবারে সরল ভাবে জবাব দিই।

তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ? না। তাহলে আমার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করো না কেন? আপনি তো দেশেই থাকেন না। মিথ্যা কথা। সত্যি। আমার বিয়েতে গেলে না কেন? আমি হাজারটা খবর পাঠালাম, তোমার কোন পাত্তা নেই।

পরে শুনলাম এক মুহূর্তের জন্য গিয়েছিলে। দেখা করলে না কেন? সময়ের অভাব ছিল? তোমার কি এতই সময়ের অভাব? বলতে বলতে আপুর কণ্ঠে অভিমান ঝরে পড়ে। আমি চুপ করে থাকি। মনে মনে বলি, আপু, আমি জানতাম আপনি আমার খবর নেবেন। কিন্তু আমাকে কেউ বলেনি আপনি আমাকে হাজারটি বার খবর পাঠিয়েছেন।

আমার পড়ার ঘরটি খুবই ছোট। বসার জন্য একটি মাত্র চেয়ার। খুব লজ্জা এবং বিব্রতবোধ হচ্ছিল। আপুকে কোথায় যে বসতে দিই! মাকে ডাকার উদ্দেশ্যে বাইরের দিকে তাকাতেই দেখি দরজার সামনে দুয়ারে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক। তাঁকে দেখিয়ে আপু বললেন, তোমার দুলাভাই।

আমি দুলাভাইকে সালাম দিতেই তিনি সহাস্যে সামনে এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, তোমার আপুর কাছে শুনেছি তুমি খুব ব্রিলিয়ান্ট বয়। আমি বলি, কিন্তু আপুর মত অত নই। নো নো ম্যান, তুমি তোমার আপুর চেয়েও ব্রিলিয়ান্ট। তোমার আপু ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পায়নি, তুমি পেয়েছ। তোমার আপু ক্লাস এইটে বৃত্তি পায়নি, তুমি মাশা'আল্লাহ ট্যালেন্ট পুলে বৃত্তি পেয়েছ।

কিন্তু আপুর রোল নম্বর বরাবরই ছিল এক- আরে বুঝলে না, সে তো ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছে। তোমার বেলায় তো আর তা নয়। তোমাকে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে আসতে হচ্ছে। তুমি দেখো, তোমার এস.এস.সি-র রেজাল্ট আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। আপু আর দুলাভাই আমাকে এরূপ প্রচুর উৎসাহ অনুপ্রেরণা দিলেন।

আমি উদ্বুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমি আমার আত্মবিশ্বাসে দৃঢ়তা পাচ্ছি ক্রমশ। বিদায়ের বেলা আপু আমার হাতে একটা জিনিস গুঁজে দিলেন। চেয়ে দেখি একটা রুমাল। রুমালটা বেশি সুন্দর হলো না।

খুব তাড়াহুড়ো করে বুনেছি তো! আপু বললেন। রুমালটা খুলতেই একটা আশ্চর্য মিষ্টি গন্ধে চারদিক ছেয়ে গেল- আপু বলেন, পছন্দ হয়নি, তাই না? দেখো, যদি ষ্ট্যান্ড করতে পারো, আমি পুরো একমাস পর্যন্ত বুনে তোমাকে একটা রুমাল বানিয়ে দিব- । আমি বললাম, আপু, এই রুমালটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এর ঘ্রাণটা কি যে ভালো! আপু রুমালটার মিষ্টি ঘ্রাণের মত খুব মিষ্টি করে হাসলেন, তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি রুমালটা দুহাতে নাকের কাছে ধরে লম্বা টান দিলাম - প্রায় পাঁচটি বছর আগে একবার আপুর আরেকটি সুগন্ধি রুমাল আমার হাতে এসেছিল, সেটিতে এমন ঘ্রাণ ছিল।

আমি নাকের কাছে রুমালটি ধরে রেখে ভাবতে লাগলাম, হাসিনা আপু, তুমি চলে গেলে, কিন্তু আমার কাছে রয়ে গেলে। তুমি ঠিক দেখে নিও আগামী পরীক্ষায় আমি ষ্ট্যান্ড করবোই। যদি না করতে পারি, তোমার এই রুমালের কসম - জীবনেও তোমার কথাটি আর ভাববো না - কক্ষণো না। আমি জানি না হাসিনা আপু আমার কথাটি আর মনে রেখেছেন কিনা। এখন তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন তা-ও জানি না।

এস.এস.সি-তে ষ্ট্যান্ড করতে না পেরে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। ষ্ট্যান্ড করতে পারলে আপু হয়তো আমাকে আরো একটি সুদৃশ্য, সুগন্ধযুক্ত রুমাল দিতেন, কিন্তু সহসাই একটা রুমালের প্রতি আমার অতিশয় আবেগ কেটে গিয়েছিল। তবে আমি যে কারণে মর্মাহত হয়েছিলাম তা হলো, ষ্ট্যান্ড করতে পারলে আমি আপুর কাছ থেকে অশেষ বাহবা, স্নেহ ও ভালোবাসা পেতাম - ষ্ট্যান্ড করতে না পেরে তা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হলাম। যদিও কিছুদিন এ নিয়ে বিষম মন খারাপ করেছিলাম, পরে সব ভুলে যাই। ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে তখন হোস্টেলে থাকি।

ফার্ষ্ট ইয়ারের শেষের দিকে আমার টিউশনিটা বন্ধ হয়ে গেলে খুব অর্থকষ্টে পড়ে যাই। সৌভাগ্যবশত সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পরপরই একটা ভালো টিউশনি পেয়ে গেলাম। আমার এক রুমমেটের বদৌলতে আজিমপুরসহ এক পুরনো ধনী বাড়িতে টিউশনিটা জুটলো। রুমমেট আমাকে সে বাড়িতে নিয়ে বাড়িওয়ালা ও তাঁর স্ত্রী এবং দু মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ছোট মেয়ে টিনা পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী এবং বড় মেয়ে হেনা বদরুন্নেছাতে দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ে।

অর্থাৎ হেনা এবং আমি একই শ্রেণীতে পড়ি। বলে রাখি, হেনা কিন্তু আমার ছাত্রী নয়, আমাকে পড়াতে হবে টিনাকে। বাড়িওয়ালাকে পুরান জমিদারের মত মনে হয়; কিন্তু তিনি বিশেষ শিক্ষিত নন, তেমনি তাঁর স্ত্রীও। তারপরও যখন টিনাকে পড়াতে বসি, দেখি বাড়িওয়ালা অথবা তাঁর সত্রী পাশে বসে থাকেন। আমি খুব বিব্রত বোধ করি।

পড়ানোর সময় কেউ সামনে বসে থাকলে কি সহজভাবে পড়ানো যায়? কিন্তু এঁরা কেন যে খামোখা সামনে বসে থাকেন তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। মেয়েটি পঞ্চম শ্রেণীর একটি পুঁচকে মেয়ে, পড়াতে পড়াতে যুগোপৎ তার সাথে যাতে আবার প্রেম গড়ে না ওঠে, এঁরা কি সে জন্য পাহারায় থাকেন? আমি ঘৃণাবোধ করতে থাকি। মেয়েটি পড়াশুনায় বিশেষ মনোযোগী নয়। এর মা-বাবার কাছ থেকেই কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম। আগের শিক্ষকগণ একে পড়িয়ে খুব একটা স্বস্তি পাননি।

অতএব, আমার ধারণা হলো আমার সাথেও টিনা অবাধ্যপনা করছে কিনা তা দেখার জন্যই এবং প্রয়োজনে মেয়েকে চোখ রাঙাবার জন্যই পড়ানোর সময় এঁরা সামনে বসে থাকেন। এ ধারণা হওয়ার পর থেকেই আমার মধ্যে সহজ ভাব চলে আসতে থাকে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আমি নিশ্চিত হতে পারলাম যে আমার পারদর্শিতায় টিনার মা-বাবা আমার ওপর বেজায় সন্তুষ্ট। টিনা অবশ্য এতদিন আমার সাথে বেয়াদবিও করেনি, পড়াশুনার প্রতিও তেমন অমনোযোগিতা ও অবহেলা প্রদর্শন করেনি। একদিন আমি আঁতকে উঠলাম।

টিনার পাশে ওর মা কিংবা বাবা নয়, হেনা বসে আছে। হেনার দিকে তাকিয়ে আমি সিমত হাসলাম, হেনার মুখটি ততখানি সিমত হলো না যতখানি আমি আশা করেছিলাম; অর্থ্যাৎ সৌজন্য প্রকাশের জন্য যতখানি সিমতহাস্য হওয়া প্রয়োজন ছিল হেনার চেহারায় সেরকম প্রসন্নতার কোন দ্যূতি নেই, কেমন সূক্ষ্ম একটুখানি কাঠিন্য তাতে প্রচ্ছন্ন ছায়ার মত ভেসে আছে। প্রতিদিন টিনাকে দু-ঘন্টা পড়াই। স্কুলের সব পড়া শেষ করে দিতে হয়। প্রথমে বাংলা।

আজ স্কুলে ওদের 'পল্লীস্মৃতি' কবিতা পড়ানো হয়েছে। আমি পুরো কবিতাটি লাইন বাই লাইন ধরে গদ্যাকারে সাজিয়ে ব্যাখ্যা করে পড়াতে শুরু করলাম। ঝাঁউশাখে, বনলতা, দোল, আম কুড়ানো, সুয়োরাণী-দুয়োরাণী, শীতের সকালে ভিজনে পিঠে খাওয়া, ইত্যাদি কথাগুলো যখন ব্যাখ্যা করছিলাম টিনা অভিভূত হয়ে সেসব শুনছিল। মাঝে মাঝে সে নিজের থেকেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন জিঞ্চাসা করা শুরু করলো। কিন্তু হেনা সেই যে কঠিন দৃষ্টিতে এক ধ্যানে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তার চেহারায় আর কোন পরিবর্তন নেই।

তা দেখে আমি আবারও লজ্জিত এবং বিব্রত হই। এরপর ইংরেজি ধরি। ছোট ছোট বাক্যের অতি সহজবোধ্য ইংরেজি। টিনাকে পড়তে বললাম। টিনা বেশ সুন্দরভাবে অর্থসহ পড়তে লাগলো।

এক জায়গায় গিয়ে সে থেমে গেল। বললো, স্যার, এই শব্দটার উচ্চারণ কি হবে? আমি বইটি আমার দিকে টেনে নিই। লাইনটি - Ali is frightened. ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলাম। Frightened শব্দটা আমার ভোকাবিউলারিতে নতুন। প্রথমত এর উচ্চারণ জানা নেই, দ্বিতীয়ত, উচ্চারণটা কাকতালে সঠিক ভাবে করতে পারলেও এর অর্থটা জনবো কার কাছ থেকে? হেনা যেভাবে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে, কোন কথা নেই, বার্তা নেই, কি জন্য বসে আছে তার কারণও জানা নেই, এ অবসহায় টিনাকে বলতে পারছি না যে ডিকশনারিটা নিয়ে এস, খুঁজে বের করি।

পঞ্চম শ্রেণীর ইংরেজি পড়াতে যদি ডিকশনারি লাগে তাহলে আমার বিদ্যার দৌড় সম্পর্কে কি কারো জানতে বাকি থাকবে? চ্যাপ্টারের ওপরের অংশ থেকে পড়ে আমি যেটা আন্দাজ করলাম তা হলো এই শব্দটার অর্থ দাঁড়ায় বিব্রত। আমি সাহস করে বলে ফেললাম, শব্দটার উচ্চারণ ফ্রিঘটেনড। অর্থ হলো বিব্রত। Ali is frightened - আলী হয় বিব্রত। টিনা জিজ্ঞাসা করে, স্যার 'বিব্রত' কি জিনিস? 'বিব্রত' অর্থ বুঝলে না? খুবই লজ্জার মধ্যে পড়া, এত লজ্জা যে বলার মত না।

টিনা খুব সন্তুষ্ট হলো। সে পড়তো লাগলো - আলী ইজ ফ্রিঘটেনড। আলী খুবই লজ্জার মধ্যে আছে। আমি বলি, ওভাবে বলবে না, বলবে আলী খুবই বিব্রত। টিনা বলে, কিন্তু 'খুবই' ইংরেজি তো 'ভেরি' এই সেনটেন্সে 'ভেরি' কোথায়? আমি বলি 'ভেরি' না থাকলেও উচ্চতর ইংরেজির বাংলা করলে মাঝে মাঝে 'খুবই' যোগ করা যায়।

টিনা বলে 'উচ্চতর' কাকে বলে? আমি বলি, উচ্চতর হলো ওপরের দিকের ক্লাস। 'ও' শব্দ করে টিনা খুশি মনে পুনরায় পড়তে শুরু করে । আমি হাঁফ ছাড়ি। টিনাকে অংক করানোর সময় প্রথম বারের মত লক্ষ্য করি যে হেনার মুখাবয়ব বেশ সদাশয়। ওর হাতে একখানা বই, বইটি বন্ধ করে আঙুলের ফাঁকে পৃষ্ঠা খুলে ধরে রেখে সে টেবিলের ওপর ভর করে গালে হাত দিয়ে বসে আছে।

সে সর্ব প্রথমে যে কথাটি উচ্চারণ করলো তা হলো, টিনা অংকে একেবারে কাঁচা। আমার কি যে স্বস্তি লাগলো, অংকে কাঁচা এ মেয়েটির পড়াশুনার ব্যাপারে এ বাড়ির সবাই খুব উদ্বিগ্ন। হেনার কথায় স্পষ্ট ফুটে উঠলো, টিনার জন্য আমার ওপরে তারা খুবই ভরসা করে আছে। পরের দিন পড়াতে গিয়ে দেখি টিনা একা, ওর মা কিংবা বাবা, কিংবা হেনা কেউ নেই। টিনাকে জিজ্ঞাসা করি, কি ব্যাপার, আজ যে তুমি একা? টিনা একেবারে ইনোসেন্টভাবে তাকিয়ে বলে, আমি তো একাই পড়ি।

তোমার আপু আসেনি আজ? আপুর আলাদা স্যার আছেন। চারজন। আপু আপনার কাছে পড়বে না। টিনা আমার কথা ধরতে পারে না বলে এ ব্যাপারে আমি আর কথা বাড়াই না। কথা প্রসঙ্গে এক ফাঁকে টিনা আমাকে দারুণ একটা সুখবর দিল।

বললো, আপনি খুব ভালো টিচার। যাহ্, কি যে বলো? হ্যাঁ, আপু বলেছে। ওর আপুর কথায় আমার প্রাণ উদ্বেলিত হয়। কঠিন চেহারার মেয়েটি যে শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যিই আমার ওপর প্রসন্ন হয়েছে তাতেই আমার বেজায় খুশি লাগতে লাগলো। তবে ইংরেজি পড়ানো শেষ হওয়ার সাথে সাথেই টিনা পুনরায় ইংরেজি বইয়ের পাতা খুলে বলে, দাঁড়ান স্যার, গতকাল একটা ভুল পড়িয়েছিলেন।

ভুল পড়ানোর কথায় আমি চমকে ওঠি। টিনা ইংরেজি বইয়ের পাতা খুলে বের করে - Ali is frightened। তারপর বলে, স্যার, আপু বলেছে frightened শব্দটার উচ্চারণ হবে ফ্রাইটেনড। এটার অর্থ হলো ভীত। ভাগ্যিস আজ ওরা কেউ সামনে নেই।

তারপরও আমি টিনার কাছে লজ্জায় মিইয়ে গেলাম। এ বাড়িতে ভুল পড়িয়ে পার পাওয়ার উপায় নেই। হেনা মেয়েটি বেশ বুদ্ধিমান বটে। গতকাল পড়ানোর সময় সে এটা লক্ষ্য করেছিল, সঙ্গে সঙ্গে আমার ভুল শুধরে দিতে পারতো, কিন্তু ছাত্রীর সামনে আমাকে সে অপ্রস্তুত করেনি। অবশ্য সে আরো বুদ্ধিমতী হলে এ ভুলটি টিনাকে না বলে আমাকেই শুধরে দিতে পারতো।

কিন্তু আমি তাতে আরো বেশি বিব্রতবোধ করতাম সন্দেহ নেই, যদিও সেটিই হতো তার জন্য সর্বোত্তম পন্থা। আমি টিনাকে জিজ্ঞাসা করি, ভীত শব্দটার অর্থ বোঝ তো? হ্যাঁ, টিনা টেনে টেনে হ্যাঁ শব্দটা উচ্চারণ করে বলে, ভীত শব্দটার অর্থ হলো ভয় পেয়ে যাওয়া। হয়েছে স্যার? হ্যাঁ হয়েছে । ভেরি গুড। টিনা বলে, স্যার, আমাদের বাসায় চারটি ইংলিশ ডিকশনারি আছে।

আপু বলেছে, ইচ্ছে করলে আপনি যে কোন একটা ডিকশনারি আপনার হোষ্টেলে নিয়ে যেতে পারেন। আমি একটা সূক্ষ্ম ইংগিত বুঝতে পারলাম। আমি যে ইংরেজিতে কাঁচা হেনা তাই বোঝাতে চেয়েছে। কিন্তু হেনা আমার একদিনের ইংরেজি পড়ানো থেকে আমার ওপর এমন একটা নেগেটিভ ইম্প্রেশন নিয়ে ঠিক করেনি। আমি মনে করি ইংরেজিতে আমি ততটা দুর্বল নই, যতটা সে ভাবছে।

টিনাকে পড়ানোর শেষ পর্যায়ে হেনা ঘরে ঢুকলো। তার চেহারায় গতকালের কাঠিন্য নেই, তবে হাসি হাসি ভাবটা কেবল অনুভব করা যায়, সুস্পষ্ট নয়। হেনা টেবিলে ঠেঁস দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, আপনি যেহেতু ঢাকা কলেজের ছাত্র, মাষ্ট বি ভেরি ব্রিলিয়ান্ট! আমি সলজ্জ হেসে বলি, মোটেও না। বাহ্। ভারী বিনয়ী তো আপনি! বলেই সে প্রথম বারের মত মিষ্টি করে হাসলো।

আমি বললাম, আপনি আমার চেয়ে অনেক বেশি ব্রিলিয়ান্ট। শাট আপ। হেনা কৃত্রিম ভর্ৎসনার করে সলজ্জ হাসতে থাকে। ওর হাসিতে মুক্তা ঝরে। একটু থেমে হেনা বলে, একটা কাজের কথা বলি? আমি ভয়ে নড়েচড়ে বসি।

হেনা বলে, 'রক্তাক্ত প্রান্তরের' নোট করেছেন? আমি অবাক হয়ে বলি, সেকেন্ড ইয়ার তো সবে শুরু। এত আগে রক্তাক্ত প্রান্তরের নোট করবো কোত্থেকে? ও-মা, নোট না করেল পড়বেন কি? নোট করার তো এখনই সময়। এরপর শুধু মুখস্থ করবেন। হেনা বলে। আমি বলি, এত আগে আমার নোট করার কোন অভ্যাস নেই।

সত্যি বলতে কি, বাংলা ইংরেজির জন্য আমি কোন নোট করি না। বাজারের নোট মুখস্থ করে পরীক্ষা দিই। হেনা হেসে দিয়ে বলে, ঢাকা কলেজের ছাত্রের এই কথা? আমার তো ধারণা ছিল ঢাকা কলেজের প্রত্যেকটা ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.