আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবনে যা পড়েছি-৪ (তারাশংকরের কবি)

সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত...............।

তখনও স্কুলের গন্ডি পার হইনি। নাইন-টেন হবে। হুমায়ুন আহমেদের নামকরা উপন্যাস "কবি" হাতের কাছে পেয়েই পড়ে ফেললাম। কী দারুণ! আতাহারের কবি জীবন আন্দোলিত করেছিল আমার কিশোর মন।

(ভাবছেন, ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি?) এর অনেক অনেক দিন পর। হাতে এল আরেক "কবি"- এ কবি তারাশংকরের। সেমিষ্টার ফাইনালের তারিখ পড়েছে। কিসের কী! গোগ্রাসে গিলে তবেই শান্তি! এবং সত্যিকার অর্থেই, এর পর হতে আমি হুমায়ুন আহমেদের বই সচেতন ভাবে এড়িয়ে চলতে শুরু করলাম! উপন্যাস কেমন করে লিখতে হয়, কেমন করে একটি কবি মানস গড়ে ওঠে- তা যেন তারাশংকর আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। কবি আতাহার, কবি নিতাইচরণের চরণের ধূলিসম যেন! মূল ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত।

অট্টহাস গ্রামে নিন্মবর্ণের ডাকাত বংশে জন্ম নেয়া নিতাইচরণ বাহ্যিক অবয়বে চার পুরুষের ঘৃনিত উত্তরাধিকার বহন করেও তার অন্তঃকরণে পরম যত্নে লালন করে চলছে সুকুমার মানবীয় বৃত্তিগুলোকে। কমবয়সে সামান্য পড়ালেখার ছোঁয়াই বদলে দিয়েছিল তার জীবন। ফলে, পূর্বপুরুষের ঘৃণিত পেশায় (খুনীর দৌহিত্র,ডাকাতের ভাগিনেয়, ঠ্যাঙাড়ের পৌত্র, সিঁদেল চোরের পুত্র ) জীবিকাধারণে অস্বীকৃতি তাকে কূলহারা করে রেলস্টেশনে কুলিগিরিতে বাধ্য করে। সেখানে, স্টেশনের পয়েন্টসম্যান রাজালাল তার একান্ত সুহৃদ ও আশ্রয়দাতা। এমনি একদিন ঘটনাক্রমে গ্রাম্যমেলার কবি আসরে সুযোগ পেয়ে নাম কামিয়ে ফেলে নিতাই।

সেই সাথে রাজালালের শ্যালিকা পার্শ্ববর্তী গাঁয়ের কৃষ্ণকায়া (দীঘল দেহভঙ্গিতে ভুঁইচাঁপার সবুজ সরল ডাঁটার মতো অপরূপশ্রী ) কূলবধু ঠাকুরঝি (উপন্যাসে এ নামেই তার পরিচিতি) আর নিতাইয়ের মাঝে গড়ে ওঠে এক অপার্থিব প্রেম- নিছক দেহজ প্রেম যার সন্ধান পায় না কখনো !কবিমনে বাসা বাঁধে ভালবাসার পঙক্তিমালা। "কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দ ক্যানে?" কিন্তু, সে সুখ বেশীদিন সয় না। সামাজিক রীতিবিরুদ্ধ এ প্রেম জানাজানি হয়ে গেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে ঠাকুরঝি। অপবাদ মাথায় নিয়ে গাঁ ছাড়ে নিতাই। যাবার আগে রাজাকে আশ্বস্থ করে যায় যে সে ঠাকুরঝিকে নষ্ট করে নি।

এর মাঝে গাঁয়েই পরিচিত হওয়া এক যাযাবর ঝুমুর দলের সাথে ঘনিষ্টতা হয়েছিল নিতাইয়ের। ঝুমুর দলে সেইসব মেয়েদের বাস, অশ্লীল নৃত্য-গীত আর আত্মবিক্রয়ই যাদের প্রধান জীবিকা। সেই ঝুমুর দলের কবিয়াল হিসেবে যোগ দেয় সে। জড়িয়ে পড়ে আরেক নতুন সম্পর্কে। ঝুমুর দলের ( দীর্ঘ কৃশতনু গৌরঙ্গী ) মেয়ে বসন্ত (বসন)এসে তার হৃদয়ে বাসা বাঁধে।

ঠাকুরঝিকে ভুলে যেতে সেও বাধা দেয় না। কবিমন পেয়ে যায় স্বাধীনভাবে সাধনার সুযোগ। অনর্গল কাব্যরসে ভেসে যায় নিতাই। সে হয়ে ওঠে 'বসন্তের কোকিল'! "তোমার চোখে জল দেখিলে সারা ভূবন আঁধার দেখি, তুমি আমার প্রানের অধিক জেনেও তাহা জান নাকি?" এতে, চিরকাল ধরে আত্মনিপীড়নে অভ্যস্থ ক্ষয়রোগী বসনের মনে আবার জেগে ওঠে বেঁচে থাকার সাধ। সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে সে নিতাইকে ঘিরে রাখতে চায়।

কিন্তু, বিধি আবার বাগড়া দিয়ে বসে। কোন কুক্ষনে নিতাইয়ের মন গেয়ে ওঠে- "হায়- জীবন এত ছোট কেনে? এ ভূবনে?" সেদিনই বুঝি মরণের ডাক শোনে বসন? অনেক দিনের রোগে ভুগে নিতাইয়ের কোলে মাথা রেখেই মারা যায় সে। শ্মশানে যখন বসনের দেহ পুড়ে সর্বভূতে লীন হল, তখনি ঝুমুর দলের সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে নিতাই আবার অজানা পথের পথিক হয়ে গেল। মাসাধিককাল উন্মাদের মত এদিক-ওদিক ঘুরে তীর্থ করেও তার মন ভরে না। অদৃশ্য কার অমোঘ আহবানে যেন তার সাড়া দিতেই হয়! নিতাই বুঝে ফেলে তার গ্রাম অট্টহাস, তার ঠাকুরঝি তাকে ডেকে চলেছে।

অতএব, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসে। যথারীতি রাজালালের ঘরই হয় তার আশ্রয়স্থল। রাজালাল তাকে জানায় ঠাকুরঝিও আর নেই। নিতাইয়ের বিরহ সে অভাগিনীকেও মরণের ওপারে ডেকে নিয়ে গিয়েছে! পাথর হয়ে যায় সে। হৃদয়ের অবিরল রক্তক্ষরণ যেন অবশেষে তাকে গ্রাম্য কবিয়াল থেকে কবির পর্যায়ে উন্নীত করে।

সে গেয়ে চলে- "এই খেদ আমার মনে ভালবেসে মিটল না সাধ, কুলাল না জীবনে! হায়- জীবন এত ছোট কেনে? এ ভূবনে?" সত্যিকথা বলতে কী , তারাশংকরের ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা আর মানবমনের অনুভূতির উপর তাঁর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুসন্ধানী দৃষ্টি ‘কবি’কে দিয়েছে অমরতা। প্রথম প্রকাশের (১৯৪২) সাত দশক পরেও এর আবেদন যেন একটুও কমে নি। ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে এর হীরকজয়ন্তী সংস্করণ। বস্তুতঃ রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের বাংলাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই ঔপন্যাসিকের (অন্যেরা হলেন শরৎ-বিভূতি-মানিক) শ্রেষ্ঠতম কীর্তি "কবি"। এক কূলবধু আর এর বারাঙ্গনা- এই দুই ভিন্নস্বভাবা নারী যেন বাহ্যিক পরিচয়কে ছাপিয়ে নিতাইয়ের কবিমানসে চিরন্তন নারী, চিন্তরন প্রেমিকার আসনে বসে তাকে কবিপদে অভিসিক্ত করেছে আর সেই সাথে "কবি" উপন্যাসকে দিয়েছে ক্লাসিকের মর্যাদা! বিদ্রোহী কবি নজরুল একজন কবির পরিচয় দিতে গিয়ে ("যৌবনের গান" কথিকা দ্রষ্টব্য) তাকে সেই পাখির সাথে তুলনা করেছিলেন গানই যার ধর্ম ও কর্ম।

তার হাসিতে গান, কান্নায় গান; জীবনভর গানই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। সে গানে কোন নিদ্রাতুরের অসময়ের নিদ্রা কখন ভঙ্গ হল তাতে পাখির কী পরোয়া! জীবনের শেষ অভিভাষনে তিনি বলেছিলেন, "কবি চায় না দান, কবি চায় অঞ্জলী, কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। " যখনি কবি নিতাইচরণের কথা ভাবি, মনে হয় নজরুল ঐ দু'লাইনে যা বলেছেন, তারাশংকর যেন এই গোটা এক উপন্যাস ধরে বলেছেন সে কথা! যাঁরা এ উপন্যাস পড়েছেন কেবল তাঁরাই জানেন অপড়ুয়ারা কী হতে বঞ্চিত থেকেই চলছেন জীবনের পথ! ধন্যবাদ। জীবনে যা পড়েছি-৩ (পথের পাঁচালী) জীবনে যা পড়েছি-২ (লোটাকম্বল) জীবনে যা পড়েছি-১ (লা মিজারেবল)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।