আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইঞ্জিনিয়ার

জীবনের এই গতিপথ...পূর্ব-পশ্চিমে যেন এক নিছক অন্বেষণ

১। রাত প্রায় একটা। ইমিগ্রেশান পার হয়ে, প্লেনে উঠলাম। পাশের সিটে এক ব্যাটা টাইপ ছেলে বসা। আমার মতই বয়স।

দেখে মনে হয় চাইনিজ, আবার ঠিক চাইনিজ না। বাহারি রঙ-এর চুল। কৌতুহল নিবারণ করতে পারলাম না। প্রশ্ন করি, “কোথা থাকা হয়?” আমার মতই মিষ্টি হেসে জবাব দেয়, “অস্ট্রোলিয়া। ” প্রতি প্রশ্নে সে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কোথা থেকে?” “বাংলাদেশ।

” “কি করা হয়?” সে আবার সুধায়। হাসিমুখে উত্তর দেই, “ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। ” “কোন সাবজেক্ট?” “ম্যাটেরিয়ালস এন্ড ম্যাটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। ” “হুম” সে বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ে। তারপর প্লেনের বডিটাতে একটু খুঁচাখুঁচি শুরু করে।

তারপরে আবার প্রশ্ন “আইচ্ছা, এই পেলেনের বডিটা কি ম্যাটেরিয়াল দ্বারা তৈরী?” ওর বলার মধ্য কি যেন একটা ছিল। আর ওটা দেখে, আমার মনে এক ভয়ংকর ভাবনা উদয় হতে থাকে। সেটা হল, ব্যাটা আবার বাচাল নাতো? তাহলে তো পুরা জার্নিটাকে সে একটা পেইনে পরিণত করবে। যাই হোক, ভদ্রভাবেই ওর প্রশ্নের উত্তর দিলাম, “সাধারণত, আলুমিনিয়ামের এলয় ইউজ হয়। ” আবার সে বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ে।

যেন আমার উত্তর শুনেই সে নিশ্চিত হল যে, আমি সত্যি ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। প্নেন আকাশে উঠা মাত্রই আমি ঘুমানোর তোড়জোড় করতে থাকি। কিন্তু বিধিবাম। সে আবার প্রশ্ন করে, “দুনিয়াতে এত সাবজেক্ট থাকতে তুমি কেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লা?” আরে ব্যাটা বলে কি? এই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য কত কাঠখড় পুড়িয়ে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলাম, আর সে বলে কিনা ইঞ্জিনিয়ারিং কেন পড়ি? ইতিমধ্য নাম জানা হয়েছে দুইজনার। ওর নাম এরিক।

এবার আমি প্রতি প্রশ্ন করি, “তুমি কি কর এরিক?” “কিছুই করি না। ” সে একটু ফিক করে হাসে। কিছুক্ষণ পরে সে নিজেই বলে, “চুল কাটি, মানে নাপিত। ” আমি অবশ্য আগেই এটা সন্দেহ করেছিলাম, তার তিন রঙ এর চুল দেখে। মাথার খুলির কেন্দ্র থেকে সামনে-পিছনে একগোছা চুল লাল, তারপরের স্টেপের চুলগুলো সবুজ আর একেবারে সাইডের চুলগুলো ভায়োলেট।

প্লেনের বালিকারা খাবার দিয়েছে ইতিমধ্যে। অতি অনুপাদেয় খাবার। এবং খাবারের ফাঁকে বেশ অনেকটা জ্ঞান অর্জিত হল। তা হল, ছেলেদের এমন সাবজেক্ট পড়তে হবে, যা হল জীবন ঘনিষ্ঠ। বলা যায়, সব ছেলেরই নাপিতগিরির উপর পড়াশুনা করা উচিত।

কারণ সেটা নাকি অস্ট্রোলিয়ার টপ সাবজেক্ট। এরিকের ডিগ্রিও নাকি এই বিষয়ের উপরে। আর মেয়েদের শুধুমাত্র পড়া উচিত নার্সিং। ইতিমধ্য আমি বুঝে গেছে, এরিক খুবই বাচাল। এক পর্যায়ে, সে হাউমাউ করা শুরু করল।

কারণ, কেন আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লাম? কেন আমি নাপিতগিরি অধ্যয়ন করলাম না? তাহলে সে আমাকে অতি সহজেই অস্ট্রোলিয়া নিয়ে যেতে পারত। সে নাকি আমাকে অস্ট্রোলিয়াতে থাকার সব ব্যাবস্থা করে দিত। আমি ভদ্রভাবেই বললাম, “আমার এখন অস্ট্রোলিয়া যাবার তেমন ইচ্ছা নেই। আর যদি কোনদিন অস্ট্রোলিয়া যাবার ইচ্ছা হয়, সেটা আমি একাই করতে পারব। বেটার তুমি আমাকে ঘুমাতে দাও।

” কিন্তু কে শোনে কার কথা। একটু পরে এরিক ঘোষণা দিল, “আমি মহাদেশ-মহাসাগর সব দেখেছি আড়াফাত (আসলে হবে আরাফাত), কিন্তু তোমার মত কাউকে পাইনি। তুমি আমার সবচেয়ে ভালো বেস্ট ফ্রেন্ড। যদিও তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছো, আমি তোমাকে অস্ট্রোলিয়া নিয়ে যাবার সব রকম চেষ্টা করব। ” বুঝলাম, আর না।

এবার ঘুমাতে হবে। ঘুমানোর অতল তলে হারিয়ে যেতে যেতে আমি শুনতে পেলাম, এরিক অনুনয় করে বিলাপ করছে “আড়াফাত, তুমি কেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লা? কেন? কেন?? কেন???” জানিনা, মানুষের মাথা ঠিক কিভাবে কাজ করে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে মাথাতে একটা স্মৃতি খেলে গেল। রাতের অন্ধকারে প্লেনটি না জানি কোন দেশের উপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে, আর তাতে আমার সেই ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়ে গেল, কেমন জানি সবকিছু অবাস্তব লাগতে থাকে। ২।

আমার ছোটবেলা। কেউ যদি আমাকে ছোটবেলায় জিজ্ঞেস করত, “খোকা তুমি বড় হয়ে কি হবে?” আমি গাল ফুলিয়ে উত্তর দিতাম, “ডাক্তার হব। ” “তাই। তুমিতো তাহলে খুব ভালো ছেলে। ” সেই আমি কেন ডাক্তার না হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হলাম? কারণ, ক্লাস সিক্সের এক ঘটনা।

বিকেলবেলা বাহির থেকে খেলে এসেছি। এখন মাগরিবের নামায পড়তে মসজিদে যাবো। নামাযের জন্য প্যান্ট চেঞ্জ করার সময়, জিপারটা জায়গামত আটকে গেল। আমি গগণবিদারী চিতকার দিয়ে উঠলাম। মা দৌড় দিয়ে আসল।

এসেই মা আমাকে কি আর রক্ষা করবে? আমাকে দেখেই মা আরেকটা গগণবিদারী চিতকার দিয়ে দিল। আর এই চিতকারে আশে-পাশে, উপরে-নীচে সব ফ্ল্যাটের বাসিন্দা, আমার সব বন্ধু-বান্ধবী, আংকেল-আন্টি সবাই দৌড় দিয়ে আসল। আমার মা বিলাপ করতে থাকে, “হায়, হায়, এখন আমার ছেলের কি হবে? ডাক্তারের কাছে নিলে তো মোটা একটা ইঞ্জেকশান জায়গামত দিয়ে অবশ করবে। তখন আমার ছেলের কি হবে রে?” যাই হোক, আমার মায়ের কন্নাকাটি দেখে, আমি আমার কান্না ভুলে গেছি। ইতিমধ্যে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের এক ইঞ্জিনিয়ার আংকেল চলে এসেছেন।

তিনি এসেই বললেম, “মুশকিল নাই। কেউ একটা কাঁচি দাও। ” কেউ একজন একটা কাঁচি জোগাড় করে দিল। তারপরে আমি তাঁর ইঞ্জিনিয়ারিং দেখতে লাগলাম। তিনি কি করলেন তা চিত্রসহকারে নিম্নে বর্ণনা করলাম।

১। শুরুতে তিনি আমার প্যান্টের জিপারের কাছে কাঁচিটা নিয়ে গেলেন। চিত্র ১ – জিপারের কাছে কাঁচি ২। তারপর তিনি আস্তে করে জিপারের অংশটুকু রেখে, বাকি প্যান্টটুকু কেটে ফেললেন। সুতরাং, আমার পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে তখন শুধু একটা জিপার।

চিত্র ২ – পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে শুধুমাত্র জিপার ৩। যেহেতু, জিপারের মাথাগুলা কেটে ফেলা হয়েছে, তাই জিপারের মুখদুটো আলগা হয়ে গেছে। চিত্র ৩ – জিপারের আলগা মুখ ৪। মুখ দুটোতে আস্তে করে টান দেবা মাত্র, সুন্দরভাবে কোন ঝামেলা ছাড়া জিপারটা খুলে আসল। চিত্র ৪ – এইভাবে বল প্রয়োগ করতে হবে ৫।

আমার মুখে এক শান্তির ঢেউ খেলে গেল। চিত্র ৫ – হাসি হাসি মুখে আমি যাই হোক, আমার মায়ের দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল। কিন্তু, আমি আসলে এই কারণে ইঞ্জিনিয়ার হই নাই। আমি ইঞ্জিনিয়ার হয়েছি অন্য কারণে। তা হল, যখন আমার জিপারটা খোলা হচ্ছিল, তাতে সেই কাজে পুরোটা সময় তদারক করছিল, আমার তদকালিন বান্ধবী ডালিয়া।

যখন পুরো জিপারটা জায়গা থেকে খোলা হল, তখন আমি ডালিয়ার মুখে যে সুন্দর ও নিস্পাপ হাসি দেখেছিলাম, তা আমি কোনদিনও ভুলতে পারিনি। আর সে হাসিটাই আমার ইঞ্জিনিয়ার হতে অনুপ্রেরণা জোগায়। ৩। প্লেনটি কোন ঝামেলা ছাড়াই ল্যান্ড করল। আমি আমার গন্তব্যে পৌছে গেছি।

কিন্তু এরিকের দুই ঘন্টা ট্রানজিট। ইমিগ্রেশানের ঝামেলা পার হবা মাত্রই, কোথা থেকে এরিক আবার তেড়েফুড়ে উদয় হল। এখন সে পিংক কালারের একটা স্যুয়েটার পরেছে। কোন ছেলে পিংক কালারের ড্রেস পরলে এমনিতেই আমার মেজাজ খারাপ লাগে, তারপরে আবার এরিকের স্যুয়েটারটা লেডিস কাটের। আমি কিছু বোঝার আগেই এরিক এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল।

ওর চোখের পানিতে আমার শার্টের কলার ভিজে যেতে থাকে। সে বিলাপ করতে থাকে, “আড়াফাত, ও আড়াফাত । তুমি চলে যাচ্ছো। কিন্তু এটা কোন বিচ্ছেদ নয় আড়াফাত, সাময়িক বিরতি মাত্র............” সে একটানা একটা যন্ত্রের মত বলেই যেতে থাকে। এদিকে আমার মনে এরিক সম্পর্কে এক ভয়ংকর ভাবনা উদয় হতে থাকে।

ব্যাটা নির্ঘাত একটা ......। ভাবলাম, আর নারে বাবা। তাই এরিককে বললাম, “সরি, এখন আমার তাড়া আছে এরিক। সাময়িক বিরতির পরে আবার কথা হবে। ” শহরতলির ভেতর দিয়ে যখন আমার ট্যাক্সিটা যাচ্ছিল, তখন আমি ট্যাক্সির জানালা দিয়ে এরিকের ঠিকানা লেখা কার্ডটি আস্তে করে ফেলে দিলাম।

উৎসর্গ – বুয়েটের সকল শিক্ষকদেরকে, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর অনুপ্রেরণা ছাড়া আমি কোনদিনও ইঞ্জিনিয়ার হতে পারতাম না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.