আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবনানন্দ দাশ: অবসরের গান

নর্দমার রাত, হিরন্ময় তাঁত

০১. শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার — চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ, তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান, দেহের স্বাদের কথা কয় – বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট করে দেবে তার সাধের সময়! চারি দিকে এখন সকাল – রোদের নরম রঙ শিশুর গালের মতো লাল! মাঠের ঘাসের পরে শৈশবের ঘ্রাণ – পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের পড়েছে আহ্বান! চারি দিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল, তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল! প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে থেকে আসিতেছে ভেসে পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে! শরীর এলায়ে আসে এই খানে ফলন্ত ধানের মতো করে যেই রোদ একবার এসে শুধু চলে যায় তাহার ঠোটের চুমো ধ’রে আহ্লাদের অবসাদে ভরে আসে আমার শরীর, চারি দিকে ছায়া — রোদ — ক্ষুদ — কুঁড়া — কার্তিকের ভিড়: চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এই খানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান, পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপাশালি ধান ভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ! আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই — নুয়ে আছে নদীর এপারে বিয়োবার দেরি না — রূপ ঝরে পড়ে তার – শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে! আজও তবুও ফুরায় নি বৎসরের নতুন বয়স, মাঠে মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ, ভাড়ারের রস! মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয় সকালবেলা রৌদ্রে; কুঁড়িমির আজিকে সময়। গাছের ছায়ার তলে মদ লয়ে কোন্‌ ভাঁড় বেঁধেছিল ছড়া! তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া; ভুলে গিয়ে রাজ্য — জয় — সাম্রাজ্যের কথা অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাকা ছিল তুলে লব তার শীতলতা; ডেকে লব আইবুড় পাড়াগাঁর মেয়েদের সব – মাঠের নিস্তেজ রোদের নাচ হবে – শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব। হাতে হাত ধরে ধরে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুরে কার্তিকের মিঠা রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে; ফলন্ত ধানের গন্ধে — রঙে তার — স্বাদে তার ভরে যাবে আমাদের সকলের দেহ; রাগ কেহ করিবে না — আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ। আমাদের অবসর বেশি নয — ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময় আমাদের সকলের আগে শেষ হয় দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ — অবসাদ – আমাদের ডেকে লয় — তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা — অবসন্ন হাত। তখন শস্যের গন্ধ ফুরায়ে গিয়েছে ক্ষেতে — রোদ গেছে পড়ে, এসেছে বিকালবেলা তার শান্ত শাদা পথ ধরে; তখন গিয়েছে থেমে অই কুঁড়ে গেঁয়োদের মাঠের রগড় হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ ঝরা মেয়ে তার শাদা মরা শেফালির বিছানার পর; মদের ফোঁটার শেষ হয়ে গেছে এ মাঠের মাটির ভিতর! তখন সবুজ ঘাস হয়ে গেছে শাদা সব, হয়ে গেছে আকাশ ধবল, চলে গেছে পাড়াগাঁর আইবুড়ো মেয়েদের দল! ০২. পুরনো পেঁচারা সব কোটারের থেকে এসেছে বাহির হয়ে অন্ধকার দেখে মাঠের মুখের পরে সবুজ ধানের নিচে — মাটির ভিতরে ইঁদুরেরা চলে গেছে — আঁটির ভিতর থেকে চলে গেছে চাষা; শস্যের ক্ষেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা! ফলন্ত মঠের’ পরে আমরা খুঁজি না আজ মরণের স্থান, প্রেম আর পিপাসার গান আমরা গাহিয়া যাই পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন! ফসল — ধানের ফলে যাহাদের মন ভরে উঠে উপেক্ষা করিয়া গেছে সাম্রাজ্যেরে, অবহেলা করে গেছে – পৃথিবীর সব সিংহাসন – আমাদের পাড়াগাঁর সেই সব ভাঁড় – যুবরাজ রাজাদের হাড়ে আজ তাহাদের হাড় মিশে গেছে অন্ধকারে অনেক মাটির নীচে পৃথিবীর তলে কোটালের মতো তারা নিশ্বাসের জলে ফুরায় নি তাদের সময়; পৃথিবীর পুরোহিতদের মতো তারা করে নাই ভয়! প্রণয়ীর মতো তারা ছেড়ে নি হৃদয় ছড়া বেঁধে শহরের মেয়েদের নামে! চাষাদের মতো তারা ক্লান্ত হয়ে কপালের ঘামে কাটায় নি — কাটায় কি কাল।

অনেক মাটির নিচে তাদের কপাল কোনো এক সম্রাটের সাথে মিশিয়া রয়েছে আজ অন্ধকার রাতে! যোদ্ধা — জয়ী — বিজয়ীর পাঁচ ফুট জমিনের কাছে – পাশাপাশি – জিতিয়া রয়েছে আজ তাদের খুলির অট্টহাসি! অনেক রাতের আগে এসে তারা চলে গেছে — তাদের দিনের আলো হয়েছে আঁধার, সেই সব গেঁয়ো কবি — পাড়াগাঁর ভাঁড় আজ এই অন্ধকারে আসিবে কি আর? তাদের ফলন্ত দেহ শুষে ল’য়ে জন্মিয়াছে আজ এই খেতের ফসল; অনেক দিনের গন্ধে ভরা ঐ ইদুরের জানে তাহা — জানে তাহ নরম রাতের হাতে ঝরা এই শিশিরের জল! সে সব পেঁচারা আজ বিকালের নিশ্চলতা দেখে তাহাদের নাম ধরে যায় ডেকে ডেকে। মাটির নিচের থেকে তারা মৃতের মাথার স্বপ্নে নড়ে উঠে জানায় কী অদ্ভুত ইশারা! আঁধারের মশা আর নক্ষত্র তা জানে – আমরাও আসিয়াছি ফসলের মাঠের আহ্বানে। সূর্যের আলোর দিন ছেড়ে দিয়ে, পৃথিবীর যশ পিছে ফেলে শহর — বন্দর — বস্তি — কারখানা দেশলাইয়ে জ্বেলে আসিয়াছি নেমে এই ক্ষেতে; শরীরের অবসাদ — হৃদয়ের জ্বর ভুলে যেতে। শীতল চাঁদের মতো শিশিরের ভিজা পথ ধরে আমরা চলিতে চাই, তারপর যেতে চাই মরে দিনের আলোয় লাল আগুনের মুখে পুড়ে মাছির মতন; অগাধ ধানের রসে আমাদের মন আমরা ভরিতে চাই গেয়ো কবি — পাড়াগার ভাঁড়ের মতন! – জমি উপড়ায়ে ফেলে চলে গেছে চাষা নতুন লাঙল তার পড়ে আছে — পুরনো পিপাসা জেগে আছে মাঠের উপরে; সময় হাঁকিয়া যায় পেঁচা অই আমাদের তরে! হেমন্তের ধান ওঠে ফলে – দুই পা ছড়ায়ে বস এইখানে পৃথিবীর কোলে। আকাশের মেঠো পথে থেমে ভেসে চলে চাঁদ অবসর আছে তার — অবোধের মতন আহ্লাদ আমাদের শেষ হবে যখন সে চলে যাবে পশ্চিমের পানে – এটুকু সময় তাই কেটে যাক রূপ আর কামনার গানে! ০৩. ফুরোনো ক্ষেতের গন্ধে এইখানে ভরেছে ভাঁড়ার; পৃথিবীর পথে গিয়ে কাজ নাই — কোনো কৃষকের মতো দরকার নাই দূরে মাঠে গিয়ে আর! রোধ — অবরোধ — ক্লেশ — কোলাহল শুনিবার নাহিকো সময় – জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোন্‌খানে কোথায় নতুন করে বেবিলন ভেঙে গুঁড়ো হয়! আমার চোখের পাশে আনিয়ো না সৈন্যদের মশালের আগুনের রঙ দামামা থামায়ে ফেল — পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ! এখানে নাহিকো কাজ — উৎসাহের ব্যথা নাই, উদ্যমের নাহিকো ভাবনা; এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা।

অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময়, পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়! সকল পড়ন্ত রোদ চারি দিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে, এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন – জেগে থেকে ঘুমবার সাধ ভালোবেসে। এখানে চকিত হতে হবে নাকো — ত্রস্ত হয়ে পড়িবার নাহিকো সময়; উদ্যমের ব্যথা নাই — এইখানে নাই আর উৎসাহের ভয়! এই খানে কাজ এসে জমে নাকো হাতে, মাথায় চিন্তার ব্যথা হয় না জমাতে! এখানে সৌন্দর্য এসে ধরিবে না হাত আর – রাখিবে না চোখ আর নয়নের পর; ভালোবাসা আসিবে না – জীবন্ত কৃমির কাজ এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার ভিতর! অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময় পৃথিবীর মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়; সকল পড়ন্ত রোদ চারি দিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে, গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে, এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।