আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জার্মানীর আদালতে হিজাব পরিহিতা নারীর হত্যাকান্ড

সকালের মিষ্টি রোদ পেরিয়ে আমি এখন মধ্যগগনে,

পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলমানদের প্রতি অন্যায়-অবিচার ও বৈষম্য নতুন কোন বিষয় নয়। যুগ যুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে বসবাসরত মুসলমানদের মৌলিক অধিকার পদদলিত হয়ে আসছে। তবে সম্প্রতি জার্মানীর একটি আদালতে বিচারের শুনানী চলার সময়ে যে লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে, তাকে পাশ্চাত্যে ইসলাম আতঙ্কের অন্যতম ফসল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ঐ আদালতে এক বর্ণবিদ্বেষী তরুণ হিজাব পরিহিতা মিশরীয় গর্ভবতী নারী মারওয়া শেরবিনিকে উপর্যপুরি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে এবং তার স্বামী তাকে বাঁচাতে আসলে পুলিশ তার ওপর গুলি চালায়। মিশরীয় নাগরিক মারওয়া শেরবিনি ২০০৫ সালে উচ্চশিক্ষার্থে স্বামীসহ জার্মানীতে পা রাখেন।

সেখানে গিয়েই তিনি মুসলমানদের প্রতি জার্মান সমাজের বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন। ফার্মেসিতে উচ্চতর ডিগ্রিধারী শেরবিনি নিজ জীবদ্দশায় জার্মান সমাজে ইসলাম বিদ্বেষ ও বর্ণবাদ কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। সম্প্রতি জার্মানীর একটি পার্কে ঘুরতে গেলে তিনি বর্ণবাদী আক্রমণের শিকার হন। একজন বর্ণবিদ্বেষী জার্মান তরুণ শেরবিনি'র হিজাবকে সন্ত্রাসের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করে এবং তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। শেরবিনি ঐ যুবকের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ করেন এবং সেখানে ঐ যুবকের অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।

আপীল আদালতে মারওয়া শেরবিনি যখন বিচারকের সামনে তাকে অপমান করার ঘটনা বর্ণনা করছিলেন, তখন অভিযুক্ত যুবক তার ওপর হামলা চালায়। 'তোর বেঁচে থাকার অধিকার নেই'- একথা বলে গর্ভবতী শেরবিনির ওপর সে উপর্যপুরি ১৮ বার ছুরিকাঘাত করে তাকে হত্যা করে। এ সময় শেরবিনির স্বামী তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে চাইলে জার্মান পুলিশ তার ওপর গুলি চালায়। এসময় শেরবিনির ৩ বছরের শিশু আদালতে উপস্থিত ছিলো এবং ঐ অবুঝ শিশুর চোখের সামনে তার মা শহীদ এবং বাবা মারাত্মকভাবে আহত হয়। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, যে জার্মান পত্রপত্রিকা অতি তুচ্ছ কোন ঘটনাকেও বড় করে তুলে ধরে, সেই গণমাধ্যম শেরবিনির হত্যাকান্ডের ব্যাপারে কয়েকদিন ধরে রহস্যজনক নিরবতা পালন করে।

নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বলে দাবিকৃত এসব গণমাধ্যম কেবল তখনই শেরবিনির লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের খবর প্রচার করে যখন অন্যান্য সূত্রের মাধ্যমে ঘটনাটি প্রকাশ হয়ে পড়ে। হিজাব পরিহিতা মুসলিম নারী শেরবিনির হত্যাকান্ডের খবর জার্মানীর গণমাধ্যমে প্রকাশ না হওয়ার ঘটনা মুসলমানদের প্রতি জার্মানীসহ পশ্চিমা সমাজের বর্ণবাদী আচরণের বিষয়টি আরো একবার বিশ্ববাসীর সামনে ফুটিয়ে তুলেছে। এমনকি যখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে হিজাব পরিহিতা মুসলিম নারীর হত্যাকান্ডের খবরটি প্রচারিত হয়েছে, তখনও জার্মান গণমাধ্যম এটিকে গুরুত্বহীন এবং একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। জার্মানীর এটর্নি জেনারেল মারওয়া শেরবিনির হত্যাকান্ড সংক্রান্ত যে কোন তথ্য প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, শেরবিনির জায়গায় যদি একজন অমুসলিম নিহত হতো, তবে পশ্চিমা গণমাধ্যম সে খবরকে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করতো এবং দীর্ঘদিন ধরে মাঠ গরম করে রাখতো।

আলজেরিয়ার আশশুরুক পত্রিকার সম্পাদক যেমনটি বলেছেন,"মুসলিম নারীর পরিবর্তে জার্মানীতে যদি কোন ইহুদী এরকম নির্মম হত্যাকান্ডের স্বীকার হতো, তবে জার্মান পত্রিপত্রিকাগুলো এ ব্যাপারে হৈ চৈ ফেলে দিতো। " জার্মানীর আদালতের বিচারক ও পুলিশের চোখের সামনে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার মুসলিম নারী মারওয়া শেরবিনির ভাই তারেক শেরবিনি এ সম্পর্কে আল আলম নিউজ চ্যানেলকে বলেছেন, "যদি ঐ হত্যাকান্ড কোন ইউরোপীয় বা পশ্চিমা নাগরিকের ওপর পরিচালিত হতো, তবে তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী এলাহী কান্ড ঘটে যেতো। কিন্তু আমার বোনের হত্যাকান্ডের ব্যাপারে তারা আশ্চর্যজনক নীরবতা পালন করেছে। এটি সকল আরব ও মুসলমানকে অবমাননার শামিল। " প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার যে নীতি গ্রহণ করেছে, দেশগুলোর গণমাধ্যম হুবহু সে নীতি অনুসরণ করছে।

এসব সরকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করেছে এবং বহু পশ্চিমা রাষ্ট্রনায়ক তাদের কথাবার্তায় ইসলাম বিদ্বেষের বিষয়টি চেপে রাখতে পারেন নি। পাশ্চাত্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুসলিম ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতীক, বিশেষ করে হিজাবের বিরুদ্ধে এক ধরনের চরম বর্ণবাদী আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এমনকি হিজাব পরার কারণে মিশরীয় মুসলিম নারী মারওয়া শেরবিনিকে হত্যা করেছে। বর্তমানে জার্মানীর বেশ কয়েকটি প্রদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারী অফিস আদালতে হিজাব পরিহিতা মুসলিম নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ রয়েছে। ফ্রান্সেও মুসলমানদের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটিতে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরিধানের ওপর কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করে রাখা হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলাম বিদ্বেষ এমনভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, সেখানে বসবাসরত মুসলমানদের সারাক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাগরিক অধিকার বিষয়ক সংস্থা এফ.আর.এ সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইউরোপীয় দেশগুলোতে গত এক বছরে বণবদী আচরণের পরিমাণ শতকরা ৮০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব দেশের শীর্ষে রয়েছে বৃটেন। ২০০৭ সালে বৃটেনে ৬১টি বর্ণবাদী হামলা হয়েছিলো। এ দৃষ্টিকোন থেকে জার্মানীর আদালতে একজন মুসলিম নারীর হত্যাকান্ড অপ্রত্যাশিত কোন ঘটনা নয়। কারণ, জার্মানীসহ পশ্চিমা দেশগুলোর গণমাধ্যম সেসব দেশে মুসলিম বিদ্বেষী পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে।

জার্মানীর একটি প্রাদেশিক পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য জামাল কারযুলি এ সম্পর্কে বলেছেন, "জার্মানীর রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যমগুলো বহু বছর আগে থেকে দেশটিতে একটি ইসলাম বিদ্বেষী পরিবেশ তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জার্মানীর আদালতে প্রকাশ্য দিবালোকে একজন হিজাব পরিহিতা মুসলিম মহিলার হত্যাকান্ডের ঘটনায় দেশটির সরকার নিজেকে নির্দোশ ভাবতে পারে না। বিশেষ করে মারওয়া শেরবিনির হত্যাকান্ডের ব্যাপারে বহু প্রশ্ন এখন সামনে আসছে। প্রকাশ্য আদালতে এ ধরনের ঘটনা ব্যাপক সংশয়েরও জন্ম দিয়েছে। কারণ, জার্মানীর আইন অনুযায়ী আদালতে জননিরাপত্তাকে হুমকিগ্রস্ত করা যায় এমন কোন ধরনের অস্ত্র বা গোলাবারুদ নিয়ে প্রবেশ করা যায় না।

আদালতে প্রবেশের সময় প্রতিটি ব্যক্তির দেহ তল্লাশি করে তার নিরস্ত্র হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয় কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় শেরবিনির ঘাতক কীভাবে ছোরা নিয়ে আদালতে প্রবেশ করলো- এটি হচ্ছে প্রথম প্রশ্ন। দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশের চোখের সামনে এতবড় একটি হত্যাকান্ড ঘটার সময় পুলিশ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলো কেনো? পুলিশ শেরবিনিকে রক্ষা করতে এগিয়ে না এসে বরং তার স্বামীর গায়ে গুলি করে। তারা ঐ ঘাতক যুবককে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে পারতো। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, বর্ণবিদ্বেষী জার্মান সমাজে আর কোন মুসলিম নারী যাতে হিজাব পরার সাহস না দেখায় সেজন্য পূর্ব পরিকল্পিতভাবে শেরবিনি'র হত্যাকান্ডের নাটক আদালতে মঞ্চস্থ করা হয়েছে।

বর্ণবাদী হামলার শিকার মারওয়া শেরবিনি আসলে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হিজাব পরতেন। এ কারণে মিশরের ঐ নারীকে 'শহীদে হিজাব' বা হিজাবের শহীদ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হিজাব হচ্ছে এমন এক ঢাল যা নারীকে লম্পট পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে রক্ষা করে। হিজাব পরিধান করে একজন নারী নিরাপত্তা সহকারে সমাজের গঠনমূলক কাজে অংশ নিতে পারে। মারওয়া শেরবিনি ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ পালন করতে গিয়ে শহীদ হওয়ার কারণে বিশ্বের মুসলমানরা তার প্রতি সহমর্মীতা প্রকাশ এবং পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি ধিক্কার জানিয়েছে।

মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় শেরবিনির জন্মস্থানে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে অত্যন্ত আড়ম্বরের সাথে তার জানাযা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। ইরানেও তার প্রতীকি দাফন সম্পন্ন হওয়ার পাশাপাশি জার্মানী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান সভাপতি ইতালির রাষ্ট্রদূতকে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে শেরবিনির নিজ দেশ মিশর সরকারের অদ্ভুত নীরবতা দেশটির জনগণকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। মিশরের অনেক আলেম ও রাজনৈতিক নেতা দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমাদ আবুল গেইতের পদত্যাগ দাবি করেছেন। সার্বিকভাবে বলা যায়, পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলাম বিদ্বেষী যে পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, তার ফলে মুসলমানরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

পশ্চিমা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও গণমাধ্যম এসব দেশে ইসলাম গ্রহণের ক্রমবর্ধমান হার রোধ করার লক্ষ্যে ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারণা চালাচ্ছে। ইসলাম মানুষের প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান হওয়ার কারণে বহু মানুষ এ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। হিজাব বা ইসলামী শালীন পোশাক হচ্ছে এ ধর্মের অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয়। কিন্তু সুস্থ সমাজের জন্য অপরিহার্য এই হিজাবকে পশ্চিমা দেশগুলো মেনে নিতে রাজী নয়। পশ্চিমা দেশগুলো মানবাধিকার রক্ষার দাবি করলেও বাক স্বাধীনতার অপব্যবহার করে নানাভাবে ইসলামের অবমাননা করছে।

এসব দেশ তাদের মতাদর্শ বিরোধী কোন দেশের সামান্য ঘটনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী হৈ চৈ ফেলে দিতে সিদ্ধহস্ত হলেও প্রকাশ্য আদালতে একজন মুসলিম নারীর হত্যাকান্ডে কোনরকম বিচলিত হয় নি। মানবাধিকারের পৃষ্ঠপোষক এসব দেশের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসী হামলায় একজন গর্ভবতী নারীর করুণ মৃত্যুতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় নি। Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.