আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খনার বচনের রাজনীতি-প্রথম পর্ব।

কতো কী করার আছে বাকি..................

দূর গাঁ থেকে আজ যারা এসেছে তাদের সমস্যা ধান চাষ নয়৷ পান-সুপারী, তাল, খেজুর গাছের ফল না ধরা বা ঝরে পড়ার সমস্যা৷ খনাবিবি একজনকে কাছে ডেকে বলে, 'শোনরে বাপু চাষার পো সুপারী বাগে মান্দার রো৷ মান্দার পাতা পচলে গোড়ায় ফড়ফড়াইয়া ফল বাড়ায়৷' লোকটির সঙ্গী প্রতিবাদ করে জানায়, 'অহন দ্যাশে আসছে লবণের দানার লাহান সাদা সাদা সার৷ সেই সার গাছের গোড়ায় দিলে মান্দার গাছের পচা পাতার চাইতে ও গুয়া বেশি ফলে৷' খনাবিবির দু'চোখ বড়বড় হয়ে ওঠে৷ মাথার ধবধবে পাকা চুলে আংগুল চালিয়ে আড়ষ্ট প্রায় জিহ্বাটা নাচতে নাচাতে বলে, 'যে না শোনে খনার বচন সংসারে তার চির পচন৷' হরপিদ দত্তরে দ্রাবিড় গ্রাম উপন্যাস থেকে নেয়া। গোটা উপন্যাসের আলোচনা এখন নয়। এখনকার আলোচনা খনাকে নিয়ে। খনা কে, এই আলোচনা অসম্পূর্ণ। কিন্তু খনাকে ভুলে আমরা গিয়েছি।

একেবারেই নাই করে দিয়েছি আমাদের নিজস্ব এই সাহিত্য, এই কৃষি বিজ্ঞানকে। খনা মস্পর্কিত কিছু আলোচনা পড়া যাক- ম্যাভেরিকের পোস্ট থেকে তাকে নিয়ে প্রচলিত নানা কাহিনী। এদের সাধারণ সুতোটি হচ্ছে, উপমহাদেশের প্রাচীন রাজ্য অবন্তী (Avanti) তথা উজ্জয়নের (Ujjain) রাজা হর্ষ-বিক্রমাদিত্যের (Harsha Vikramaditya) রাজপ্রাসাদে প্রধান জ্যোতির্বিদ ছিলেন বিখ্যাত পন্ডিত বরাহমিহির (Varahamihira), আনুমানিক ৫০০ খ্রীষ্টাব্দের কথা। বরাহমিহিরের পুত্র জন্মগ্রহণ করলে তিনি পুত্রের কোষ্ঠি (horoscope) বিচার করে প্রচন্ড ভয় পেয়ে যান। হিসেব করে দেখেন মাত্র এক বছরের মধ্যেই মারা যাবে তার প্রিয় শিশুপুত্র।

পিতা হয়ে পুত্রের মৃত্যু অসহায়ের মত অবলোকন করতে হবে আর ভয়ংকর দিনগুলি গণনা করে যেতে হবে, এই চিন্তা সহ্য করতে না পরে তিনি ভাসিয়ে দেন পুত্রকে, পাত্রে ভরে নদীর স্রোতে। অনেক দূরের এক রাজ্যে, নদী থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে রাক্ষস সম্প্রদায়। কিন্তু মারা যায় না শিশু, বড় হতে থাকে রাক্ষসদের মধ্যে। ষোল বছর বয়সে শাণিত বুদ্ধির এক রাক্ষস মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় সে, বিয়ে করে তাকে। মেয়েটি তার জ্যোতির্জ্ঞান প্রয়োগ করে জানতে পারে তার স্বামী মিহির উজ্জয়নের বিখ্যাত পন্ডিত বরাহমিহিরের পুত্র।

একদিন দুজন মিলে রওয়ানা দেয় উজ্জয়নের পথে। পুত্র-পুত্রবধুর পরিচয় পেয়ে রাজপ্রাসাদে তাদের গ্রহণ করেন বরাহ। কৃষিকাজে মেয়েটির ছিল অগাধ জ্ঞান আর গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিচার করে আবহাওয়ার চমৎকার পূর্বাভাস দিতে পারত সে। উজ্জয়নের কৃষকরা ব্যাপক উপকার লাভ করে তার কাছ থেকে, আর তা দেখে রাজা বিক্রমাদিত্য মেয়েটিকে তার রাজ্যের দশম রত্ন (tenth jewel) হিসেবে আখ্য দেন। খনা বি. জ্যোতিষ ও গণিতশাস্ত্রে পারদর্শিনী প্রাচীন বাংলার প্রখ্যাতা নারী, মিহিরের স্ত্রী।

খনার বচন শস্য বৃক্ষরোপণ গৃহনির্মাণ জ্যোতিষ প্রভৃতি সম্বন্ধে ছড়ার আকারে প্রচলিত বচন, যা খনার রচিত বলে প্রসিদ্ধ। বোবার বিজ্ঞান প্রচলিত গল্পে খনা ছিলেন লঙ্কাদ্বীপের রাজকুমারী। মতান্তরে রাক্ষসকবলিত কোনো এক রাজ্যের অনিন্দ্যসুন্দর রাজকুমারীর নাম ছিল লীলাবতী যিনি পরে খনা নামে পরিচিত হন। খনা অর্থ বোবা এবং জিহ্বা কর্তনের পর নামটি প্রতিষ্ঠা পায়। কথিত আছে, জ্যোতিষশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞানের ফলে খনা প্রায়ই রাজসভাতে আমন্ত্রিত হতেন।

ফলে প্রতিহিংসাপরায়ণ শ্বশুর বরাহ মিহির ছেলে মিহিরকে লীলাবতীর জিহ্বা কাটার নির্দেশ দেন। বাবার নির্দেশে মিহির খনার জিহ্বা কর্তন করেন। তবে গল্পমতে কথিত রাজকন্যা স্বামীর কাছে অনুরোধ করেন যে, জিহ্বা কর্তনের আগে কিছু বলতে চান। স্বামী অনুমতি দেন। এ সময় খনা আবাদ, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, যাত্রা, গবাদি, শস্যাদি, ফলাদি, গ্রহ-নক্ষত্রাদি সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত বচন দেন যা পরে খনার বচন নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়।

খনার বচন সবচেয়ে বেশি প্রচলিত কৃষক সামজে; যাদের কোনো লিখিত ভাষা নেই। মুখে মুখে প্রচলিত এসব ভাষা যুগ যুগ ধরে তাদের কৃষিকাজ এবং জীবনাচারে প্রভাবিত হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানীরা বিষয়টিকে সোজা চোখে না দেখলেও খনার বচন তার অবশ্যম্ভাব্যতা থেকে কক্ষচ্যুত হয়নি। বরং গ্রামের কৃষকরা বিজ্ঞানের ভাষার চেয়ে প্রবাদ-প্রবচনে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তবে অনেক বিজ্ঞজন খনার বচনকে আধুনিক বিজ্ঞান হিসেবে অভিহিত করতে গিয়ে প্রবচনগুলো খনার বিজ্ঞান হিসেবে অভিজ্ঞান করেন।

বচনগুলো অষ্টম অথবা নবম শতাব্দীতে রচিত। তবে আজো তা নির্ভুল ও সূক্ষ্মদৃষ্টিসম্পন্ন নীতিবাক্য হিসেবেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। খনাকে বিশ্লেষণের আরো পথ আছে- রণদীপম বসু বলেছেন আমাদের সাহিত্যের লৌকিক বাংলায় ছন্দের প্রথম দোলাটা প্রথম কাকে কখন কোথায় কীভাবে দিয়েছিলো তা জানার সুযোগ না হলেও ‘খনা’ নামের আড়ালে মূলত লোকায়ত জনভাষ্যগুলোই যে মৃত্তিকালগ্ন জীবনলগ্ন হয়ে বহুকাল যাবৎ আমাদের জনরুচিকে চটুল নৃত্যে দুলিয়ে এসেছে তা সহজেই অনুমেয়। উঠতে বসতে বিবাহে যাপনে ফসলে বুননে হাসিতে আড্ডায় দুঃখে কষ্টে এক কথায় বাঙালি জীবনের প্রতিটি স্পন্দনে শিক্ষণীয়, নিন্দনীয়, বিদ্রুপ কটাক্ষ বা নির্দোষ মজা করার যে শ্লোকগুলো এখনো ভেসে বেড়ায় গ্রামবাংলার লৌকিক জনপদে মুখে মুখে, এগুলোর রচয়িতার নাম কেউ না জানলেও এতে ছন্দের চমৎকারিত্ব, বুদ্ধির ঝিলিক আর জীবনঘনিষ্ট শব্দের আশ্চর্য শক্তিমত্তায় সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। ‘কলা রুয়ে না কেটো পাত/ তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।

অথবা ষোল চাষে মুলা/ তার অর্ধেক তুলা/ তার অর্ধেক ধান/ বিনা চাষে পান’ (খনার বচন)। আমাদেরই পূর্বপুরুষদের এই সৃষ্টিশীল উজ্জ্বলতাগুলো নিজস্ব ক্ষমতাশৈলীর জোরেই স্বমহিমায় টিকে আছে এখনো। শাসন করছে লোকায়ত মনোভূমিকে। এগুলোই বচন, শোলক বা ছড়া নামে সমধিক পরিচিত হয়ে আসছে। খুবই লক্ষণীয় যে, প্রায় সব ছড়াতেই আমাদের লৌকিক কবিরা স্বরবৃত্তের হালকা চটুল ছন্দ ব্যবহার করেছেন।

স্বরের স্বতঃস্ফূর্ত গতিদোলার সাথে স্বাভাবিক শ্বাসাঘাতের অনুরণনের মাধমে ছন্দশীল কথাগুলো প্রাকৃতিকভাবেই এগিয়ে যায় বলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ছন্দকে প্রাকৃতিক বা লৌকিক ছন্দ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। হালকা চালের এই ছড়াগুলোতে সমকালীন লোকজীবনের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকেও লোকায়ত জীবনধারার সাথে মিশিয়ে আশ্চর্য নিপুনতায় প্রকাশ করা হয়েছে। ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেবো কিসে?/ ধান ফুরুল, পান ফুরুল খাজনার উপায় কি?/ আর কটা দিন সবুর কর, রসুন বুনেছি। ’ কিশোরকবিতা’র কোষ্ঠীবিচার করতে হলে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত লৌকিক কবিদের এই লোকায়ত ধারাটিকে কিছুতেই ভুলে যাওয়া চলবে না আমাদের। খনার বিজ্ঞান।

সম্পাদনা: অরূপ রাহী ভারতীয় উপমহাদেশে যুগে যুগে নারী পণ্ডিতরা সম্মানিত হয়ে আসছেন। অপালা, বাক, গার্গী প্রমুখের ধারাবাহিকতায় আর একটি অমর নাম খনা। লোকজ জীবনের বিভিন্ন দিক, তথা কৃষি, রন্ধন, খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস, প্রাত্যাহিক, গৃহ-নির্মাণ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে খনার উপলব্ধি অসাধারণ। পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক পাণ্ডিত্য যেভাবেই আমরা ব্যাখ্যা করি না কেন খনা'র সমান মর্মদৃষ্টি একালেও অনেক পণ্ডিতের মধ্যে বিরল। লেখকের মতে "অনেকের মতে, খনা কেবল 'লোকবচন' বা 'লোকশাস্ত্র'।

খনার কাজকে বিজ্ঞানের চর্চা বলতে অনেকে নারাজ। আমরা খনার কাজকে বিজ্ঞান বলতে চাই। খনা কেন বিজ্ঞান? বিজ্ঞান বিষয়ে লম্বা তর্কে এখানে ঢোকার সুযোগ নেই। আমরা এখানে শুধু এটুকু বলতে চাই, খনা বিজ্ঞান এই জন্য যে তার চর্চার একটা বিকাশশীল পদ্ধতি আছে। খনা বিজ্ঞান এই জন্য যে তা সামান্য ও বিশেষ জ্ঞান উৎপাদন করে।

খনা বিজ্ঞান এই জন্য যে তা সামান্য ও বিশেষ সত্য উৎপাদন করে। " খেয়াল করুন সমস্তই সাধারণের জীবন ঘনিষ্ঠ। জলকাদা সম্ভূত। অসংখ্য খনার বচন আমাদের কৃষিজ জীবনের কথা বলে। যা থেকে আমাদের শিল্প-অর্থনীতি দৈনন্দিন জীবন বিচ্ছিন্ন।

আর সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সেই মানুষগুলো আর তাদের সাহিত্যরস হারিয়ে যাচ্ছে। এই লিখার মূল উদ্দেশ্য খনার রাজনৈতিক গুরুত্ব উপলব্ধি। আগামী পর্বে এই বিষয়ে আলোচনার আশা রাখি। ডাক বচনও আছে। পরবর্তীতে তাও আলোচনার অংশ হবে।

ডাকের বচন খনার বচন আমরা জানি। কিন্তু ডাকের বচনকে অতটা চিনিনা। অথচ ডাকের বচন এককালে বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল। কৃষক ও বউঝিরা এই বচনগুলোকে কণ্ঠস্থ করে রাখতেন। তবে খনার বচন বেশি প্রচলিত বলে তার ভাষা কালক্রমে সহজ হয়ে গেছে।

কিন্তু ডাকের বচন অতটা প্রখ্যাত হয় নি বলে তার ভাষার প্রাচীনতা অনেকাংশেই রক্ষা পেয়েছে। 'ডাক' কোন ব্যক্তিবিশেষের নাম নাও হতে পারে। হয়ত একাধিক ব্যক্তি কালক্রমে বিশেষ জ্ঞানের যে পদগুলো রচনা করেছেন তাকেই ডাকের বচন বলা হয়। ডাক শব্দটি ডাকিনী শব্দের পুংলিঙ্গ হতে পারে। মধ্যযুগে বা প্রাচীন যুগে জ্ঞানী ব্যক্তিরা আধিভৌতিক শক্তির অধিকারী ছিলেন বলে অনেকে মনে করেন।

"চলিত কথা' অর্থেও ডাকের বচন কথাটি প্রযুক্ত হতে পারে। দীনেশচন্দ্র সেন অবশ্য ডাক'কে বঙ্গের সক্রেতীস্‌ বলেছেন। (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, ১ম খণ্ড, ১৯৯৬, পৃ. ৯৪) খনা কৃষক ও গ্রহনক্ষত্র বিষয়ে পণ্ডিত ছিলেন। তার বচনগুলির বেশিরভাগ কৃষিকাজ ও ভাগ্যগণনা সম্পর্কিত। কিন্তু ডাকের বচন কিছুটা ভিন্নরকম।

এখানে মানব-চরিত্রের বিভিন্ন দিককে কখনও নির্মোহ কখনও বা সরাসরি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মানবজীবনের সারাৎসার ডাকের বচনগুলির অন্যতম আলোচ্য বিষয়। ধারণা করা হয় এই ডাকের বচনগুলি ৮০০-১২০০ খৃস্টাব্দের মধ্যে রচিত হয়েছিল। ডাকের বচনের একটি উদাহরণ ক) ঘরে আখা বাইরে রাঁধে। অল্প কেশ ফুলাইয়া বাঁধে।

। ঘন ঘন চায় উলটি ঘাড়। ডাক বলে এ নারী ঘর উজার। । আগামী পর্বে খনার বচনের রাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হবে।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।