আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বৈষম্যের বেড়াজালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

ভালো লাগে জোছনা রাতে মেঘ হয়ে আকাশে ভাসতে.... :)

শুরুটা এভাবেই- সন্ধায় ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পেলাম আমার এক টরন্টোর বন্ধু এম এস এন-এ একটা লিন্ক দিয়েছে। প্রথম আলো.কম দেখে নিশ্চিত হলাম এটা ভাইরাস না। গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। কিছু বুঝেও যেন বুঝছিলাম না। শিরোনামটা ছিল: "উত্ত্যক্ত করার কারণে অতিষ্ঠ হয়ে সহপাঠীকে খুন করে ইকবাল।

" কি ঘটল- কে ইকবাল? তাকে কে কেন উত্ত্যক্ত করল আর কাকেই বা সে খুন করল, আমার বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা ছিলনা। পড়া শুরু করলাম। তারা দুইজনই নটর ডেম কলেজের ছাত্র। ইকবাল গ্রাম থেকে আসা ছেলে। এ কারণে আজিজ নামে তার এক সহপাঠী তাকে নিয়ে অনেক বিদ্রুপ করত।

সেকারণে ইকবাল একসময়ে কলেজে আসা বন্ধ করে দিল। উপস্থিতি কম হওয়ার কারণে কলেজ থেকে জরিমানা করা হল। সেই টাকা দেয়ার সামর্থ্য ইকবাল-এর ছিলনা। একদিন দেরী করে আসার কারণে কলেজ ইকবাল-কে দিয়ে ঘাস কাটায়। এতে সে অপমানিত হয়ে প্রতিশোধের পরিকল্পনা করে।

পরিকল্পনা মাফিক সে আজিজের সাথে ভাব করে একদিন একটা বাড়ির নিচে নিয়ে গিয়ে ছুড়িকাঘাত করে হত্যা করে। গুরুত্ব ঘটনা এইটুকুই। যে দেশে প্রতিদিন কত কত খুন হচ্ছে তার মধ্যে এটার স্থান কোথায়। কিন্তু কিছু কারণে এ ঘটনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমার ব্যক্তিগত কারণ হলো আমি এই কলেজের ছাত্র ছিলাম আমি নিশ্চিত নটরডেমের অনেক এক্স ছাত্ররা এই ব্লগে আসেন।

আর অব্যক্তিগত কারণ অসংখ্য। নটরডেম কলেজ হাতে গুনা অল্প কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি, যেখানে ছাত্ররা ভর্তি হয় মেধার ভিত্তিতে। সাধারণ ভাবে মাধ্যমিক পরীক্ষায় গ্রামের ছেলেরা অত ভাল মার্ক তুলতে পারেনা- তাই তাদের জন্য ভর্তির যোগ্যতা কমিয়ে দেয়া হয়, যাতে সুযোগ সুবিধা বন্চিত এসব শিক্ষার্থীরা যাতে একটি সুযোগ পায়। কোথায় সমস্যা? নটর ডেম কলেজে একই সাথে ক্লাস করে মন্ত্রীর ছেলে আর কৃষকের ছেলে। মেধা তাদের এনে দেয় একই কাতারে।

এরকম পরিবেশে অনেকেই হয়ত একটা ব্যপার ভুলে গিয়েছিলেন- শ্রেণী বৈষম্য। সত্যি বলতে এই বৈষম্য আমিও দেখেছি- কখনও কিছু ভাবিনি। গ্রাম থেকে আসা ছেলেদের নিয়ে কিছু বলা হলে আমরা রেফার করতাম 'ফরেনার' হিসেবে। ফার্স্ট ইয়ার-এর পর থেকে যখন আমরা সবাই আরো এক জন আরেকজনকে কাছাকাছি জানা শুরু করলাম, তখন ব্যাপারগুলো অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। তখন 'ফরেনার'-রা আর আমরা কাউকে আলাদা কিছু মনে করতাম না।

একটা বিষয়ে না বলেই পারছিনা। তারপরেও কিছু ছেলে ছিল; যাদের সহনশীলতা আমাকে ভাবাত। গ্রামের ছেলেদের সাথে অনেক বাজে ব্যবহার- ঠাট্টা বিদ্রুপ- বিশেষ করে কিছু 'বিশেষ' স্কুলের ছেলেরা এই কাজটি বেশি করত। বিশ্লেষণ এই খুনের ঘটনার বিশ্লেষণ করলে অনেক গভীরে ঢুকে যায় ঢাকার শিক্ষা ব্যবস্থার। অনেকে মানতে না চাইলেও ঢাকার শিক্ষা ব্যবস্থা পুরো দেশ থেকে একটু আলাদা।

অসুস্থ প্রতিযোগীতা- বাবা মা, শিক্ষকদের নিয়মিত চাপ, ঘোড়ার রেইসের মত অবুঝ ছেলেমেয়েগুলো শুধুই গিলে যায় কিছু না বুঝে। তাদের আশে পাশে কি হচ্ছে কোনো বিন্দুমাত্র আইডিয়া নাই- কেউ কেয়ারও করেনা। জিপিএ ফাইভ আমার পেতেই হবে- যে করেই হোক। শুধু জিপিএ ফাইভ-এর কোনো বেইল নাই- গোল্ডেন ফাইভ। না পেলে পরিবারের মান সম্মান নিয়ে টানা টানি।

কিছু বিশেষ স্কুল আবার অভিজাত পরিবারগুলোর মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের ছাড়া কাউকে ভর্তি করেনা। প্রচন্ড ধনী এসব বাবা মায়ের ছেলেমেয়েরা অনেকে কখনও নিচু শ্রেনীর লোকজনকে কাজের মানুষ অথবা ড্রাইভার ছাড়া কখনও কিছু ভাবেনি। দামী দামী কাপড় চোপড়, ওয়েস্টার্ন মিউজিক-এর মধ্যে বড় হওয়া কিশোরটি জানেনা কিভাবে গ্রাম থেকে আসা ছেলে যে হয়ত কখনও আগে ঢাকাতেই আসেনি তার সাথে কিভাবে মিশতে হবে। গ্রামের সে ছেলে কখনও মেটালিকার নাম শুনেনি, অথবা জানেনা কোন কোন ফাস্ট ফুড-এর দোকানে সবচেয়ে ভাল স্যান্ডউইচ পাওয়া যায়। তার সাথে মিশলে ক্লাস কমে যাবে- দল বেধে পচানো গেলে মন্দ না।

আর গ্রামের ছেলেটিও জানেনা শহরের ছেলেরা কি পছন্দ করে। অথবা কিভাবে আশেপাশের দামী কলেজগুলোর অভিজাত পরিবারের মেয়েদের সাথে ভাব করা যায়। এসব নিয়ে মাঝে মাঝেই তাদের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। প্রস্তাবনা এগুলো যেন স্বাভাবিক কিশোর প্রবৃত্তি। মনে করিয়ে দেয় ফটিক-এর কথা।

পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হয় রবীন্দ্রনাথ-এর ছুটি। এমন সাহিত্যের শিক্ষার দরকার কি যা আমাদের মনুষত্ব্য শিখাতে পারেনা- শিখায় কিভাবে শুধু ভাল মার্ক পেতে হবে? এমন না যে আমরা এগুলো জানিনা। সবসময়ে এড়িয়ে গিয়েছি। এখনই সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ধনী দরিদ্র বৈষম্য দূর করার। হয়তো অবাস্তব; কিন্তু কিছু প্রস্তাবনা: ১।

লাখ টাকা ডোনেশন দিয়ে নয়- মেধা দিয়ে যেন একটা ছাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে সরকারের উচিত তা রেগুলেট করা। ২। ছাত্র ছাত্রীদের সহনশীলতা, শ্রদ্ধা - এসব মৌলিক মানবিক ব্যাপারগুলো শিখানো পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হোক। উন্নত দেশগুলোতে এধরণের বিষয়ের উপর শিখানো হয় যেহেতু বিভিন্ন বর্ণের , ধর্মের মানুষজন একসাথে থাকে। ৩।

বৈষম্যমূলক ঘটনা গুলো স্কুল কলেজে আরো সিরিয়াসলি টেকল করা উচিত। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম বৈষম্যের মাঝে বড় না হয়- এটা কখনও আমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবেনা। ৪। বাবামাদেরকেও শিখতে হবে অযথা ছেলেমেয়েদের উপর চাপ না বাড়িয়ে, তাদের সঠিক শিক্ষার বিকাশ ঘটানোর দিকে কিভাবে মন দিতে হবে। ৫।

লেখক লেখিকাদের এইরকম বিষয়ের উপযোগী করে স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়দের জন্য বই লেখা উচিত- যাতে একজন আরেকজনকে জানতে পারে। শহরের ছেলেটার জানা উচিত গ্রামের ছেলেটা আয়রন মেইডেন না শুনলেও রাতে ফাকি দিয়ে হয়ত বাউল গান শুনেছে। একজন আরেকজনকে না জানলে এই বৈষম্য কোনোদিন দূর হবেনা। ৬। আপাতত আমাদের বাসার যে ছোট বাচ্চারা আছে তাদের সাথে এগুলো নিয়ে কথা বলা দিয়ে আমরাই শুরু করতে পারি ঘর থেকে।

সহনশীলতা, ধৈর্য্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এগুলো এখনও বাংলাদেশে ঘর থেকেই আসে। সবার শেষে বলতে চাই- আমরা চাইনা একটা অসুস্থ ভবিষ্যত প্রজন্ম। আমরা চাই- যেসব ভালো কাজগুলো আমরা করতে পারিনি তা তারা করবে- শুরুটা আমাদেরকেই করতে হবে- তাদের সুস্থভাবে বড় হ্ওয়া নিশ্চিত করে। আমি নিহতের আত্মার শান্তি কামনা করি। এরকম পরিণতি যেন আর কোনো কিশোরের না হয়।

সৃষ্টিকর্তা আমাদের শক্তি দিন। যারা আরো পড়তে চান, তাদের জন্য লিন্ক: Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.