আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবিতার তৃতীয় বাংলা: আরশিতে আর্দ্র আরক



কবিতার তৃতীয় বাংলা: আরশিতে আর্দ্র আরক ফকির ইলিয়াস ------------------------------------------------------------------- কবিতার সূর্যোদয়কে ভালোবেসে আমরা তার পাশে দাঁড়াই। কবির কালিক অবস্থান তখন আমাদেরকে স্পর্শ করে খুব ঘনিষ্ট ভাবে। যে চারপাশকে ধারণ করে কবি লিখছেন তার প্রত্যয় পংক্তি- সেই ভূমি চিত্রটি কেমন? কেমন করে বেড়ে উঠছে সেই মাটির প্রজন্ম। তা জানার জন্যও আমরা ক্রমশঃ আগ্রহান্বিত হই। ২০০৯ এর একুশে বইমেলায় তেমনি মাটিচিত্রটিকে ধারণ করে একটি কাব্য সংকলন বেরিয়েছে।

''তৃতীয় বাংলার নির্বাচিত কবি ও কবিতা''। সম্পাদনা করেছেন কবি আবু মকসুদ। তৃতীয় বাংলা কোথায়? এই প্রশ্নটি যে কেউ করতেই পারেন। হ্যাঁ, গ্রেট বৃটেন- যেখানে বাঙালি প্রজন্মের কয়েক পুরুষের বসতি, সেই ভূমিকেই এখন বলা হচ্ছে তৃতীয় বাংলা। সন্দেহ নেই বৃটেনে বাঙালি অভিবাসীরা বেড়ে উঠেছেন সুসংহতভাবে।

মিশন এবং ভিশন নিয়ে এগুচ্ছে বলীয়ান প্রজন্ম। তা তো আশা জাগানিয়া বটেই। কারণ বিদেশ বিজনে নিজ সাহিত্য সংস্কৃতির প্রখরতা কে ছড়িয়ে দেবার যে বাসনা-তা তো শক্তিমানরাই করতে পারেন। তৃতীয় বাংলা তথা ইংল্যান্ডে বসে যারা বাংলা কবিতা চর্চার নিরীক্ষণ করছেন নিয়মিত, তাদের মধ্য থেকে বিশজন কবির কবিতা স্থান পেয়েছে এই সংকলনে। প্রত্যেক কবির ছ’টি করে কবিতা আছে গ্রন্থটিতে।

লেখা স্থান পেয়েছে কবির নামের আদ্যক্ষরের ধারাবাহিকতা অনুসারে। একজন কবি তার কবিতায় কি বলতে চেয়েছেন, আর একজন পাঠক তা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণ করবেন- তা নিয়ে ভিন্নমত থাকতেই পারে। কারণ সবার দেখার যোগ্যতা এবং প্রানশক্তি সমান নয়। আবার কোনো কবি মহাকাল স্পর্শ করতে পারবেন কি না- তা নিয়েও হতে পারে দীর্ঘ বিতর্ক। মনে পড়ছে মার্কিন কবি জেমস্ টেট এক আড্ডায় বলেছিলেন- আমি যদি সমকাল কেই আমার কবিতায় ধারণ করতে না পারি- তাহলে মহাকালকে স্পর্শ করার বাসনা তো দিবাস্বপ্ন মাত্র।

তার কথাটি এখনো আমার কানে বাজে। আমি এটা মানি এবং বিশ্বাস করি, পঠন-পাঠন মানুষকে জ্ঞানের আলোতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। খুলে দেয় অন্যনয়ন। কিন্তু যারা প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরকে শিক্ষা দিয়ে যান- তারা? তারা তো পড়েন নি অনেক কিছুই। তারপরও পড়াবার যোগ্যতা পেলেন কিভাবে? এ প্রসঙ্গে এলেই রবীন্দ্রনাথ আবারও আমাদের মানসে নমস্য হয়ে উঠেন।

‘তৃতীয় বাংলার নির্বাচিত কবি ও কবিতা’ সংকলনটিতে কবিদের পরিচিতি, ছবিও যুক্ত হয়েছে। একজন পাঠক জানতে পারবেন কবির শিকড় সম্পর্কে। এই যে শিকড়কে পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্ব তা একজন সম্পাদক করেছেন সৃজনশীল উদ্দেশ্যবোধ থেকে। কারণ আজ থেকে দু’শ বছর পর কেউ একজন এই গ্রন্থটি হাতে নিয়ে জানতে পারবে কবি সম্পর্কেও। কোন গবেষক উদ্ধৃতি দেবার প্রয়োজনে, খুঁজে পাবেন একজন অভিবাসী কবির আদি ঠিকানা।

দুই এই সংকলনে যাদের কবিতা স্থান পেয়েছে, এরা কেউ নবীন। কেউ বহুল পঠিত কবি। কেউ রাজনীতিসচেতন উদ্যমী। আবার পাশাপাশি, শালুক ভেজা ভোরের মতো কোমল হৃদয়ের অধিকারী। হ্যাঁ, তাদের কবিতা সে সাক্ষ্যই দিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর।

প্রখর চেতনাবাদী কবি শাহ শামীম আহমেদ এর ‘আত্মপরিচয়’ কবিতাটি পাঠে তা আমরা অনুধাবন করতে পারি খুব সহজে। যাই- শূন্য থেকে শূন্যে ভেসে যাই চাঁদের শরীর থেকে পান করি জ্যোৎস্নার মদ কল্পলোক থেকে তুলে আনি মুঠো মুঠো স্বপ্নের কণা আমি তো কেউ না- হাতে কিছু নাই [আত্মপরিচয়/শাহ শামীম আহমেদ] স্বপ্নগুলোকে প্রতিদিন বাজী রেখে যে মানুষ নিরন্তর সংগ্রাম করে যান তার নামই কবি। এখানে উচ্চকন্ঠ‌ হবার সুযোগ না থাকলেও রয়েছে ভাবনার শিখরতা আর প্রত্যয়ের চূড়া ছুঁয়ে দেখার পর্যবেক্ষণ। থেকেই যায় প্রতিক্ষণ। কবি আতাউর রহমান মিলাদ যদিও এটাকে ‘খুচরো জীবন’ বলে আখ্যায়িত করেন আমি বলি পরিপূর্ণ আয়নাচূর্ণ।

কারণ যে আয়নাটিতে প্রতিদিন মুখ দেখতাম আমি, তা ভেঙে গেলেও স্মৃতিমুখটুকু চিরদিন সজীব এবং প্রাণবন্তই থেকে যায়। আত্মপক্ষ সমর্থিত নাগরিকবৃন্ধ। কে কার প্রতিপক্ষ যায় না বুঝা। লব্ধ ঋণে। দূরের ধোয়া।

নির্ণয় করি আগুনের জন্মতিথি। পোড়া স্বভাবে মাতি বেঁচে থাকার তীব্র আয়োজনে। [খুচরো জীবন/আতাউর রহমান মিলাদ] ঠিক একইভাবে নির্ণয়ের দ্রাঘিমাকে কাছে টেনে ঘুমহারা পাখি জীবন বেছে নিতে পারেন সেই কবিই। গন্তব্য কিংবা অবস্থান তখন তার কাছে মুখ্য না হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার কর্মযজ্ঞই প্রধান আরাধ্য হয়ে উঠে। অগনন দিন যায় বেদনার শলাকা পড়ে বিদ্যমান শব্দেরা শুধু উলঙ্গঁ-নৃত্য করে ঘরময় ওহে চঞ্চল এই বহমান কালে তুমি কেন আর আঁচলে জড়াও একবার উড়িয়ে দেখো উদ্দেশ্যহীন নায়ের বাদাম যে পথে রচিবে কেবল বিদ্যমান সোনার হরফ।

[সংসার/আহমদ ময়েজ] এভাবে উত্তাপের উজানে দাঁড়িয়ে তৃতীয় বাংলার বসতি আর প্রতিবেশী রচনা করতে চেয়েছেন যে সব কবিরা তারা বার বারই নিবদ্ধ হয়েছেন সেই বাংলার আঁচলে, যে বাংলা মাতৃরূপ প্রতিদিন তার সন্তানদেরকে ডাকে দুহাত বাড়িয়ে। একটি সত্য খুব স্পষ্ট, যাদের কবিতা এই গ্রহে স্থান পেয়েছে এরা সবাই বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হয়েছেন বাংলামাটির সোঁদা গন্ধ বুকে ধারণ করেই। ফলে বাংলাদেশের প্রকৃতি, সমাজ-জীবন, প্রেম, বিরহ, জীবন ও নগরের দ্যোতনা অংকিত হয়েছে তাদের কবিতায়। এখানে বহুমাত্রিক কিছু পংক্তি তুলে দেয়া যেতে পারে। ক. ঐ যে দেখছো একজোড়া ডাগর চোখ এখানেই থাকে যতোসব স্বপ্নের আকর পোশাক ভেদ করে পুঙ্খানুপঙ্খ তোমাকে দেখার দূরদৃষ্টি।

[কবির আবক্ষ ছবি/ আবদুল কাইয়ুম] খ. নয়মাসে ত্রিশ লাখ গোলাপ প্রতিবাদে আত্মাহুতি দিয়ে বিজয় এনেছে-ইতিহাস জানা যায়নি কোথাও কোনো কালে তোমাদের প্রেরণায় বিশ্বময় ঋতুময় বাংলাদেশ [আমার মাত্র ষাট সেকেন্ড শুধু তোমাদের জন্য/ আনোয়ারুল ইসলাম অভি] গ. ঝম্ ঝম্ পদ্যময় জীবনের প্রার্থনা ওদের বুকে মৃত কোথায় সেই প্রার্থনা গান? আকাশহীন এই ভূমি বীরেরাতো সব মাটিতেই আছে কাপুরুষ কেবল আঁকেনি আজও মনের দেয়ালে ছবি [ঝরাপাতার মতো/ ইকবাল হোসেন বুলবুল] ঘ. মহাকালের পাড়ে সুরমার জলও জরুরী বিষয়-সাঁকো হয় মউজদীনসাহিত্যঘাট। নেমে আসো হে, নদীর মোহনা'দি কেটে যাও দৃশ্যান্তরে-হাওর-বাওর ঘেটে জল-তরী পেরিয়ে কাব্যদানার মতো তুমি আছো মাটিতে মিশে। [অনুভূতির স্মরণ সকাশে (কবি মমিনুল মউজদীনকে) ওয়ালি মাহমুদ] ঙ. তুমি যখন বাদল হয়ে আগলে রাখো মৃত্তিকাকে তুমি যখন ছায়াতরু হয়ে ধরে রাখো দুপুরের নির্জনতা তুমি যখন পিতা হয়ে এক জাতির সামনে তুলে ধর তার পতাকা তখন বেদনায়ও রাঙা হয় মন... [পরিচয়/খাতুনে জান্নাত] সংকলনটির কবিতাগুলোতে কবিরা তাদের চিত্রকল্পের বুনন নির্মাণ করেছেন খুব নিজস্বতায়। দেখার পার্থক্য, ভাবনার তৃতীয় কিংবা চতুর্থ সত্তা নিয়ে আঁচড়ে বিশিষ্টতা তাই পরখ করতে কষ্ট হয় না। গন্তব্য গোলক সব কবিরই এক।

তারপরও যাত্রাপথের বাছাই ভিন্ন। আর এভাবেই মিলিত হয়ে যাচ্ছে কবিতার বিশ্বমোহনা। তিন যদি মহাকালের চিহ্নিত করণের কথাই বলি, তবে মুগ্ধতায় লেখা হবে তারই নাম যিনি সমবায়ী কবি। আমি একটি কথা সবসময়ই স্পষ্ট করে বলি, কবিতা নিয়ে আমি কখনওই হতাশ নই। নই কবি নিয়েও আমার কোন হতাশা।

কারণ চিশ্বভ্রমাণ্ড টি বড় বৃহৎ স্থান। এখানে খুদ্ দানা খুটে খাবার অধিকার প্রতিটি প্রাণীরই আছে। ভাষাব্যঞ্জনার মাঠে তাই শব্দ নিয়ে খেলে যাবার অধিকারও আছে সকল কবির। আমি আবারো সজোরে দরোজায় কড়া নাড়ি যখন দেখি আমার সতীর্থ কবি বলছেন, যখন স্পর্শসুখে ফুটিয়েছি ফুলকুঁড়ি ফুল আবির মাখিয়েছি, উজ্জীবনের রঙে রাঙিয়েছি জীবনের ঘাস অনন্ত অসুখে মোড়া জীবনে দূরে ঠৈলেছি সিরাপের শিশি শ্যাওলা, আবছা অন্ধকূপ মাড়িয়েছি নীরবতায় কষ্টের বিছানা ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছি উৎসারিত আলোয় হারিয়ে ফেলিনি কৃষ্ণমেঘে নক্ষত্রের দিন নির্দেশনা [সূর্যসমবায়ে/আবু মকসুদ] বাহ! কি চমৎকার আলোর ঝলক। কৃষ্ণমেঘে যে কবি নক্ষত্রের দিকদিশা হারান না, তিনিই তো প্রকৃত নাবিক।

কবিতার বিশাল জাহাজ তার হাতে সুনিয়মের নিরাপত্তা পাবে- আমরা সে ভরসা করতেই পারি। কবিতায় অস্তিত্বের অন্বেষণ একটি প্রধান বিষয়। এই ধারাবাহিকতা সংরক্ষণে একজন কবি যখন মৌলিকতার সংযোজন ঘটান তখন তার পরিচয় হয়ে উঠে ভিন্নমাত্রার। কবি মুজিব ইরম তার কবিতায় আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার করছেন দীর্ঘদিন থেকে। বাউল কিংবা মরমী গানের ধারায় নিজের নাম যুক্ত করে গীতিকবিতা লেখার ঐতিহ্য শত শত বছরের।

মুজিব ইরম সেই ধারাকে আধুনিক কবিতায় নবরূপায়ন দিয়েছেন। মানুষ কেবলি ভুলে যায় নিজ সাং, নিজস্ব আয়াত। তারপর ঘুরেফিরে পঞ্চনদী-নিজের নিকটে এসে ধরা পড়ে যথার্থ নিয়মে। আজ এ ভোরবেলায় এ বড়ো সত্য বানী ভাবিলো ইরমে। [সাং নালিহুরী/মুজিব ইরম] চিহ্নগুলো রেখে যাবার আকুলতা কোন হৃদয়ের মাঝে নেই? সবাই-ই চায় তার স্মৃতিটুকু ধরে রাখুক এই মহান মাটি।

আর তাই শুরুর প্রস্তুতি নিয়ে কবির আকুতি আমরা শুনি ঠিক এভাবেই... তবে এইভাবে শুরু হোক রঙহীন অযাচিত দিন এসো নতজানু হই প্রগলভ সময়ের কাছে একহাতে কৌপিন অন্যহাত সিক্ত শিশিরের জলে তুমি তো নামহীন-গোত্রচ্যুত তুমি তো কখনোই ছিলে না কুলীন পথের সাথেই হোক তবে সখ্যতা [পদচিহ্ন/রেজওয়ান মারুফ] কবিতায় ‘জীবন’এর অনুষঙ্গঁ আর ‘প্রেম’ এর বেদনাকে খুঁড়ে দেখার যে প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করি-তা একটি সর্বময় শক্তি যোগায় আমাদের মনে। আমরা, একটি মানুষ যেভাবে কবি হয়ে উঠি তার অনন্ত সাক্ষ্য এই গাছপালা, নদী-নালা। কারণ একটি সবুজ বৃক্ষকে সামনে রেখে নির্জন আরাধনা, অথবা একটি নদীর প্রস্থান দৃশ্য দেখতে দেখতে ঢেউয়ের সাম্রাজ্যে হারিয়ে যাবার পৃথক আনন্দ আছে। আর সমাজের দানবিক শক্তির বিরুদ্ধে হুংকার দেবার সাহস! তাও এক অনাবিল প্রশান্তির নাম। কবিতায় সামাজিক অনাচারের প্রতিবাদ করা সেজন্যই হয়ে উঠে একজন কবির নৈতিক দায়িত্ব।

এমন স্থিরচিত্রের উৎসমূল আমরা পাই এই সংকলনের বেশ কিছু কবিতায়। চ. একটা পুরনো গল্পের শুরুটা এমন, কালো এক সোমত্থ শরীরকে টেনে হিচঁড়ে নিয়ে গিয়ে অসীম ভোগ শেষে টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এক বিস্তীর্ণ এলাকায় তারপর থেকে সেখানকার মাটির রং লাল, কাল শরীরের ধমনীতেও যে লাল স্রোত ছিল সে কথা অজানা ছিল দীর্ঘদিন, তবু মেয়েটা ছড়িয়ে রেখেছিল তার দু’পা, একদিন কর্ষণে উঠে এলো উর্বরতা, লাল মাটির ভেতরেই লুকানো ছিল জীবন। [এক থোকা রাত্রের জন্য অপেক্ষা-৫/মাসুদা ভাট্টি] ছ. দুঃখ বিলাসী নদী তুমি হয়ে উঠো তোমার মত তোমার অস্থিত্বের অহংকার এখনো শান দেয়া ছোরার মতো ধারালো। যা কিনা তোমাকে করবে অনেক বেশী দুঃখ বিলাসী। যে দুঃখ অনেক বেশী পাওয়ার, যে দুঃখ অনেক শুদ্ধ ভালোবাসার।

[নদী দুঃখ বিলাসী/মিলটন রহমান] জ. আমার ইচ্ছেগুলি দৌড়াতে দৌড়াতে কতটি মাইল ফলক-অতিক্রম করে গেলে আর কত যে রোদ্রছায়া বৃষ্টিভেজা পথ ঠেলে তোমার প্রস্ফুটিত হৃদয়কমলের স্পর্শটুকু দিয়ে যাবে [গাণিতিক বিকাশ/মুজিব রহমান] ঝ. অতঃপর কালান্তরে রুগ্ন সায়াহ্নে স্বীকৃতি দাবী নির্লজ্জ কুমার পিতার দাম্ভিক স্বীকারোক্তি কৃষাম্বরে আবৃত্ত এ আমার আপন অনুতাপ এ আমার শুক্রানুতে অনাকাঙ্খি বেড়ে ওঠা আমারই অসংযমী বেপরোয়া বেহিসেবী দেহবিলাস [পুরুষানুতাপ/তাবাসসুম ফেরদৌস] অনুপ্রাস আর উৎপ্রেক্ষার রোদ নিয়ে এই সংকলনের প্রতিটি কবিতা খুঁজতে চেয়েছে ধ্যানী ঋজুরেখা। যা এসময় বাংলা কবিতার প্রবাহের সাথে খুব নিবিষ্ট পাঠে মিলিয়ে দেখার দাবী রাখে। এক সময় ছিল প্রবাসী কবিদের কবিতা দেখলে ঢাকার কোন সাহিত্যমোদেী প্রথমে কিছুটা থমকে যেতেন। এবং প্রবাসী কবিতাকর্মীদেরকে দেখা হতো অনেকটা ‘কাঁচা’ হিসেবে। এনিয়ে নিকটঅতীতে বিতর্কও কম হয়নি।

এই গ্রন্থটি তা খণ্ডন করতে মূল্যবান দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে। পাখীদের গ্রামে রংধনু মেলা বসতো, পাখিরা জলজ আনন্দে মেলায় কাটতো সাঁতার। [পাখির মেলায়/কাজল রশীদ] অথবা; মুখের আদল ভেঙে গেলে চেনাহীন সুখগান ফিরে ফিরে আসে তার গভীরে বাজে চাপাচাপা সুর, মাদল মাদল গান গেয়ে যায়-এ আমার পৃথিবী, এ আমার সুখতান [মুখ ও মুখের আদল/শাহনাজ সুলতানা] এমন চিত্রকল্প আর উপমাগুলো মনে করিয়ে দেয় শ্রাবণের কণ্ঠহার হয়ে বাংলাদেশ থেকেই যাচ্ছে একজন প্রাসী কবির মননে জাগ্রত হয়ে। চার. জলের অলিন্দে বসে কবিতার পান্থনিবাস নির্মাণ করেন কবি ফারুক আহমেদ রনি। তার কবিতঅয় প্রেম ও দ্রোহের উন্মীলন লক্ষ্য করি সমানভাবে।

মাধবী, এই জরাজীর্ণ উদাসীনার দোহাই নষ্ট প্রতিক্রিয়া আর নিরুদ্দেশের ম্লান পদচ্ছায়া অতিক্রম করে তুমি ভূকম্পনে প্রলোভিত হও সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে যুগল নক্ষত্রের মতো নিষ্পলিক কবিদের ব্যবচ্ছেদ করো। [মাধবী তোমার জন্য/ফারুক আহমেদ রনি] বৃটেনের কাব্যাঙ্গঁকে সমৃদ্ধ করতে গেল দুই দশকে অনেক নতুন মুখ এগিয়ে এসেছেন। তারা সমৃদ্ধ করেছেন কবিতার আর্দ্র আরকে টেমস নদীর পাড়। এই নিবন্ধের শেষপ্রান্তে এসে তেমনি দুজন মেধাবী কবির নাম আমি নিতে চাই গরিমার সাথে, যাদের কবিতা এই সংকলনে স্থান পেয়েছে। তাদের একজন সৈয়দ রুম্মান আর অন্যজন সৈয়দ আফসার।

বাংলা কবিতায় সৈয়দ রুম্মানের চৈতন্য পরিধি আমাকে ব্যাপক আশান্বিত করেছে। তার ছ’টি কবিতার প্রতিটিই পরিপুষ্ট ফালগুনের কৃষ্ণচূড়ার মতো। আমার কাছে মনে হয়েছে। বিশাল অধ্যবসায়পর্ব সেরেই, কবিতার জমিনে কর্ষণপর্ব শুরু করেছেন সৈয়দ রুম্মান। পড়া যাক তার ক’টি পংক্তি... একাকী গায়েন গেছে মিলনের টানে অগ্নিঝরা রোদে কত পুড়ায়ে আবীর দেখেছি কেবল যাওয়া সেকি আহ্বানে, মিহিধ্যানে দ্যায় সাড়া বানভাসি নীড়।

[বানভাসি নীড়/সৈয়দ রুম্মান] আর সৈয়দ আফসার এর কবিতা পড়ে মনে হয়েছে এক নিটোল প্রেমতৃষ্ণার মোহ রাঙিয়ে গেছে তার মনীষা। তিনি এক হাত রেখেছেন বরফে আর অন্যহাত আগুনে। যার সংম্রিশণ দিয়েছে পাঠককে এক নেশাঘোর। নারীর ঠোঁটের গন্ধ মানে ভিন্ন আমেজ, লাজ ঢাকতে চোখে লাগিয়েছি সুর্মা যতবার এগিয়েছো তুমি নতজানু হয়েছি, ততবার, কে তবে ছিল দায়হীন রঙিন ঠোঁটে জ্বালাতন বাড়ে-স্মৃতি ডালায় পেতেছি ৯ই মার্চ এবার করো ক্ষমা আল মাহমুদের 'সোনার দিনার নেই', চুম্বন ছাড়া কিছুই পাবে না কোনোদিন [মিলেমিশে-৩/সৈয়দ আফসার] পাঁচ. ‘নির্বাচিত কবিতা’র অর্থ এই নয় যে, এটাই শেষ নির্বাচন। কালের সমৃদ্ধ তৃতীয় বাংলায় এমন নির্বাচন হতেই থাকবে।

রদ্ধ অনুরণন আর বপনের ভিন্নতা দাঁড়াবেই শির উঁচু করে। তবে এই গ্রন্থটি তার স্বপক্ষে প্রতিভূ হিসেবে কাজ করবে- সে প্রত্যাশা আমি করেই যাবো। মুদ্রণ মানে এবং প্রচ্ছদের সৌন্দর্যতায় সংকলনটি অপূর্ব। প্রবাস প্রকাশনী’র পক্ষে প্রকাশ করেছেন কবি কাজল রশীদ। প্রচ্ছদ- নাজিব তারেক।

মূল্য - একশত টাকা, তিন পাউন্ড, পঁচ ডলার। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে-‘তৃতীয় বাংলার আগামী প্রজন্মের হাতে’। প্রথম মোড়কে ক্ষুদ্র ভূমিকা লিখেছেন তরুন কবি, ‘বৈঠা’ সম্পাদক শিহাব শাহরিয়ার। শেষ মোড়কে বিশজন কবির সাদাকালো ছবি গ্রন্থটির সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। ‘প্রাসঙ্গিক কথা’য় সম্পাদক আবু মকসুদ এই প্রকাশিত গ্রন্থটির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন।

‘প্রবাস প্রকাশনী’ ইংল্যান্ড থেকে এর আগেও আরো সতেরটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এজন্য সাধুবাদ পাবার দাবীদার প্রকাশনাটি। কবিতার তৃতীয় বাংলায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে নির্যাস জমা হচ্ছে-তার আলো ছাড়িয়ে পড়ুক বিশ্বময়। ############## ################## সাপ্তাহিক সুরমা, লন্ডন। ১০- ১৬ জুলাই ২০০৯ সংখ্যায় প্রকাশিত


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।